বাংরিপোসি বিস্তারিত
“এখানে থাকা যাবে না দাদা” অনির্বাণ মুখ ব্যাজার করে বললো। এখানে মানে ওডিশা সরকারের পান্থ
নিবাস। পোঃ বাংরিপোসি, জেলা ময়ুরভঞ্জ, ওডিশা। থাকা তো যাবে না বুঝলাম বাপু, কিন্তু যাওয়াটা
যাবে কোথায়? ধারে কাছে তো বাড়ী ঘর দোর কিছুই চোখে পড়েনি তেমন। কারেন্ট আছে
বটে, কিন্তু আলোও তো দেখছিনা কোথাও, যদিও সন্ধ্যে
নেমে এসেছে প্রায়। যাকে বলে গুবলেট কেস একদম! থাকার জায়গা যদিও বা পাই, পটি করবো
কোথায়? মাঠে আমার নিজের যদিও আপত্তি নেই, মাদ্রাজের
সেই রাজু ড্রাইভারের বিভূতিতে আমার হাঁটুর যথেষ্ট আপত্তি থাকবে সেটা নিশ্চিত।
বাংরিপোসির বিড়ম্বনার রাগটা গিয়ে পড়ছিল মাদ্রাজিদের ওপরে – আহাম্মক
লোকজন, জটিল ভাষা ছাড়া বোঝে না, দুম করে কেউ ওইভাবে গাড়ী দরজা বন্ধ করে, যেখানে কিনা
আমি হাফ ঠ্যাং গাড়ীর বাইরে দিয়ে বসে আছি? রাজুটা যদি অমন ক্যালাস না হতো, আজকে আমি
একটুও বিপদে পড়তাম না। আসার সময় একটু আগে দেখেছি একটা দোকানে আলনা বিক্রি হচ্ছে, ওকে কি বলবো
একটা চেয়ারের মাঝখানটা একটু গোল করে কেটে দিতে?
টেলিগ্রাফের গ্র্যাফিটি তে সপ্তাহান্তের ট্যুরের
গপ্প থাকে, তার অনেকগুলো জায়গাই একদম ভুষি, কিন্তু সপ্তাহ
তিনেক আগে “দিস উইকেন্ড ইউ ক্যান বি অ্যাট বাংরিপোসি” পড়ে হঠাতই মনে রোমাঞ্চের সঞ্চার হয়েছিল। এরম রোমাঞ্চ আমার প্রায়ই
হয়, আমি নিজে ছাড়া অন্য কেউ তাতে বিশেষ পাত্তা দেয় না, কিন্তু তাতে
আমার কিছু যায় আসে না, আমি ইন্সট্যান্ট স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। বুদ্ধদেব গুহর “বাংরিপোসির
দুরাত্তির” মনে পড়ে গেলো। বাংলো, তার হাতা, তারপরে একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে অল্প
ঘাসের ওপরে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু শুকনো শালপাতা আর আকাশমণির স্প্যাঘেটি ফল, বাংলোর চৌহদ্দি
ঘেরা ছোট শালকাঠের খুঁটিতে বাঁধা বিনুনি করা কাঁটাতারে, যাতে ছুঁচলো
করে লাগানো ওই তারেরই টুকরো –
সেটা আবার খুলে বার করতে পারলে স্প্রিংএর মতো দেখতে হবে। সেই
বেড়ায় আশাই প্রধান, ভরসা তেমন নেই।
বনানীর রং |
পরের দিন অফিস গেছি, সুজলের দোকানে
চা খেতে গিয়ে অনির্বাণ জয়িতাকে বলল “সৌম্যদা কে বলো, ডিসেম্বরে
যাচ্ছিই”। আমি জানতে চাইলাম, কোথায়? বলল মুর্শিদাবাদ।
নতুন গাড়ী কিনেছে, লং ড্রাইভে যেতে চায়। সৌম্যর গাড়ীটা বছর দুয়েকের পুরনো, কিন্তু হাইওয়ে
দেখেনি বিশেষ। দুয়ে মিলে যাওয়া যাবে, ফ্যামিলি ট্রিপ, বাবাইও যাচ্ছে
সংসার সমেত, আমাকেও যেতে বলল। মুর্শিদাবাদ মজার জায়গা, কিন্তু কতটা
রোম্যান্টিক, সেটা লোকবিশেষে তারতম্য হয়। সেখানে মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে আলিবর্দি
খাঁ, সিরাজ,
মীরজাফর হয়ে আজকের চৌধুরিবাবু – সবার কীর্তিকলাপের
নিদর্শন আছে, সিরাজ-আলিবর্দির নিরালা কবরে শুকিয়ে যাওয়া ফুলের গন্ধে গায়ে
কাঁটা দেওয়া আছে, পড়ন্ত বিকেলে নৌকায় চেপে গঙ্গায় হারিয়ে যাওয়ার মজা আছে, সেখানের
সব মানুষেরই নিজের একটা করে স্বতন্ত্র গল্প আছে, কিন্তু থাকার জন্যে সেই বহরমপুরের সূতির মশারি
টানানো ছত্রিওয়ালা খাটের খুপরি হোটেলের ঘর, খাওয়ার জন্যে নিতান্ত মিষ্টি দেওয়া সবকিছু, এটা নেওয়ার
জন্যে বেশ উদার মনের মানুষ হতে হয়। সবথেকে বড় অসুবিধে, ওখানের রাস্তা
বড়ই খারাপ। অনির্বাণ সবে বলছে সৌম্য নাকি একটা নতুন রিসোর্টের খোঁজ পেয়েছে, মুর্শিদাবাদে, একদম গঙ্গার
ধারে, আর তক্ষুনি সৌম্যর ফোন – কেলো! যে রিসোর্টে থাকার প্ল্যান হচ্ছিল, সেটা ডিসেম্বর
এর সব উইকেন্ডেই বুকড্, তাই অন্য কোথাও খুঁজতে হবে। আমি ফস্ করে বললাম – “বাংরিপোসি যাবে?”
