চেন্নাই ও আরেক
বন্ধু
চেন্নাই থেকে ফিরেছি মাস দেড়েক হয়েছে,
বস্ বলল আবার যেতে হবে। এবারের গন্তব্য কোয়েম্বাতুর। বৌ তখন ক্যারিইং, আর ওই সময়ে
মেয়েদের অভিমান বেড়ে যায়, বেচারাকে একা ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছিল না।, কিন্তু চাকরি,
না থাকলে খাবো কি, তাই যেতেই হবে। কোয়েম্বাতুর জায়গা মন্দ নয়। তামিলনাড়ুর এক
কোনায়, কেরলের বেশ কাছাকাছি। উটির পাহাড়ের ঠিক নিচে, সুন্দর সবুজ শহর একটা। পরিস্কার,
পরিচ্ছন্ন, প্ল্যান্ড। প্রচুর মুসলিম থাকেন, তাই উর্দু খুব চালু ভাষা ওখানে। আর
তার মানে হিন্দিও মোটামুটি চলে। ভালই হল। মাঝে একটা রোববার পড়লে ঢুঁ মারা যাবে
পাহাড়েও। অ্যারিস্টোক্র্যাট এর স্যুটকেসটা হাফ গোছানোই ছিল, কয়েকটা ফ্রেশ জামা
কাপড় ঢুকলো শুধু।
ঘোষবাবু তখনো আছেন, তাই এবারেও ডাইরেক্ট
ফ্লাইটের আশা করা বৃথা। আবার সেই সঞ্জীবদা – এবারে টিকিট
পাওয়া গেলো গুয়াহাটি-কলকাতা-ভুবনেশ্বর-চেন্নাই ফ্লাইটে। কিন্তু চেন্নাই থেকে
কোয়েম্বাতুর কিভাবে যাবো, সেটা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিলো। ওভারনাইট ট্রেনের
টিকিট পাওয়া গেলো না, সব বুকড্। চেন্নাই থেকে তখন সবে কোয়েম্বাতুরের ফ্লাইট চালু
হয়েছে, কিন্তু সে খবর আমাদের কাছে ছিল না।
ভাবছিলাম কি করা যায়, হঠাৎ মনে পড়লো রবিশঙ্করের
কথা। রবিশঙ্কর ডিউ-পন্টের চেন্নাই শাখার আইটি হেড, জানুয়ারির শেষে কলকাতায় এসেছিল
ট্রেনিং নিতে, তখন বেশ ভাব জমেছিল। কলকাতায় শ্বশুরবাড়ী। ফোন করলাম। রবিশঙ্কর
উচ্ছ্বসিত – এত তাড়াতাড়ি দেখা হবে সেটা ভাবেনি আগে – বলল, কোনো চিন্তা কোরো না, সব দায়িত্ব আমার। দুর্দান্ত সব
বাস আছে এখানে, তার একটায় আমি সামনের দিকের টিকিট কেটে রাখছি, তুমি শুধু চেন্নাইতে
পৌঁছও, তাহলেই হবে।
পরের দিনই রবিশঙ্করের ইমেল চলে এলো, তাতে
লেখা আছে কেপিএন ট্রাভেলস্ এর ৮:৩০ এর চেন্নাই-কোয়েম্বাতুর বাসে ৭ নম্বর সিটটা বিজিথ
ভোস এর নামে, অর্থাৎ আমার। দক্ষিন ভারতীয়রা কোন একটা বিচিত্র কারনে আমার নামের
বানান কখনই ঠিক লিখতে পারেনা, কখনো বিজিথ, কখনো বিজি, কখনো আবার বিজু, একবাত ডিজিট
ও লিখেছিল। আর বোস টা প্রায়শঃই বস, ভোস বা বোশ হয়ে যায়। একটা কারন অবশ্যই ওদের
বর্ণমালা – যেখানে একশোর বেশী যুক্তাক্ষর, কিন্তু শুদ্ধ
বর্ণে ক-খ-গ-ঘ – এই চারটের জন্য একটাই অ্যালফাবেট, তেমনি
চ, ট, ত, প সিরিজেও এক জিনিস। এর নানাবিধ অসুবিধের মধ্যে একটা প্রধান অসুবিধে হল,
ওরা তাই সুরের রাজা হয়েও আন্তাক্সারিতে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যায়। তা না হোক, আমি
যাচ্ছি কাজে, আর সময় পেলে, একটু ঘুরতেও, তাই গান নিয়ে আন করে লাভ নেই, বানান নিয়েও
না।
ক্রেডিট কার্ডের ঝামেলা মিটেছে ততদিনে।
কিন্তু এবারে আর কোনো রিস্ক নেওয়া নেই, বস্কে বললাম যথেষ্ট পরিমান ক্যাশ না দিলে
আমি এবারে যাবোই না। বস বিশেষ বাক বিতন্ডা করলো না, অ্যাপ্রুভ্যাল হয়ে গেলো কয়েক
মিনিটেই। দিন সাতেকের ট্যুর, ঘোষবাবুর ভাঙ্গা হৃদয় টুকরো টুকরো করে দিয়ে দু খানা
একশো টাকার বান্ডিল পকেটে পুরে নিলাম। উনি যতবার বললেন “গুনে নিয়েছেন তো?” আমি ততবার “আপনি গুনে দিয়েছেন তো?” বলে একটা নারকীয়
সুখ অনুভব করলাম – শালা বুড়ো, আগের বার কিপ্টেমি না করলে
মোটেই ওরকম দুর্দশা হতো না, এবারে দ্যাখ শালা কেমন লাগে!
