Saturday, May 30, 2015

জস্পিন্দার ও একটি ম্যানুয়াল ভাইরাস

জস্পিন্দার ও একটি ম্যানুয়াল ভাইরাস

হিন্দি বলা খুব সোজা। সেন্টেন্সের শেষে "হ্যায়" লাগিয়ে দিলেই অনেকটা হয়ে যায়। এছাড়া তুমি কে তুম, আমি কে হাম, এরকম কয়েকটা চেঞ্জ - হিন্দি ইস অন। তাই আমরা হিন্দিতে যারা কথা বলে তাদেরকে হিন্দুস্তানি বলি, আর আমরা বাঙ্গালীরা যে হিন্দুস্তানি, সেটাও ঠিক, কারন আমরাও খুব সহজে হিন্দি বলতে পারি। তাই আমাদের কাছে ভারতীয় রা মুলতঃ চার প্রকার - বাঙ্গালী, পাঞ্জাবীহিন্দুস্তানি আর ম্যাড্রাসি। যাদের ভাষা বোঝা যায় না, তারা সবাই ম্যাড্রাসি। হিন্দুস্তানি দের মধ্যে মাড়োয়ারি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি - এরা সবাই পড়েন। কিন্তু পাঞ্জাবী রা পড়েন না। কারন ওনাদের মাথায় পাগড়ী থাকে।

পাঞ্জাবী দের নিয়ে যেমন অনেক হাসির গল্প ও চুট্কি আছে, তেমনি তাঁদের সাহস, বিরত্ব ও মেজাজ নিয়েও অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী আছে। তাই বলা নিস্প্রয়োজন যে জস্পিন্দার কওর ধিল্লোঁ যখন ফ্রেশার হিসেবে আমাদের কোম্পানি জয়েন করলো, তখন নারীসঙ্গে চরম উৎসুক জনতাও তার দিকে চট করে ভিড়বে না। অতএব জস্পিন্দার জয়েন করে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিজের মতো করে কিসব করতে থাকলো।

আমি তাড়াতাড়ি অফিসে আসা পছন্দ করি। অনেক সময়েই সবার আগে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু কিছুদিন ধরে দুজন আমার থেকেও আগে আসা শুরু করেছে। একজনের নাম কুমার বোস। “কুমার বোস” নামটা বললে সাধারনতঃ যেমন ছবি মনে ভাসে, এ মোটেই তেমন না – কুমার লম্বাও নয়, ছিপছিপেও নয়, বয়স অল্প হলেও বেশ একটা টায়ার টাইপের ভুঁড়ি আছে, মুখে অসংখ্য দাগ এবং বাঁ গাল বরাবর একখানা মস্ত কাটা দাগ – হয়তো কোন অপারেশান বা অ্যাক্সিডেন্টের, কিন্তু চাপা গলায় “অ্যাকশানের সময়ে গুপ্তি মেরে দিয়েছিল” বললে অনেকেই বিশ্বাস করে নেবে। কারন কুমার খুব, খুব গম্ভীর। আসলে কিন্তু কুমার মোটেই রাগী বা রাশভারী নয়, কুমার মিতবাক্, এবং লাজুক। এতোটাই, যে জয়েন করার দিন দুপুর দুটো অবধি চেপে বসেছিল, কারন টয়লেটটা কোন দিকে, এটা জিজ্ঞেস করতে ওর নাকি লজ্জা করছিল। কুমার তাড়াতাড়ি এসেছে কারন একটা নতুন ক্লায়েন্টের সিস্টেম স্টাডি করছে, ফটাফট সেটা লিখে ফেলতে হবে, টাইপের স্পিড নেই, তাই সকাল থেকে ওয়ার্ড নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে।

আরেকজন এসেছে। জস্পিন্দার। জস্পিন্দারের তাড়াতাড়ি আসার কারন টা অন্য – বাবা অফিসের পথে পৌঁছে দিয়ে যান, তাই তাড়াতাড়ি। জস্পিন্দার নিজের টেবিলে পৌঁছে, ব্যাগ রেখে রেস্টরুমে ঘুরে এলো, তারপরেই একটা মিনি টিফিন বক্স খুলে ব্রেকফাস্ট টা সেরে নিলো। আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল যে রেস্টরুমে আসলে ব্রাশ করতে গেছলো কিনা (আমি সিওর তাই ছিল), কিন্তু ইনি হলেন কুমারের একদম উল্টো, কমপ্লিট চ্যাটার বক্স, তাই রিস্ক নিলাম না – কাঁহাতক আর সক্কালসক্কাল বকরবকর করা যায়, এক্ষুনি পাঁচশো কথা বলে কান পচিয়ে দেবে!

টিফিন শেষ হয়ে গেছে, আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে রেখেছি পাছে বকবক করতে হয়, জস্পিন্দার কুমারকে ধরে ফেলল। “হাই, আই অ্যাম জস্পিন্দার, অউর আপ?” কুমার নিরুপায় হয়ে ডান টা বাড়িয়ে বলল “গুড মর্নিং, আই অ্যাম কুমার বোস, আই অ্যাম সো প্লিজড্ টু মিট ইউ”। জস্পিন্দার খিল খিল করে হেসে উঠলো “আরে আপ তো ইত্নি ফর্ম্যাল হো গ্যায়ে! হিন্দি আতি হ্যায় না?” কুমার কে এই প্রথম একটু যেন মুচকি হাসতে দেখলাম – “হাঁ, থোড়া বোহুত”। আমি এক কান থেকে হেডফোন টা খুলে রাখলাম, খুব দারুন কিছু একটা হতে যাচ্ছে, শোনা দরকার।

পরের প্রশ্ন, এবং সেটা বেশ কড়া “মুঝে তো ফক্সপ্রো কা উয়ো দিয়া হ্যায়, ক্যা বোলতা হ্যায়, হাঁ, প্রোগ্রামিং। আপকো ক্যা ওয়ার্ড প্রোগ্রামিং দিয়া হ্যায়? ক্যায়সে করতে হ্যায় ইয়ে? মুঝে এক থোড়া ‘হেলো ওয়ার্ল্ড’ ওয়ালা চিজ লিখ কে দিখায়েঁ তো?” আড়চোখে দেখলাম, মুচকি হাসি কোথায় হাওয়া, কুমারের মুখ হাগু চাপার মতো, অনেক কষ্ট করে হিন্দি আর ইংরেজি মিলিয়ে বোঝাতে থাকলো যে এটা প্রোগ্রামিং না, এটাকে বলে সিস্টেম ডকুমেন্টাশান, প্রোগ্রাম লেখার আগে এটা জরুরী। জস্পিন্দার মানার পাত্রী নয় – ম্যান্নে তো লিখি হ্যায় প্রোগ্রাম, মুঝে তো ইয়ে সব জরুরত নহি পড়ি?”

খানিক তর্ক চলার পরে জস্পিন্দার পরের বোমাটা ফাটালো “খ্যার, ছোড়িয়ে। ইয়ে বতাইয়েঁ, মুঝে তো ট্যান দেতি হ্যায়, আপকো কিত্না মিলতা হোগা?” কুমার সত্যিই ট্যান – বোকা বোকা মুখ করে জানতে চাইলো “ট্যান মানে?” – একটু আধটু দিল্লি ঘোরা না হলে বাঙ্গালীর “ও” কারান্ত জিভ ও “এ” কারান্ত কানে সত্যিই ধরা মুশকিল, কিন্তু জস্পিন্দার ক্লিয়ার করে দিলো “আরে ইয়ার, ট্যান থাউস্যান্ড, স্যাল্রি, স্যাল্রি!” কুমার বিড় বিড় করে বলল “ওরে শ্শালা, বাচ্চা মেয়ে আবার ইয়ার বলছে”, কিন্তু জস্পিন্দারের থেকে তাতে নিষ্কৃতি নেই, “কিঁউ, বংলা মে কয়া ফুসুর ফুসুর করতে হো আপ, নেহি বাতানা? ঠিক হ্যায়, উও তো ম্যান্নে পতা করনি কোয় মুশকিল নহি, এচআর কো পুছ লুঙ্গি, নহি তো পাপ্পা কো বোলতেহি পতা কর লেঙ্গে!” বলে হাত ধুতে আবার ওয়াশ রুমে চলে গেল, কুমার কেটে পড়লো সিগারেট খেতে।

এর পরে ভিড় বাড়ায় ওখানে আর লেনদেন বাক বিতন্ডা কিছু হয়নি, কিন্তু বিকেলের দিকে আমাদের একজন সিনিয়র ম্যানেজারের কিউবিক্লের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনলাম জস্পিন্দার ওপারে দরবার করছে “মুঝে আপ উও ওয়ার্ড ওয়ালা প্রোগ্রামিং মে ডালিয়ে, উস্মে জ্যাদা স্যাল্রি মিলতি হ্যায়!”

----

কয়েক দিন গেছে। জস্পিন্দার এখন আমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই বকবক করে, আমার পেছনের সিটেই বসে, আমাকে হোম্লি লেগেছে বোধহয়, কারন আমি একটু আধটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা পাঞ্জাবি বলতে পারি, বুঝতে পারি, ওদের দুঃখ কষ্ট কিছুটা হলেও জানি, আর হিন্দিতে আমার একদম অসুবিধে নেই, তার কারন আমার মামাবাড়ী বিহারে। আমিও কথা বলি, কারন সবসময়ে চান্স থাকে গল্পের স্টকে কিছু একটা অ্যাড করার, তাই বেশী বকার চাপ থাকলেও খুব ব্যাস্ত না থাকলে একটু বোকা বোকা উত্তর দিই, একদিন বলেওছে “ভিজি ভইয়া, আপ তো সর্দার সে ভি বদতর হো দিমাগ কে মামলে মে”, কিন্তু আমি খনি পেয়ে গেছি, এসব তো হবেই, অকুপেশ্যানাল হ্যাজার্ড!

একদিন অফিসের অনেকেই বাইরে কোথাও একটা খেতে গেছে, আমাদের এরিয়া তে আছি শুধু আমি, অমিত আর জস্পিন্দার। অমিত সিনহাও আমাদের মতো টিফিন নিয়ে আসতো, তরকারি আর রুটি। একদম ফিক্সড, কোন ব্যতিক্রম নেই। তরকারি টা যাই হোক, সঙ্গে রুটি ছাড়া আর কিচ্ছু থাকবে না, এবং রুটি গুলো চার টুকরো করা থাকবে। অমিত ও কখনই একসাথে এক্টার বেশী দুটো টুকরো মুখে পুরবে না, প্রতিটা রুটির টুকরো আলাদা করে একটু তরকারি মুড়ে খাবে। সেদিন আলু-পটলের তরকারি, সঙ্গে রুটি। অমিত ভাব জমাতে শুরু করলো। প্রথম প্রশ্ন অবশ্যই আবহাওয়া নিয়ে “কিত্না গোরমি হ্যায় না আজ?” জস্পিন্দারের চট, জলদি উত্তর “মুঝে কিঁউ লাগ্নি হ্যায় গর্মি? ম্যায় তো সুব্হে সে এসি মে হি হুঁ!” হক কথা, একদম ঠিক কথা – গরম তো আমার কি? আমি এসি তে জমে যাচ্ছি, আর এই দেখো, একজন এলেন, বলছেন কিত্না গোর্মি। যত্তসব!

অমিত আজকে বরফ ভাঙ্গবেই, তাই একবার, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সাহি কাহা” বলে পরের প্রশ্ন করলো “আচ্ছা, ইয়াসবিন্দার (বাঙ্গালীর ধর্ম মেনে - বানান ও উচ্চারণ পালটানো), আপলোগ প্যাটোল খাতি হো?” আলু-পটলের তরকারি খেতে খেতে একটা ক্রাঞ্চি পাকা বিচি মুখে এসেছে, সেটা দাঁতে পড়ায় পপকর্ণ ভাজার মতো ফটাস্ করে একটা আওয়াজ হয়েছে, তাই পরের প্রশ্ন খুঁজতে মাথা খাটাতে হয়নি তেমন, সত্যিই তো, সর্দারজিরা সর্ষোঁ-দি-সাগ, মাকাই দি রোটি, তড়কা মারকে ডাল মাক্ষানি, চিকেন বাটার মশালা এমন কি অমৃতসরি ফিশ কারি ও খায়, কিন্তু পটল খায় কি? জস্পিন্দার এই প্রথম মাথা ঘুরিয়ে মুখ টা বেঁকিয়ে বলল “ইয়াক! আপ ভি না? খানে কে টাইম পে কোই পাট্হোল কা বাত করতে হ্যায়? উসমে কিত্নি কচড়া র্যাহতা আপকো পতা হ্যায়? গাই ভাঁইস, রোড কি কুত্তা ভি নহি পিতা হোগা উস্মে সে। খাতে হ্যায় রোটি অউর আলু-পরওয়াল কি সব্জি, শোচতে হ্যায় পাট্হোল কি! গন্ধা ভাইয়া বুলায়েঙ্গে আপকো অব সে!” অমিত থতমত খেয়ে থেমে গেল, প্রথমতঃ নতুন নামটা খুবই দুঃখজনক, আর দ্বিতীয়তঃ পটল ও পটহোল নিয়ে ফারাকের ব্যাপারটা বুঝতেই অনেকটা সময় চলে গেছে – তারপর নতুন করে আলোচনা করার আগ্রহটাও তাই চলে গেছে। অবশ্য “প্যাটোল” আনতো না তারপর অনেকদিন ধরে, সেটা ভালো লাগে না বলে নাকি খেতে গেলেই পটহোলের কথা মনে হয় বলে, সে আমায় বলেনি।

---

মাস ছয়েক চলে গেছে। এর মধ্যে জস্পিন্দার ভালই মিশে গেল সবার সঙ্গে। আড্ডা দিতে শুরু করলো, একটা দুটো বাংলা কথা বলতে শুরু করলো, এমনকি সর্দার জোক বললেও খুব কিছু একটা রাগতো না, শুধু বলতো “ঠিক হ্যায় না, মেরি তো একবার কনফার্মেশান হো যায়ে, ফির সবকা যওয়াব দুঙ্গি ম্যায় তো!” কারন তার শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে, ফ্রেশার হয়ে কনফার্মড লোকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই। ততদিনে নিজের নাম পাল্টে Jassi লিখতে শুরু করেছে, মডার্ন ও হয়েছে অনেক, নিজেই যাতায়াত শুরু করেছে অফিসে, এমন কি মাঝে সাঝে সবার সঙ্গে বাইরেও খেতে যায়। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, গুড়্গাঁও এর ছেলে, ম্যারেজ লিভ ও স্যাংশন হয়ে গেছে, আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। একদিন ইচ্ছে হল, একটু টেস্ট করে দেখি, পরীক্ষায় পাস করতে পারে কিনা। একটা ইমেইল লিখলাম জস্পিন্দারকে, তাতে সাবজেক্ট লাইন টা এরকম “Microsoft Virus Alert!!”  আর  ভেতরে লেখাঃ

A new type of virus has infected many Windows PCs. This is the first ever manual virus. To activate this, the user needs to go to the command prompt, write CD windows/system32 and press enter. After this, if the user types del *.* /y, then the virus gets activated and the computer stops from booting next time.

