রোদ্দুরময় রবিদিবস
একটা প্রশ্ন করবো? না থাক,
একটু পরে করছি।
......
বরং রবীন্দ্র জয়ন্তীর
শুভেচ্ছা জানাই। সব বাঙ্গালীদেরই জানাই, আর সেই বাঙ্গালীদের তো অবশ্যই, যাঁরা
“কওল্কতা” তে “রোসোগল্লা” খেয়ে বলেন “আমি কুব বালো আছে”। আফটার অল, আদমি টি নোবেল-কা-প্রাইজ
পেয়েছিলেন – আনেক ফায়দা হোয়েছিল তাতে, লাখ রুপিয়া সে উপর। বাংলার এক খুব-বেশী-বাঙ্গালী
মানুষ, সবার পিসি তিনি, এখনো ডহর বাবুকে খুঁজছেন কিন্তু পাননি, অতএব দ্বিমত এড়াতে
জানিয়ে রাখি, আজকে জয়ন্তীর কোনো রোল নেই, আজকে শুধুই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, তাই
রবীন্দ্রনাথের ফটো তে মালা দেওয়ার পরে জয়ন্তীর ছবি খুঁজবেন না দয়া করে – কারন
ওনাকে ওখানে পাওয়া যাবে না, উনি নাট্রাজান উপাধী নিয়ে পলিটিক্স এ যোগ দিয়েছেন ও
এখনো বেঁচে বর্তে আছেন, প্লাস উনি অন্য ক্যাম্পের। বরং আপনি যেটা চাইছেন, সেটাই
শুনুন। আজকে বাংলার জাতীয় কবির জন্মদিন, তাই আজকে আমাদের একরকমের ভাষা আর সংস্কৃতি
দিবস ও বটে। তাই, বাঙ্গালী দুই মাসে তিন পার্বণের একটা অবশ্যই আজকে।
বাঙ্গালী রবিঠাকুরকে নিয়ে যে
ন্যাকামীর একশেষ করবে, খেতে হাগতে সব যায়গাতেই টেনে নিয়ে যাবে, তা কিন্তু জানাই
ছিল। ভদ্রলোক নিজেও জানতেন ওনাকে নিয়ে এই রকমই হবে, তাই সব কিছু নিয়ে গান কবিতা
লিখে গেছেন, যাতে ব্যবহার করা যায়। এমনকি নিজের জন্মদিন নিয়েও। ছবিও আঁকতেন,
কিন্তু সেই যেবার ওনার একটা ছবি দেখে ওনার সেজোপিসি বলেছিলেন “ওরে রবি, তুই মানুষ
ছেড়ে একানড়ির ছবি আঁকছিস কেন?” তারপর থেকে আঁকার ব্যাপারটা ভাইপো অবনীর হাতেই ছেড়ে
দিয়েছিলেন।
সে যাই হোক, কোটি খানেক
কবিতা লিখে, আর ওরকমই গান লিখে, সুর দিয়ে, এমনকি গেয়ে ফেয়ে রবি এমন যা তা করে
ফেললেন, যে সাহেবরা চিন্তায় পড়ে গেল। এই লোক টিকে তো বাগে আনা যাইতেছে না! গান
লিখিতেছে, পোয়েট্রি লিখিতেছে, মডিফায়েড নূর ও রাখিয়াছে, এমন কি এমন ড্রেস করিতেছে,
রবার্ট স হিম দ্য আদার ডে অ্যান্ড থট দিস ইস গালীব? সো সেক্যুলার! নাইটহুড
ডিয়াছিলাম, সেটাও ফেরত করিয়া দিয়াছেন। হাউ টু কন্ট্রোল হিম?