সকাল এগারোটায় ফ্লাইট, অফিস যাইনি আর
সেদিন, বাড়ির থেকে সোজা এয়ারপোর্ট। চেক ইন করার সময় উইন্ডো সিট চাইলাম, ইন্ডিয়ান
এয়ারলাইন্সের মাসিমা দিতে পারলো না, বলল নেই নাকি। যাকগে, কি আর করা। প্লেনে উঠে
দেখলাম অনেকে বসে আছেন আগের থেকেই, তখন মনে পড়লো প্লেন টা আসছে গুয়াহাটি থেকেই লোক
নিয়ে, তাই জানালা খালি নেই। এইল সীটে বসে পড়লাম, আর অবাক করে দিয়ে ফ্লাইট একদম ঠিক
সময়ে টেক অফ করলো।
প্লেন উড়ছে, লক্ষ্য করছিলাম, আগের বার
যেমন স্যুট বুট পরা লোকই বেশী দেখেছিলাম, এবারে তেমন লোক খুব কম। নিতান্ত ছা পোষা
লোকজনেই ভর্তি সব সিট। বছর দুয়েক আগে গুয়াহাটি গেছলাম, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের একটা
কাজে, তখন নাগুর মুখে শুনেছিলাম দক্ষিনের ব্যাঙ্কগুলো প্রায় সমস্ত কর্মচারীকেই
উত্তর পূর্ব ভারতে দু বছরের ম্যান্ডেটরি পোস্টিং দেয়। আন্দাজ করলাম, এনারা সেরকমই
লোক জন। একটু কান পেতে আলোচনা গুলো শুনতেই বুঝলাম আমার গেস টাই ঠিক।
এনারা অনেকেই ফোর্থ ক্লাস স্টাফ, বেশিরভাগ
উড়িষ্যার, কিছু অন্ধ্র আর তামিলনাডুর, বছর শেষের ছুটি কাটাতে ব্যাঙ্কের পয়সায়
প্লেনে ফিরছেন। অনেকেরই সঙ্গে পরিবার। দুপুরে বাড়ী পৌঁছে যাতে আর খাবারের ঝামেলা
না করতে হয়, সে ব্যাপারে সদাই তৎপর। কেউ দ্বি টা অন্ডা নিলেন, কেউ চারিটা। সমস্ত
ম্যাগাজিন ব্যাগে ঢুকে গেলো। কেউ কেউ সিটের ওপরে পা তুলে দিচ্ছেন, কেউ বা বারো
চোদ্দবার মাথার ওপরের এয়ার হোস্টেস কে ডাকার বোতাম টিপেই সময় কাটিয়ে দিলেন, কেউ
চার প্যাকেট চিনি নিয়ে পকেটে ঢোকালেন। একজন ফ্যানটা ধরে কষে পাক দিতেই কড়াৎ করে
শব্ধ করে তার বাইরের রিংটা তাঁর হাতে চলে এলো, তিনি এদিক ওদিক চেয়ে সেটা সামনের
সিটের পেছনের জালির পকেটে গুঁজে দিলেন। একটা বাচ্ছা সিটের ওপরে দাঁড়িয়ে অক্সিজেন
মাস্কের খোপ্টা টেনে ফাঁক করে বলছিল “এ বাপু, এটঠি
মধ্যিরে টিউবো অছি”, এমন সময়ে একজন এয়ার হোস্টেস এসে কড়া
ধমক দিতে সে ক্ষান্ত হলো। এয়ারবাস এ ৩২০ তখন জমজমাট, এমন সময়ে অ্যানাউন্সমেন্ট হল
বেল্ট বেঁধে বসতে, কারন ভুবনেশ্বর চলে এসেছে, প্লেন নামবে এবারে।
যাঁরা ভুবনেশ্বর প্রায়ই যান, তাঁরা
জানেন, শহরের একটু আগে পাহাড় আছে, সেখানে এয়ার পকেট হয় খুব, তাই রোলিং খুব বেশী।
আমারো অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু এক মহিলার কাণ্ডে থতমতঃ খেয়ে ভুলে গেলাম। এটা বোধহয়
ওনার প্রথমবার, প্লেন রোল করতেই চেঁচাতে শুরু করলেন – “মু মরি জিবো গো!
মু আর করিবিনি গো! মু কে নামাই দিয় গো! কাঁই মুকে শাস্তি দিলু রে!” এয়ারহোস্টেস সিট থেকে উঠে এসে দু এক কথা বলার চেষ্টা
করলেন, তারপরে ক্ষান্ত দিয়ে আবার নিজের জায়গায় চলে গেলেন। মহিলা চালিয়ে গেলেন,
থামলেন সেই প্লেন ল্যান্ড করার পরে। নিজের সিট ভিজে গেছে, সামনের ভদ্রলোকের কলারের
পেছনে বমি, হাসি হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে গটগটিয়ে নামার সময় বীরাঙ্গনার ভঙ্গিতে বলে
গেলেন “সড়া, ম্যাড়া****, এ সবে মু কৌণ নাই, মু কে
কিচ্চি করিতে পারিবিনি সড়া!” ওই সিট টা বাকি
রাস্তা যে খালিই যাবে, সে বলাই বাহুল্য। অন্য অনেকেই নেমে গেলেন, আমরা কিছু পরে
আবার ওড়া শুরু করলাম।
ডিউ পন্টের তারামণি তে মস্ত অফিস আছে,
গুম্নিপুডি তে কারখানা, কিন্তু রবিশঙ্কর বসে মাইলাপোরের অফিসে। এয়ারপোর্ট থেকে
একটা প্রিপেড নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। রিসেপশনে খবর দিতেই রবি বেরিয়ে এলো, “ওয়াও, বিজিথ বোসা” বলে জড়িয়ে ধরল।
লাঞ্চ করানোর জন্য চাপাচাপি করছিল, আমি বললাম দরকার নেই। একটু পরে ব্যাগ স্যুটকেস
অফিসে রেখে বেরিয়ে পড়লাম, রবির স্কুটি তে।
রবির স্কুটির খবর আমেরিকা জানে না, জানা
থাকলে নাসা নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতো। চেন্নাইতে হেলমেটের বালাই নেই তেমন। তবে
লোকজন ধুলো নিয়ে খুব সচেতন, তাই মাথায় রুমাল বাঁধা থাকে। হেলমেটের সামনের কাঁচ
যেরকম দেখতে হয়, সেরকমই কাঁচ ওখানে মোটা ইলাস্টিক ব্যান্ড সমেত কিনতে পাওয়া যায়,
খুব সেল। সেই ফেস্মেট পরে রবি চলল চেন্নাইয়ের রাস্তায় তার রকেট নিয়ে। পেছনে বসে
আমি, সিটের দুটো পাশ খামচে ধরে আছি, পা দুটো পেঁচিয়ে তুলে দিয়েছি পেছনের নাম্বার
প্লেটের ওপরে।
সেন্ট্র্যাল লাইব্রেরী, ভেল্লুভ্র
কোট্টায়াম, ফোর্ট, মন্দির – এসব ঘুরে যখন টি
নগরের জি এন চেট্টি রোডে পৌঁছেছি, দিন গড়িয়ে আসছে তখন। অফিস থেকে স্যুটকেস ব্যাগ
গুলো তুলে নিলাম, কফি খেলাম একটু। ব্যবস্থা অন্যরকম – চা আর কফি, দুয়েরই থকথকে সিরাপের মতো বানিয়ে রাখা আছে একটা
