জস্পিন্দার ও একটি
ম্যানুয়াল ভাইরাস
হিন্দি বলা খুব সোজা।
সেন্টেন্সের শেষে "হ্যায়" লাগিয়ে দিলেই অনেকটা হয়ে যায়। এছাড়া তুমি কে
তুম, আমি কে হাম, এরকম কয়েকটা চেঞ্জ - হিন্দি ইস অন। তাই আমরা
হিন্দিতে যারা কথা বলে তাদেরকে হিন্দুস্তানি বলি, আর আমরা বাঙ্গালীরা যে
হিন্দুস্তানি, সেটাও ঠিক,
কারন আমরাও খুব সহজে হিন্দি বলতে
পারি। তাই আমাদের কাছে ভারতীয় রা মুলতঃ চার প্রকার - বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, হিন্দুস্তানি আর ম্যাড্রাসি। যাদের ভাষা বোঝা যায়
না, তারা সবাই ম্যাড্রাসি। হিন্দুস্তানি দের মধ্যে মাড়োয়ারি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি
- এরা সবাই পড়েন। কিন্তু পাঞ্জাবী রা পড়েন না। কারন ওনাদের মাথায় পাগড়ী থাকে।
পাঞ্জাবী দের নিয়ে যেমন
অনেক হাসির গল্প ও চুট্কি আছে,
তেমনি তাঁদের সাহস, বিরত্ব
ও মেজাজ নিয়েও অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী আছে। তাই বলা নিস্প্রয়োজন যে জস্পিন্দার কওর
ধিল্লোঁ যখন ফ্রেশার হিসেবে আমাদের কোম্পানি জয়েন করলো, তখন
নারীসঙ্গে চরম উৎসুক জনতাও তার দিকে চট করে ভিড়বে না। অতএব জস্পিন্দার জয়েন করে
নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিজের মতো করে কিসব করতে থাকলো।
আমি তাড়াতাড়ি অফিসে আসা
পছন্দ করি। অনেক সময়েই সবার আগে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু কিছুদিন ধরে দুজন আমার থেকেও
আগে আসা শুরু করেছে। একজনের নাম কুমার বোস। “কুমার বোস” নামটা বললে সাধারনতঃ যেমন
ছবি মনে ভাসে, এ মোটেই তেমন না – কুমার লম্বাও নয়, ছিপছিপেও নয়, বয়স অল্প হলেও বেশ
একটা টায়ার টাইপের ভুঁড়ি আছে, মুখে অসংখ্য দাগ এবং বাঁ গাল বরাবর একখানা মস্ত কাটা
দাগ – হয়তো কোন অপারেশান বা অ্যাক্সিডেন্টের, কিন্তু চাপা গলায় “অ্যাকশানের সময়ে
গুপ্তি মেরে দিয়েছিল” বললে অনেকেই বিশ্বাস করে নেবে। কারন কুমার খুব, খুব গম্ভীর।
আসলে কিন্তু কুমার মোটেই রাগী বা রাশভারী নয়, কুমার মিতবাক্, এবং লাজুক।
এতোটাই, যে জয়েন করার দিন দুপুর দুটো অবধি চেপে বসেছিল, কারন টয়লেটটা কোন দিকে,
এটা জিজ্ঞেস করতে ওর নাকি লজ্জা করছিল। কুমার তাড়াতাড়ি এসেছে কারন একটা নতুন
ক্লায়েন্টের সিস্টেম স্টাডি করছে, ফটাফট সেটা লিখে ফেলতে হবে, টাইপের স্পিড নেই,
তাই সকাল থেকে ওয়ার্ড নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে।
আরেকজন এসেছে। জস্পিন্দার।
জস্পিন্দারের তাড়াতাড়ি আসার কারন টা অন্য – বাবা অফিসের পথে পৌঁছে দিয়ে যান, তাই
তাড়াতাড়ি। জস্পিন্দার নিজের টেবিলে পৌঁছে, ব্যাগ রেখে রেস্টরুমে ঘুরে এলো, তারপরেই
একটা মিনি টিফিন বক্স খুলে ব্রেকফাস্ট টা সেরে নিলো। আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে
হচ্ছিল যে রেস্টরুমে আসলে ব্রাশ করতে গেছলো কিনা (আমি সিওর তাই ছিল), কিন্তু ইনি
হলেন কুমারের একদম উল্টো, কমপ্লিট চ্যাটার বক্স, তাই রিস্ক নিলাম না – কাঁহাতক আর
সক্কালসক্কাল বকরবকর করা যায়, এক্ষুনি পাঁচশো কথা বলে কান পচিয়ে দেবে!