রবি ওদিকে লিখেই চলেছেন।
গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ। নিজেই ঠাকুর ছিলেন, এখনো কিছু বাঙ্গালী
ওনাকে পুজো করে, তাই ঠাকুর দেবতা পুজা নিয়ে তো লিখছেনই, দেশ নিয়েও লিখছেন “উদাসি
নিবে, সেবি দেশ, ইনি কেশ এ” – ইন্দ্রলুপ্তের দল বলল এ আমাদের গান, স্টক এক্সচেঞ্জ
বলল এ আমাদের, দেখছেন না, সেবির কথা লেখা আছে? প্রেম রসে ভিজিয়ে অমিত্রায়কে নিয়ে
এমন লিখলেন যে মাইকেল তাতে খার খেয়ে একটা ছন্দই বানিয়ে ফেললেন – অমিত্রায়-খার
ছন্দ। কালী পুজোর জন্য লিখলেন “নাচে শ্যামা তালে তালে”, কয়েকজন সেটা জন্মাষ্টমীতেও
চালিয়ে দিল, বলল ওই শ্যামা আসলে শ্যাম, রবি ওটা সাউথইন্ডিয়ায় থাকতে লিখেছিলেন বলে
ওটা শ্যামা লিখেছেন। দুর্গাপুজো নিয়ে লিখলেন “আনন্দধারা বইছে ভুবনে” (মতান্তরে ওটা
ভোটে জেতার গান), বাংলা মদ নিয়ে লিখলেন “আমার শন আর বাংলা, আমি তোমায় ভালো বাসি”, ডেলি
প্যাসেঞ্জার দের নিয়ে লিখছেন “এপ্পর বাসে রবে কি হায়?”, ছবি বিশ্বাস কে নিয়ে
লিখছেন “তুমি কি কেবলি ছবি?”, ওপেন হার্ট সার্জারি নিয়েও লিখছেন “তোমারি চরনে দিব
হৃদয় খুলিয়া”, আবার বসিরহাট নিয়েও লিখছেন “গামছারা ওই রাঙ্গাম আঁটির পথ”। পুলিশ কে
নিয়ে লিখলেন “জেরা তে মোর দু আর গুলি ভাঙলো” – সব থানার বড়বাবু একসাথে খুশি হয়ে
গেলেন। প্রতিবন্ধি ভাই বোন দের জন্য লিখলেন “আন অন্ধ লোকে, মঙ্গল আলোকে”, যুদ্ধ
নিয়ে লিখলেন “শঙ্খ ছেড়ে বিউগল, তায় নিজেরে অপমান” – সাহেবদের নিজেদের মিলিটারিও আর
ওনার ওপরে তেমন রেগে থাকতে পারলো না।
শেষ পর্যন্ত সেই নোবেল
সাহেব, যাঁর জন্য গীতিনাট্য লিখতে গিয়ে বার বার রবি বাবুর মনে পড়েছে তাঁর স্ত্রীর
কথা, যিনি নোবেল কে ছেড়ে চলে গেছলেন মাঝরাতে, সেই নোবেলের জন্য লিখে ফেললেন একটা
গান
“তুমি তো সেই যাবেই চলে।
তুমি তো সেই যাবেই চ'লে,
কিছু তো না রবে বাকি--
আমায় ব্যথা দিয়ে গেলে, জেগে
রবে সেই কথা কি॥”
নোবেল বাবুর নাতি বললেন, এই
তো চান্স, এই লোকটা আমার দাদুর জন্যেও গান লিখেছে, একে নোবেল প্রাইজ দাও। চার্চিল
কে নিয়েও ওনার এক ভক্তের একটি কবিতা ছিল (অপ্রকাশিত) –
“ঝুঙ্কু ওনার নিয়েছে
কাড়িয়া, ভেঙ্গেছে কাদম বিনির দিল,
সময় তো তাকে করবে না ক্ষমা,
ছিঁড়ে খাবে তাকে চার চীল।।”
তাই ব্রিটিশরাও বলল “হ্যাঁ,
হ্যাঁ, হ্যাঁ!” চায়না বলল “হ্যাঁ, উনি তো আসলে আমাদের লোক, গান লিখেছেন না – আমি
চিনি গো চিনি?” আমেরিকা বলল “অকুন্ঠ আঁখি মেলি হের প্রশান্ত বিরাজিত” আসলে ওদের
গান, ওই যে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে লস এঞ্জেলেস, ওই নিয়ে লেখা – হের টা শুনে
জার্মান মনে হচ্ছে, কিন্তু হিটলার তো এখন আব্বুলিস হয়ে গেছে, তাই চাপ নেই। জাপান
শুধু কিছু বলতে পারেনি, কিন্তু বোমাবাজি আর নেতাজি নিয়ে চাপে না থাকলে ওরাও সিওর
বলতো রবিঠাকুর জাপানি, নাহলে আমাদের ন্যাশানাল ফ্লাওার চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে কখনোই
লিখতেন না “ও আমার চন্দ্রমল্লিকা”।
সারা বাংলা আনন্দে হই হই
করে উঠলো। বড়বাজারের বাঙ্গালীরা বললেন “কিতনা নাফা আছে? জ্যাদা হো তো দেনা চাহিয়ে
না নোবিল? ইতনি সি কাগজ মে কিতাব বানাকে ইতনা ভাও, তো পেরাইজ তো দিবার দরকার আছে
নাকি?”