বাংরিপোসি কোথায়? এক কথায়
বললে উড়িষ্যায়, আর আরো কিছু কথায় বললে বলতে হয় উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ
আর ঝাড়খণ্ডের সংযোগস্থলে, ছোটনাগপুর প্লেটোর এক কোনায় সদাই ঘুমিয়ে থাকা একটা গ্রাম্য শহর। সিমলিপাল অভয়ারন্যের কোর এরিয়া এখান থেকে একশো এগারো
কিলোমিটার ড্রাইভ ঠিকই, কিন্তু পাহাড়-জঙ্গলের শুরু শ্রেফ পাঁচ কিলোমিটার দুরে। কলকাতা
থেকে মাত্র ২২৮ কিলোমিটার দুরে,
পুরোটাই হাইওয়ে, খড়গপুর - বহড়াগোড়া হয়ে এন এইচ ৬ অর্থাৎ কিনা
বোম্বে রোড ধরে গেলেই আসবে বোম্বে মোড়, সেখান থেকে আর মাত্র ১৪ কিলোমিটার গেলেই বাংরিপোসি।
অনির্বাণ এক পায়ে খাড়া, সৌম্যও রাজি হয়ে গেলো, আর বাবাই? সলিডারিটির একটা মুল্য আছে তো? অতএব চালাও
সেডান প্রানভরিয়া।
অনির্বাণ আর সৌম্য দুই প্রধান চালক, আমি বিপৎকালীন, আর বাবাই
যাত্রীদের এন্টারটেনমেন্টের দায়িত্ত্বে। ওটিডিসি থেকে বুকিং হয়ে গেলো পান্থনিবাসের, ডবল বেড
রুমের ভাড়া মোটে দেড়শো টাকা। খাদ্যসম্বন্ধীয় আপাতঃ সমস্যার সমাধানে সৌম্য মেট্রো ক্যাস
অ্যান্ড ক্যারি খালি করে দিল,
মায় এক বন্ধুর কাছ থেকে কাবাব বানানোর ওভেন আর কাঠকয়লা ধার করে
ফেলল। এছাড়া গাড়িটা সারভিসিং করিয়ে নিলো, ৪ খানা র্যাকেট আর ৪ পিস ফেদার কিনে ফেলল, এমনকি একটা
নতুন বালতি আর মগ, গাড়ী ধোয়ার জন্যে। যে বাবাই সিরাপ খাওয়ার আগে দেখে নেয় অ্যালকোহল
কনটেন্ট বেশী আছে কিনা, সেই বাবাই আবেগে মাতোয়ারা হয়ে যাওয়ার আগের দিন স্পেন্সার থেকে
১৭০০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলল একটা ওয়াইনের বোতল। আমার মূল চাপের যায়গাটা আমি পান্থনিবাসে
৩ বার করে ফোন করে হাল্কা করে নিলাম – আপলোগোকে ওঁয়াহা কমোড হ্যায় না? অন্য একটা
চাপ হয়েছিল মাঝে, একদিন ঝাড়গ্রামে মাওবাদীরা একটা বোমা ফাটালো, রাস্তায়
ট্রাকে আগুনও ধরিয়ে দিল, তাই ঠিক হল আমরা বালেশ্বর হয়ে যাবো, একটু ঘুরপথে।
বেলদায় ব্রেকফাস্ট |
ডিসেম্বরের তেরো তারিখ, ঠান্ডার
নামগন্ধ নেই আমাদের পচা কলকাতায়,
ব্যাগ ভর্তি করে জ্যাকেট সোয়েটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভোরবেলায়, উড়িষ্যার
ঠান্ডার মোকাবিলায়। দুটো গাড়ীর ডিকি ভর্তি শুধু খাবারের সরঞ্জাম, এছাড়া স্ন্যাক্স
আর জল। মাঝে একবার টায়ার পাঙ্কচার হওয়ায় কোলাঘাটে দেরি হল বেশ অনেক্ষন, কারন দোকানি
এর আগে কখনো রেডিয়াল টায়ার দেখেনি। শেষ মেষ খড়গপুর পেরিয়ে কংক্রিটের হাইওয়ে দিয়ে ১৬০
কিলোমিটার স্পিডে হোন্ডা সিটি রকেট উড়ে এসে বেলদায় প্রথম ল্যান্ড করলো, পেছনে সৌম্যর
অ্যাকসেন্ট। সেখানে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে জয়ীতার শাশুড়ীর
বানানো কড়াইশুটির কচুরি, সঙ্গে মশলাদার আলুর দম, শেষে সন্দেশ – একেবারে
ষোলোকলা ব্রেকফাস্ট। বাবাই এর মধ্যেই আলতো করে একটা অফিসের কনকল সেরে নিলো, ইন্দ্রানী
ফটাফট একটা এক্সট্রা মাঙ্কি ক্যাপ ব্যাগ থেকে বের করে ছেলেকে পরিয়ে দিল, আমি আর সৌম্য
একটা করে সিগারেট ফুঁকে নিলাম,
সুপর্ণা খাবারের প্লেট নিয়ে বুবাই এর পেছনে ধাওয়া করেই কাটিয়ে
দিল, জয়িতা দুরে একটা ট্রেন দেখে বলল “এটা কি কিরুন্ডুলের