সকালে পাঠিয়েছিলাম মেইল টা, তারপর অনেক্ষন কোন হট্টগোল না দেখে বুঝলাম নাহ, পাস করে গেছে, পাত্তাই দেয়নি। বিকেল চারটে নাগাদ জস্পিন্দার মুখ কাঁচুমাচু করে আমার ডেস্কে এলো, বলল “ভিজিদা, মেরি তো লগ গ্যায়ী। ক্যা, আপ ভি, ভাইরাস স্ক্যান নেহি করতে হো। আপ কা ম্যাশিন সে মুঝে এক ভাইরাস আয়ি থি আজ সুব্হে, ম্যায় তো অব তক ট্যান টাইমস নর্টন চলায়ি, লেকিন কভি ভি ভাইরাস ক্লিন কা মেসেজ নহি আয়ি! মেরা শাদি কা তো হো গিয়া ছুট্টি!” আমি একটু গোবেচারা মুখ করে বললাম “ফিরসে চলাকে দেখো না, হো যায়েগা” জস্পিন্দার বলল “হাঁ, অউর নেহি ভি হুয়ি তো মেরি তো কোই নেহি, ম্যায় তো কল যা রহি হুঁ! উও মোটু সওতিক ফির ইউজ ক’রেগা মেরি ম্যাশিন, প্রব্লেম হুয়ি তো উসিকি লগেগী ওয়াট!”

---

জস্পিন্দার ম্যারেজ লিভ থেকে আর ফেরৎ আসেনি। দিল্লিতেই নাকি চাকরি পেয়ে গেছে। একদিন ওর বাবা এসে একটা ব্যাগ আর কয়েকটা পেন ছিল সেগুলো নিয়ে গেলেন। ভাইরাস টাও কি অবস্থায় আছে, সেটা জানার আগ্রহ হয়নি এরপর। ভুলেই গেছলাম। আজকে একটা একদম একরকম “ভাইরাস এলার্ট” দেখলাম ফেসবুকে, তাই জাস্সির কথা মনে পড়ে গেল আবার।



Sunday, May 24, 2015

দুই মাসে তিন পার্বণ (তৃতীয় পার্বণ)

প্রতিশোধ

এস-ও-এস কথাটার মানে আমরা কম বেশী সবাই জানি। সেভ আওয়ার সৌলস্ - রবিঠাকুরের নাম ব্যবহার করে একটা বাংলা রুপান্তর ও চালিয়ে দেওয়া যায় - নিস্তারো মোর সত্ত্বা। অতএব বাংলার যে অনুষ্ঠানের নামের মধ্যেই এস-ও-এস আছে, তা যে আমাদের দুই মাসে তিন পার্বণের শেষ ও সেরা পার্বণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জামাইSOSঠী – বাংলার তাবড় শ্বশ্রুপিতারা যেদিন মুখে হাসি রেখেও মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠেন, রাবীন্দ্রিক ভাষায় লিখলে যা দাঁড়ায় –

ভরা গ্রীশ্মের দহন কঠোর,
আসিছে জামাতা - অগ্নি জঠর,
বাজারে আগুন, যাহাই কিনুন,
কিছুই তো নহে সস্তা,
লোনের টাকায় জামাতা বিদায়,
নিস্তারো মোর স্বত্বা।
---
দুর্গা আমাদের বাঙ্গালীদের ন্যাশানাল ও ঈন্টারন্যাশানাল জোনে মেইন ঠাকুর হিসেবে সবার ওপরে আছেন। অন্য সব ঠাকুরের থেকে বেশী হাত, সঙ্গে সবথেকে বেশী অন্য ঠাকুর ঘুরে বেড়ান (লক্ষী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, শিব, এমনকি যাকে সংহার করছেন, সেই অসুর ও এক টাইপের ঠাকুর), পাঁচ দিনের পুজো অন্য কারো হয়না, শাড়ী না দিলে ডিভোর্স, ডিস্কাউন্ট না দিলে বয়কট, ছুটি না দিলে রেজিগ্নেশান, বোনাস না দিলে অনশন – এগুলো একসাথে শুধু এই পুজোতেই হয়। তাঁর হাসব্যান্ডও খুব কম পপুলার নন।  প্রাচীন ভুটানের লিঙ্গ ব্যাকুলতা দেখে ট্যুরিস্ট বাঙ্গালী যদিও ফিস ফিস করে অনেক সমালোচনা করেন, “ঈস, ছেলে মেয়ে নিয়ে ‘ওসব’ দেখা, জাস্ট লজ্জাস্কর!” বলে হাহাকার করেন, সেই বাঙ্গালীই আবার প্রতিটি গাছের তলায় মন্দির বানিয়ে ওই একই জিনিসের মাথায় ইয়ের রিপ্রেসেন্টাটিভ হিসেবে দুধ ঢালেন, তখন ‘ওসব’ টাই মূল হয়ে দাঁড়ায়। আদীরস-প্রিয় বঙ্গসন্তানের তাই শিব মন্দির তৈরিতে কোন খামতি নেই। দুই বাংলা আলাদা হওয়ার আগে শীতলা দেবী ছিলেন এপার বাংলার আরেক পপুলার দেবী, কিন্তু বাংলা ভাগের পরে শনি ঠাকুর এপারে বেশ ভালই বসতি গড়েছেন, তাই এখন ওখানে কম্পিটিশান। এদিক ওদিক দু একটা ভৈরবের আস্তানা, বিবি মাতার মন্দির, ওলাইচন্ডীর তলা আর কালীমায়ের ও মনসার আস্তানাও আছে, তাঁরাও মন্দ পপুলার নন। কিন্তু এর মধ্যেও, অলমোস্ট কোন মন্দির ছাড়াই যাঁর সবথেকে বেশী বার পুজো হয় এক বছরে, তাঁর নাম ষষ্ঠী। এনার অনেক গুলো পরব, তার মধ্যে প্রধান – জামাইষষ্ঠী।

একটু মিথোলজি ঘাঁটি – মন্দ লাগবে না। ষষ্ঠিদেবীর ডিপার্টমেন্ট রিপ্রোডাকশান ও চাইল্ড কেয়ার। তার মানে শিবের কৃপা হলে যা যা করা হয়, তার পরের ষ্টেজ টা এনার আন্ডারে। সুন্দরী, নিশ্চয়ই ফিগার কনশাস ও লাইট ওয়েট, নাহলে বেড়ালের পিঠে চেপে ঘোরা যায় না। তবে ছোট দেবতা তো, এক্সিকিউটিভ র্যাঙ্ক এর নয়, তাই ছোট কোম্পানিতে যেমন পান থেকে চুন খস্লেই চাকরি চলে যায়, এনার রাজ্যেও ব্যাপারটা সেরকম। রেগে গেলে বাচ্চাদের চিকেন পক্স করে দেন, সে রোগের ও নাম “মায়ের দয়া”। তাই মা আছেন ভীষন ভাবে। নীল ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী তো আছে, আর আছে জামাইষষ্ঠী। মহিলার এক সময়ে ছ’টা মাথা ছিলো, এখন একটায় এসে ঠেকেছে, তবে প্রয়োজনে বাকি গুলো বের করতে পারেন। আমাদের স্ত্রীরা পঁয়ত্রিশ পেরোলেই সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীরও মা হয়ে যান, অন্ততঃ হাবে ভাবে, এনার কেস টা তার উল্টো – আগে স্কন্ধের মা বলে পরিচিত ছিলেন, পরে সহচরী – সেই স্কন্ধ, যে কিনা ভেল্লায়ুধা ওরফে শরভ ওরফে মুরুগন ওরফে দেবসেনাপতি ওরফে আমাদের হোমলি কার্ত্তিককুমার – দ্য এল্ডার সন অফ শিভা অ্যান্ড দুর্গা।

একটু কার্ত্তিকের কথা আপনাদের শুনতেই হবে। কার্ত্তিক কিন্তু ওঁদের অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড, মানে শিব-দুর্গার। গল্পটা এইরকম - আগুনের দেবতা অগ্নিদেবের উত্তাপ নিয়েই কারবার, কিন্তু একবার মিউট্যান্ট ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট রাক্ষসদের সঙ্গে নতুন টাইপের যুদ্ধ করার জন্য নতুন কাউকে চাই, তাই ওনার বাবা হওয়ার ইচ্ছে হল। এদিক ওদিক মুনি ঋষিদের বউদের নিয়ে ট্রাই করলেন, কিন্তু তারা বলে দিলেন এই হাইপার লোকটাকে জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না, একদম পারভার্ট, পাঞ্জাবি, যা তা করে। এই ফাঁকে স্বাহা নামের এক গেঁয়ো দেবী, যিনি কিনা অনেকদিন ধরে অগ্নিদেবের স্বপ্ন দেখতেন রাত্রে, তাঁর তখন ইচ্ছে হল ট্রাই করে দেখার যদি ট্রায়ালে পাস করতে পারেন – যেমন অনেকের সা-রে-গা-মা-পা তে গান গাওয়ার ইচ্ছে হয়। অডিশনে পাসও করে গেলেন তিনি, আর ফাইন্যাল রাউন্ডে এক্সট্রা প্রিকশান হিসেবে গঙ্গার থেকে একটু জল ধার নিয়ে রাখলেন, কুল্যান্ট হিসেবে – সেই জলের ধারার নাম হল গঙ্গা নদী। শেষ পর্যন্ত ছেলে হল, নাম রাখা হল শরভু – গঙ্গা নদীর ধারে শর গাছের মধ্যে হয়েছিলেন, তাই। সেখানে ছয় কৃত্তিকা স্নান করছিলেন, তাঁদের এই বাচ্চা দেখে শখ হল, বাচ্চাকে দুধ পান করাবেন। শোনা যায়, এক সাথেই ছয় কৃত্তিকার স্তন্যপান করবেন বলে ডারউইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে মিউট্যান্ট এক্সের মতো এক চান্সেই এক্সট্রা পাঁচটা মাথা বের করেছিলেন এই পুত্র সন্তান – তাই সেই কৃত্তিকা থেকেই কার্ত্তিক নামটা চালু।

কিন্তু সে ছেলে ছয় দিনেই বড় হয়ে গেলো, পপুলারিটি সলমান খানের থেকেও বেশী, টানাটানি শুরু হল তাই। স্বাহা কে অগ্নিদেবের বউ বানিয়ে দেওয়া হল বটে কিন্তু আদালত বলে দিলো - পেটে ধরলেই যে মা বলা যাবে তা নয়, উনি সারোগেট মাদারও হতে পারেন। গঙ্গা বললেন আমার দেওয়া জলের সাপ্লাই ছিল বলেই বাচ্চাটা জন্মেছে, তাই ওয়াটার চুক্তির বলে আমিই ছেলের মা। অগ্নিদেব বললেন আমি না থাকলে ইয়েটা কে দিত? কৃত্তিকারাও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন – ওনারা ফস্টার মাদার ব’লে কথা! কি যে হয়, কেউ বলতে পারছে না।

ওদিকে মহিষাসুরকে পটকে দেওয়ার পরে দুর্গার আর বাইরের কাজ বিশেষ থাকে না, তাই বাড়ী নিয়েই পড়ে থাকেন। শিবের সঙ্গে রোমান্সটা বিয়ের আগে ভালই জমেছিল, কিন্তু বিয়ের পরে লোকটার কি যে হল, রোজ কৈলাশে পার্টি ক’রে, নেশার ঘোরে তান্ডব নেচে রাত দুপুরে বাড়ী ফেরে, কখনো আবার ফেরেও না, কনজ্যুগ্যাল লাইফ শিকেয় উঠেছে, কাজের লোক বাড়ী আসে না, এমনকি একটা বাচ্চা কাচ্চাও নেই যে তাকে নিয়ে একটু সময় কাটাবেন। একদিন শিব একটু হাল্কা ছিলেন, দুর্গা আবদার করলেন – আমি জানি না, তুমি যদি নিজে না করতে চাও, ঠিকাচে, কিন্তু আমাকে অ্যাট লিস্ট কোথাও থেকে একটা বাচ্চা এনে দাও, অ্যাড্যাপ্ট করি। ওদিকে কার্ত্তিক কে নিয়ে বাদানুবাদ তখন তুঙ্গে উঠেছে, শিব দেখলেন এই সুযোগ, একদম পাড়ার বড় দাদার মতো সাইটে পৌঁছে বললেন – অনেক হয়েছে কিচাইন, এবারে কেটে পড়ো সবাই, আমিই নিয়ে যাবো এটাকে, আমার আর দুর্গার ছেলে হিসেবেই সবাই জানবে একে। ঠিকাচে, নাম টা নাহয় কার্ত্তিকই থাক। সবাই “ওক্কে, শিবু দা বলছে যখন, তখন অন্যায় চেয়ে নিলাম” বলে কার্ত্তিককে শিবের হাতে হ্যান্ড ওভার করে চলে গেলো, কেউ আর কোন বিশেষ লাফড়া করলো না – আফটার অল শিবুদা বলে কথা। শিব তাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে দুর্গাকে বললেন “এই নাও, তোমার ছেলে, এনে দিলাম, এবারে দেবতা করার দায়িত্ব তোমার”। দুর্গা খুব খুশি, নতুন পাওয়া ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে হাসি মুখে বললেন “ও আর নতুন কথা কি, ও তো সব পুরুষমানুষই ক’রে”।


দিন কেটে যায়, শিব গাঁজা ভাং নিয়ে কৈলাশে পড়ে থাকেন, বাড়িতে বেসিক ট্রেনিং শেষ হলে কেরিয়ারের কথা ভেবে দুর্গা কার্ত্তিককে আর্মিতে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে কার্ত্তিকের খুব উন্নতি হল, প্রমোশান পেয়ে পেয়ে জেনারেল হয়ে গেলেন। দুর্গা খুব খুশি, পাড়ার দেবতাদের আর তাদের বৌদের রামকৃষ্ণ সুইটসের বাক্স পাঠালেন, অনেকেরই তাতে জ্বলে গেলো, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না, আর দুর্গা বুক ফুলিয়ে পাড়ায় ঘুরতে থাকলেন – হাসব্যান্ড নেশাড়ি তো কি, ছেলে টা দ্যাখ, কেমন সোনার টুকরো!