-- এই সব হলে যা হয়, তাই হল
– রবিঠাকুর নোবেল পেয়ে গেলেন। সারা বিশ্বে আরো নাম ছড়ালো। এক কাশ্মীরি পন্ডিতের
যাবতীয় কলকাঠি নাড়া কে অগ্রাহ্য করে দেশবাসী ওনাকে জাতীয় কবি বলে ডাকতে শুরু করলো।
সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালীর এটাই
দরকার ছিল। ওই পচা বৈশাখের গরমে হিউমিডিটি কে ভুলে যাওয়ার একমাত্র টোটকা –
রবিঠাকুর বলে ওই দাড়িওয়ালা দাদু। পাড়ায় শীতলা পুজো? নো পরোয়া – বাবুল সুপ্রিয়র
গলায় “কতবার ভেবেছিনু” চালিয়ে দাও, সম্প্রীতি বজায় থাকবে। দুর্গাপুজোয় কালচার্যাল
কালার চাই? বড় বড় করে জে-বি-এল লেখা বক্সে হেমন্ত চালাও “ওগো নদী আপন বেগে”।
শ্মশান ঘাটে নতুন বিধবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন? চালাও “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু” –
চার মিনিটে চোখের জল সাহারায় চলে যাবে। ট্রাফিকের চাপে বিপর্যস্ত? ক্রসিঙে স্পিকার
লাগাও, চলবে “আমার এই পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দুরে”, অফিসের বাবু
অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টারের লাল দাগের দুঃখ ভুলে যাবেন। গয়নার দোকানের অ্যাডের
জন্য ছবি পাচ্ছো না? দাড়িওয়ালা তো আছেই? ই মেইলে সিগ্নেচারে একটা এথনিক ব্যাপার
আনতে চাও? পছন্দ মতো একটা লাইন লিখে হাইফেন দিয়ে লিখে দাও – ট্যাগোর – কেউ চেক করে
দেখবে না। সুন্দরী লেখিকা হয়েও ফুটেজ মরীচিকা? লেখ রবি ঠাকুর বলেছিলেন “রেপ
ডেস্ট্রয়স দ্য চ্যাস্টিটি অফ অ্যা উওম্যান, সো শি মাস্ট বি সতী ফায়েড” – দুনিয়া
গালি দেবে, কিন্তু তোমাকে সবাই চিনে যাবে, তারপর ১৩ বছর পরে সালমানের মতো ভালো
মানুষ এর সার্টিফিকেট যোগাড় করে নিলেই হল।
আরো আছে। হঠাৎ লাভ লেটার
পেয়ে গেছ? গাও “সখী ভালোবাসা কারে কয়?” হাফ সোল খেলে হিসেব নাও “আমি তোমায় যত,
শুনিয়েছিলেম গান, তার বদলে আমি চাইনি কোন দাম”। রাতে ঘুম আসছে না? জর্জদার গলায়
“আধেক ঘুমে, নয়ন চুমে” চালিয়ে দাও, ঘুমের বাপ এসে ঘুম সাপ্লাই করে যাবে। সকালে
অ্যালার্ম চাই? টাইমারে লাগিয়ে দাও “এদিন আজি কোন ঘরে গো”। উনি সব যায়গায় আছেন।
জৈষ্ঠ এলো বলে, হিমসাগর উঠেছে সবে, দুপুরে শেষ পাতে দুধ ভাত দিয়ে আম মাখা খাও আর
ভাবো লোকটা এই নিয়েও লিখেছিল – “পিপিলিকা কাঁদিয়া যায় পাতে”। আর এতো ব্যবহার করছ
বলে যদি একদিন আদিখ্যেতা দেখানোর ইচ্ছে হয়, তাহলে সেকেন্ড বিগ ইভেন্ট অফ দ্য
বেঙ্গল সামার তো আছেই – পঁচিশে বৈশাখ?