ট্রেন? একই রঙ - আমরা সবাই খ্যা খ্যা করে উঠলাম,
অনির্বাণ চুপি চুপি কোলিন বের করে গাড়ীর বনেটে লেগে থাকা আলুর
দম পরিস্কার করে ফেলল আর রূপমা একটু মেকআপ করে ফেলল।
ঘন্টা দুয়েকের কিছু কম সময়ে ওয়েলকাম টু বালেশ্বরকে
লেফটে রেখে ডানদিকে ঘুরে বারিপাদার পথে পড়তেই রাস্তা যদিও সিক্স লেন থেকে টু লেন হয়ে
গেল, ভাঙ্গা মোটেই নয়, বেশ ভালো, এটাও জাতীয় সড়ক, ৫ নম্বর, গাড়ী তাই
চলল হুড়হুড়িয়ে। বারিপাদা বাইপাসে আবার থামা, এবারে লাঞ্চ। “হোটেল মহুয়া” নামের ধাবায় উৎকল রাঁধুনির হাতে রান্না তড়কা, মুরগির কারি
আর গরম গরম হাত রুটি - ভালই।
পৌনে দুটোয় আবার যাত্রা শুরু। নতুন পাতা ব্রড গেজ লাইনের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে যাচ্ছি
তো যাচ্ছিই, রূপসা পেরোলাম খানিক আগে, বিকেলে গড়িয়ে এসেছে প্রায়। একটা তেমাথা মতো যায়গায় হুশ করে বাঁ দিকে একটা রাস্তাতে ঢুকে
পড়লাম আমরা। তখন ভেবেছিলাম ওটাই বোম্বে মোড়, পরের দিন জেনেছি বোম্বে মোড় ওখান থেকে আরো
১৩ কিলোমিটার। যাই হোক, ক্ষতি হয়নি কিছু, ১১ কিলোমিটার লজঝড়ে ভাঙ্গা রাস্তায় গিয়ে শেষে
দেখলাম কিছু বাড়ী ঘর দোর, দোকানও আছে,
তার একটার সামনে সাইনবোর্ড, তাতে প্রচুর কালো রঙের জিলিপির ছবি আঁকা আছে।
ওটাই উড়িয়া হরফ, বাঙ্গালির সেটা দেখলে মনে হতেই পারে লেখা আছে ঘাঙ্ঘিঘোঘী, কিন্তু নিচে
ইংরেজিতেও লেখা আছে বাংরিপোসি,
তাই বুঝলাম গন্তব্যে পৌঁছেছি। একমিনিটেই পেরিয়ে গেলাম লোকবসতি, আর ডানদিকের
আরেকটা চওড়া রাস্তায় আমাদের রাস্তাটা মিশলো। ঠিক মোড়ের মাথাতেই মরুদ্যানের মতো একখানা
এফ এল শপ্, সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম ওই রাস্তাটা এন এইচ সিক্স। সেইখানেই, একজন বছর
ত্রিশ এর ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথায় মাফলারের পাগড়ী বেঁধে হাফহাতা সোয়েটার পরে বগলে
হাত গুঁজে - তাঁকে পান্থনিবাস কোথায় জিজ্ঞ্যেস করতেই অম্লানবদনে একটুও না হেসে বিধান
দিলেন “এটঠি,
শত পাদো”। ভাবছিলাম কি অসভ্য
রে বাবা, তারপর খেয়াল হল এটা তো উড়িষ্যা, এখানে ওটার
মানে একশো পা। তা একশো না হোক,
শ তিন চার পা ফেললে যতটা যাওয়া যায়, সেখানে রাস্তার
ওপরে একটা চেকপোস্ট জঙ্গলে ঢোকার,
বাঁ দিকে একটা ছোট পুকুর, তাতে অসংখ্য লাল শালুক ফুটে আছে বিকেল ৫টার
সময়েও, আর রাস্তার ডান দিকে একটা গেট, সেখানে লেখা
“ওয়েলকাম টু ওটিডিসি পান্থনিবাস, বাংরিপোসি”।
চেকপোস্টের পুকুরে লাল শালুক |
গেটের পর সরু লম্বাটে মতো বাগানের শেষে বাংলো, গেট থেকে
বাংলো অবধি পিচ বাঁধানো রাস্তাটা হাল্কা চড়াই। বাগানটা এমনিতে খুব অপরিস্কার নয়, কিন্তু কিছু
কংক্রিটের জিনিষপত্র পড়ে আছে অগোছালো ভাবে, তাই মোটেই দৃষ্টিনন্দন না। অল্প কয়েকটা শাল
সেগুনের গাছ। বাঁ দিকে কয়েকটা নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে দেখলাম (এতোদিনে নিশ্চয়ই ব্যবহার
যোগ্য হয়ে গেছে সেগুলো)। পান্থনিবাসের মূল বাড়িটা বেশ পুরনো, বছর ষাটেক
তো হবেই, কিন্ত ব্রিটিশ ঘরানার নয়, নিতান্তই দেশি, লম্বা লম্বা
রড দেওয়া জানালা। বাংলোর সামনে পৌঁছে কাউকে দেখতে না পেয়ে হাঁক ডাক শুরু করলাম, একটু পরে