করে পাত্রে, পটে গরম দুধ আর পাশে চিনি। দুধ ঢেলে নাও কাপে, এক চা চামচ চা বা কফির সিরাপ,
তারপর তিতকুটে ভাব কাটানোর জন্যে প্রভূত পরিমানে চিনি – ড্রিংক তৈরি। সাতটা নাগাদ ডিনার করতে গেলাম। রবি দেখলাম
বিন্দাস মুরগি খাচ্ছে, শুধু আমাকে একবার সিরিয়াস মুখ করে বলল – তোমার সঙ্গে আমার বউ এর কখনো দেখা হলে কিন্তু বোলো না যে
আমি আমিষ খাই। আমার বয়েই গেছে! সেই সময়টা আমি মদ্যপানে বিরতি দিয়েছি নানা শারীরিক
কারনে, রবি একাই হুইস্কি খেয়ে চোখ ঢুলু ঢুলু করে ফেলল। খাবারের শেষে জবরদস্তি বিল
পেমেন্ট করে স্কুটিতে করে পৌঁছে দিল বাস স্টেশনে। আমি ওকে টা টা করে ভেতরে ঢুকে
পড়লাম।
চেন্নাইতে বাস স্ট্যান্ড বলে কম, স্টেশন
বলে বেশি। সেখানে প্রত্যেক নামকরা ট্র্যাভেলসের একটা করে ঘর আছে, ওয়েটিং হল। কে পি
এন এর ওয়েটিং হলে বসে আছি, মাইকে একজন তামিলে কিছু কথা বললেন, বাসের নাম্বারটা
শুনে একবার গিয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কনফার্ম করে নিলাম – এটাই আমার বাস। সামনে এসে দাঁড়ালো এখানা সাদা রঙের উঁচু
বাস, গায়ে কালো দিয়ে টাইমস নিউ রোমান ফন্টে লেখা কে পি এন ট্রাভেলস প্রাইভেট
লিমিটেড, মস্ত লম্বা, বেশ উঁচু। ভেতরে টু বাই টু সিট, অড নাম্বার গুলো জানলা, ইভেন
গুলো এইল। মস্ত সিট, বোতাম টিপে প্রায় শুইয়ে ফেলা যায়, মাথার কাছটা আবার বালিশের
মতো উঁচু করা। বাসে উঠে বাঙ্কে সুটকেস রেখে বসে পড়লাম সাত নম্বর সিটে, ব্যাগ টা
ছোট, তাই কোলে রাখলাম।
বিদঘুটে একটা তামিল ডিস্কো অ্যালবাম
চালিয়ে বাস ছেড়ে দিলো। প্রচুর লোকজন, পুরুষরা সব্বাই ধুতি পরা মালকোঁচা মেরে,
মহিলারা শাড়ি, কপালে বড় টিপ, মেটে সিঁদুরের, তার সঙ্গে চোখে পড়ার মতো বড় সাইজের
সোনার নাকছাবি। সবারই চুল অল্পবিস্তর পেপার সল্ট, নারকেল তেল খাওয়ার ফল। যে যার
মতো করে আনণে রেন্ডে মূণে ণালে করে সিট গুনে গুনে নিজের জায়গায় বসে পড়লেন। একজন
মহিলা পতিরেণ্ডে পতিরেণ্ডে করে চেঁচাচ্ছিলেন, ভাবছিলাম বোধহয় স্বামীর চরিত্র নিয়ে
গাল পাড়ছেন, তারপর দেখলাম তিনি আমার পেছনের রো তে বারো নম্বর সিটে বসলেন। আট নম্বর
টা খালিই রইল, কেউ ওঠেনি। মাঝে একজন সাদা শার্ট প্যান্ট পরা আবলুশ ভদ্রলোক ‘টিকিটা চেক পান্নি’ এলেন, তাঁকে
টিকিট দেখাতেই না সুচক মাথা নেড়ে চলে গেলেন, অর্থাৎ ঠিক আছে।
চেন্নাই ছাড়িয়ে খানিক দূর যাওয়ার পরে,
তখন ঘন্টা খানিক কেটেছে, বাস একবার দাঁড়ালো, সামনে লেখা “মুরুগান’স ডাবা হোটেল”। সেখানে নেমে সিগারেট ফুঁকে নিলাম একটা, তারপর বাসে উঠে
সিট টা লম্বা করে নিলাম। বাস ছাড়লো আবার, লাইট নিভিয়ে দেওয়া হল, গানের ভলিউম
প্রথমে কমিয়ে দেওয়া হল, তারপর একদম বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল পৌনে চারটে নাগাদ। বাস দাঁড়িয়ে
আছে, জানালা দিয়ে দেখলাম সামনের সাদা স্কুল বাড়িটায় লেখা – ‘সেলম হাই স্কুল,
সেইল, সেলম’। অনেকটাই চলে এসেছি তাহলে! স্টিল অথরিটি
অফ ইন্ডিয়ার কারখানা আছে এখানে। বাবা সেইলেই চাকরি করতেন, তাঁর কাছে শুনেছি এটাই
সেইলের একমাত্র প্ল্যান্ট যেখানে স্টেনলেস স্টিল তৈরি হয়। বাবার পঁচিশ বছর চাকরি
হওয়ার পরে এক বাক্স বাসন দিয়েছিল গিফট হিসেবে, সেই বাক্সে লেখা ছিল সেলম স্টিল।
দক্ষিন ভারত ভ্রমনে এসেও সেলমের ওপর দিয়ে গেছলাম, তার আগে ভাবতাম যায়গাটার নাম
সালেম, সেবারের রাজু ড্রাইভার সে ভুল কাটিয়ে দিয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়লো, এখান থেকে
কোয়েম্বাতুর ঘন্টা তিনেক হবে। এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি মারলাম চায়ের সন্ধানে, পেলাম না
কিছু। কফি ছিল, কিন্তু অত বেশি মিষ্টি আমি খেতে পারি না, তাই ছেড়ে দিলাম। পাঁচ
মিনিটেই বাস ছাড়লো আবার, লাইট ও নিভে গেলো।
পাঁচ মিনিটেই লাইট আবার জ্বলে উঠলো। সেই
চেকার ভদ্রলোক এসে তামিলে কি সব যেন বললেন, কিছুই বুঝলাম না, শুধু কোয়েম্বাতুর
শব্ধটা চেনা ঠেকলো, বলেই আবার চলে গেলেন ড্রাইভারের কাছে। বাসের সব্বাই হই হই করে
উঠলো, পতিরেণ্ডে মুখ দিয়ে কুকুরকে ডাকার মতো চুকচুক করতে থাকলেন, তাঁর স্বামী
পতিন্নূন্নূ নম্বর সিট থেকে ডজ করে বেরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন সামনের দিকে,
আরো খবরের খোঁজে।
আমি স্ট্রেইট হয়ে বসে আছি, পতিন্নুন্নু
ফিরছেন, খপাস করে হাতটা চেপে ধরে বললাম “হোয়াট?”। উনি চোখ গোল গোল করে শুধু বললেন “কোয়েম্বাতুর, বাম্ব, আল ব্যাড” – অর্থাৎ
কোয়েম্বাতুরে বোমা ফেটেছে, খবর খুব খারাপ। হাত ছেড়ে দিলাম, উনি নিজের সিটে গিয়ে
বসলেন। এর থেকে বেশি খবর এই বাসে আর পাওয়া যাবে না। সিধে হয়ে বসে আছি, বাকি সব্বাই