......
ওই দিন একদল আছে, যারা ঘুম
থেকে উঠেই গুগল ইমেজেস এ একটা সার্চ দেয় – রাবিন্দ্রানাথ ট্যাগোর, তারপর পছন্দ মতো
একটা ছবি, আর যেকোনো একটা কবিতা জুড়ে সিধে টুইটার বা ফেসবুকে পোস্ট। সবাইকে জানানো
– আমি রবিঠাকুর কে চিনি, সো ট্রিট মি অ্যাজ “সাংস্কৃতিক”। আরেকদল আলমারি খুলে
ন্যাপথালিন ঝেড়ে মায়ের গরদের লাল পাড় সাদা শাড়ীটা বের করে লাল ব্লাউসের ওপরে
চাপিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ধুতি পাঞ্জাবি পরা কারোর সঙ্গে – হয় পাড়ার মাঠে, কিম্বা
রবীন্দ্রসদনে। সেখানে একটু গান আর কবিতার সঙ্গে আড্ডা আর কালচার্ড দুগ্গিবাজী
সেরে বাড়ী ফিরে ফ্যান এর তলায় ভেনাসের পোজে বসে বগলের ঘাম সুকোও।
অফিস নেই আজ, তাই তাড়াও নেই।
ব্যাঙ্ক অ্যাকাইন্ট ছিল না তাঁর, তাই রবিঠাকুরের জন্মদিনে সব ব্যাঙ্ক ও বন্ধ।
ওদিকে শনিবার বলে অনেকেরই ছুটি। তাই আজ বড় আরামের দিন, আজ সংস্কৃতিকে লেপ্টে
খাওয়ার দিন। যে কোনো প্রশ্নের সব সময়েই বেশ সঙ্গীতময় উত্তর। বউ এই পাগলামো দেখে
কখনো বলেও উঠতে পারে “কি ব্যাপার? আজকে মনে হচ্ছে ঘোষ বৌদির সঙ্গে বেশ মাখো মাখো
ছিলে?” ছেলে ভাববে “কেস টা কি? মালটা আজকে হিটলার থেকে চৈতন্য হয়ে গেল?”