সেরকম থাকলেই ভাল ছিল, কিন্তু তা তো হবার নয়। ময়ূরের পিঠে চেপে যুদ্ধ, অন্যমা কালীর ফেলে রাখা দারু খেয়ে ড্রাইভিং, মাঝে মাঝে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে হরিণ শিকার ইত্যাদি নিয়ে ছিলেন বেশ, যেমন সলমান খান থাকেন, হল কি, একবার ভ্যাকেশানে বাড়ী এসেছেন, দুর্গা তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন – ওরে কাতু, অনেক তো হল, এবারে একটা বিয়ে কর? কার্ত্তিক ফট করে বললেন, “করতে পারি মা, কিন্তু একদম তোমার মতো বউ চাই আমার!”

কি সর্বনেশে কথা! একতা কাপুর তখন নেই, কিন্তু তাও মায়ের বেদম রাগ হয়ে গেল, অনেকবার ফ্রোজেন মোমেন্ট দেখা গেল, ব্রাইটনেস বেড়ে আবার কমে গেল, ঝ্যাং ঝ্যাং করে আওয়াজ হল, স্বর্গের নর্তকীরা আ-আ-আ করে গেয়ে উঠলেন, আর মা দুর্গা, অ্যাজ ইউজুয়্যাল, একখানা অভিশাপ ঝেড়ে দিলেন – বদের ধাড়ী ছেলে, এখনই ঘর ভাঙ্গার প্ল্যান, বাপ টা নেশা করে পড়ে থাকে, ভেবেছিলাম একটা বউ এনে কদিন বাড়ির কাজ হ্যান্ডওভার করে একটু শান্তি তে থাকবো, মাঝে মাঝে বিউটি পার্লার যাব, আর তুই কিনা আমার কম্পিটিটার আনার প্ল্যান করছিস? হবে না? বাপের রক্ত কোথায় যাবে? নে, আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তোর বিয়েই হবে না, বিয়ে করলেই সব বউ বটগাছ হয়ে যাবে – ইউ উইল সাফার ফ্রম ইটারন্যাল সেলিব্যাসি!

ব্যাস, একদম কেলো! ওদিকে প্রজাপতি তো মেয়ে ষষ্ঠীর বিয়ে অলমোস্ট ঠিক করে ফেলেছে কার্ত্তিকের সঙ্গে, ইন্দ্রের সাজেশান মেনে। তিনি বললেন, “বৌদি, এটা কেমন হচ্ছে?” আর ভেল্লিয়াম্মা, – তার কি হবে? ভেল্লি কে জানেন না তো? জানার কথাও না আপনাদের। আমি এই লাইনে আছি তাই জানি। কার্ত্তিক একবার ব্যাঙ্গালোর গেছলো, সম্ভবতঃ আইবিএম এর হয়ে অ্যাক্সেঞ্চ্যুরের সঙ্গে একটা ডিল এর ব্যাপারে, সেখানে লোকাল মেয়ে ভেল্লির সঙ্গে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। কেটে পড়ার চান্স ছিল, কিন্তু কার্ত্তিক একটু হাল্কা নেওয়ায় ভেল্লির বাবা নাম্পি ধরে ফেললেন। নাম্পি তখন মাইক্রোসফটের ইন্ডিয়া হেড, তাই খুব ইনফ্ল্যুইয়েনশিয়াল, চাপের মুখে কার্ত্তিক তাকে বিয়ে করার কথা দিয়ে দিয়েছেন। দুর্গার রাগের খবর কার্ত্তিক তাঁকে ইমেলে জানিয়েছেন, নিম্পি সটান কলকাতায় এসে দুর্গার সঙ্গে দেখা করে বললেন, “ইয়ারে? মুরুগানা ইঙ্গে পো? ওয়েডিঙ্গা মুড়িয়াদে? নো ওয়েডিঙ্গা, নো ফ্যামিলি, এপ্ড়ি পসিবেল ম্যাডাম? ইল্লে ম্যাডাম, রিকোয়েস্টা, প্লিজ কান্সিডারা!”

দুর্গার রাগ কিছুতেই কমে না। এমনকি তামিল ভাষা শুনেও হাসি পাচ্ছে না। তখন নাম্পি আর প্রজাপতি, দুজনে মিলে দুর্গা কে অনেক তেল টেল, বডি স্প্রে, লোশান, কেরালা হারব্যাল ম্যাসেজের ফ্রি পাস আর বিউটি পার্লারের গিফট হ্যাম্পার দেওয়ার পরে একটা কম্প্রোমাইজ হল – ওক্কে, তিনজনে একসাথে থাকতে পারে, কিন্তু নো অফিসিয়াল বিয়ে।

প্রজাপতি বললেন বেয়ান, এটা কি হয়? কিছু তো একটা করুন যাতে অ্যাট লিস্ট বউ বউ বলে মনে হয়? দুর্গা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিকাচে, ষষ্ঠীর ভালো নাম তো দেবসেনা? আর আমার কেতো হল আমাদের আর্মি, মানে দেব সেনা দের সেনাপতি, তাই ওকে দেব-সেনাপতি বলা হয়। হাইফেন টা একটু সরিয়ে দিচ্ছি, ওকে এবার থেকে দেবসেনা-পতি বলে ডাকা হবে, তবে হ্যাঁ, ছেলেটা আমার বনে জঙ্গলে ঘুরে রোগা হয়ে যায়, ওকে বছরে একদিন অন্ততঃ ভাল করে খাওয়াতে হবে। আর আগের যা যা কেস আছে দুজনের, তার এগেন্সটে একটা করে বটগাছ লাগাতে হবে। প্রজাপতি রাজি, না হওয়ার কিছু নেই – স্লিম ফিগারের কার্ত্তিক আর কতো খাবে? উনি প্রমিস করে দিলেন।

অন্য রিলেশান টা তখনো রিসল্ভ হয়নি। ভেল্লি, অর্থাৎ বল্ল নামটা কেমন যেন ঠেকছিল, তাই তার নাম বল্লম করে দিলেন দুর্গা, বললেন “ওই দেখ নাম্পি, আমার ছেলে তোমার মেয়ের নামের জিনিস কে সব সময়ে হাতে ধরে রেখেছে, তাই ওরা সুখেই থাকবে”। শেষে কার্ত্তিক কে আলতো করে বললেন “ওই বল্লম তো সবসময়ে হাতে তুলতে পারবি না, তাই কলকাতায় এলে ওটাকে কেটে ছোট করে পেছনে শরগুচ্ছ লাগিয়ে দিবি, ওটাই তখন তীরের কাজ করবে”।

সল্যুশানে সবাই খুশি। নাম্পি “রোম্বা সন্তোষম ম্যাডাম!” ব’লে ব্যাঙ্গালোর ফিরে গিয়ে জানিয়ে দিলেন, কার্ত্তিকের সঙ্গে দেবসেনা আর ভেল্লি, দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে, আর কার্ত্তিক অন্যভাবে কি করে যেন ভেল্লির মামা হয়, তাই এই বিয়ে সিদ্ধ। আসল কেস টা এদিকের লোকের জানা রইল, কিন্তু দুর্গার ভয়ে কেউ আর মুখ খুল্লো না। কার্ত্তিকের সঙ্গে থেকে থেকে ষষ্ঠীরও ছয় খানা মুখ গজানোর ক্ষমতা হল। তাই এখনো কিছু পুরনো পোর্ট্রেটে ছটা মুখ দেখা যায়। বড় বউ, তাই ওনাকে রিপ্রোডাকশান আর চাইল্ড কেয়ার দেওয়া হল। আর ভেল্লি কে এখন দক্ষিণে বল্লম, আর এখানে তীর হিসেবে দেখানো হয়। কার্ত্তিক এক হাতে ধরে থাকেন তাকে, কিন্তু তাঁর দেবী রুপের পোর্ট্রট আর দেখা যায় না।

এতোটা হ্যাজালে যে চলতো না, এমন নয়। দুটো কারনে হ্যাজালাম। প্রথম কারন, গল্পটা শোনার পর থেকে পেটের মধ্যে গিজ গিজ করছে, বলতে না পারলে ভবম হাজাম হয়ে যাব, তাই। (যাঁরা জানেন না ভবম হাজাম কে, তাঁরা দয়া করে সুখলতা রাও এর লেখা “নিজে পড়” আর “নিজে শেখো” বই দুটি পড়ে নেবেন)। আর দ্বিতীয়টা কারণটা প্রাসঙ্গিক – জামাইষষ্ঠীর পুরো ব্যাপারটা এই মিথোলজি না পড়লে বোঝা যাবে না।

বর্তমানে ফেরৎ আসি। সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালী তার চিরশত্রু শীতের সর্দি থেকে ছাড়ান পেতে যে বৈশাখকে বছরের শুরুতে স্বাগত জানিয়েছিল, যে উদ্দীপনায় রবিঠাকুর আর নজরুলের গান গেয়ে রোদ্দুর রায় কে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেই উৎসাহে এখন ক্ষান্তি। বৈশাখ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গেছে এক মাস ধরে, কালবৈশাখী হয় না আর, মাঝে মাঝে নিম্নচাপ হয়, তাতে কিছু বাড়ী ঘর ভাঙ্গে, আর শেষে বাতাসের আর্দ্রতা আরো দুই মাত্রা বেড়ে যায়। দুপুরে শুলে মনে হয় প্রেসার কুকারে শুয়ে আছি, আর মাত্র দুটো সিটি বাকি, তারপরেই হাড় গলে দুধে চোবানো পাঁউরুটির মতো হয়ে যাবে। রাত্রেও শান্তি নেই। এরই মাঝে, দুই মাসে তিন পার্বণের সেরা পার্বণ, জামাইষষ্ঠী।

বাজারে মাছ মাংস সব্জি ফল ফলাদি ইত্যাদি দরাদরি করে কেনাকাটার কাজ টা আগের দিনই মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। দরাদরি করেও যে লাভ হয় কিছু, তা নয় – অগ্নিদেব সদাই ব্যস্ত সেখানে কাজে, যাতেই হাত দেবেন, তাতেই তিনি আছেন। আর জামাইষষ্ঠী ফল ছাড়া হয় না। ফলের মধ্যে প্রথম ফল – আম। বাঙ্গালীর কোষ্ঠকাঠিন্যের ব্যাকুলতা নিয়ে বানানো ছবি পিকু এবছর যেমন ব্যবসা করেছে, আম নিয়ে সৃজিত যদি একটা ছবি করতেন, ধরুন লিকু, সে দারুন ব্যাপার হতো। সারা বছর বাঙ্গালী আমের আশায় থাকে, যখন তখন লিক হতে থাকে সেই আমের আশা আমাষার ফল, আর গ্রীষ্মে তারা সেই আম খায় – প্রথমে কিছু বেহুদা আম, অনামী, টক, হাফ টক, নট সো টক, হাল্কা মিষ্টি, তার থেকে খুব মিষ্টি - হিমসাগর, আর ল্যাংড়া। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে সুন্দর ভাবে লাল রং করা সোনারপুরের মজফফরপুরি লিচু আর ইঞ্জেকশান দেওয়া তরমুজ। আঙ্গুরের আর আপেলের দাম আগুন, কিন্তু কার্ত্তিক বলে কথা, একটু না আনলে চলে? একটু ফুটি হলেও মন্দ হয় না। সঙ্গে একটু খেজুর, আর বেদানা।

জামাইরূপী কার্ত্তিক সকালেই এসে হাজির, সপরিবারে। এবং এসেই খাবেন, আর খেতেই থাকবেন। ওটাই নিয়ম। কাস্টোমারি প্রনামের পরে “এসো বাবা এসো! ওগো শুনছো, অমুকবাবাজি এসে গেছে, ওকে একটু জল দাও” বলে প্রজাপতি শ্বশুরমশাই অন্য ঘরে চলে যান নিজের ভুলের হিসাব করতে করতে, বাই দ্য টাইম স্টেজে হাজির শাশুড়ি মা। ভালোবাসার স্বর্ণভান্ড। জামাই যা চাইছে, উনি তার দ্বিগুন বা তিনগুন দেবেনই – আস্ক ওয়ান, গেট ট্যু মোর ফ্রি! প্রথমেই ফলাহার। আর জামাইও যেন শিবের নয়, অগীর বাচ্চা। যা পাচ্ছে, তাই হাবড়াচ্ছে। এক মুন্ডু নিয়ে ঢুকেছিল, খাবারের প্লেট দেখলেই কৃত্তিকাদের কথা মনে পড়ে যায়, আর ওমনি পাঁচ খানা এক্সট্রা মন্ডু গজিয়ে যায়! “এমা, একি করছেন? এতো কি কেউ খেতে পারে?” বলে ফটাফ্ফট্ প্লেট থেকে পেটে চালান, পাঁচ মিনিটেই মাছিরাও গাল দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শুধু ফল খেয়ে জল খেতে নেই, তাই কিঞ্চিৎ মিষ্টিরও সুবন্দোবস্ত আছে।