ঘুমিয়ে পড়লো আবার, পতিরেণ্ডের ফুরফুর করে নাক ডাকছে।
এক ঘন্টায় একটা বড় বাস স্ট্যান্ডে বাসটা
ঢুকল। উঠে গেলাম সামনে, ড্রাইভার বললেন “ইরোড়। পো মা”। সবাই নামবে, পেছনে লাইন পড়ে গেছে, আমাকেও নামতে হল।
ইরোড়ের আকাশে রক্তিম আভা দেখা দিয়েছে তখন। “পো, পো, পো” – বাসের ড্রাইভার
সমানে বলে চলেছে। আরেকবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রাই করলাম, তাতে বুঝলাম এই বাস আর
যাবে না, এখান থেকে আবার চেন্নাই ফিরে যাবে।
হতোদ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, দেখলাম আমার
বাসের অনেকেই একটা অন্য আকাশী-সাদা স্টেট বাসে উঠছেন। আমিও পেছন পেছন উঠে পড়লাম। এই
বাসেই প্রথম একজন প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক দেখলাম। পরিস্কার ইংরেজি বলেন। ভরসা
পেলাম একটু। ওনাকে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে। উনি বিস্তারিত বললেন, তার সারমর্ম
এরকম – আগের দিন আমি যখন রবির রকেটে চেপে চেন্নাই টহল দিচ্ছি, সেই
সময়েই কোয়েম্বাতুরে বিজেপির একটা র্যালি ছিল, তাতে ভাষণ দেবার কথা ছিল লালকৃষ্ণ
আডবানির। সেখানেই গোটা দুয়েক বোমা ফেটেছে গতকাল, তবে কেউ হতাহত হয়নি, গন্ডগোল ছিল
বটে, তবে আজকে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। আমি জানতে চাইলাম উনিও কোয়েম্বাতুর যাচ্ছেন
কিনা, তাতে বললেন না, উনি আগেই এক জায়গায় নেমে যাবেন। তা হোক, এবারে একটু শান্ত হল
মনটা।
বাস চল্লো গড়গড়িয়ে, ঝকঝকে রাস্তা, মাঝে
মাঝে দাঁড়াচ্ছে, একজন দুজন উঠছে নামছে, পাশের ভদ্রলোক আমাকে অল দ্য বেস্ট জানিয়ে
নেমে গেলেন এক যায়গায়। অ্যাড্রিন্যালিন ফ্লো কমে এসেছে, আবার ঘুম ঘুম পাচ্ছিল
একটু। ভোর ছটা হবে, একটা পুলিশের জীপ ডিপারের সিগন্যাল দিয়ে আমাদের পাশ কাটালো,
তারপর হাত দেখিয়ে বাসটাকে দাঁড়াতে বলল। দুজন নামলেন, ড্রাইভার মুখ বের করেছে, কথা
বলছে সেই দুজনের সঙ্গে, আমিও জানালা দিয়ে মুন্ডু বের করে বোঝার চেষ্টা করছি কি
হচ্ছে, কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেলাম। আমাদের বাসের কন্ডাক্টর। ভাঙ্গা উর্দুতে
বললেন, উৎরো, আগে নেহি যায়েগী বস্। কেন? পুলিশ বলছে।
ব্যাগ পত্র নিয়ে নামলাম, পুলিশের জীপ এর
মধ্যেই চলে গেছে, আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস ফেরৎ চলে গেলো তার পিছু পিছু, দেখলাম বাসে
বাকি যে ছয় সাত জন ছিল, তারা কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেলো। চওড়া রাস্তা, বেশ
খানিকটা ছেড়ে দোকানপাট, সব বন্ধ। রাস্তার পাশে ক্যালানের মতো দাঁড়িয়ে একা বিজিথ
ভোস, তামিল তেরিয়াদে, এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে সবুজ রঙের ক্লাব-লাগেজের ছোট
ব্যাগ, একটা নেড়ি কুত্তাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও, রেপ উইদাউট কপিউলেশন এরেই কয়
নিশ্চয়।
যায়গাটা কোথায়? দোকানে দেখছি লেখা আছে
কোয়েম্বাতুর, কিন্তু সে তো ডিট্রিক্ট ও হয়? একটু পরে ঠাহর হল, অনেক দুরে একটা অটো
দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় এক কিলোমিটার হবে, তাই আগে চোখে পড়েনি। কি আর করা, হাঁটতে শুরু
করলাম। দেখলাম বাহন চালক পুজো করছেন। বললাম, জায়েগা? উত্তর এলো, ইল্লা সার, ন।
ইল্লে কে আমা করাতে গেলে কি করা দরকার, ভাবছি, আবার প্রশ্ন এলো – কিদরকো জায়েগা? বললাম আর এস পুরম। শিউরে উঠে বল্ল ‘আর কে পুরম নাহি জানা হোতা সার” হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আবার প্রশ্ন – “ইউ গিব হ্নড্রেড
ফিফটি?” দেবো বাবা, উপায় কি? উঠে বসলাম, আর ঠিক
দু মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আর এস পুরম, এতটাই কাছে, স্বচ্ছন্দে হেঁটে আসা যেতো।
কি আর করা, দেড়শো টাকা গচ্চা গেলো, অটো
চলে গেলো আমাকে নামিয়ে দিয়ে, একটা টি এর মতো মোড়ে। সামনে, টি এর ডান বগলের নিচে একটা
মস্ত কর্নার প্লটে হোটেল অন্নপূর্ণা, বিশাল বড়, কিন্তু বন্ধ, পুরো সামনের দিক টা
রোলিং শাটার নামানো আছে। আসে পাশে অনেক দোকান, সব বন্ধ। ওদিকে একটা গ্রীন্ডলেস
ব্যাঙ্কের হোর্ডিং দেখা যাচ্ছে, সেটাও বন্ধ মনে হল।
এখন আর ধৈর্য হারানর মানে হয় না, শুধু
ঠিক সময়ের অপেক্ষা, কপাল আমার খুলবেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি, দেখলাম
খাঁকি ড্রেস পরা একজন, বোধহয় দারোয়ান হবে, এসে একটা শাটারের তালা খুলল, একটু তুলে
ভেতরে ঢুকে গেলো। শাটার টা নামাবে, আমি পেছন পেছন ঢুকে গেলাম। লোকটা হাঁ হাঁ করে
উঠলো – বন্ধ্ হ্যায়, বন্ধ্ হ্যায়! নিকুচি করেছে! বঙ্গমাতাকে স্মরণ
করলাম একবার, তারপর পরিস্কার বাংলায় বললাম “তাতে আমি কি করবো?