বাংলোর ডানদিকের রান্নাঘর কাম ডাইনিং থেকে দু জন বেরিয়ে এলো, তাদের একজন
চৌকিদার, অন্যজন রাঁধুনি। বাড়ীটা পুরোপুরি চৌকো, তার চারটে
কোনায় চারটে রুম, দুটো রুমের মাঝে একটা করে বাথরুম, মোট চারটে
ঘরের জন্য দুটো। প্রথম দুটো ঘর বাসযোগ্য, কিন্তু তিন নম্বর ঘরে ঢুকেই মাথায় বাজ পড়লো।
এ কি অবস্থা? এক খানা
৪০ ওয়াটের বাল্ব জলছে, তাতে কিছুই দেখা যায় না প্রায়। এক খানি ৪ ফিট চওড়া খাট, তাতে অতি
ময়লা একটা চাদর, বালিস নেই। জানলার পাল্লা কোন এক রাত্রে বনফায়ারে ব্যবহার করা
হয়ে গেছে, তাই সেখানে চট বাঁধা। দরজাটা চৌকিদার অনেক ধাক্কা দিয়ে খুলে
ফেলল বটে, কিন্তু বন্ধ বোধহয় আর করা যাবে না। সবথেকে ভয়ঙ্কর সে ঘরের দেওয়াল
– একখানা থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে, আর অন্য
দেওয়ালে চুনকামের ওপরে বিরল মানচিত্র। চৌকিদার বলল ট্যাঙ্ক থেকে জল লিক্ করছে বলে
এই অবস্থা। পাশের অন্য ঘরটার অবস্থাও তথৈবচ। সবারই মুখ শুকিয়ে গেছে, কোনভাবে
অন্য দুটো ঘরেই শেয়ার করে থাকা যায় কিনা ভাবা হচ্ছে, অনির্বাণ বলল, না দাদা, এখানে থাকা
যাবে না।
দেখা যাক কি আছে কপালে, এই ভেবে
সৌম্যকে স্ত্রীধন, পুত্রকন্যাধন ও অন্যান্য ব্যাগ-স্যুটকেস-ধনের পাহারা ও মশক নিধনের
দায়িত্ত্ব দিয়ে একটা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি, অনির্বাণ, আর বাবাই। দারোয়ান বলেছিল বটে একটা লজো অছি
সে পাসাড়ে, কিন্তু আসার সময় চোখে পড়েনি বলে চিন্তাতেই ছিলাম। শ দেড়েক মিটার
বাংরিপোসির দিকে ফেরত গিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে একটা দোতলা বাড়ী দেখে ভাবলাম ট্রাই করা
যাক। গেটের আগল খুলে ভেতরে ঢুকে চোখে পড়লো মোড়াম ফেলা রাস্তার পাশে সুন্দর বাগান, ওপাশে লন, রাস্তার
শেষে সুন্দর একখানা দোতলা বাড়ী। নতুনই হবে, দোতলার ছাদে তখনো ডুম জ্বেলে রাজমিস্ত্রিরা কিসব কাজ করছে। তাদেরই একজন
ডেকে নিয়ে এলো রামকৃষ্ণকে, সেই এই বাড়ীর কেয়ারটেকার। হাফ ট্রাইব্যাল, রামকৃষ্ণর
একটা চোখ খারাপ, অল্প কথার মানুষ। সে বলল এটা একটা রিসোর্ট, নতুন হয়েছে, নাম সিমলিপাল
রিসোর্ট। মালিকের নাম্বার পাওয়া গেলো তার কাছে, ফোন করে ফেললাম। মালিকের নাম বি সি বাসা (০৬৭৯১-২২৩২৪৭, ৯৪৩৭৬১২৭৪৭, ৯৪৩৮০০২১৯২, ৯৮৬১৯৭৭৩০৩), প্রানখোলা
মানুষ, পেশায় কন্ট্রাক্টর, নিজের দোকানও আছে বাংরিপোসিতে, ৫ মিনিটের
মধ্যে এসে হাজির হলেন বাইক নিয়ে। রুম খুলে দেখালেন, আহামরি কিছু নয়, কিন্তু ভদ্রস্থ, পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন এবং নিচের তলার তিনটে রুমের মধ্যে দুটোতেই ওয়েস্টার্ন টয়লেট। গীজার নেই, কিন্তু রামকৃষ্ণ
কে বললেই জল গরম করে এনে দেবে। দোতলার ঘরগুলি আরো ভালো আর সবেতেই ওয়েস্টার্ন, কিন্তু একটা
ঘরে কাজ হচ্ছে ফ্লোরিংএর, তাই একসাথে থাকার ইচ্ছায় একতলার তিনটে ঘরই নিলাম আমরা। রুম রেট
৩৫০ টাকা করে রফা হল, যদিও উনি বলছিলেন অনেক কমে করে দিলেন, খুব শিগ্রি
নাকি ওই রুমের ভাড়া আটশো হবে। এই ফাঁকে বলে রাখি, সেই পান্থনিবাস কিন্তু এখন ব্যক্তিগত মালিকানায়
চলে গিয়ে এক খানা ঝাঁ চকচকে রিসোর্টে পরিনত হয়েছে, তার নতুন নাম “খৈরি রিসোর্ট”, ভাড়া বোধহয়
৮০০ টাকা। ভেতরের ডাইনিং হল এখন ভালো রেস্টুরেন্ট বলে নাম করেছে।