ওদিকে দেবসেনা ওভারইটিং অ্যান্ড এফেক্টস অফ এক্সট্রা ক্যালোরি নিয়ে কার্ত্তিককে একটু ফ্লার্টিং খোঁটা দিয়ে মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে ভিড়ে গেছেন - নিজের পাঁচটা এক্সট্রা মুখ বের করে দুর্গার কেচ্ছা শুরু করে দিয়েছেন, যেন কৈলাশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশান – শ্বশুরবাড়ী কৈলাশে ওনার অত ঠান্ডাতেও কিচেনে ঢুকলে ঘাম হয়, কিন্তু এই প্রেস রিপোর্টিং এর ব্যাপারে ওনার খুব ইন্টারেস্ট, তাই একটুও গরম লাগছে না, ঘাম মুছছেন আর বকেই চলেছেন, নভজ্যোত সিধুর মতো। জামাই বাবাজী এরপর একটু মাঠা মারা লস্যি গিলে শালীদের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট করবেন, শালাকে একটু ডিভাইন জ্ঞান দেবেন, তারপর বিশ্রাম নেবেন, তাই ইলেকট্রিকের বিলের কথা ভুলে গিয়ে এসি চালিয়ে দেওয়া হল। নিজের রুম টার কন্ট্রোল হারিয়ে শালা মনে মনে বলবে, শালা জাম্বু, চার অক্ষরের বোকা, ফোকটে হাবড়াচ্ছে আর জ্ঞান দিচ্ছে ফ্রি তে, এরপর আমার পাজামা পরবে আর শালা আমার বদনাম হবে। এরই ফাঁকে চৈত্র সেলের ডিস্কাউন্টে কেনা শাড়ি, সালোয়ার, পাঞ্জাবি আর টি শার্ট বিতরন হয়ে গিয়েছে, শ্বাশুড়ি তাই আহ্লাদে আটখানা, শালার ও রাগ টা একটু পড়েছে।

লাঞ্চের ডাক পড়ল। সেখানে পঞ্চব্যাঞ্জন সমাহার, কিন্তু জামাইয়ের তাতে একটুও চাপ নেই। পেটে অগ্নিদেব নিয়ে খেতে বসেছেন, সবকিছুই হজম হয়ে যাবে, গ্যারেন্টি আছে – অগ্নিদেব এখনো রেগে আছেন – সেই যে, শিবুদা ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেলো, তার রাগ! এরপর ইলেক্ট্রিকের বিল আরেকটু বাড়িয়ে দুপুরের বৌয়ের সঙ্গে শালার এসি রুম এ দরজায় ছিটকিনি তুলে চামড়া ঘষাঘসি, তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুম আছে, বিকেলে একটু ছাদে হাওয়া খাওয়া আছে। সন্ধ্যায় চা আর সিঙ্গাড়া সহযোগে এ পাড়ার স্পেশ্যাল মাটন রোল আছে। সব হয়ে গেলে রাতের খাবারের ছাঁদা বেঁধে আরেকদফা প্রণাম সেরে কার্ত্তিক আর ষষ্ঠী কৈলাশ অভিমুখে যাত্রা করেন। টা টা করা হয়ে গেলো, শালীরা বলল কার্ত্তিক দা, নেক্সট বারে কিন্তু সিনেমা নিয়ে যেতে হবে, কার্ত্তিক মাথা নাড়াতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। ট্যাক্সি মেন রাস্তায় উঠলে কার্ত্তিক বউকে বলেন “তোমার মা খুব ভাল, কিন্তু তোমার বাপ টা মাইরি চিপ্পুস আছে, শালা আইসক্রিম, আমাদের ওখানে পাহাড়ে দুধ আর চিনি ঢেলে দিয়ে নন্দীকাকু কে দিয়ে একটু নাচ করালেই হয়ে যায়, আর শালা বুড়ো কোয়ালিটির বদলে কি একটা অমল আইসক্রিম না কি খাইয়ে দিল, কাল সিওর ডিসেন্ট্রি”। ষষ্ঠীর ও পাঁচ মুখ বেরিয়ে আসে, মুখঝামটা দিতে। কার্ত্তিক একটা সিগারেট ধরান। ষষ্ঠী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। একটু পরেই বাড়ী পৌঁছে যাবেন দুজনে, তারপর কালকে অফিস।

ওদিকে প্রজাপতি মশাই রাত্রে রুটি আর কুমড়োর তরকারি খেয়ে শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর ঘুমন্ত শরীর হাতড়ান, তারপর আপনা হাথ জগন্নাথ হয়ে ভাবতে থাকেন, পি এফ এর লোন টা এমাসেও শোধ হল না – হে ভগবান, বাঁচাও মোর স্বত্ত্বা, একটু যদি বৃষ্টিও দিতে, কর্তা? একটু পরেই নাক ডাকতে থাকে, দুজনেরই। বাঙ্গালীর থার্ড পার্বণ এভাবেই শেষ হয়।

পুনশ্চঃ – প্রতিশোধের গল্পের শেষ এখানেই নয়। ভেল্লিদের ওখানে কার্ত্তিক এখনো যায়। অফিসের কাজে, যেতেই হয়। গেলেই নাম্পির কথা মনে রেখে কার্ত্তিক কে ওরা ভাত, এরিয়েল, পোরিয়েল, সাম্বার আর রাসম এর সঙ্গে রান্ডিভা কেক আর চেট্টিনাড় চিকেন খাওয়ায় – তাতে একবারেই সাত জামাইষষ্ঠীর পুণ্যফল লুপ্ত হয়। সে প্রতিশোধের কথা অন্য কোনদিন বলবো। 

Saturday, May 09, 2015

দুই মাসে তিন পার্বণ ((দ্বিতীয় পার্বণ)

রোদ্দুরময় রবিদিবস

একটা প্রশ্ন করবো? না থাক, একটু পরে করছি।

......

বরং রবীন্দ্র জয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানাই। সব বাঙ্গালীদেরই জানাই, আর সেই বাঙ্গালীদের তো অবশ্যই, যাঁরা “কওল্কতা” তে “রোসোগল্লা” খেয়ে বলেন “আমি কুব বালো আছে”। আফটার অল, আদমি টি নোবেল-কা-প্রাইজ পেয়েছিলেন – আনেক ফায়দা হোয়েছিল তাতে, লাখ রুপিয়া সে উপর। বাংলার এক খুব-বেশী-বাঙ্গালী মানুষ, সবার পিসি তিনি, এখনো ডহর বাবুকে খুঁজছেন কিন্তু পাননি, অতএব দ্বিমত এড়াতে জানিয়ে রাখি, আজকে জয়ন্তীর কোনো রোল নেই, আজকে শুধুই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, তাই রবীন্দ্রনাথের ফটো তে মালা দেওয়ার পরে জয়ন্তীর ছবি খুঁজবেন না দয়া করে – কারন ওনাকে ওখানে পাওয়া যাবে না, উনি নাট্রাজান উপাধী নিয়ে পলিটিক্স এ যোগ দিয়েছেন ও এখনো বেঁচে বর্তে আছেন, প্লাস উনি অন্য ক্যাম্পের। বরং আপনি যেটা চাইছেন, সেটাই শুনুন। আজকে বাংলার জাতীয় কবির জন্মদিন, তাই আজকে আমাদের একরকমের ভাষা আর সংস্কৃতি দিবস ও বটে। তাই, বাঙ্গালী দুই মাসে তিন পার্বণের একটা অবশ্যই আজকে।

বাঙ্গালী রবিঠাকুরকে নিয়ে যে ন্যাকামীর একশেষ করবে, খেতে হাগতে সব যায়গাতেই টেনে নিয়ে যাবে, তা কিন্তু জানাই ছিল। ভদ্রলোক নিজেও জানতেন ওনাকে নিয়ে এই রকমই হবে, তাই সব কিছু নিয়ে গান কবিতা লিখে গেছেন, যাতে ব্যবহার করা যায়। এমনকি নিজের জন্মদিন নিয়েও। ছবিও আঁকতেন, কিন্তু সেই যেবার ওনার একটা ছবি দেখে ওনার সেজোপিসি বলেছিলেন “ওরে রবি, তুই মানুষ ছেড়ে একানড়ির ছবি আঁকছিস কেন?” তারপর থেকে আঁকার ব্যাপারটা ভাইপো অবনীর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

সে যাই হোক, কোটি খানেক কবিতা লিখে, আর ওরকমই গান লিখে, সুর দিয়ে, এমনকি গেয়ে ফেয়ে রবি এমন যা তা করে ফেললেন, যে সাহেবরা চিন্তায় পড়ে গেল। এই লোক টিকে তো বাগে আনা যাইতেছে না! গান লিখিতেছে, পোয়েট্রি লিখিতেছে, মডিফায়েড নূর ও রাখিয়াছে, এমন কি এমন ড্রেস করিতেছে, রবার্ট স হিম দ্য আদার ডে অ্যান্ড থট দিস ইস গালীব? সো সেক্যুলার! নাইটহুড ডিয়াছিলাম, সেটাও ফেরত করিয়া দিয়াছেন। হাউ টু কন্ট্রোল হিম?

রবি ওদিকে লিখেই চলেছেন। গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ। নিজেই ঠাকুর ছিলেন, এখনো কিছু বাঙ্গালী ওনাকে পুজো করে, তাই ঠাকুর দেবতা পুজা নিয়ে তো লিখছেনই, দেশ নিয়েও লিখছেন “উদাসি নিবে, সেবি দেশ, ইনি কেশ এ” – ইন্দ্রলুপ্তের দল বলল এ আমাদের গান, স্টক এক্সচেঞ্জ বলল এ আমাদের, দেখছেন না, সেবির কথা লেখা আছে? প্রেম রসে ভিজিয়ে অমিত্রায়কে নিয়ে এমন লিখলেন যে মাইকেল তাতে খার খেয়ে একটা ছন্দই বানিয়ে ফেললেন – অমিত্রায়-খার ছন্দ। কালী পুজোর জন্য লিখলেন “নাচে শ্যামা তালে তালে”, কয়েকজন সেটা জন্মাষ্টমীতেও চালিয়ে দিল, বলল ওই শ্যামা আসলে শ্যাম, রবি ওটা সাউথইন্ডিয়ায় থাকতে লিখেছিলেন বলে ওটা শ্যামা লিখেছেন। দুর্গাপুজো নিয়ে লিখলেন “আনন্দধারা বইছে ভুবনে” (মতান্তরে ওটা ভোটে জেতার গান), বাংলা মদ নিয়ে লিখলেন “আমার শন আর বাংলা, আমি তোমায় ভালো বাসি”, ডেলি প্যাসেঞ্জার দের নিয়ে লিখছেন “এপ্পর বাসে রবে কি হায়?”, ছবি বিশ্বাস কে নিয়ে লিখছেন “তুমি কি কেবলি ছবি?”, ওপেন হার্ট সার্জারি নিয়েও লিখছেন “তোমারি চরনে দিব হৃদয় খুলিয়া”, আবার বসিরহাট নিয়েও লিখছেন “গামছারা ওই রাঙ্গাম আঁটির পথ”। পুলিশ কে নিয়ে লিখলেন “জেরা তে মোর দু আর গুলি ভাঙলো” – সব থানার বড়বাবু একসাথে খুশি হয়ে গেলেন। প্রতিবন্ধি ভাই বোন দের জন্য লিখলেন “আন অন্ধ লোকে, মঙ্গল আলোকে”, যুদ্ধ নিয়ে লিখলেন “শঙ্খ ছেড়ে বিউগল, তায় নিজেরে অপমান” – সাহেবদের নিজেদের মিলিটারিও আর ওনার ওপরে তেমন রেগে থাকতে পারলো না।

শেষ পর্যন্ত সেই নোবেল সাহেব, যাঁর জন্য গীতিনাট্য লিখতে গিয়ে বার বার রবি বাবুর মনে পড়েছে তাঁর স্ত্রীর কথা, যিনি নোবেল কে ছেড়ে চলে গেছলেন মাঝরাতে, সেই নোবেলের জন্য লিখে ফেললেন একটা গান
“তুমি তো সেই যাবেই চলে।
তুমি তো সেই যাবেই চ'লে,     কিছু তো না রবে বাকি--
আমায় ব্যথা দিয়ে গেলে, জেগে রবে সেই কথা কি॥”

নোবেল বাবুর নাতি বললেন, এই তো চান্স, এই লোকটা আমার দাদুর জন্যেও গান লিখেছে, একে নোবেল প্রাইজ দাও। চার্চিল কে নিয়েও ওনার এক ভক্তের একটি কবিতা ছিল (অপ্রকাশিত) –
“ঝুঙ্কু ওনার নিয়েছে কাড়িয়া, ভেঙ্গেছে কাদম বিনির দিল,
সময় তো তাকে করবে না ক্ষমা, ছিঁড়ে খাবে তাকে চার চীল।।”
তাই ব্রিটিশরাও বলল “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ!” চায়না বলল “হ্যাঁ, উনি তো আসলে আমাদের লোক, গান লিখেছেন না – আমি চিনি গো চিনি?” আমেরিকা বলল “অকুন্ঠ আঁখি মেলি হের প্রশান্ত বিরাজিত” আসলে ওদের গান, ওই যে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে লস এঞ্জেলেস, ওই নিয়ে লেখা – হের টা শুনে জার্মান মনে হচ্ছে, কিন্তু হিটলার তো এখন আব্বুলিস হয়ে গেছে, তাই চাপ নেই। জাপান শুধু কিছু বলতে পারেনি, কিন্তু বোমাবাজি আর নেতাজি নিয়ে চাপে না থাকলে ওরাও সিওর বলতো রবিঠাকুর জাপানি, নাহলে আমাদের ন্যাশানাল ফ্লাওার চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে কখনোই লিখতেন না “ও আমার চন্দ্রমল্লিকা”।

সারা বাংলা আনন্দে হই হই করে উঠলো। বড়বাজারের বাঙ্গালীরা বললেন “কিতনা নাফা আছে? জ্যাদা হো তো দেনা চাহিয়ে না নোবিল? ইতনি সি কাগজ মে কিতাব বানাকে ইতনা ভাও, তো পেরাইজ তো দিবার দরকার আছে নাকি?”
-- এই সব হলে যা হয়, তাই হল – রবিঠাকুর নোবেল পেয়ে গেলেন। সারা বিশ্বে আরো নাম ছড়ালো। এক কাশ্মীরি পন্ডিতের যাবতীয় কলকাঠি নাড়া কে অগ্রাহ্য করে দেশবাসী ওনাকে জাতীয় কবি বলে ডাকতে শুরু করলো।

সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালীর এটাই দরকার ছিল। ওই পচা বৈশাখের গরমে হিউমিডিটি কে ভুলে যাওয়ার একমাত্র টোটকা – রবিঠাকুর বলে ওই দাড়িওয়ালা দাদু। পাড়ায় শীতলা পুজো? নো পরোয়া – বাবুল সুপ্রিয়র গলায় “কতবার ভেবেছিনু” চালিয়ে দাও, সম্প্রীতি বজায় থাকবে। দুর্গাপুজোয় কালচার্যাল কালার চাই? বড় বড় করে জে-বি-এল লেখা বক্সে হেমন্ত চালাও “ওগো নদী আপন বেগে”। শ্মশান ঘাটে নতুন বিধবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন? চালাও “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু” – চার মিনিটে চোখের জল সাহারায় চলে যাবে। ট্রাফিকের চাপে বিপর্যস্ত? ক্রসিঙে স্পিকার লাগাও, চলবে “আমার এই পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দুরে”, অফিসের বাবু অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টারের লাল দাগের দুঃখ ভুলে যাবেন। গয়নার দোকানের অ্যাডের জন্য ছবি পাচ্ছো না? দাড়িওয়ালা তো আছেই? ই মেইলে সিগ্নেচারে একটা এথনিক ব্যাপার আনতে চাও? পছন্দ মতো একটা লাইন লিখে হাইফেন দিয়ে লিখে দাও – ট্যাগোর – কেউ চেক করে দেখবে না। সুন্দরী লেখিকা হয়েও ফুটেজ মরীচিকা? লেখ রবি ঠাকুর বলেছিলেন “রেপ ডেস্ট্রয়স দ্য চ্যাস্টিটি অফ অ্যা উওম্যান, সো শি মাস্ট বি সতী ফায়েড” – দুনিয়া গালি দেবে, কিন্তু তোমাকে সবাই চিনে যাবে, তারপর ১৩ বছর পরে সালমানের মতো ভালো মানুষ এর সার্টিফিকেট যোগাড় করে নিলেই হল।

আরো আছে। হঠাৎ লাভ লেটার পেয়ে গেছ? গাও “সখী ভালোবাসা কারে কয়?” হাফ সোল খেলে হিসেব নাও “আমি তোমায় যত, শুনিয়েছিলেম গান, তার বদলে আমি চাইনি কোন দাম”। রাতে ঘুম আসছে না? জর্জদার গলায় “আধেক ঘুমে, নয়ন চুমে” চালিয়ে দাও, ঘুমের বাপ এসে ঘুম সাপ্লাই করে যাবে। সকালে অ্যালার্ম চাই? টাইমারে লাগিয়ে দাও “এদিন আজি কোন ঘরে গো”। উনি সব যায়গায় আছেন। জৈষ্ঠ এলো বলে, হিমসাগর উঠেছে সবে, দুপুরে শেষ পাতে দুধ ভাত দিয়ে আম মাখা খাও আর ভাবো লোকটা এই নিয়েও লিখেছিল – “পিপিলিকা কাঁদিয়া যায় পাতে”। আর এতো ব্যবহার করছ বলে যদি একদিন আদিখ্যেতা দেখানোর ইচ্ছে হয়, তাহলে সেকেন্ড বিগ ইভেন্ট অফ দ্য বেঙ্গল সামার তো আছেই – পঁচিশে বৈশাখ?

......

ওই দিন একদল আছে, যারা ঘুম থেকে উঠেই গুগল ইমেজেস এ একটা সার্চ দেয় – রাবিন্দ্রানাথ ট্যাগোর, তারপর পছন্দ মতো একটা ছবি, আর যেকোনো একটা কবিতা জুড়ে সিধে টুইটার বা ফেসবুকে পোস্ট। সবাইকে জানানো – আমি রবিঠাকুর কে চিনি, সো ট্রিট মি অ্যাজ “সাংস্কৃতিক”। আরেকদল আলমারি খুলে ন্যাপথালিন ঝেড়ে মায়ের গরদের লাল পাড় সাদা শাড়ীটা বের করে লাল ব্লাউসের ওপরে চাপিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ধুতি পাঞ্জাবি পরা কারোর সঙ্গে – হয় পাড়ার মাঠে, কিম্বা রবীন্দ্রসদনে। সেখানে একটু গান আর কবিতার সঙ্গে আড্ডা আর কালচার্ড দুগ্গিবাজী সেরে বাড়ী ফিরে ফ্যান এর তলায় ভেনাসের পোজে বসে বগলের ঘাম সুকোও।

অফিস নেই আজ, তাই তাড়াও নেই। ব্যাঙ্ক অ্যাকাইন্ট ছিল না তাঁর, তাই রবিঠাকুরের জন্মদিনে সব ব্যাঙ্ক ও বন্ধ। ওদিকে শনিবার বলে অনেকেরই ছুটি। তাই আজ বড় আরামের দিন, আজ সংস্কৃতিকে লেপ্টে খাওয়ার দিন। যে কোনো প্রশ্নের সব সময়েই বেশ সঙ্গীতময় উত্তর। বউ এই পাগলামো দেখে কখনো বলেও উঠতে পারে “কি ব্যাপার? আজকে মনে হচ্ছে ঘোষ বৌদির সঙ্গে বেশ মাখো মাখো ছিলে?” ছেলে ভাববে “কেস টা কি? মালটা আজকে হিটলার থেকে চৈতন্য হয়ে গেল?”
বিকেলে বড় ইভেন্ট – মাইক, চোং, চেঞ্জার, টিউনার – সব এসেছে। তবলায় টং টাং করে টিউনিং হচ্ছে। হারমোনিয়ামের পাশে এস্রাজও হাজির, এমনকি খোল ও নাকি এসেছে, সঙ্গে করতাল। পাড়ার বাচ্চারা প্রথমে আবৃত্তি করবে – তুমি কি তাহাকে ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” এর পর বড়দের প্রবেশ। ইকো তে ভয়েস সেট করে গাইতে হবে প্রথমে “এসো হে বৈশাখ”, যদিও বৈশাখের অলরেডি চব্বিশ দিন আসা হয়ে গেছে, তারপর ম্যান্ডাটারি “হে নূতন, দেখা দিক আরবার”, তারপর অন্য গান। পাবলিকের ধৈর্য কম, তাই দ্রুত লয়ের গান এ শিফট করো এবারে, নইলে ক্রাউড কভার কমে যাবে। শেষের দিকে গলার মুন্সিয়ানা দেখানোর জন্যে একটু নজরুলগীতিও চলতে পারে বরং – রবি বাবু দিনু ঠাকুরের পাল্লায় পড়ে যে মীড়ের ক্যারামতি দেখিয়েছেন, ওখানে সুর ভুল হওয়ার চান্স অনেক অনেক বেশী - বরং নজরুলগীতি নিজের সুরেই গাওয়া যায় – শেষে বলে দিলেই হবে “এটি একটি অপ্রচলিত সুরে গাইলাম – আপনাদের ভাল লাগলে আমারো লাগবে”। আর অনেকেই এখন দুজন বড় কবির চাপ এক মাসে নিতে অপারগ, তাই আজকাল “রবীন্দ্র-নজরুল” সন্ধ্যার আধিক্য বেশী। বেশ একটা বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি টাইপের ব্যাপার হল – সেম মাইক ভাড়ায় দুজনকেই নমস্কার জানিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলা গেল। সংস্কৃতি মনা বাঙ্গালী অনুষ্ঠানে গেয়ে আর শুনে আপ্লুত হয়ে বাড়ী আসার সময় গান ধরলো সালমানি স্টাইলে, “তুমি কোন কানুনের fool গো”। কাল রোববার।

এরকমই বেশ চলছিল, কিন্তু বছর দুয়েক আগে উদয় হলেন রোদ্দুর রয়। আজকের দিনে ওনার ব্যাপারে দু কথা না বললে কিছুই বলা হয় না, তাই বলছি।

রোদ্দুরের জন্ম হয়েছিল রাঁচিতে। পিতা ও মাতা, দুজনেই একই মনস্তাত্বিকের অধীনে ভর্তি ছিলেন, তারি মাঝে দুজনের প্রেম। পিতা পর্তুগীজ, নাম সুওর, অর্থাৎ জল। ঝড়ে ডুবে যাওয়া জাহাজের ভাঙ্গা কাঠের টুকরো ধরে তাঁর বাবা পেন্ট্রাম (মানে কলম-বাস যেমন নাম হয়, ওদেশে পেন-ট্রাম বা পেন্সিল-জাহাজ ও নাম হয়) এদেশে এসেছিলেন, তারপর গোয়া তে চেনা ভাষায় কথা বলছে দেখে একজন সদয় পাদ্রী তাঁকে স্থান দেন। জাহাজ ভেঙ্গে পড়ার সময় মাথায় চোট লেগেছিল, তাই পেন্ট্রামের চিন্তাধারা টা একটু পাল্টে গেছলো, কিন্তু মানুষ খারাপ ছিলেন না। পাদ্রী ভদ্রলোক তাঁর বিয়েও দিয়েছিলেন, ছেলে হয়েছিল, নাম দিয়েছিলেন সুওর, জলে ভেসে আসার কথা মনে রেখে জলের সঙ্গে মিলিয়ে। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি, পেন্ট্রামকে পাগল বলে বদনাম দিয়ে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। পেন্ট্রামও এরপর একদিন ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোম্বে পৌঁছে যান। দাদার স্টেশানে লাইনের ওপরে শুয়ে ট্রেন আসার শব্দ শুনছিলেন, ড্রাইভার ট্রেন থামায়নি, তাই তিনি চলে গেলেন পরপারে। নশ্বর শরীর ছাই হয়ে গেলো, আত্মা জমা দিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। তারপরে কি করে সুওর রাঁচি পৌঁছলেন, সে অন্য গল্প।

রোদ্দুরের মা ছিলেন ফুলের মতো, তাই তাঁর আশ্রয়দাত্রী তাঁর নাম রেখেছিলেন রোজ – গোলাপ। কালো গোলাপ দেখা যায়না, খুব বেশী হলে একদম গাঢ় লাল, কিন্তু রোজ ছিলেন চেন্নাইয়ের একমাত্র ব্যাতিক্রম। বাবা মা কে কেউ দেখেনি, তাই মারগারেট দয়া করে রাতে শুতে দিতেন তাঁকে - নামটাও তাঁরই দেওয়া। শোনা যায় জন্ম থেকেই রোজের এই জগতের পারিপার্শ্বিক বস্তু সমগ্রে ভারী অনীহা ছিল, কেবলমাত্র খাবার জিনিস বাদ দিয়ে, তাই পাড়ার বোকা লোকে তাঁকে অ্যাব বলতো, কিন্তু তাতেও যে তাঁর বিকার ছিল, এমন কথা নিন্দুকেও বলে না। শৈশব কাটিয়ে যৌবনের মুখে মুখে যখন তাঁর জামা কাপড়ের প্রতি অনীহা সানি লিওনের থেকেও বেশী হয়ে দাঁড়ালো, এক দিন চেন্নাই সেন্ট্রালের সামনের ডিভাইডারের ওপরে গলায় পুঁতির মালা আর নিম্নাঙ্গে পেটিকোট পরে এক পা তুলে আপামর জনসাধারণকে লাথি ও ওয়াইল্ডলাইফ দেখাচ্ছিলেন, মাদার টেরিজার এক ভক্ত তাঁকে রাঁচি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। রোজ এর স্টাইল কপি করে যিনি নাম কামালেন, তাঁর নাম সিল্ক স্মিথা।

রোজ এর অঙ্গবস্ত্রের প্রতি অনীহা এর পরেও মোটেই কমেনি, তাই সুওরের সঙ্গে দেখা হওয়ার খুব শিগ্রীর মধ্যেই কামদেবের ভরে দুজন কে আর দুরে রাখা গেল না। ওঁদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো “শুয়ো-রোজ”, আর রোজমিলনের রোজ-গার হিসেবে তাঁদের এক সন্তানের জন্ম হল কিছুদিনের মধ্যেই। আইসক্রিম স্কুপের মধ্যে ভোমরা পড়ে গেলে যেমন লাগবে, তেমন দুটি চোখ – দুটি দুদিকে ছড়ানো, শুদ্ধ ভাষায় “স্কুয়িন্ট”। পদ্মবিচির মতো দাঁত, সাদার চারপাশে কালো দাগ দিয়ে ঘেরা। মাথা যেন ধুত্রোর ফল আলকাতরায় চোবানো হয়েছে। সুওরের সু, আর তার সঙ্গে রোজ, দুই মিলে সুরজ ছাড়া আর কিছু ভাবাই যায় না, তাই সূর্যের দীপ্তি নিয়ে জন্ম হল এক কালজয়ী পুরুষের, নাম রাখা হল রোদ্দুর। যেদিকে দু চোখ যায়, সেদিকে যেতে গেলে এই নরদেহ দুই ভাগে ভাগ করতে হবে, তাই যাওয়ার কথা তিনি আর ভাবলেন না, ঠিক করলেন, রয়েই যাবেন, তাই রয়ে গেলেন। নিজেই নিজেকে উপাধী দিলেন – রয়। তিনি তখনই জানতেন, যে তিনি থাকবেন। এই যে অনেকে রোদ্দুরকে শুয়োরের বাচ্চা বলে, সেখানে বানানের ভুল থাকতে পারে, কিন্তু ভুল মানে নেই – রোদ্দুর সুওরেরই সন্তান।

সুয়োর একদিন রোজ কে রবি ঠাকুরের বলাকা থেকে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন – রোজের সেই শুনে বকপাখি হয়ে ওড়ার ইচ্ছে হলো, কুঁয়োর ওপরে জয়েন্ট ট্রায়াল দিতে গিয়ে চিত্রগুপ্তের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেল দুজনের, উনিও ভালোবেসে দুজনকেই এন্ট্রি দিয়ে দিলেন, তারপর থেকে ওঁদের খবর কেউ রাখে না। যে রোদ্দুর নিজেকে রয় উপাধী দিয়েছিলেন, তিনিও আর রইলেন না রাঁচিতে - রোদ্দুর দিল্লি চলে গেলেন, দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে।