বিকেলে বড় ইভেন্ট – মাইক,
চোং, চেঞ্জার, টিউনার – সব এসেছে। তবলায় টং টাং করে টিউনিং হচ্ছে। হারমোনিয়ামের
পাশে এস্রাজও হাজির, এমনকি খোল ও নাকি এসেছে, সঙ্গে করতাল। পাড়ার বাচ্চারা প্রথমে
আবৃত্তি করবে – তুমি কি তাহাকে ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” এর পর বড়দের
প্রবেশ। ইকো তে ভয়েস সেট করে গাইতে হবে প্রথমে “এসো হে বৈশাখ”, যদিও বৈশাখের
অলরেডি চব্বিশ দিন আসা হয়ে গেছে, তারপর ম্যান্ডাটারি “হে নূতন, দেখা দিক আরবার”,
তারপর অন্য গান। পাবলিকের ধৈর্য কম, তাই দ্রুত লয়ের গান এ শিফট করো এবারে, নইলে
ক্রাউড কভার কমে যাবে। শেষের দিকে গলার মুন্সিয়ানা দেখানোর জন্যে একটু নজরুলগীতিও
চলতে পারে বরং – রবি বাবু দিনু ঠাকুরের পাল্লায় পড়ে যে মীড়ের ক্যারামতি দেখিয়েছেন,
ওখানে সুর ভুল হওয়ার চান্স অনেক অনেক বেশী - বরং নজরুলগীতি নিজের সুরেই গাওয়া যায়
– শেষে বলে দিলেই হবে “এটি একটি অপ্রচলিত সুরে গাইলাম – আপনাদের ভাল লাগলে আমারো
লাগবে”। আর অনেকেই এখন দুজন বড় কবির চাপ এক মাসে নিতে অপারগ, তাই আজকাল
“রবীন্দ্র-নজরুল” সন্ধ্যার আধিক্য বেশী। বেশ একটা বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি টাইপের
ব্যাপার হল – সেম মাইক ভাড়ায় দুজনকেই নমস্কার জানিয়ে কর্তব্য সেরে ফেলা গেল।
সংস্কৃতি মনা বাঙ্গালী অনুষ্ঠানে গেয়ে আর শুনে আপ্লুত হয়ে বাড়ী আসার সময় গান ধরলো
সালমানি স্টাইলে, “তুমি কোন কানুনের fool
গো”। কাল রোববার।
এরকমই বেশ চলছিল, কিন্তু
বছর দুয়েক আগে উদয় হলেন রোদ্দুর রয়। আজকের দিনে ওনার ব্যাপারে দু কথা না বললে
কিছুই বলা হয় না, তাই বলছি।
রোদ্দুরের জন্ম হয়েছিল
রাঁচিতে। পিতা ও মাতা, দুজনেই একই মনস্তাত্বিকের অধীনে ভর্তি ছিলেন, তারি মাঝে
দুজনের প্রেম। পিতা পর্তুগীজ, নাম সুওর, অর্থাৎ জল। ঝড়ে ডুবে যাওয়া জাহাজের ভাঙ্গা
কাঠের টুকরো ধরে তাঁর বাবা পেন্ট্রাম (মানে কলম-বাস যেমন নাম হয়, ওদেশে পেন-ট্রাম
বা পেন্সিল-জাহাজ ও নাম হয়) এদেশে এসেছিলেন, তারপর গোয়া তে চেনা ভাষায় কথা বলছে
দেখে একজন সদয় পাদ্রী তাঁকে স্থান দেন। জাহাজ ভেঙ্গে পড়ার সময় মাথায় চোট লেগেছিল,
তাই পেন্ট্রামের চিন্তাধারা টা একটু পাল্টে গেছলো, কিন্তু মানুষ খারাপ ছিলেন না।
পাদ্রী ভদ্রলোক তাঁর বিয়েও দিয়েছিলেন, ছেলে হয়েছিল, নাম দিয়েছিলেন সুওর, জলে ভেসে
আসার কথা মনে রেখে জলের সঙ্গে মিলিয়ে। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি, পেন্ট্রামকে পাগল বলে
বদনাম দিয়ে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। পেন্ট্রামও এরপর একদিন ছেলের হাত ধরে
হাঁটতে হাঁটতে বোম্বে পৌঁছে যান। দাদার স্টেশানে লাইনের ওপরে শুয়ে ট্রেন আসার শব্দ
শুনছিলেন, ড্রাইভার ট্রেন থামায়নি, তাই তিনি চলে গেলেন পরপারে। নশ্বর শরীর ছাই হয়ে
গেলো, আত্মা জমা দিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। তারপরে কি করে সুওর রাঁচি পৌঁছলেন, সে
অন্য গল্প।
রোদ্দুরের মা ছিলেন ফুলের