যাই হোক, এবারে কনসলিডেশনের পালা। পান্থনিবাসে পৌঁছে খবর দিতেই স্ত্রিয়দের শুকনো মুখে হাসি
ফিরে এলো, ঝিমিয়ে পড়া ঝিয় আর পুয় রা আবার মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে শুরু করলো আর বাপোরা
বিবিধ জলের টান অনুভব করতে শুরু করলেন। রিসোর্টে ফেরত এসে বাপীর ধাবায় ফোন করা হল
(৯৪৩৯০৯৪২৪২) – ফটাফট চা
আর পেঁয়াজি চলে এলো। বাসা বাবুর পাঠানো রাঁধুনিও চলে
এলো একটু পরেই, সঙ্গে হেল্পার, রান্নার বাসনও – মোট ৩০০
টাকা পার ডে। রাঁধুনিকে রান্নার জিনিষপত্র বের করে দিলাম গাড়ীর ডিকি থেকে – আজকের মেনু
নিরামিষ ভুনি খিচুড়ি, সঙ্গে বেগুন ভাজা, আলু ভাজা, ডিম ভাজা। রান্নাঘরটা বাড়িটার পেছনের দিকে, আলাদা করে
বানানো অ্যাসবেস্টসের ছাদ দেওয়া একটা ঘর, গায়ে লতানে ফুলগাছ, সামনে একটা
নভেল বসার জায়গা, যার সিট ও পাথরের স্ল্যাব, টেবিলও তাই, তিন দিক
খোলা। আমরা যে যার রুমে চাবি দিয়ে সব্বাই ওখানেই বসে পড়লাম।
রান্নাঘর |
বাসা বাবু এলেন একটু পরে, বসে আড্ডা
দিলেন খানিক আমাদের সাথে। পরিস্কার হিন্দি বলেন, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও। চা শেষ, তাই বাবাইয়ের
ওয়াইন খোলা হল। বাবাই গ্লাস হাতে নিয়ে প্রথমেই চরম বেসুরে “এই তো জীবন, যাক না যতই
খুশি যেদিকের প্রান” ধরল, তারপর গ্লাস নিয়ে সুকুমার রায়ের “ঠোঙ্গা ভর্তি
বাদাম ভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না” এর চলমান
উদাহরন হয়ে ঘুরতে লাগলো এদিক ওদিক মিনিট পনেরো, আর শেষে ইন্দ্রানীর দিকে তাকিয়ে “তুমি রাগ
করছ? তাহলে যাও,
আর খাবই না” বলে পুরো গ্লাসটাই জবাগাছের গোড়ায় ঢেলে দিল।
আমি সিগ্নেচার, সৌম্যও তাই,
অনির্বাণ আর বাসা বাবু ওয়াইনের দায়িত্ব নিলেন।
শুনতে লাগলাম বাংরিপোসির গপ্পো, বাসা বাবুর
মুখে, মাঝে মাঝে রাঁধুনি আর রামকৃষ্ণ দু এক কথা বলতে লাগলো। বাংরিপোসি
খুদে শহর, গ্রাম বলাই শ্রেয়, ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে কিছু টালির আর খোলার
চালের বাড়ী, অল্প কয়েকটা পাকা বাড়ী আর কিছু দোকান, আর একটা
হাট, এই নিয়েই বাংরিপোসি। এখানের বেশির ভাগ অধিবাসীই আদিবাসী, এছাড়া অল্প
কিছু উৎকল ও হিন্দিভাষি মানুষ থাকেন এখানে। শহরের এক পাশে বাঘা যতিনের বুড়িবালাম, অন্য পাশে
পাহাড় আর জঙ্গল। রিসোর্টের পেছনে দিগন্তবিস্তৃত এক ফসলি জমি, সেখানের
ধান কাটা হয়ে গেছে, উঠে আছে শুকনো ধানের গোড়া, তার পেছনে দুরে আবছা দেখা যাচ্ছে পাহাড়, চাঁদের আলোয়।
সে পাহাড়ের চেহারা স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসে আঁকা পাহাড়ের মতোই, ছাই রঙ্গা, নিখুঁত বেল
কার্ভ। বাসা বাবুর দোকানে তাঁর ভাই বসেন, তিনি নিজে একখানা খনির ইজারা নিয়েছেন, সেখানে আদিবাসীরা
পাথর কাটার কাজ করে, তাদের সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক, একদম তাদের
দাদার মতো – এই সব বলছিলেন। মাওবাদী নিয়ে কথা উঠতে তিন গ্লাস ওয়াইনের পরেও
সযত্নে এড়িয়ে গেলেন, তাতে এটুকু বুঝলাম যে আমাদের ওই নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার দরকার
নেই। সাড়ে দশটায় খিঁচুড়ি চলে এলো,