......এরপর, বেশ চলছিল, কিন্তু কোন এক সকালে উঠে রোদ্দুর ঠিক করলেন, উনি গান গাইবেন। হ্যাঁ! উনি গান গাইবেন।
...
বাংলার কোন কোন সঙ্গীতকারের পশ্চাদ্দেশের মৃত্যুর কারন তিনি হয়েছেন, সেই নিয়ে এখনো রিসার্চ চলছে, তবে গানের পেছনের সঙ্গে রোদ্দুরের শত্রুতা একদম সুনিবিড়। অন্য ভাবে ভাবা, সে তো আছেই, গান কে অগান করা, সেই ওনার মোক্ষ। তাই উনি সেই ঘরানার নাম দিয়েছেন মোকসা ঘরানা। যদিও উনি নিজে কিছু গান ও লিখেছেন, ওনার লক্ষ্য মুলতঃ অন্যের বিখ্যাত গান। তার মাঝে রবি ঠাকুরের গান ওনার লিস্টের একদম প্রথমে – কারন সেই রবি ঠাকুরের বলাকার পাঠ থেকেই যে তিনি তাঁর পিতা মাতা কে হারিয়েছেন, সেই দুঃখ তিনি তাঁর পাষান হৃদয়ে খোদাই করে নিয়েছেন। তাই একের পর এক রবি ঠাকুরের গানের পেছন নিয়ে তিনি পড়ে আছেন – তাঁর লক্ষ্য – পেলেই মারো। এর নেট রেজাল্ট – গত দু বছরে ইউটিউবে রবি ঠাকুরের গান লোকে যত শুনেছে, তার থেকে অনেক বেশী শুনেছে রোদ্দুরের হাতে তাদের মৃত্যুর ধ্বনি। ডাক্তার দের পশার বেড়ে গেছে – কারন রোদ্দুর কে শোনবার পর কারো বমি পায়, কারো বুক ধড়ফড় করে, কেউ পাগলের মতো হাসে, কেউ বা দেওয়ালে মাথা ঠোকে – বাঁকুড়ায় নাকি তিন মাসের পোয়াতি এক হবু মায়ের ডেলিভারি হয়ে গেছে ওই রোদ্দুরকে শুনে – নার্সিংহোম লাগেনি। তাঁর এই যে বিশ্বজোড়া গোঁসা, তার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ভিক্টিম বাঙ্গালীর রবি ঠাকুর। 

যে রামছাগলটা এই পয়লা বৈশাখে মাংসের দোকানে স্বর্গের সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছিল সে নাকি সেদিন ইউটিউবে কমেন্ট করেছে – “শালা মানুষের বাচ্চারা, আমার দাড়ি আর তোদের রবিঠাকুরের দাড়ি নিয়ে অ্যানালজি টেনে যখন ওই লজিকের ছাত্রটা পাতা ভরিয়েছিল, তখন তো খুব হেসেছিলি? এবারে দেখ, কার যায়গা কোথায়?”

ভয় লাগে, রবি অস্তাচলে চলে গেলে যেমন একটু আলো থাকে, তাকে এখন থেকে হয়তো রোদ্দুর বলা হবে। এটুকুই আশা,  রবি আজও যায়নি অস্তাচলে, তার আলোই এখনো পথ দেখায় বাঙ্গালীকে। যেদিন রোদ্দুরের পথ দেখতে হবে, সেদিন আমি আন্দামানে চলে যাব, জারোয়াদের কাছে।

......


একটা প্রশ্ন করবো? যখন হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে কোথাও যান, সেতুটা কার নামে, সেটা মনে থাকে তো?

Wednesday, April 15, 2015

দুই মাসে তিন পার্বণ (প্রথম পার্বণ)



সংস্কৃতি মনা বাঙ্গালীর কাছে বোশেখ-জ্যোষ্ঠির মতো মাস হয় না। ইভেন্টএ ঠাসা এই দুটো মাসে গরম কে ভুলে থাকার ও ভুলিয়ে রাখার সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো কালচারএর মধ্যে ডুবে যাওয়া, এমন গভীরে, যে লোডশেডিং হলেও ধুর শালাবলার বদলে আলো আমার আলোগাইতে ইচ্ছে হবে।
সুযোগ ও মন্দ নেই মাসের প্রথম দিনটাই বছরের প্রথম দিন, তাই শুভস্য শীঘ্রম, শীঘ্রতর, শীঘ্রতম।

নববর্ষের শুভেচ্ছা (প্রথম পার্বণ)

আগে বছরের প্রথম দিনে নতুন জামা পরে বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়ার যে রীতি ছিলো তা এই মনস্কামনায় যে বছরের বাকি দিন গুলোও যেন ভাল মন্দ মিশিয়েও ভালোর দিকেই যায় বেশী। বছরের প্রথম দিন টা এখনো আছে, ট্রেনের শেষ কামরার মতো, প্রণাম আর আশীর্বাদ ও আছে, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা কে খুঁজে নিতে হয় এখন।

এই যে অপদার্থ ইংরেজ গুলো, ব্যাটারা যাওয়ার সময় ওদের ভাষাটার টুক্রো টাক্রা কুড়িয়ে নিয়ে যেতে ভুলে গেলো, তাতেই তো হল যত্তো মুশকিল! যতদিন ওরা ছিল, “ইয়েস, নো, ভেরি গুডএর বাইরে আমরা জানতাম, কারুর সঙ্গে দেখা হলে ইংরেজি তে বলতে হয় হ্যাল্লো, হাউ ডু ইউ ডু?” আর কেউ থ্যাঙ্ক ইউবললে নিয়ম হচ্ছে বলা মেনশান নট। নীরদচন্দ্র বলে এক বাঙ্গালী বিলেতে থেকে ইংরেজি ভাষার ষষ্ঠী পুজো করছিলেন বটে সেই সময়েও, কিন্তু সে সময় ওনাকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি বিশেষ। এমতাবস্থায় কি করা?

নেতাজী হারিয়ে যাওয়ায় কংগ্রেসের প্রতি রাগ টা কেমন কমে আসছিলো, শ্যামা বাবুও চলে গেলেন, পূর্বপাকিস্তানের মানুষের সাথে ভাইচারা দেখিয়ে কিঞ্চিৎ ক্ষিদেয় কাতর হলাম কিছুদিন, শেষে কিছু না পেয়ে আমরা আমাদের প্রগতীশীল শাড়ি কে ভুলে ওই বুক-পেট এক করা মাও স্যুট এর প্রতি প্রনয় জানালাম - আর সেই মাও ৎসে তুং এর কাছ থেকে জানলাম যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা বলে একটা দেশ আছে, যদিও ওরা বেশির ভাগই সাহেব এবং সাদা চামড়া, তাদের হাত নিঃসন্দেহে কালো, লোমশ, নিকষ কালো, এবং তারা সেই হাত বাড়িয়ে দিলে তা গুঁড়িয়ে দেওয়াই নিয়ম।

হামান দিস্তায় কেমন জোর ছিলো, হাত গুঁড়োনো গেছে কিনা এসব বলা মুশকিল, কিন্তু এর মাঝেই আমরা ইংরেজি অভিধানকে অনেক দানে সমৃদ্ধ করে ফেলেছি যেমন ঘেরাও, লাঠিচার্জ, বন্ধ, ধর্না ইত্যাদি ইংরেজি অভিধানের এই নতুন শব্দগুলো আমাদেরই দান। আমেরিকার কালো হাত ধরে আমরা শিখেও নিয়েছি যে হ্যালোরবদলে হাইবললে অনেক সুন্দর শোনায়, কেউ থ্যাঙ্ক ইউবললে উত্তরে তাকে ওয়েলকামজানানো টাই রীতি। সুন্দরের আহ্বানে লম্বা করে শুভ নববর্ষ বলাও ভুলে গিয়ে ছোট্ট করে হ্যাপি পয়লা বৈশাখ বলা শুরু করে দিয়েছি কখন যেন। বেশ মডার্ন শোনাচ্ছে না ব্যাপারটা?
বলার মাধ্যমও পাল্টে গেছে। আগে শুভেচ্ছা, প্রণাম আর ভালোবাসা বিনিময় হতো হয় মুখোমুখি, কিম্বা পত্রালাপে। ধরুন আপনার মামা থাকেন দিল্লিতে, তাঁকে নববর্ষের প্রণাম জানিয়ে চিঠি লিখতেন, সে চিঠি তিনি হাতে পেতেন রবীন্দ্র জয়ন্তী নাগাদ, কিন্ত তাতে কোনো ক্ষতি যে হতো, তা নয় তিনিও চিঠি পাবেন এই ভরসায় আগাম আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি লিখে দিতেন। বরং তাতে নববর্ষ নববর্ষ ভাব টা আরো বেশ কিছুদিন থাকতো।

ফোন আসায় আরো একটু ভালো হল একটু অন্যরকম ভালোএকদম হাতে গরম দিনের দিন প্রণাম ও জানানো হয়ে গেলো, আবার সঙ্গে সঙ্গে আশীর্বাদ টাও হাতিয়ে নেওয়া গেলো চিঠির জন্যে হা-পিত্যেস করে বসে থাকার ব্যাপার নেই। বরং চিঠিতে অনেক কথা লিখতে গেলে অনেক সময় লাগে, পোস্টাপিসে যেতে হয়, লাইন দিয়ে পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খাম, ডাকটিকিট এসব কিনতে হয়। তার বদলে কি সুন্দর সব কথা বলা হয়ে গেলো, পয়সা একটু বেশী গেলো, কিন্তু তা যাক, কাজ টা তো আরো ভালো, আরো সুষ্ঠ করে হয়ে যায়, না কি? একদম ম্যাগীর টু মিনিট ন্যুডল্সের মতো।

শ্যাম পিত্রোদার কল্যাণে সেলফোন আসার পরে দেখা গেলো টেক্সট মেসেজে কাজ একই হয়, কিন্তু খরচা আরো কম। অতএব, বাঙ্গালীর এক কথা কথা কম, টাইপ বেশী। ভোর থেকে শ্যামের বাঁশী চালু প্রতি দু মিনিটে একবার করে ট্যাঁক ট্যাঁক করে উঠবে যন্ত্র কিন্তু বাংলায় টাইপ টা তখনো করা যেতো না সেলফোনে তাই সেই সবেধন নীলমণি ইংরেজিই ভরসা। যাকে পাঠিয়েছেন, তিনি প্রাতঃকৃত্য সেরে এসে নাকে চশমা তুলে দেখলেন মোট বত্রিশ খানা মেসেজ, বত্রিশ জন বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে যাদের মধ্যে অন্ততঃ তিন জন আছে, যারা আছে বলেই ওনার মনে ছিল না। সবারই মোটামুটি এক কথা - উইশ উই এ ভেরি হ্যাপি পাইলা বাইসাখ স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা। এক টাকার মেসেজে পয়লা বৈশাখ এর দায়িত্ব উদ্ধার, একদম পুরো পরিবারের সবার জন্য, অর্থাৎ পার হেড চার আনা। যাকে পাঠালেন, সে পড়লে পড়লো, না পড়লে আপনার দায় নেই। আর আতাক্যালানে ভদ্রলোক হ্যাপি পাইলা বাই সাখপড়ে যদি ভাবেন আপনি বাঙাল ভাষায় জানতে চেয়েছেন শাক কিনে খুশি হয়েছে কিনা, তার ভার ও আপনার নয় বাড়িতে নিশ্চয়ই টেক স্যাভি ছেলে মেয়ে আছে, সে বুঝিয়ে দেবে। মোট কথা, এই একবিংশ শতাব্দী তেও এক টাকায় বড় কাজ টা হয়ে গেলো কিনা? উত্তর উনি দিতেই পারেন, দিলে ওনার পয়সা যাবে, তাই সে মাথাব্যাথার থেকেও আপনার রেহাই।

অনেকে মেসেজেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন এর মধ্যে, কিন্তু খর্চায় পোষাচ্ছিল না ঠিক। এক টাকা বাঁচানোর ও রাস্তা পাওয়া গেলো তখন তার নাম হোয়াটস অ্যাপ আর ফেসবুক মেসেঞ্জার সেই মার্কিনী কালো হাত ধরেই এলো। একটাই মেসেজ, বাংলায় ও টাইপ করতে পারবেন কারন অ্যান্ড্রয়েডের কল্যাণে এখন বাংলায় টাইপ করা যায় - এক সঙ্গে দুশোবাহান্ন জন কে পাঠালেও সেই একই ডেটা চার্জ। দশ পয়সায় হয়ে যাবে।

এবারে আপনার যদি এই দুশোবাহান্ন জনের নাম টাইপ করতে ভালো না লাগে, তাহলে আরো সহজ উপায় আছে। ফেসবুকে শুধু একটা স্ট্যাটাস টাইপ করে দিন। অবাঙ্গালি বন্ধুদের ও জানাতে চান আজকে আপনার নববর্ষ? তাহলে বাংলায় লিখে ইংরেজি হরফে টাইপ করে দিন – “সুভো নাবা বারশা উইশ ইউ অ্যা ভেরি হ্যাপি বেঙ্গালি নিউ ইয়ার। অনেক ওয়েবসাইটে ফ্রি তে ছবি পাওয়া যায়, তার একটা পছন্দ করে ঝেড়ে দিন, লেখার সঙ্গে পোস্ট করে দিন। এতে ফোন ও লাগে না অফিসের ইন্টারনেট ব্যবহার করে একদম ফোকটে পাঠিয়ে দিন। হয়ে গেলো নববর্ষের ভালোবাসার দান-প্রতিদান। একশো বছরে নববর্ষের এই টুকু বিবর্তন কি কাম্য নয়?