টিফিন শেষ হয়ে গেছে, আমি কানে
হেডফোন লাগিয়ে রেখেছি পাছে বকবক করতে হয়, জস্পিন্দার কুমারকে ধরে ফেলল। “হাই, আই
অ্যাম জস্পিন্দার, অউর আপ?” কুমার নিরুপায় হয়ে ডান টা বাড়িয়ে বলল “গুড মর্নিং, আই
অ্যাম কুমার বোস, আই অ্যাম সো প্লিজড্ টু মিট ইউ”। জস্পিন্দার খিল খিল করে হেসে উঠলো “আরে
আপ তো ইত্নি ফর্ম্যাল হো গ্যায়ে! হিন্দি আতি হ্যায় না?” কুমার কে এই প্রথম একটু
যেন মুচকি হাসতে দেখলাম – “হাঁ, থোড়া বোহুত”। আমি এক কান থেকে হেডফোন টা খুলে
রাখলাম, খুব দারুন কিছু একটা হতে যাচ্ছে, শোনা দরকার।
পরের প্রশ্ন, এবং সেটা বেশ
কড়া “মুঝে তো ফক্সপ্রো কা উয়ো দিয়া হ্যায়, ক্যা বোলতা হ্যায়, হাঁ, প্রোগ্রামিং।
আপকো ক্যা ওয়ার্ড প্রোগ্রামিং দিয়া হ্যায়? ক্যায়সে করতে হ্যায় ইয়ে? মুঝে এক থোড়া ‘হেলো
ওয়ার্ল্ড’ ওয়ালা চিজ লিখ কে দিখায়েঁ তো?” আড়চোখে দেখলাম, মুচকি হাসি কোথায় হাওয়া,
কুমারের মুখ হাগু চাপার মতো, অনেক কষ্ট করে হিন্দি আর ইংরেজি মিলিয়ে বোঝাতে থাকলো
যে এটা প্রোগ্রামিং না, এটাকে বলে সিস্টেম ডকুমেন্টাশান, প্রোগ্রাম লেখার আগে এটা
জরুরী। জস্পিন্দার মানার পাত্রী নয় – ম্যান্নে তো লিখি হ্যায় প্রোগ্রাম, মুঝে তো
ইয়ে সব জরুরত নহি পড়ি?”
খানিক তর্ক চলার পরে
জস্পিন্দার পরের বোমাটা ফাটালো “খ্যার, ছোড়িয়ে। ইয়ে বতাইয়েঁ, মুঝে তো ট্যান দেতি
হ্যায়, আপকো কিত্না মিলতা হোগা?” কুমার সত্যিই ট্যান – বোকা বোকা মুখ করে জানতে
চাইলো “ট্যান মানে?” – একটু আধটু দিল্লি ঘোরা না হলে বাঙ্গালীর “ও” কারান্ত জিভ ও “এ”
কারান্ত কানে সত্যিই ধরা মুশকিল, কিন্তু জস্পিন্দার ক্লিয়ার করে দিলো “আরে ইয়ার, ট্যান
থাউস্যান্ড, স্যাল্রি, স্যাল্রি!” কুমার বিড় বিড় করে বলল “ওরে শ্শালা, বাচ্চা
মেয়ে আবার ইয়ার বলছে”, কিন্তু জস্পিন্দারের থেকে তাতে নিষ্কৃতি নেই, “কিঁউ, বংলা
মে কয়া ফুসুর ফুসুর করতে হো আপ, নেহি বাতানা? ঠিক হ্যায়, উও তো ম্যান্নে পতা করনি
কোয় মুশকিল নহি, এচআর কো পুছ লুঙ্গি, নহি তো পাপ্পা কো বোলতেহি পতা কর লেঙ্গে!”
বলে হাত ধুতে আবার ওয়াশ রুমে চলে গেল, কুমার কেটে পড়লো সিগারেট খেতে।
এর পরে ভিড় বাড়ায় ওখানে আর লেনদেন
বাক বিতন্ডা কিছু হয়নি, কিন্তু বিকেলের দিকে আমাদের একজন সিনিয়র ম্যানেজারের
কিউবিক্লের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনলাম জস্পিন্দার ওপারে দরবার করছে “মুঝে
আপ উও ওয়ার্ড ওয়ালা প্রোগ্রামিং মে ডালিয়ে, উস্মে জ্যাদা স্যাল্রি
মিলতি হ্যায়!”