আমি কি বন্ধ করেছি? আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, আমাকে থাকতে না দিলে পুলিশে কমপ্লেন
করবো। ম্যানেজারের কাছে নিয়ে চল এক্ষুনি, নাহলে তোমার বাম্বু করে দেবো”। বাম্বু, পুলিশ, কমপ্লেন
এগুলো ইচ্ছে করে ইংরেজি শব্ধই বললাম, ফর স্পেশাল এফেক্ট। বঙ্গমাতা কৃপা
করলেন, দারোয়ান চুপ করে গেলো, আমি গট গট করে রিসেপশনে চলে গেলাম, পেছনে দারোয়ান,
গুটি গুটি পায়ে ফলো করছে। সামনে সুন্দর মডার্ন কাউন্টার, তার পেছনে অসংখ্য চাবি
ঝুলছে, কাউন্টারের ওপরে দেখা যাচ্ছে শুধুই দুখানা পা।
আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনে সেই পা নেমে
গেলো, উঠে বসলেন আমারই বয়সি এক যুবক। সাদা শার্ট, সাদা ধুতি। এক মুখ দাড়ি,
ঘুমোচ্ছিলেন, তাই চুল উস্কো খুস্কো। আমি বললাম হাই, আই আম ফ্রম ক্যালকাটা, আমার
বুকিং আছে। উনি কিছু না দেখেই বললেন “আই এয়াম সারি সার,
প্লীস ফাইন্ড সাম আদার হোটেল”। মশকরা হচ্ছে? এত
ঝামেলা করে হোটেলে ঢুকেছি, হোয়াট ডু ইয়উ মীন বাই ফাইন্ড আদার? আই অ্যাম হিয়ার ফর
ব্রুক বণ্ড, অ্যান্ড আই অ্যাম এন এস্টীমড গেস্ট অফ দেম। ইফ ইউ ডু নট অ্যালাউ মি,
আই অ্যাম গোয়িং টু কমপ্লেন এগেনস্ট্ ইউ, ইন অ্যা ওয়ে, সো দ্যাট দে মুভ ওভার টু
অ্যা ডিফারেন্ট হোটেল ফর অল দেয়ার গেস্টস! কাজ হয়েছে। ভদ্রলোক আমাকে “ওান সেকেন্ড সার” বলে কাকে একটা
ফোন করলেন, ওনার বস হবে। অনেকবার “সার ওয়ান্দে, ইদি
ব্রুকবন্ড ইঙ্গে” এই সব বললেন, তারপর আমার দিকে ফিরে
বললেন, ওকে সার, মায় বাস সেস্ য়ু ক্যান স্টে।
এরপরে আমি একটু হাল্কা হলাম। জানতে
চাইলাম কি এত চাপের জিনিস হয়েছে যে হোটেলে গেস্ট রাখা যাবে না? ওনার নাম মাণি,
বললেন আগের দিন কাছাকাছিই বোমা ফেটেছে, আবার যদি কিছু হয়, এই ভয়ে ওনারা গেস্ট
রাখতে চাইছেন না। বাইরে কারফিউ, উনি নিজেও আটকে গেছেন, বাড়ী যেতে পারেন নি গতকাল
থেকে। চাবি দিয়ে দিলেন রুমের, একখানা ছেলে, নাম আলম, আমার ব্যাগটা নিয়ে রুমে পৌছে
দিল, সাত তলায় রুম, নাম্বার ছশোসাত।
রুমে ঢুকেই ক্লান্তি কেটে গেলো – সামনের পুরো দেওয়ালটা কাঁচের, তার ওপারে দেখা যাচ্ছে উটির
পাহাড়। কাঁচের ওপাশে ব্যাল্কনি, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। রোদের তেজ নেই তেমন, ফুর
ফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, আলমকে জিজ্ঞেস করলাম – কাঁহা হুয়া ইয়ে
সব? আলম বাঁ দিকের ব্যাঙ্ক টার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ‘ইধারকো সার!” এতক্ষনে দেখলাম,
গ্রীন্ডলেস ব্যাঙ্কের সামনেটা প্রায় পুরোটাই উড়ে গেছে, রাস্তার ওপরে একটা ছ ফিট
ডায়ামিটারের গর্ত। বাপ রে! রুমে ঢুকে এলাম আবার।
সকালের কাজ সারার সাথেই ঝপ করে স্নানটাও
সেরে নিলাম। তখনো বাড়ীতে ফোন ছিল না, বাড়ীর সামনের দোকানে ফোন করে জানালাম আমি
পৌঁছে গেছি – আমি দেখিনি বটে, কিন্তু বাড়ির সবাই টিভি
দেখেছে, চিন্তাতেই ছিল নিশ্চয়ই। এখানের নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। একটু পরেই ফোন
বাজলো, রামানাথন ফোন করেছেন, এখানের একাউন্টস ম্যানেজার, জানতেন আমি আসছি তাই
হোটেলে ফোন করে খবর রাখছিলেন আমি কখন ঢুকছি। সাবধানে থাকতে বললেন, আর বললেন আজকে
ফ্যাক্টরিতে এসো না, একে রবিবার, তায় কারফিউ, হেঁটে আসতে হবে। আমার যাওয়ার কোনো
ইচ্ছাই ছিল না, সেটা আর বললাম না। বাড়ির থেকে ফোন এলো, বললাম সব ঠিক আছে। বসের ফোন
এলো তারপর, বলে দিল একটুও ঝুট ঝামেলা দেখলে যেন কেটে পড়ি। আর তারপরেই, ভীষণ খিদে
পেল।
রুম সারভিস ডায়াল করলাম। ওয়ান চিকেন
স্যান্ডউইচ, ওয়ান ডাবল এগ ফ্রাই, ওয়ান অরেঞ্জ জুস, চিল্ড। উত্তর এলো, চিকেন
স্যনাডুইচ ইল্লে সার। ওকে, দেন এগ অর ভেজ স্যান্ডউইচ? আবার উত্তর, স্যান্ডউইচ
ইল্লে সার। ভীষণ রেগে বললাম, দেন হোয়াট ডু ইয়ু হ্যাভ? নিরবিকার জবাব, ওয়ানলি ইডলি
সার। মাণিকে ফোন করলাম। উনি জানালেন কারফিউ চলছে, হোটেলে কোন কিছু নেই আর, কুকও
নেই, নিজেদের খাওয়ার জন্য ইডলি বানিয়েছে ওরা, খেলে খেতে পারি, না হলে হরি মটর।