প্রত্যেক জাতিনিষ্ঠ বাঙ্গালী তাই এখন সকালে উঠেই, কিম্বা কেউ কেউ আগের দিন অফিস থেকে কিম্বা রাতে বাথরুম যাওয়ার সময়, একটা কাজ অতি অবশ্যই করে সেটা হলো ফেসবুকে একটা পোস্ট করা শুভা নাবা বারসা। তারপর সারাদিন কি করে? সে গল্প এর পর।

ভোজনম্ শরণম্

ছাগলদের কোনো জ্যোতিষী নেই। থাকলেও তার আয় তেমন হতো না, কারন ছাগলের ভবিষ্যৎ গণনা করা খুব সহজ, যে কেউ করতে পারে। প্রথম দুই সন্তানের জন্যে দুগ্ধ প্রাপ্তি তে অগ্রাধিকার, তৃতীয় থেকে খুঁজে খেতে হবে, শক্তিশালী দুই ভাই-বোনের খাওয়া শেষ হলে সেই ফাঁকে কারন দুগ্ধপথ মাত্র দুটো। ঘাস পাতা খাওয়া শুরু করলে বঞ্চনার থেকে মুক্তি। অতঃপর গৃহস্তের ডান্ডায় প্রহার, কচি লাউডাঁটা খেয়ে ফেলার অপরাধে। নারী হলে প্রতি বছর মাতৃত্ব প্রাপ্তি। পুরুষ হলে বেশীরভাগের খুব অল্পবয়সে পুরুষত্ব নাস্তি, প্রতি দশে নয়জনের তাই, এবং ভরন্ত যৌবনে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি। দশের মধ্যে চার জনের রবিবারে, বাকি চার উৎসবে, এবং বাকি দুই অন্য দিনে, তবে সবাই মুলতঃ উষাকালে।

বেঁচে থাকার সবথেকে বড় জ্বালাতন হল সব সময়ে মরে যাব, মরে যাববলে ভয় পেতে হয়। ছেলেদের চোট পেতে হয়, একটু বড় হয়ে হাফ সোল খেতে হয়, বিয়ে করে গুটিকতক সাবসিডাইসড বাচ্চা পয়দা করে বড় করতে হয়, চাকরী করতে হয়, ইয়েস স্যার করতে হয়, রিটায়ার করতে হয়, বুড়ো বয়সে প্যান্টে হিসু করে ফেলতে হয়, প্রস্টেটের সাইজ নিয়ে চিন্তা করতে হয়, আর আসে পাশে কেউ পটল তুললেই সেই ভয় মরে যাবো নাকি? পাঁঠা দের এর কোনোটাই করতে হয় না জন্মাও, চাচার হাতে খাসি হয়ে দিন দুয়েক চেঁচাও, তারপর চাচার বৌয়ের দেওয়া দানা খেয়ে পুরুষ্ট হও, আর কদিন পরে ম্যাহ্যা করে একটা ডাক দিয়ে ভোরবেলায় ফুটুস হয়ে যাও। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ হয়, মানুষ তখন সরকারি অনুদানে সমৃদ্ধ রেশন এর চাল, ডাল তেল কেনে, রৌদ্রের মধ্যেও, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। নববর্ষের দিন ভোর বেলায় বেরোলে অনেকের ভুল ধারনা হতে পারে যে দুর্ভিক্ষ ফের এসেছে কারন বাজারে লম্বা লম্বা লাইন। তার মধ্যে সবথেকে বড় লাইন টা অতি অবশ্যই মাংসের দোকানের। এই এক যায়গায় কিন্তু উর্দুর চল খুব রাং, সিনা, গর্দান, চাঁপ, কলিজা, দিল... এবং সেখানেও বাছাবাছি – “চাচা, বাচ্চা খাবে, খাসি দেবে না, খুব চর্বি হয়, পাঁঠা দাও, হাড় একদম হয় না যেন, না না, চর্বি দেবে না, হার্টের জন্য খুব খারাপ, এই জন্যেই তো রেড মিট ছেড়েই দিয়েছি প্রায় আজকে নেহাৎ বচ্ছরকার দিন, তাই এলাম, না হলে এই গরমে কেউ বড় মাংস খায় নাকি?” যিনি বলছেন, তাঁর বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ প্রতি রোববার ওই লাইনে ওনাকে দেখা যায়, তা সে যতই গরম হোক, আর তাঁর নিজের বাচ্চা হাড় চিবিয়ে পাউডার করে দিতে পারে তিন মিনিটে, কিন্তু নিজে খাবেন না অথবা স্ত্রী বকবে বলে অকারনে কিছু মিছে কথা বলে ফেললেন। আরো খানিক বাকবিতন্ডা চল্লো সাদা চর্বি টা আসলে চর্বি না রেওয়াজি। মেটে বেশী হলেও খারাপ, কম হলেও খারাপ। অন্য পাঁঠার মাংস ঢুকে গেলে ভেজাল। বাছা বাছিতে বিরক্ত হয়ে চাচা গোল মতো এক খানা নিটোল মাংস দিতে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন ওকি, ওকি, ওসব কি দিচ্ছো? ওসব আমরা খাই না, ওটা বাদ দাও, বাদ দাও। চাচা জানতে চাইলেন আপনি না খাবেন তো কৌন খাবে? ইয়ে তো সবসে নরম গোস্ত আছে?” সঙ্গে সঙ্গে একটু রসিকতাও হয়ে গেলো – “আমাদের লাগে না, তোমাদের তো অনেক বাচ্চা হতে হয়, তোমার লাগবে, বাড়ী নিয়ে যাও” – এই বলে খানিক হ্যা হ্যা করে হাসি। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটি তার বাবার আঙ্গুল নেড়ে জিজ্ঞ্যেস করলো বাবা, ওটা কি দিচ্ছিল চাচাদাদু? বাবা মুচকি হাসি মুছে নিয়ে তৎক্ষনাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন এই জন্যেই তোকে বাজারে আনতে চাই না। সব কিছু নিয়ে কথা! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো একদম! ওই দেখো, বেড়াল, দেখো, কেমন খেলছে!এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মাংস নিয়ে মাঝবয়সী ভদ্রলোক পাঁঠার মাংস নিয়ে বাড়ী ফিরলেন স্ত্রী বললেন এটা কি দিয়েছে গো? খারাপ কিছু নয় তো?” ভদ্রলোক আড় চোখে দেখে নিয়ে বললেন মেটে!স্ত্রী রেগে গেলেন আমি মেটে চিনি না?” ভদ্রলোক শান্তনা দিলেন – “না, না, ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছি, ঝগড়াও করেছি দিয়ে দিচ্ছিল বলে, এটা দিল, কিম্বা গুর্দা হবে, ভালো জিনিস দেখো না নাকি কাগজে, কিডনি কত্তো টাকায় বিক্কিরি হয়। স্ত্রী ও খুশী হয়ে চলে গেলেন যে খারাপ জিনিস দেয়নি যেন খারাপ জিনিসখেলে বেস্টিয়ালিটির দায়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত।

শুধু যে মাংস এসেছে, তা নয়। চিংড়িও এসেছে। আগে হলে ইলিশ আসতো। কিন্তু একে ফারাক্কা বানিয়ে গঙ্গার জল দিই না, তার পরে আবার আউট হওয়া রোহিত শর্মা চোট্টা আম্পায়ার এর কল্যাণে সেঞ্চুরী বানিয়ে বাংলাদেশের হাতের গোড়া থেকে বিশ্বকাপ টা হড়কে দিয়েছে, তাই রেডিও মুন্নার প্রচারে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ আর আমাদের ইলিশ দেয় না। এদিকে ইলিশ তেমন ওঠে না, চোরা পথে ওপার থেকেই কিছু আসে, সেই ইলিশ কিনতে গেলে অনেককেই কিডনি বিক্রি করতে হতে পারে, তাই ইলিশ বাড়ী আসে না আর। চিতল আসতো, কিন্ত উঠছে না দিন কয়েক। তাই চিংড়িই ভরসা। মন্দ কি? প্রথমে বাদাম দেওয়া কুড়কুড়ে আলুভাজার সঙ্গে একটু চাপ চাপ মুগের ডাল দিয়ে সাদা, ভাত, তার পরে সুক্তো। পাকা রুই দিয়ে দই রুই ও আছে। এরপর প্রচুর পরিমানে কাজু কিসমিস দেওয়া গোবিন্দভোগ চালের পোলাও, সঙ্গে চিংড়ি আর কচি পাঁঠার কষা মাংস, শেষ পাতে রামকৃষ্ণ স্যুইটসের দই আর রাজভোগ। এই না হলে পয়লা বৈশাখ? কে না জানে, কবিগুরু যে লিখে গেছেন এসো হে বৈশাখ এসো এসো সে তো এই খাবারের জন্যেই!

রাতের খাবার অবশ্য হোটেল থেকে আসে, কারন স্ত্রী রাতে রান্না করতে নারাজ। অনেকে ছাই পাঁশ খান সন্ধ্যেয়, তাতেও অনেক স্ন্যক্স আসে, তাই কারো কারো রাতের খাওয়া বন্ধও থাকে অনেক সময়ে। সকালেও একটু বেশী হয়ে গেছে, তারপরে এই সব স্ন্যাক্সেও অনেক ক্যালোরি কিনা, তাই। রাতে শোয়ার আগে হাফ মাতাল বাঙ্গালী ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে ঘেমো বগলের কথা ভুলে গান ধরে বহুযুগের ওপাড় হতে আষার এলো আমাড় মনে। সারাদিন যে সংস্কৃতির ছোঁয়া তাকে ছুঁয়ে গেছে, তার শেষ রেশ হিসেবে।
সংস্ কৃতির কথা পরের বার।




Friday, April 10, 2015

বসন্ত গেলো ব’লে

বসন্ত গেলো ব’লে

নিউ টাউনের ন্যাড়া রাস্তার ধারে পচা রোদের খপ্পর থেকে বাঁচবার জন্য দোকানের ভেতরে দাঁড়িয়ে চোখ কুঁচকে সচীনদার আদা-লিকার দিয়ে সিগারেট খাচ্ছি আর ভাবছি আজকেও একটু বৃষ্টি হলে বেড়ে হতো, সামনে দিয়ে একটা অটো চলে গেলো, একদম স্লো মোশানে। একটু দুরেই প্রভূত পরিমানে ব দিয়ে লেখা হোর্ডিং দিয়ে সাজানো ব্বিশ্ব ব্বাংলা সরনী, সেখান দিয়ে সাঁই সাঁই করে এয়ারপোর্ট চলে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ী, এমন মডার্ন যায়গায় স্লো মোশানে অটো? এটা খুবই অবাক ব্যাপার না? ভাঁড়ের যেমন হ্যান্ডেল হয় না, মাদুলির ব্র্যান্ড হয় না, পাঁচালীর অথার হয় না, চিনে জিনিসের গ্যারেন্টি হয়না কিম্বা জেমস বন্ডের বউ হয়না, ঠিক তেমনই অটোরও স্লো মোশান হয়না। অটোকে আস্তে চালালে বাবা বিশশোকম্মার অসম্মান হয়, পৌরুষে টান পড়ে, রাস্তার সমস্ত মারুতি, পাইভেট, ট্যাস্কি আর সমু গাড়িকে অযাচিত সন্মান দেওয়া হয় আর হোল ডে তেও মাইনে করা যায় না, তা সে যতই বাজার ভালো হোক। তাই অটো জোরেই চলে। এমনকি অটোর জোরে চলা এখন একটা মানদন্ড – একবার এক সাহসী অ্যাম্বাস্যাডার চালক আমাদের অটোকে ওভারটেক করে ফেলেছিলেন বলে আমাদের অটোচালক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন “এ ডাইভার সিওর আগে অটো চালাতো” – এমনই সুনাম অটোর স্পিডের।

কিন্তু সেই গর্ব, সেই সুনামে চুনকালি মাখিয়ে এই অটো সত্যিই আস্তে চলছে। এতোটাই, যে বাঁ দিকের উনুনের উপরে ঝুঁকে থাকা সচীনদার সিড়িঙ্গে বউ আর ডান দিকে আদিরসের আধা স্বাদের লোভে দোকান “করতে” আসা সচীনদার সবে ম্যাট্টীক  পাস করা মেয়ে, এদের দুয়ের মাঝ দিয়ে ঝাড়া এক মিনিট দেখা গেলো অটোটাকে। তিন দিকে কেরোসিন কাঠের সরু ফ্রেম এর ওপরে লাগানো ফ্লেক্স, মাথায় মাইক। ফ্লেক্স গুলোতে খুব বড় করে ৮০% আর খুব ছোট করে “আপ টু” লেখা আছে, আর তার পাশে জামা, জুতো, ব্রা, জাঙ্গিয়া, নাইটি, প্রেশার কুকার, ইন্ডাকশন ওভেন, মোবাইল ফোন, গাড়ী ইত্যাদির মাঝে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন হাত কাটা ব্লাউস পরা লাস্যময়ি স্বাস্থ্যবতী মামনি, যেন ও দোকানে গিয়ে কিছু কিনলেই উনি আপনার গাল বা অন্য কিছু আলতো করে টিপে দিয়ে বলবেন “দুষ্টু!”, আর আপনার এক সপ্তাহের স্বপ্নের রসদ চলে আসবে তাতে।