----
কয়েক দিন গেছে। জস্পিন্দার এখন
আমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই বকবক করে, আমার পেছনের সিটেই বসে, আমাকে হোম্লি
লেগেছে বোধহয়, কারন আমি একটু আধটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা পাঞ্জাবি বলতে পারি, বুঝতে পারি,
ওদের দুঃখ কষ্ট কিছুটা হলেও জানি, আর হিন্দিতে আমার একদম অসুবিধে নেই, তার কারন
আমার মামাবাড়ী বিহারে। আমিও কথা বলি, কারন সবসময়ে চান্স থাকে গল্পের স্টকে কিছু
একটা অ্যাড করার, তাই বেশী বকার চাপ থাকলেও খুব ব্যাস্ত না থাকলে একটু বোকা বোকা
উত্তর দিই, একদিন বলেওছে “ভিজি ভইয়া, আপ তো সর্দার সে ভি বদতর হো দিমাগ কে মামলে
মে”, কিন্তু আমি খনি পেয়ে গেছি, এসব তো হবেই, অকুপেশ্যানাল হ্যাজার্ড!
একদিন অফিসের অনেকেই বাইরে
কোথাও একটা খেতে গেছে, আমাদের এরিয়া তে আছি শুধু আমি, অমিত আর জস্পিন্দার। অমিত
সিনহাও আমাদের মতো টিফিন নিয়ে আসতো, তরকারি আর রুটি। একদম ফিক্সড, কোন ব্যতিক্রম
নেই। তরকারি টা যাই হোক, সঙ্গে রুটি ছাড়া আর কিচ্ছু থাকবে না, এবং রুটি গুলো চার
টুকরো করা থাকবে। অমিত ও কখনই একসাথে এক্টার বেশী দুটো টুকরো মুখে পুরবে না,
প্রতিটা রুটির টুকরো আলাদা করে একটু তরকারি মুড়ে খাবে। সেদিন আলু-পটলের তরকারি,
সঙ্গে রুটি। অমিত ভাব জমাতে শুরু করলো। প্রথম প্রশ্ন অবশ্যই আবহাওয়া নিয়ে “কিত্না
গোরমি হ্যায় না আজ?” জস্পিন্দারের চট, জলদি উত্তর “মুঝে কিঁউ লাগ্নি হ্যায় গর্মি?
ম্যায় তো সুব্হে সে এসি মে হি হুঁ!” হক কথা, একদম ঠিক কথা – গরম তো আমার কি? আমি
এসি তে জমে যাচ্ছি, আর এই দেখো, একজন এলেন, বলছেন কিত্না গোর্মি। যত্তসব!
অমিত আজকে বরফ ভাঙ্গবেই,
তাই একবার, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সাহি কাহা” বলে পরের প্রশ্ন করলো “আচ্ছা, ইয়াসবিন্দার (বাঙ্গালীর
ধর্ম মেনে - বানান ও উচ্চারণ পালটানো), আপলোগ প্যাটোল খাতি হো?” আলু-পটলের তরকারি
খেতে খেতে একটা ক্রাঞ্চি পাকা বিচি মুখে এসেছে, সেটা দাঁতে পড়ায় পপকর্ণ ভাজার মতো
ফটাস্ করে একটা আওয়াজ হয়েছে, তাই পরের প্রশ্ন খুঁজতে মাথা খাটাতে হয়নি
তেমন, সত্যিই তো, সর্দারজিরা সর্ষোঁ-দি-সাগ, মাকাই দি রোটি, তড়কা মারকে ডাল
মাক্ষানি, চিকেন বাটার মশালা এমন কি অমৃতসরি ফিশ কারি ও খায়, কিন্তু পটল খায় কি? জস্পিন্দার
এই প্রথম মাথা ঘুরিয়ে মুখ টা বেঁকিয়ে বলল “ইয়াক! আপ ভি না? খানে কে টাইম পে কোই পাট্হোল
কা বাত করতে হ্যায়? উসমে কিত্নি কচড়া র্যাহতা আপকো পতা হ্যায়? গাই ভাঁইস, রোড কি কুত্তা ভি
নহি পিতা হোগা উস্মে সে। খাতে হ্যায় রোটি অউর আলু-পরওয়াল কি সব্জি, শোচতে হ্যায় পাট্হোল
কি! গন্ধা ভাইয়া বুলায়েঙ্গে আপকো অব সে!” অমিত থতমত খেয়ে থেমে গেল, প্রথমতঃ নতুন
নামটা খুবই দুঃখজনক, আর দ্বিতীয়তঃ পটল ও পটহোল নিয়ে ফারাকের ব্যাপারটা বুঝতেই