সে অমৃত স্বাদ ভোলার না। খেয়ে দেয়ে বাবাইয়ের পেছনে লেগে ঘুমিয়ে
পড়লাম সাড়ে এগারোটা নাগাদ।
সকাল ৬ টায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে, প্রাতঃকৃত্য
সেরে বাইরে এলাম। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। হাল্কা কুয়াশায় রহস্যময় হয়ে আছে
পেছনের পাহাড়গুলো। একটা মিঠে রোদ বাংলোর সামনের মোড়ামগুলো কে আগুন রঙা করে দিয়েছে।
বাগানের দেবদারুর পাতা থেকে টুপ টুপ করে পড়ছে শিশির। একটু দুরে বস্তি, সেখানে খোলার
চালের বাড়ীর পাশ দিয়ে উঠছে কয়লা,
গুল আর ঘুঁটের ধোঁয়া, তার নেশা ধরানো গন্ধে ছোটবেলার মামাবাড়ী মনে
পড়ে যায়। বাগানের শিশির ভেজা ঘাসে দুখানা বাচ্ছা এস্কিমো ঘুরছে – একটা বাবাইয়ের
ছেলে, অন্যটা অনির্বাণের মেয়ে – দুটোতে শালিখ পাখির মতন কিচির মিচির করে শোরগোল
করছে। আমার আর সৌম্যর পারসোন্যাল এস্কিমো দুটো অনেকটাই বড়, তাই তারা
ঘুমচ্ছে। রামকৃষ্ণ বালতি তে জল নিয়ে আসছে, আর অনির্বাণ জ্যাকেট আর হাফ প্যান্ট পরে মোষ
ধোয়ার মতো গাড়ী ধুচ্ছে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে। হাতে
নিমদাঁতন, রাঁধুনি সায়েব এলেন দাঁত খিঁছিয়ে, হেল্পার
উনোন ধরাল, জল বসালো –
চা হবে,
স্নানের জল গরম হবে। একটু পরে সিনিয়রমোস্ট এস্কিমোর উদয় হল রুমের
দরজা খুলে, পাজামার ওপরে খাঁকি রঙা ফুল প্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে
উলিকট, তার ওপর ফুল শার্ট, ফুল সোয়েটার, সবার ওপরে
ব্লু জ্যাকেট যার কাঁধ থেকে কবজি অবধি একটা হলুদ আর একটা সাদা রেখা কবজি অবধি টানা
আর কাঁধে সামান্য খুস্কি, পায়ে মোজার ওপরে নাইকির জুতো, মাথায় নস্যি রঙের মাফলার ঘোমটা দিয়ে বাঁধা। শ্রী অভিজিৎ পাল, ওরফে বাবাই। রামকৃষ্ণকে বসিয়ে রেখে স্নানের
জলের বালতি বইতে শুরু করলেন তিনি। আসতে আসতে বাকি সবাইও বেরিয়ে এলো। চা আর মঞ্জিনিস
এর কেক শেষ করে এক এক করে স্নানে যাওয়া শুরু হল।
কনকদেবীর মন্দির
|
পরের কাজ, বাজারে যাওয়া। ইন ফ্যাক্ট, হাটে যাওয়া।
ছেলেরা চারজনেই একসঙ্গে বেরোলাম। এনএইচ৬ ধরে একটু আসতেই এফ এল শপের মরূদ্যান, তার ডানদিকর
রাস্তায় থেকে বসেছে হাট। বেশ জমজমাট, প্রচুর লোকজন এসেছে। আমরা অ্যাকশানে নেমে
পড়লাম। সৌম্য আবেগে ভেসে গ্যালো,
অ্যাতো টাটকা খাবার নাকি ক্ষেতেও পাওয়া যায় না। বাঙালী বিদেশ
বিভুঁই গেলে যে খাবার তার সবচেয়ে বড় বন্ধু, সেই পাঁঊরুটির পাহাড় কিনে ফেলা হল। প্রচুর
কলা, কমলালেবু আর আপেলের সঙ্গে মুরগির বংশবিস্তারের আশায় ছাই দিয়ে
ষাটখানা ডিম নিলাম আমরা। টাটকা রুই মাছ কেনা হল ভাজা খাওয়ার জন্যে। বাঁধাকপি, টমেটো, আলু, পেঁয়াজ, আদা – এসব তো আছেই, প্লাস দুপুরে
খাওয়ার জন্য মুরগির মাংস, রাতে কাবাবের জন্যে বোনলেস, আর সবার শেষে ডিনারের জন্য খাসি। নতুন এক্সপিরিয়েন্স
হল একটা – পাঁঠা/খাসি কেনার আগে টিপে টুপে দেখা গায়ে যথেষ্ট মাংস আছে কিনা, আর ম্যান্ডেটরি
দাঁত দেখা, খাসির বয়স বোঝার জন্যে। খাবারের গন্ধমাদন নিয়ে ফেরত এলাম ১০টা
নাগাদ। চটপট পাউরুটি, মাখন,
জ্যাম এর সঙ্গে কলা, ডিমসেদ্ধ আর শেষ কয়েকখানা কলকাতার মিষ্টি।
গাড়িগুলো রাস্তায় চলে এলো আবার।
যাচ্ছি ঘাটি দেখতে, অর্থাৎ কিনা