মতো, তাই তাঁর আশ্রয়দাত্রী তাঁর নাম রেখেছিলেন রোজ – গোলাপ। কালো গোলাপ দেখা
যায়না, খুব বেশী হলে একদম গাঢ় লাল, কিন্তু রোজ ছিলেন চেন্নাইয়ের একমাত্র
ব্যাতিক্রম। বাবা মা কে কেউ দেখেনি, তাই মারগারেট দয়া করে রাতে শুতে দিতেন তাঁকে -
নামটাও তাঁরই দেওয়া। শোনা যায় জন্ম থেকেই রোজের এই জগতের পারিপার্শ্বিক বস্তু
সমগ্রে ভারী অনীহা ছিল, কেবলমাত্র খাবার জিনিস বাদ দিয়ে, তাই পাড়ার বোকা লোকে
তাঁকে অ্যাব বলতো, কিন্তু তাতেও যে তাঁর বিকার ছিল, এমন কথা নিন্দুকেও বলে না।
শৈশব কাটিয়ে যৌবনের মুখে মুখে যখন তাঁর জামা কাপড়ের প্রতি অনীহা সানি লিওনের থেকেও
বেশী হয়ে দাঁড়ালো, এক দিন চেন্নাই সেন্ট্রালের সামনের ডিভাইডারের ওপরে গলায় পুঁতির
মালা আর নিম্নাঙ্গে পেটিকোট পরে এক পা তুলে আপামর জনসাধারণকে লাথি ও ওয়াইল্ডলাইফ
দেখাচ্ছিলেন, মাদার টেরিজার এক ভক্ত তাঁকে রাঁচি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। রোজ
এর স্টাইল কপি করে যিনি নাম কামালেন, তাঁর নাম সিল্ক স্মিথা।
রোজ এর অঙ্গবস্ত্রের প্রতি
অনীহা এর পরেও মোটেই কমেনি, তাই সুওরের সঙ্গে দেখা হওয়ার খুব শিগ্রীর মধ্যেই
কামদেবের ভরে দুজন কে আর দুরে রাখা গেল না। ওঁদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো
“শুয়ো-রোজ”, আর রোজমিলনের রোজ-গার হিসেবে তাঁদের এক সন্তানের জন্ম হল কিছুদিনের
মধ্যেই। আইসক্রিম স্কুপের মধ্যে ভোমরা পড়ে গেলে যেমন লাগবে, তেমন দুটি চোখ – দুটি
দুদিকে ছড়ানো, শুদ্ধ ভাষায় “স্কুয়িন্ট”। পদ্মবিচির মতো দাঁত, সাদার চারপাশে কালো
দাগ দিয়ে ঘেরা। মাথা যেন ধুত্রোর ফল আলকাতরায় চোবানো হয়েছে। সুওরের সু, আর তার
সঙ্গে রোজ, দুই মিলে সুরজ ছাড়া আর কিছু ভাবাই যায় না, তাই সূর্যের দীপ্তি নিয়ে
জন্ম হল এক কালজয়ী পুরুষের, নাম রাখা হল রোদ্দুর। যেদিকে দু চোখ যায়, সেদিকে যেতে
গেলে এই নরদেহ দুই ভাগে ভাগ করতে হবে, তাই যাওয়ার কথা তিনি আর ভাবলেন না, ঠিক
করলেন, রয়েই যাবেন, তাই রয়ে গেলেন। নিজেই নিজেকে উপাধী দিলেন – রয়। তিনি তখনই
জানতেন, যে তিনি থাকবেন। এই যে অনেকে রোদ্দুরকে শুয়োরের বাচ্চা বলে, সেখানে বানানের
ভুল থাকতে পারে, কিন্তু ভুল মানে নেই – রোদ্দুর সুওরেরই সন্তান।
সুয়োর একদিন রোজ কে রবি
ঠাকুরের বলাকা থেকে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলেন – রোজের সেই শুনে বকপাখি হয়ে ওড়ার
ইচ্ছে হলো, কুঁয়োর ওপরে জয়েন্ট ট্রায়াল দিতে গিয়ে চিত্রগুপ্তের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে
গেল দুজনের, উনিও ভালোবেসে দুজনকেই এন্ট্রি দিয়ে দিলেন, তারপর থেকে ওঁদের খবর কেউ
রাখে না। যে রোদ্দুর নিজেকে রয় উপাধী দিয়েছিলেন, তিনিও আর রইলেন না রাঁচিতে -
রোদ্দুর দিল্লি চলে গেলেন, দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রকের উপদেষ্টা হিসেবে।
......এরপর, বেশ চলছিল,
কিন্তু কোন এক সকালে উঠে রোদ্দুর ঠিক করলেন, উনি গান গাইবেন। হ্যাঁ! উনি গান
গাইবেন।
...