সারেন্ডার করতে হল। আলম এলো ইডলি নিয়ে। সিগারেট ফুরিয়ে গেছল, বললাম এনে দিবি? বলল,
দিচ্ছি। এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিংসের দাম নিলো পঁয়তাল্লিশের বদলে একশো টাকা,
উপায় নেই, দোকান বন্ধ সব। সারা দিন টিভি দেখে কাটলো। দুপুরে রাভা পোঙ্গাল - আমাদের
সুজির হালুয়া, আর রাত্রে গিজড়ি, মানে খিঁচুড়ী।
সন্ধ্যে টা কাটিয়ে দিলাম ব্যাল্কনিতে বসে
ওয়াকম্যানে গান সুনে আর পাহাড় দেখে। ভালো লাগলো দেখে, রাস্তা দিয়ে, যদিও প্রায়
অন্ধকার, এক দুটো লোক মাঝে মাঝেই যাচ্ছে। স্বাভাবিক হচ্ছে কোয়েম্বাতুর।
সকালে বেরোলাম যখন, অন্নপূর্ণার রোলিং
শাটার খুলেছে, যদিও ফ্যাসাডের দোকান গুলো বন্ধ। উল্টো ফুটে একটা পানের দোকান আর
একটা জলখাবারের দোকান খুলেছে। একটু এগিয়ে একটা অটো পাওয়া গেলো, হুশ করে পৌঁছে
গেলাম ফ্যাক্টরির গেটে। সবার সঙ্গে আলাপ হল। রামানাথন (এনারও নামের অন্য পার্ট টা
রামাকৃষ্ণান) আলাপ করিয়ে দিলেন বাকিদের
সঙ্গে - রভিচন্দ্রন, গুরুমূর্তি আর জয়সুধা। রামানাথন ত্রিচির তামিল ব্রাহ্মণ, বাংলাও
বলেন ভালই, অনেকদিন কলকাতায় পোস্টেড ছিলেন। রভিচন্দ্রন আর গুরুমূর্তি দুজনেই
ইংরেজি বলেন স্পষ্ট, হিন্দিও বলেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা, দুজনেরই পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স।
গুরুমূর্তির মাতৃভাষা কান্নাডা, রভিচন্দ্রনের মালায়ালাম। জয়সুধা লোকাল মেয়ে। সব
মিলিয়ে টোট্যাল ন্যাশানাল ইন্টিগ্রেশন একদম। এদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট ওই শ্যামলা
রঙা জয়সুধা। মাত্র তেইশ বছর বয়স, আই টি অফিসার এখানের, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে
পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছে এখানে, মুখে সদাই হাসি, আমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সেই
জিনিস রেডি।
কাজ এগোতে লাগলো ভালোই। দুপুরে ওদের
ক্যান্টিনে ভালোই খেলাম, দক্ষিনি খাবার, কিন্তু চেন্নাই-পন্ডিচেরীর সেই উগ্র
গন্ধটা নেই। এক বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গেও আলাপ হল, সুবীরবাবু, ছাব্বিশ বছর আগে
বনগাঁ থেকে এসে এখানেই সংসার পেতেছেন, মাটির সঙ্গে যোগাযোগ নেই তেমন, তাঁর কাছে বাংলাদেশ
এখনো প্রমোদ দাশগুপ্তর সময়েই আছে। সন্ধেয় যখন ফিরলাম, তখন অনেক দোকান খুলে গেছে
হোটেলের আসেপাশে।
কোয়েম্বাতুর শহরটা খুবই প্ল্যান্ড, যেন
ক্লাস ওয়ানের অঙ্ক খাতা। দুই রো করে বাড়ী, তারপরেই একটা রাস্তা, চওড়া। আমার
হোটেলের ব্যাল্কনিটা রাস্তার পেছনের দিকে, সেদিকে আরেকটা রাস্তা। পরের দিনটা কেটে
গেলো নির্ঝঞ্ঝাটে। পেছনের রাস্তাটায় একটা আকাশী ফিয়েট পার্ক করা ছিল, তাতে নাকি
বোমা থাকতে পারে, সেই নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলছে। সকাল সন্ধ্যেয় দেখতাম নীল
জংলা ড্রেস পরা বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা অনেক কিছু করছে ওখানে। পরের দিন ট্রাক ভর্তি
মাটি, স্টোণ চিপ্স, পিচের গাড়ী, রোড রোলার চলে এলো, ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তা
রিপেয়ার হবে। সামনের দোকান গুলো এক এক করে সব খুলে গেলো, যদিও ভীড় নেই এখনো।
সাইকেল, অটো চলা শুরু হল, শুধু পেছনের রাস্তাটা নো এন্ট্রি হয়ে রইলো।
আমি রোজ ফ্যাক্টরি যাচ্ছি, লাগছেও ভালো। ব্রিটিশদের
তৈরি ফ্যাক্টরিটা চা-কফির, কফিই প্রধান, একদিকে ওয়্যারহাউস, সেখানে একটা শেডে ডাঁই
করে রাখা কফি বিন্সের বস্তা, অন্যটায় কালচে খয়েরি রঙের চিকোরির পাহাড়। চিকোরি একটা
গাছের শেকড়। কফিতে চিকোরিই প্রধান উপকরন, ফিল্টার কফিতে চিকোরি থাকে সত্তর শতাংশ,
ইন্সট্যান্ট কফিতেও নাহোক ষাট শতাংশ তো বটেই। কফি বিন্সে মূলতঃ গন্ধ আর হাল্কা রঙ
হয়, তিতকুটে স্বাদ, তাতে ভলিউম আসে চিকোরি দিয়ে। দুটোকেই রোস্ট করা হয়, তার মিঠে
কড়া গন্ধ ভেসে থাকে বাতাসে, তারপর গুঁড়ো করে প্যাকেট করা হয় – ফিল্টার কফি। ইন্সট্যান্ট কফির অন্য প্ল্যান্ট লাগে, সে