এনএইচ৬ ধরে বাংরিপোসির উল্টোদিকে। গোটা দুই কিলোমিটার গেলেই ঘাটির রাস্তা শুরু। সে
রাস্তা অবশ্যই দার্জিলিং এর পাকদণ্ডির ধারে কাছে নয়, তবে পাহাড়ি হাইওয়ে বলা যায়, বাঁক টাক
ভালই আছে। পাহাড়ে তিন কিলোমিটার উঠলেই বাংরিপোসি মাতার মন্দির, অন্য নাম
দ্বারসুনি পিঠো, দুর্গার মন্দির, যে দেবীকে কেউ ডাকেন কনকদেবী নামে, কেউ বা বনদুর্গা।
খুবই জাগ্রতা দেবী, এলাকার লোকজন তো মানেনই, সমস্ত গাড়ী/ট্রাক/বাসের লোকজন কয়েন ছুঁড়তে
থাকেন, আপনি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার মাথাতেও দু একটা পড়বে।
ছোট মন্দির, নানা রঙে রাঙানো, ভেতরে সাদা মার্বেল বাঁধানো মেঝের ওপরে পেতলের
সিঙ্ঘাসনে দেবির অধিষ্ঠান, মর্মর মূর্তি, নাকি, প্রস্তর খন্ড, বোঝা মুশকিল
কারন ফুলের মালায় ঢাকা। ছবি তোলায় কোন বাধা নেই। রাস্তার অন্য পারে শ খানেক মিটার পাহাড়ের
গা বেয়ে উঠলে এক খানা গুহা পাওয়া যায়, খুব সাংঘাতিক কিছু নেই সেখানে, তবে ওপরে
ওঠার আনন্দ অবশ্যই আছে। সে আনন্দে আমি বঞ্চিত, তাই আলতো করে নিজে সিনিয়র সিটিজেন বলে ঘোষণা
করে দিলাম, বাকিরাও ‘চল না,
চল না” বলে খানিক্ষন গোল করে শেষে উৎসাহ হারিয়ে গাড়ীতে
উঠে বসলো।
আরো অনেকটা এগিয়ে গিয়ে প্রায় সমতল একটা যায়গায়
দাঁড়ালাম। দুপাশে জঙ্গল, খুব ঘন নয়,
কিন্তু প্রচুর লম্বা সমস্ত গাছ, তাতে নানা
রঙের পাতা। রাস্তার দু পাশে শাল গাছের সারি, রাস্তাটাকে ক্যানোপির মতো ঢেকে রেখেছে, মাঝে মাঝে
একটা করে ট্রাক পেরিয়ে যাচ্ছে,
তার আওয়াজ ছাড়া কোনো বিজাতীয় আওয়াজ নেই, পাখির ডাক
শোনা যাচ্ছে, গাছ থেকে শুকনো পাতা পড়ছে, তার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। এক আদিবাসী ভদ্রলোক
দু খানা বলদ নিয়ে চলে গেলেন,
লক্ষ্য করলাম একটু দুরে জঙ্গলের ভেতরে একটা ছোট গ্রাম আছে। রাস্তার পাশে লেখা “এলিফ্যান্ট
করিডোর”।
এবারে ফেরার পালা। একটুখানি গেলেই রাস্তার
বাঁয়ে এক খানা ন্যাচারাল লেক,
তাতে ফুটে আছে কোটি কোটি লাল শালুক, দূর থেকে
দেখলে মনে হয় রক্ত জমে আছে, গাঢ় কালচে লাল রঙ। মাঝে
দু একটা সাদা বক, উড়ে যাচ্ছে,
ফের এসে অন্য যায়গায় বসছে। খানিক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম আমরা
সবাই সেখানে, ওই দিঘির পাড়ে।
দুপুরে মাছ ও মুর্গীদের উদ্ধার করে আবার বেরিয়ে
পড়লাম, এবারে যাবো হাটিয়া দেখতে, আদিবাসী হাট, সেখানে তাড়ি
আর হাঁড়িয়া আছে, সাঁওতাল নারী পুরুষ আছে, হরেকরকম হাঁড়ি আছে, ডোকরার কাজ
আছে, ঝাঁটা আছে,
ঝুড়ি আছে,
কুলো আছে,
ট্রাঞ্জিস্টার রেডিও আছে, ছাগল ভেড়া গরু আছে, আর আছে কুঁকড়া
ফাইট, মানে মুরগির লড়াই।
বোম্বে মোড় থেকে বারিপাদার রাস্তা ধরে গোটা
ছয় কিলোমিটার গেলে বাঁ দিকে মেটো রাস্তা চলে গেছে, সেই রাস্তায় ৩-৪ কিলোমিটার গেলে হাটিয়া। মন্দ
নয় যায়গাটা, পোট্রেট তোলার আদর্শ জায়গা। ঘন্টা দুয়েক ছিলাম, তারপর সন্ধ্যে
নামার আগেই ফেরার পথ ধরলাম, কারন ওই মেঠো রাস্তা। ফেরার পথে বোম্বে মোড়ে দাঁড়ালাম একবার, এটিএম আছে
ওখানে।
এনএইচ৬ এ ওঠার সময় সূর্য নামলো পাটে, রাস্তার
ওপরে সোনা ঢেলে দিল যেন – তাকিয়েও থাকা যায়না, আবার শুধুই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। যাই হোক, কবিত্ব বাড়ানোর