বাংলার কোন কোন সঙ্গীতকারের
পশ্চাদ্দেশের মৃত্যুর কারন তিনি হয়েছেন, সেই নিয়ে এখনো রিসার্চ চলছে, তবে গানের
পেছনের সঙ্গে রোদ্দুরের শত্রুতা একদম সুনিবিড়। অন্য ভাবে ভাবা, সে তো আছেই, গান কে
অগান করা, সেই ওনার মোক্ষ। তাই উনি সেই ঘরানার নাম দিয়েছেন মোকসা ঘরানা। যদিও উনি
নিজে কিছু গান ও লিখেছেন, ওনার লক্ষ্য মুলতঃ অন্যের বিখ্যাত গান। তার মাঝে রবি
ঠাকুরের গান ওনার লিস্টের একদম প্রথমে – কারন সেই রবি ঠাকুরের বলাকার পাঠ থেকেই যে
তিনি তাঁর পিতা মাতা কে হারিয়েছেন, সেই দুঃখ তিনি তাঁর পাষান হৃদয়ে খোদাই করে
নিয়েছেন। তাই একের পর এক রবি ঠাকুরের গানের পেছন নিয়ে তিনি পড়ে আছেন – তাঁর লক্ষ্য
– পেলেই মারো। এর নেট রেজাল্ট – গত দু বছরে ইউটিউবে রবি ঠাকুরের গান লোকে যত
শুনেছে, তার থেকে অনেক বেশী শুনেছে রোদ্দুরের হাতে তাদের মৃত্যুর ধ্বনি। ডাক্তার
দের পশার বেড়ে গেছে – কারন রোদ্দুর কে শোনবার পর কারো বমি পায়, কারো বুক ধড়ফড় করে,
কেউ পাগলের মতো হাসে, কেউ বা দেওয়ালে মাথা ঠোকে – বাঁকুড়ায় নাকি তিন মাসের পোয়াতি
এক হবু মায়ের ডেলিভারি হয়ে গেছে ওই রোদ্দুরকে শুনে – নার্সিংহোম লাগেনি। তাঁর এই
যে বিশ্বজোড়া গোঁসা, তার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ভিক্টিম বাঙ্গালীর রবি ঠাকুর।
যে রামছাগলটা এই পয়লা
বৈশাখে মাংসের দোকানে স্বর্গের সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছিল সে নাকি সেদিন ইউটিউবে কমেন্ট
করেছে – “শালা মানুষের বাচ্চারা, আমার দাড়ি আর তোদের রবিঠাকুরের দাড়ি নিয়ে অ্যানালজি
টেনে যখন ওই লজিকের ছাত্রটা পাতা ভরিয়েছিল, তখন তো খুব হেসেছিলি? এবারে দেখ, কার
যায়গা কোথায়?”
ভয় লাগে, রবি অস্তাচলে চলে
গেলে যেমন একটু আলো থাকে, তাকে এখন থেকে হয়তো রোদ্দুর বলা হবে। এটুকুই আশা, রবি আজও যায়নি অস্তাচলে, তার আলোই এখনো পথ
দেখায় বাঙ্গালীকে। যেদিন রোদ্দুরের পথ দেখতে হবে, সেদিন আমি আন্দামানে চলে যাব,
জারোয়াদের কাছে।
......
একটা প্রশ্ন করবো? যখন
হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে কোথাও যান, সেতুটা কার নামে, সেটা মনে থাকে তো?
No comments:
Post a Comment