প্ল্যান্ট এখানে নেই। অনেকটা যায়গা জুড়ে কারখানা, ভেতরে সবুজ লন, ইঁট বাঁধানো
রাস্তা, মাঝে মাঝে কৃষ্ণচুড়ার গাছ, লাল ফুল হয়ে আছে, কিছু হলুদ আর সাদা শিরীষ, পাউডার
পাফ, হলদে রাধাচুড়া, বেগ্নে ফুলের জাকারান্ডা। ইঁটের বর্ডার দেওয়া নুড়ি পাথর ফেলা
রাস্তার দুপাশে কেয়ারি করে সিজন ফ্লাওয়ার লাগানো, মাঝে কিছু পাতাবাহার – কারখানা নয়, মনে হয় যেন কোনো বাগানে এসেছি।
বুধবার সকাল এগারোটা হবে, জমিয়ে কাজ
চলছে, হঠাৎ দুম করে একটা শব্ধ পেলাম। পাত্তা দিইনি তখন, কিন্তু তার একটু পরেই একটা
হই হট্টগোল শুরু হল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম লোকজন পাঁচিলের পাশে একটা যায়গায় ভীড় করেছে।
পায়ে পায়ে আমিও গেলাম, রভিচন্দ্রনের দেখা পাওয়া গেলো। জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? রভিচন্দ্রন
বলতে লাগলো আঙুল দেখিয়ে। কারখানার সামনে একটা চওড়া রাস্তা, তার ওপাশে খানিকটা ফাঁকা
জমি, শ পাঁচেক মিটার হবে। তারপর আরেকটা বাউন্ডারি ওয়াল, তিন ফুটের, তার ওপাশে
লক্ষ্য করলাম সেই নীল জামা পরা বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা। একজন এসে খবর দিল ওটা একটা
স্কুলের মাঠ, স্কুল ছুটি, তাই কয়েকটা বস্তির বাচ্চা ওখানে ডাস্টবিন ঘাঁটছিলো।
ওখানেই বোমাটা ফেটেছে, একটা বাচ্চা মারা গেছে, অন্য একজনের অবস্থাও ভালো না। এর
বেশি কিছু জানা গেলো না, একটু পরে আবার ফিরে এসে কাজে বসলাম, কিন্তু মনটা ভালো
থাকল না আর।
কিছু পরে পিয়া ফোন করলেন। জানতে চাইলাম,
কবে আসছেন, কারন ওনারও আসার কথা। বললেন সেই নিয়েই ফোন করেছেন, অফিস থেকে আসতে বারন
করছে, আমাকেও বললেন বেরিয়ে পড়তে, কারন ব্যাপারটা খুব একটা ভালো ঠেকছে না। আমারও
ভালো লাগছিল না। আসার দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাবো কি করে? বাস তো
বন্ধ, ট্রেন এও ওঠা যাবে কিনা জানিনা। তখনই জানলাম, কোয়েম্বাতুর থেকে চেন্নাই
ফ্লাইট চালু হয়েছে সবে, ব্যাঙ্গালোর-কোয়েম্বাতুর-চেন্নাই। তার টিকিট পাবো কোথায়?
পিয়া বললেন, চিন্তা করবেন না, সে দায়িত্ব জয়সুধার।
জয়সুধা কোনো একটা ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন
করলো। তারা একজন কে পাঠিয়ে দিল একটু পরেই। তিনি আমার টিকিট নিয়ে এসেছেন, পরের দিন
বারোটায় ফ্লাইট। ব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপের মেশিন বের করলেন, পেমেন্ট হয়ে
গেলো। আমি এই ফাঁকে রভিচন্দ্রনকে ধরে একটা দোকান থেকে দুই পেটি ব্যানানা চিপ্স
কিনে আনলাম, কলকাতায় খুব চাহিদা তার, তখন পাওয়াও যেত না তেমন। বেরিয়ে পড়লাম ৫টা
নাগাদ, হোটেলের দিকে। দেখলাম হোটেলের আসেপাশের দোকানপাট আবার বন্ধ হয়ে গেছে, আমি
রুমে ঢুকে পড়লাম।
খানিক্ষন টিভি দেখলাম। আজকের বোমা ফাটার
খবর আছে, তাছাড়া নতুন আর কোন খবর নেই। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। জুতোটা আগেই খুলেছি, জামা
টা গোঁজা ছিল এতক্ষন, এবারে বের করলাম। লাইট চলে গেলো হঠাৎ। চপ্পলটা পায়ে গলিয়েছি,
ফোন টা বাজলো। মাণি।
বিজিথ, ইউ আর স্টিল দেয়ার? হ্যাঁ রে
বাবা, তা তো আছিই। কালকে বেরোবো। মাণি এরপর যা বলল, সেটা আচমকা, আতঙ্কের এবং
আশঙ্কার। পেছনের রাস্তাটায় যে ফিয়াট টা ছিল, যার দরজা খোলা যাচ্ছিল না পাছে বোমা
ফেটে যায়, পুলিশকর্তারা ঠিক করেছেন, সেটা আজকেই খোলা হবে। বোমা ফাটতেই পারে, তাই
সাবধানতা রাখতে সমস্ত বাড়ী খালি করে দেওয়া হচ্ছে। লাইটও পুলিশের আদেশেই নেভানো
হয়েছে, যদিও বোমার সাথে আলোর কি সম্পর্ক, সেটা বোঝা গেলো না, হয়তো দিওয়ালীর রাতের
মতো ব্যাপার, আলো জ্বললে দেখা যাবে না ভালো, তাই। মাণি বলল, ইউ নীড টু রান বিজিথ,
ইউ আর দ্য লাস্ট পার্সন ইন্সাইড দ্য হোটেল আদার দ্যান মি।
মাথা কাজ করছে না ঠিকমতো, কি কি করা
উচিৎ? লাফ দিয়ে পড়ে ফোল্ডারটা নিলাম হাতে, ওতে ফেরার টিকিট। ব্যাগ থেকে টাকা বের
করে নিলাম, আর নিলাম ক্যামেরা টা। ঘরের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে ছুটে বেরোলাম বাইরে,
পায়ে চপ্পল। প্যাসেজটা অন্ধকার। লিফট চলছে না, সেটা বলতে হয় না। সিঁড়ির কাছে