তাগিদে মরুদ্যান থেকে রসদ নিয়ে ঢুকে পড়লাম আবার বাংরিপোসি রিসোর্টে।
সন্ধ্যের কাবাব আর রাতের পাঁঠার সঙ্গে গান, আর গানের
সাথে অবাক জলপান – নেট রেজাল্ট হল রাত বারোটার সময় সৌম্যর হঠাৎ হুজুগ – রাতের ঘাটি
দেখব। কেউ রাজি হয় না কিন্তু বাবু যাবেনই, দরকার হলে একাই যাবেন, একবার বলেও
ফেললেন একাই এসেছি একাই যেতে হবে। অনির্বাণ রূপমার কাকুতিতে মিনতি করে ফেলল, অভিজিৎ মাফলারটা
আবার ভালো করে বেঁধে বারান্দায় পায়চারি শুরু করলো। জয়িতা হাল ছেড়ে দিয়ে ধ্রাম করে দরজাটা
বন্ধ করে দিল, সৌম্য উদাস হয়ে বলল “বুঝেছ বিজিৎ, এর নাম সংসার, এত কিছু
করলাম, এখন একটু রাতের ঘাটি দেখতে চেয়েছি বলে এই ব্যবহার!” সত্যিই তো, রাতের ঘাটিই
তো, এ তো আর দ্রৌপদির বস্ত্রহরন নয় যে দেখলে পাপ হবে!
আমি বেরোলাম, সৌম্যর সঙ্গে
ওর গাড়ীতে।
কনকদেবীর মন্দিরে একখানা বাল্ব জ্বলছে শুধু।
মাঝে মাঝে ট্রাক যাচ্ছে, তার হেডলাইটের আলোতে চোখধাঁধাঁনো চমক্, আর পয়সা
ফেলার ঠুং করে শব্দ। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ, একদম চুপ
করে। ঠান্ডা লাগছিল বেশ, একটু একটু কাঁপছিলাম। একটুক্ষণ পরে চোখ সয়ে গেল, দেখলাম চাঁদের
আলোয় সবকিছু সাদা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর জঙ্গলের নিজের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এবার, নির্বাক
শব্ধ সেসব। ঝিঁঝির টানা ডাকের মাঝে কখনো ডেকে উঠছে রাতজাগা কোনও পাখি। হঠাৎ উড়ে গেল
সাদা মতো কী একটা, প্যাঁচাই হবে। অনেক অনেক দূরে বোধহয় একটা হাতি ডেকে উঠল। সামনের
ঝুপসি গাছটার পাতা থেকে টুপ করে এক ফোঁটা শিশির পড়লো নীচের একটা শুকনো পাতার ওপর। একটা
পোকা চমকে উড়ে গেল। তার ডানার শব্দ শুনলাম না কী? খেয়াল করিনি, কখন যেন
আনমনে মিশে গেছি, পাহাড়ের সুন্দরী বেটি বাংরিপোশি ছুঁয়ে ফেলেছে আমায়, বুকের মাঝখানে।
বুড়িবালামের রক্ত
|
কানছিড়া/লুলুং যাওয়ার রাস্তা
|
বুড়িবালামের নীল পাথর
|
পরের দিন কানছিঁড়ায় গিয়ে কিশোরী বুড়িবালামকে
দেখে এসেছি। খরস্রোতা নদীর বুকে বহু বছর থেকে গোল হয়ে যাওয়া পাথর কুড়িয়ে এনেছি, মাঝে দেখেছি
লাল হয়ে থাকা মর্চে রঙ্গা জল। লুলুং যেতে পারিনি রাস্তায় কাজ হচ্ছে বলে, কিন্তু সেখানেই
এক নীল শার্ট পরা অল্পবয়স্ক কুলি সর্দারের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভাব জমিয়েছি। এদিকে লাল শালুক
ছড়িয়ে আছে সবখানে, আজকে তাদের দেখে অবাক হইনি আর, চোখ সয়ে
এসেছে এবারে। ফেরার পথে আদিবাসীরা পথ অবরোধ করেছিলেন তাই আলের ওপর দিয়ে গাড়ী চালিয়ে
আনতে হয়েছিল। সেই অবরোধ আজকে উঠবে কিনা সেই নিয়ে বাবাই তার ব্যাঙ্গালোরের ম্যানেজারকে
ফোন করে জানতেও চেয়েছিল কারন ভদ্রলোক উৎকল। যাই হোক, সে অবরোধ ও উঠে গেলো কিছু পরে। এরপরে ব্যাস্ত
সমস্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছি আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে, ফিরে তাকাইনি আর। সন্ধ্যের মুখে জলেশ্বরের
চা দোকানে দাঁড়িয়ে লাল আকাশে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেলো, পাহাড়ের বেটি আবার
একলা হয়ে যাবে আজ রাতে। ভালবাসা রয়ে যাবে, সম্পর্কটা
ছিন্ন।