অনেকটা সময় চলে গেছে – তারপর নতুন করে আলোচনা করার আগ্রহটাও তাই চলে গেছে। অবশ্য “প্যাটোল”
আনতো না তারপর অনেকদিন ধরে, সেটা ভালো লাগে না বলে নাকি খেতে গেলেই পটহোলের কথা
মনে হয় বলে, সে আমায় বলেনি।
---
মাস ছয়েক চলে গেছে। এর
মধ্যে জস্পিন্দার ভালই মিশে গেল সবার সঙ্গে। আড্ডা দিতে শুরু করলো, একটা দুটো
বাংলা কথা বলতে শুরু করলো, এমনকি সর্দার জোক বললেও খুব কিছু একটা রাগতো না, শুধু
বলতো “ঠিক হ্যায় না, মেরি তো একবার কনফার্মেশান হো যায়ে, ফির সবকা যওয়াব দুঙ্গি
ম্যায় তো!” কারন তার শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে, ফ্রেশার হয়ে কনফার্মড লোকদের সঙ্গে
ঝগড়া করতে নেই। ততদিনে নিজের নাম পাল্টে Jassi
লিখতে শুরু করেছে, মডার্ন ও হয়েছে
অনেক, নিজেই যাতায়াত শুরু করেছে অফিসে, এমন কি মাঝে সাঝে সবার সঙ্গে বাইরেও খেতে
যায়। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, গুড়্গাঁও এর ছেলে, ম্যারেজ লিভ ও স্যাংশন হয়ে গেছে, আর
মাত্র কয়েক দিন বাকি। একদিন ইচ্ছে হল, একটু টেস্ট করে দেখি, পরীক্ষায় পাস করতে পারে
কিনা। একটা ইমেইল লিখলাম জস্পিন্দারকে, তাতে সাবজেক্ট লাইন টা এরকম “Microsoft Virus Alert!!” আর ভেতরে লেখাঃ
A new type of
virus has infected many Windows PCs. This is the first ever manual virus. To
activate this, the user needs to go to the command prompt, write CD
windows/system32 and press enter. After this, if the user types del *.* /y,
then the virus gets activated and the computer stops from booting next time.
সকালে পাঠিয়েছিলাম মেইল টা,
তারপর অনেক্ষন কোন হট্টগোল না দেখে বুঝলাম নাহ, পাস করে গেছে, পাত্তাই দেয়নি।
বিকেল চারটে নাগাদ জস্পিন্দার মুখ কাঁচুমাচু করে আমার ডেস্কে এলো, বলল “ভিজিদা,
মেরি তো লগ গ্যায়ী। ক্যা, আপ ভি, ভাইরাস স্ক্যান নেহি করতে হো। আপ কা ম্যাশিন সে
মুঝে এক ভাইরাস আয়ি থি আজ সুব্হে, ম্যায় তো অব তক ট্যান টাইমস নর্টন চলায়ি, লেকিন
কভি ভি ভাইরাস ক্লিন কা মেসেজ নহি আয়ি! মেরা শাদি কা তো হো গিয়া ছুট্টি!” আমি একটু
গোবেচারা মুখ করে বললাম “ফিরসে চলাকে দেখো না, হো যায়েগা” জস্পিন্দার বলল “হাঁ,
অউর নেহি ভি হুয়ি তো মেরি তো কোই নেহি, ম্যায় তো কল যা রহি হুঁ! উও মোটু সওতিক ফির
ইউজ ক’রেগা মেরি ম্যাশিন, প্রব্লেম হুয়ি তো উসিকি লগেগী ওয়াট!”
---
জস্পিন্দার ম্যারেজ লিভ
থেকে আর ফেরৎ আসেনি। দিল্লিতেই নাকি চাকরি পেয়ে গেছে। একদিন ওর বাবা এসে একটা
ব্যাগ আর কয়েকটা পেন ছিল সেগুলো নিয়ে গেলেন। ভাইরাস টাও কি অবস্থায় আছে, সেটা
জানার আগ্রহ হয়নি এরপর। ভুলেই গেছলাম। আজকে একটা একদম একরকম “ভাইরাস এলার্ট”
দেখলাম ফেসবুকে, তাই জাস্সির কথা মনে পড়ে গেল আবার।