গেলাম। স্কাইলাইট দিয়ে হাল্কা আলো আসছে আকাশের। হাতড়ে হাতড়ে সাতটা ফ্লোর নামা,
সেটা যে কত কঠিন, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছি, প্রতিটা স্টেপে। প্রানের ভয়, তাই বোধহয় দশ
মিনিটেই নেমে এসেছিলাম। নিচে একখানা মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাণি, আমাকে
দেখে একটু হাসি ফুটলো, কিন্তু চোখে ভয়, বলল গুড গড, ইউ আর হিয়ার ইন টাইম। মোমবাতি
নিভিয়ে দুজনে বাইরে এলাম, দারোয়ান শাটার নামিয়ে দিল।
রাস্তায় কে যেন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে, এতো
অন্ধকার। অনেকেই আছে রাস্তায়, কিন্তু আলো নেই কোনো। মাঝে মাঝে বিড়ি সিগারেটের আগুন
জোনাকির মতো, কেউ কেউ টর্চ জ্বালছেন কখনো কেমনো। মাণি একটু পরে কোথায় চলে গেলো,
অন্ধকারে ঠিক ঠাহর পেলাম না। উল্টোদিকের একটা দোকানের সিঁড়িতে বসলাম। মশা
কামড়াচ্ছে, পোকা উড়ছে। মাঝে মাঝে একজন মুখে টর্চ মারছে, আমি কলকাতায় হলে বাপান্ত
করে দিতাম, বিদেশ বিভুঁই বলে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকছি। লোকজন তামিলে কি যেন
বলছে, জানতে চাইছে, আমি কিছুই বুঝছি না। কেউ একজন বোধয় প্রশ্ন করে উত্তর পেল না বলে
গালাগালি দিল আমাকে। হাতটা মুঠো করে রাখলাম, সহ্য করতেই হবে। কিছু বললাম না, মুখে
হাসিটা আটকেই রেখেছি। সময়ও দেখতে পাচ্ছি না, টর্চ টা নিয়ে নামিনি। এক একটা মুহূর্ত
যেন একটা করে ঘন্টা, সময় কাটছে না কিছুতেই।
অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে এসেছে,
একটা আউটলাইন দেখে মনে হল যেন মাণি। ডাকলাম, সাড়াও পেলাম, মাণিই বটে। কটা বাজলো?
মাণি বলল সাড়ে আটটা। আর কতক্ষন? নো আইডিয়া। এমন সময় রাস্তায় একজোড়া আলো দেখা গেলো।
জীপের আলো। কাছে আসতে বুঝলাম, পুলিশ। কয়েকজন নেমে কিছু একটা বললেন, আর মানি আমার
পিঠ চাপড়ে বলল “ইট ইস নাট গোয়িং টু হ্যাপেন টুডে, সো উই
আর সেফ নাউ!” বিস্তারিত শুনে বুঝলাম, গাড়িটার দরজা
কিছুতেই খোলা যায়নি, রাতের অন্ধকারে জোর করে খুলতে গিয়ে ওটা ফাটানো ঠিক হবে না বলে
মনে হয়েছে, তাই আপাততঃ বন্ধ ব্যাপারটা। কালকে সকাল আটটায় আবার শুরু হবে কেত্তন।
কয়েক মিনিটেই আলো চলে এলো, রুমে ফেরত গেলাম।
যে আমি গত সাত বছরে সূর্যদয় দেখিনি, সেই
আমি সকাল পাঁচটায় উঠেছি পরের দিন। সাড়ে পাঁচটায় চেক আউট, মাণিকে ঘুম থেকে টেনে
তুলে। হোটেলের সামনে অটো পাইনি, হেঁটেই চলে গেলাম ফ্যাক্টরিতে, হাতে স্যুটকেস
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। গেটে তালা ঝুলছে, ক্লান্ত আমি ঘেমে নেয়ে ফুটপাথেই স্যুটকেস রেখে
বসে পড়েছি, এমন সময়ে একজন দারোয়ান দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এলো – “কেয়া হুয়া সাব? আপ
আভি? য়াঁহা?” হাসলাম শুধু। আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো সে,
ফ্যানের হাওয়ায় বসলাম। জয়সুধা এলো সবার আগে, কার্ড পাঞ্চ করতে এসে আমাকে দেখে মুখে
চমকানো হাসি। ইউ? বললাম কালকের বৃত্তান্ত্ব। এর পর একে একে সবাই এলো, গল্প করতে
করতে কখন যেন সাড়ে দশটা বেজে গেছে, গাড়ী চলে এলো। ছোট্ট এয়ারপোর্ট, লাউঞ্জে বসে মা
দুর্গাকে ডাকছি, ফ্লাইট যেন ক্যান্সেল না হয়।
ঠিক সময়েই প্লেন উড়লো। চেন্নাই পৌঁছে
এবারে জি এন চেট্টি রোডের হোটেল ডি সি ম্যানর, রবিশঙ্কর রেকমেন্ডেড। তেরোশো টাকা,
ইয়েসি। ফেরার টিকিট টা ওপেন ছিল, হোটেলের রুম থেকে এয়ারলাইন্সে ফোন করে পরের দিনের
জন্যে কনফার্ম করলাম, সিট ছিল, হয়ে গেলো। রবিশঙ্করকে ফোন করলাম, জানালাম সব গল্প।
বলল আসছে একটু পরেই। চা এসেছে, এক চুমুক দিয়ে উঠে জানলার পর্দাটা সরালাম।
রাস্তায় অফিস ফেরতা লোকজনের ঢল নেমেছে।
বাস যাচ্ছে, অটো, বাইক, মোপেড। ফিল করলাম, এমন ভালো শহর সারা দক্ষিন ভারতে আর নেই।
মানুষ তো কোয়েম্বাতুরেও ছিল, এখানে রবিশঙ্করও আছে।
1 comment:
দারুন লেখা। এক লপ্তে পড়ে ফেললাম। এই সব নিয়ে একটা ছোট বই করো না কেন? কত লোক কত কিছু নিয়ে লিখে বই বের করছে।
Post a Comment