অটোতে দুজন মানুষ। একজন ফুল প্যান্ট আর ডোরাকাটা বগল বের করা গেঞ্জি পরে চালকের আসনে, মাথায় একটা গামছা বাঁধা। পেছনে আরেকজন, ইনি হাফ হাতা টিশার্ট পরিহিত, নিম্নাঙ্গে জিন্স, পায়ে কিটোস, হাতে মাইক। সমানে বলে চলেছেন – “আর মাত্র পাঁজ দিন, একসিস মলে চলে আসুন চোইত্তো সেল এর মজা নিতে। সম্পুরনো এ সি মলের দ্বিতলে বাদশার সোরুমে। একানে আম্নি পাচ্চেন আপ্টু এইট্টি পারসেন ছারে, এই ডান্দিগ চেপে চালা না বাঁ, লেপ্টে সিকুটি হাত নারছে দেকছিস না নাকি বাঁ, ফালতু মা মাসি করবে, হ্যাঁ, আপ্টু এইট্টি পারসেন ছারে দামী ব্যান্ডের ব্রা, প্যান্টি, গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, নাইটি আর সমস্ত টাইপের ভেতোরের যামা। সনগে লাকি ড্র তে আম্নি পাচ্চেন একটি মারুতি গাড়ী, দশটি মোবাইল ও আরো অন্যান্য উপহার। আসুন আসুন আসুন!” বসন্ত গেলো বলে তাহলে? একলা বৈশাখের আর মাত্র পাঁজ দিন?
বাঙ্গালীর ভুল যায়গায় ঠিক জিনিস দেওয়াটা একটা বহু পুরোনো রোগ। এখানেও তার খামতি নেই। যে পাড়ায় এই প্রচার, সেখানে সচীনদা তার পরিবার নিয়ে থাকে বটে, ভোম্বলের মা বাবাও থাকে, কিন্তু তারা কি অ্যাক্সিস মলে যাবে? সচীনদার মেয়ের যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সচীনদার স্টেটমেন্টের বোঝায় সে ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছে – za বাপ সায়ের দোকান দেয়, তার মেয়েরে ওসব zaয়গায় zeতি নাই। ওদের পাড়ায় ইস্তেহার সাঁটা আছে মা তারা সুই-টস্ এর পাশের দেয়ালে - মল ও মুত্র যেখানে সেখানে ত্যাগ করবেন না, এতে পরিবেশ নষ্ট হয়, নিচে হিন্দিতে লেখা জাঁহা শোচ, ওয়াঁহা সৌচাল্যায়, পাশে বিদ্যা বালান। এটা তো সহজ কথা – যেখানে সেখানে হাগলে মুতলে তো ওই যে বিদ্দা পরীর বেশে দাঁড়িয়ে আছে গ্যাল্মার নিয়ে, সে গন্দে টিক্তে না পেরে চলে যাবে, সে তো ঠিকই। তাই মলের সঙ্গে মলামেশাটা কেমনতরো, সে ওদের ভালই জানা আছে। কিন্তু সৌচালয়ে শোচ, ওই লাইনটা ভালো বোঝা যায় না, কারন সে ব্যারাম ওদের নেই, তাই। সে ব্যারাম আছে আপাতঃ উৎকৃষ্ট বাঙ্গালির – যাঁরা চেয়ারপ্রতীম কমোডে বসে চাপ দেন, তাঁদের, যদিও সেলফোনের উৎপাতে বাঙ্গালীর সৌচালয় শোচ আজ বিলুপ্তির পথে।

তাঁরা এপাড়ায় থাকেনও না। কিন্তু রোজ আসেন। কেউ গাড়ীতে ড্রাইভারের পেছনে কিম্বা পাশে বসে, কেউ নিজে চালিয়ে, কেউ বাইকে, কেউ বা অফিস বাসে, এমন কি কয়েক জন অটোতেও আসেন। এদের মধ্যে পুরুষেরা সকলেই প্যান্ট ও শার্ট পরেন, বেশীর ভাগই ব্র্যান্ডেড, পায়ে চামড়ার জুতো থাকে, আর শুক্রবারে জিন্স-টি-শার্ট এর সঙ্গে সাদা জুতো। মহিলারা কি কি পরেন সে বলা খুব লম্বা বলা হবে, কারন মহিলাদের যদিও সোমবার হয় শিবের পুজো করলে, মঙ্গলবার হয় মা সন্তোষীর ভক্ত হলে, এমনকি বেস্পতিবারও হয় মা লক্ষ্মীর কৃপা চাইলে, শুক্রবারটা ওঁদের মোটেই আলাদা নয়, তাই পোষাক পরিধানের নিরিখে ওঁদের সদাই শুক্রবার। এই কারনেই ওঁরা যা যা পান, তাই তাই পরেন, রোজ। এতে ঈর্ষা করার কিছু নেই, কারন শুক্রবারটা একটা বেশ ফ্রি ফ্রি দিন, তাই সেদিন অনেকে যে অনেক কিছু পরেনও না, একদম খোলামেলা থাকেন, সেও লক্ষ্য করলেই টের পাওয়া যায়। পুরুষদের কাছে এই ডিস্ক্রিমিনেশান যেমন কষ্টের, তেমনি সহজে দেখার আনন্দটাও যে অপরিসীম, তা বলাই বাহুল্য, তাই প্রতিবাদ টা করবো করবো করেও আর করা হয়ে ওঠে না। তা এই যে দু দল সেক্সুয়্যালি চরম ডিস্ক্রিমিনেটেড মানবদল, এঁদের মধ্যেও কিন্তু সমতা এনে দেওয়ার জন্য আমেরিকান কোম্পানী আবিষ্কার করেছে এক ইউনিভার্সাল লেভেলার। এনাদের সবাইকে, পুরুষ নারী সকলকে, গলায় ঝোলাতে হয় একখানা লকেট, নাহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ। সে লকেটের নাম ব্যাজ, নীল-লাল-সাদা দড়ি দিয়ে ঝোলাতে হয়, যে যেমন রঙের পায় আরকি, সামনে ছবি আর নাম, পেছনে ম্যাগ্নেটিক স্ট্রিপ, যার ছোঁয়া দিয়ে দরজার কঠোর মনেও একটু চিড় ধরানো যায় প্রতিবার, সে লকেট দেখতে না পেলেই আধা ইংরেজি জানা সিকিওরিটি চেঁচিয়ে বলবে – প্রিজ ডিস্প্লে ইওর ব্যাজ স্যার! এখানে হিসি পেলে বাথ্রূমে যাবো বলাটা অসভ্যতা, বলতে হয় ওয়াশরুম, যদিও ওখানে গিয়ে সবাই যে ওয়াশ করেই বেরোন,  বিশেষতঃ ছোট কাজের পরে, এমন কোনো প্রমান নেই। এখানে ওপরে ওঠার জন্য লিফট নেই, আছে এলিভেটার। এখানে প্রত্যেকে অন্ততঃ চার বার করে বাইরে বেরোন প্রতিদিন, হাসিমুখে - কেউ ধুমপান করতে, কেউ চা খেতে, কেউ বা বন্ধুকে সঙ্গ দেবার জন্যেই শুধু, কিন্তু ফায়ার ড্রিলে বেরোতে হলেই মুখ ব্যাজার করতে হয়, কারন ওটাই নিয়ম। এখানে সমস্যা কে কেউ প্রব্লেম বলবে না, সবার কাছেই সমস্যা মানে চ্যালেঞ্জ। এখানে কল দিয়ে জল পড়ে না, শুধুই শব্দ হয়। তাই এখানে ইজের বা পিরান কি, সেটা তো কেউই জানেন না, এমনকি জনসমক্ষে ব্রা বা প্যান্টি বলাটাও অসভ্যতা। এখানে পেটির একটুও ঢাকতে অপারগ গেঁয়ো শায়ার নতুন নাম পেটি-কোট। এখানে সালোয়ার-কামিজের নতুন নাম স্যুট। এঁদের কাছে অন্তরবাস কে লঁজারি বলতে তেমন শোনা যায়না যদিও, লিঙ্গারি বললে এঁরা সবাই বুঝবেন, নিদেন পক্ষে আন্ডারওয়্যার। এনারা কেউ যাবেন কি? ওই বাদশা তে?
একটা সময় ছিলো, যখন বছরের এই সময়টায় একটা হাফ প্যান্ট আর একটা হাফ শার্ট (ফুল হলে চলবে না) একদম বাঁধা পাওনা ছিল। মায়ের ও একটা শাড়ি পাওনা হতো, কিন্তু মা সেটাকে তুলে রেখে দিতো, জষ্ঠি মাসের প্রথম মঙ্গলবারে সেটার উদবোধন হতো, ওটা পরে মা বিড় বিড় করে বলতো “সোনার মঙ্গলচন্ডী রুপোর থালা, কেন মা মঙ্গলচণ্ডী হল এতো বেলা, হাসতে, খেলতে, সোনার দোলায় দুলতে,  নির্ধনেরে ধন দিতে, রাজার মুখে পান দিতে, অপুত্রকে পুত্র দিতে, অন্ধরে চক্ষু দিতে, আইবুড়োর বিয়ে দিতে, অন্তকালে স্বর্গ পেতে কোরোনা হেলা, ঠারি ঠুরি পায়রাগুলি, ঠাকুর চল্লেন কৈলাসপুরী, যে বলে তার স্বর্গবাস, যে শোনে তার কৈলাস”। পয়লা বৈশাখে নতুন জামা পরতাম বটে, কিন্তু আর কিছু করতাম বলে মনে পড়ে না। বরং ওই জয়মঙ্গলবারে মা জেঠিমা প্রথমে ফল, তারপর বেগুনী আর বাদাম ভাজা দিয়ে মুড়ি খেতো, ওটা বেশি উত্তেজক ছিল। ছোট শহরের ছোট বাজারে সারা বছরই দরদামের চাপে একটু ডিস্কাউন্ট দিতেই হয় মুখচেনা খদ্দের কে, তাই চৈত্র সেল বলে বস্তুটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কলকাতায় এসেই। হাতিবাগানের রাস্তায় প্রচুর হকার “সেল সেল সেল সেল, ফিফটি পঞ্চাশ, ফিফটি পঞ্চাশ” করে এক তালে চেঁচিয়ে বিক্রি করছে পাঞ্জাবি। এরকম চলছিল অনেকদিন। হাতিবাগান। এস্প্ল্যানেড। গড়িয়াহাট। তারপর দেখলাম গড়িয়াতেও হচ্ছে। কিন্তু আর হল না। কোন ফাঁকে আস্তে আস্তে গজিয়ে উঠছিল প্যান্টালুন, ওয়েস্টসাইড। মেজোবিত্ত বাঙ্গালী সেখানে ঢুকতে তখনো ভয় পায়, কিন্তু একটু পয়সা থাকলেই সাহস করে ঢুকে পড়াও যায়। কিনবো কি না, সে পরের কথা, ওখানে ঢুকে দেখলে তো কেউ খেদিয়ে দায় না? আর সেই ভয় পুরো কেটে গেল, যখন বিয়ানি সায়েব বিয়োলেন বিগ বাজার। সারা বছরটাই চৈত্রমাস তার পর থেকে। বাঙ্গালী এখন তাই সারাবছরই চৈত্র সেলের “মজা নেয়”।

তা বলে কি পয়লা বৈশাখে নতুন জামা হবে না? নিশ্চয়ই হয়। জামা হয়, প্যান্ট হয়, জুতো হয়, শাড়ি হয়, সালোয়ার স্যুট ও হয়। বাদশার সেল এ কেনা হয় কি না জানি না, কিন্তু অন্তর্বাস ও যে কেনা হয়, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এই ভাবেই বাঙ্গালী এখনো প্রস্তুত হয় নতুন বছর কে স্বাগত জানাতে। আর এই বাঙ্গালীর মধ্যে ব্যাঙ্গালুরু তীর্থ সেরে ফেরা আই টি সন্তানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বাংলা নববর্ষের আগের দিন তাই ইমেইল আসে – “ইট ইস টাইম তো সেলিব্রেট এগেইন, সো টুমরো উই এক্সপেক্ট দ্য টিম টু কাম টু অফিস ড্রেসড ইন এথনিক ওয়্যার”।

বাঙ্গালীর এথনিক ওয়্যার ব্যাপারটা একটু ঝাড়ের জিনিস। ওপরের দিক টা পাঞ্জাবি, সেটা ঠিক আছে। জিন্স এর সঙ্গে যায় ও ভালো। মাথা গলিয়ে পরে নাও, ব্যাজের লকেট তার ওপরে ঝুলিয়ে নিলেই হল। কিন্তু নিচের দিকের রিয়েল এথনিক ওয়্যার আসলে ধুতি। এবং ওখানেই কেলো টা। ধুতির মধ্যে লুঙ্গির মতোই একটা ফ্রি এয়ার ফ্লো বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা যায়না। প্লাস জুতোর ওপরে পরা যায়না, স্নিকার্স এর সঙ্গেও না। অতএব চটি কেনো, ইলাস্টিক দিয়ে ধুতি কোমরে আটকাও, তারপর সেক্সি লেগ যেন খুব বেশি এক্সপোসড না হয়, সেই নিয়ে ব্যাস্ত থাকো সদাই। অনেকে তাই হাফ এথনিক হয়ে পাজামা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। মেয়েদের শাড়ি নিয়ে আলাদা কিছু চাপ আছে বলে মনে হয় না, বরং যার একটু এক্সপোজার প্রয়োজন, সে আঁচল টা দরকার মতো টাইট বা লুস করে নিতে পারে। সকালে একটু ফুল টুল দিয়ে লবি টা সাজাও নিজেরাই। এদিন দুপুরে একসাথে লাঞ্চ। তবে কোম্পানী ভুরীভোজের বন্দোবস্ত করে না আজকাল আর, তাই বাঙ্গালী দুপুরে ওলন্দাজ হয়ে যায়। চাঁদা তুলে খাবার আসে, সাধারনতঃ বিরিয়ানি। কিছু ক্ষেত্রে চাইনিস বা পাস্তাও আসে - ওগুলোই এখন বাঙ্গালি খাবার, খেতে খেতে একবার বললেই হল – আই জাস্ট লাভ দ্য সুক্তো অ্যান্ড চিতোলস পেটি ফ্রম ভাজাহারি ম্যান্না। দুপুরে একটু কাজ, তারপরে এথনিক ড্রেস পরা আই টি বাঙ্গালী এই একদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে – বাচ্চাদের নিয়ে ব্যেওমকেশ বাক্সি দেখতে হবে না? তারপর একা একা কিম্বা দঙ্গলবেঁধে একটু দারুপান, শেষে আবার প্যাকেটের খাবার খেয়ে নববর্ষের রাতে শুতে যায় বাঙ্গালী।

অটো টা এগিয়ে গেলো। এখনো শুনতে পাচ্ছি – “আর মাত্র পাঁজ দিন আম্নি এই সুযোগ পাচ্চেন”। সচীনদার মেয়ে বাবার দোকানে ক্যাশ সামলাচ্ছে, বউ উনুনে কয়লা দিচ্ছে, সচীনদা ওপাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি চায়ের ভাঁড়টা ফেলে আবার ভাবলাম, আর মাত্র পাঁচ দিন, তারপরেই অনুপমের বসন্ত চলে যাবে।