বোড়ে
পুরন্দর খাঁর বংশধর হলে সাহস আর বুদ্ধি যে
বেশী হবেই, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ কেবল বোকারাই করবে। সাহসের কথা বললেই
শঙ্কর কাকুর ঘটনা মনে পড়ে – রাতের বেলায় তিন চার রকম অস্ত্র নিয়ে ঘুমোতে যেত, বেড়ালের
ভুত আক্রমন করলে যাতে কোনভাবেই পরাজয় স্বীকার না করতে হয়। আর বুদ্ধি? সে দূর ও
নিকট, আমাদের বংশে দুইই আছে, চাঁদের শোভার মতো। তবে ভাবনা কিসের? ভাবনা যুদ্ধ
লাগলে। কারন পুরন্দর খাঁর বংশে সেনাপতি অলমোস্ট সবাই, বোড়ের বড়ই
অভাব এই বাড়িতে। তাই অর্ডার করার লোক অনেকই, মানার লোক খুঁজে বের করতে হয়। তবে সেনাপতির
ও গ্রেড আছে, সেই হিসেবে বড়, মেজো, সেজো, ন, ফুল থেকে নিয়ে ছোট অবধি সবারই অলিখিত গ্রেডিং
করা আছে। এই বিভিন্ন গ্রেডের সেনাপতি দের আমি কখনো বাইরে দেখিনি তা নয়, তবে সব্বাইকে
এক জায়গায় দেখার সেরা জায়গা নোহারী।
সেনাপতিদের নিয়ে আলাদা করে লেখার অবকাশ তো
রইলই। কিন্তু তার মাঝে রেয়ার কমোডিটি একজন বোড়ের কথা না লিখলে খুব অন্যায় হবে। সে আমাদের
অসীম কাকু।
উপেন্দ্রনাথ এর চতুর্থ ভ্রাতা নোহারীর মায়া
কাটিয়ে কলকাতায় গেলেন ডাক্তারি পড়তে। রূপবান পুরুষ তিনি, ডাক্তারি
পড়া তো হলই, কিন্তু মদনদেবের ছোঁড়া তীরের খোঁচা তিনি অ্যাভয়েড করতে পারলেন
না, ইচ্ছাও যে তেমন ছিল, তা নয়। অতএব বীর নৌসেনাপতি পুরন্দর খাঁর বংশধর
অক্ষয়কুমার বসু যাবতীয় বীরত্ব জলাঞ্জ্বলি দিয়ে বিবাহবন্দি হলেন কলকাতার এক বনেদি বাড়ীর
সুন্দরী বালিকার কাছে। সেটাও তেমন আহামরি কিছু ব্যাপার নয়, এমন হয়েই
থাকে, কিন্তু সঙ্গে যেটা হল, সেটা হল শশ্রুপিতা নিজের আদরের মেয়েকে কিছুতেই
চোখের বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলেন না, নোহারী হাজার হলেও গ্রাম, সেখানে ব্রিটিশদের
তৈরি কলকাতার হাওয়া তেমন পৌঁছয়নি,
তাতে সন্দেহ নেই, তাই সেখানের জমিদারের মাটির বাড়ীর থেকে মেয়েকে
কলকাতার একতলা পাকা বাড়ীতেই থাকতে বলাটা শ্রেয়। অক্ষয়কুমার দ্বিতীয় বার বন্দি হলেন, এবারে গৃহ-জামাতা
হয়ে।
এই পরিবার নিয়ে দু এক কথা না বললেই নয়। বেলেঘাটার
আলোছায়া সিনেমা, যা এখন পাল্টে বিগ বাজার হয়েছে, তার ঠিক
পেছনেই অক্ষয়কুমারের নতুন বাসস্থান হল। রাস্তার ওপরে সার দিয়ে চারখানি ঘর। ঘরগুলির
একদম বাঁ দিক দিয়ে বাড়ীর এনট্রান্স। ভেতরে ঢুকেই ডানদিকে বারান্দা, সেখানে ওই
চারটে ঘরের ঢোকার দরজা। বারান্দার সামনে উঠোন, তারপর একদিকে রান্নাঘর, অন্যপাশে
বাথরুম ও পায়খানা। বারান্দায় সার দিয়ে ওপেন র্যাক, তাতে খবরের কাগজ, পুরনো খাতা
ও বইয়ের ওপরে পুরু ধুলোর আস্তরন। বাথরুমে যে মাকড়সারা জাল বুনেছিল, তাদের কম
সে কম ষোল হাজার জেনারেশন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ঝুল সেই তেমনি রয়ে গেছে। উঠোনের শ্যাওলায়
রোলার স্কেট ছাড়াই রোলার স্কেটিং করা যায়। বাথরুমের বাল্বের ফিলামেন্টটা শুধু দেখা
যায়, হয়ত এডিসন নিজেই তৈরি করেছিলেন সেই বাল্ব, তাই এখনো
কাটেনি। বাথরুমের ভেতরে চৌবাচ্চা,
তার পাড়ে রাখা থাকে
একখানি এলুমিনিয়ামের মগ। তার তলার দিকটা কোন এক সময়ে হয়তো ফ্ল্যাট ছিল, কিন্তু আছাড়
খেয়ে খেয়ে ক্রমশঃ গোলাকৃতী ধারন করেছে। বাথরুমে ঢুকে যদি ওই মগ একবার টাচ করে ফেলা
হয়, তাহলেই চিত্তির, কমসে কম পনেরো মিনিট লাগবে ওটাকে ব্যালেন্স
করে বেরিয়ে আসতে।
এই বাড়িতেই বড় হচ্ছিল অক্ষয়কুমারের চার ছেলে
ও দুই মেয়ে। তারা সবাই ভীষণভাবে কল্কাত্তাইয়া ঢঙ্গে হালুম গেলুম করে, ছ কে চ বলাটাই
তাদের স্টাইল, আর আজীবন কুপমন্ডুক থাকায় কলকাতার বাইরের কোন কিছু সম্বন্ধেই
তেমন ধ্যান ধারনা নেই তাদের। এরা কোনদিন পরিক্ষায় ফেল করে না, তবে কেউ যদি জানতে
চায় কেন এরা আগের ক্লাসেই গত তিন বছর আছে, তখন উত্তর আসে, এরা ক্লাসে
পাকা হওয়ার জন্য রয়ে গেছে। নোহারী যে মঙ্গলগ্রহে, সে ব্যাপারে এরা সবাই নিশ্চিত।
বড় ছেলে বলাই। তিনি নিজে ষাট পেরিয়েও সমবয়সি
সুনীলের বয়স তার ছেলের সমান ভাবেন। উৎপল দত্ত যেভাবে ছবি তে অবাক হতেন, বলাই ও তেমনি
খেজুর গুড় দেখলে অবাক হন, গঙ্গা ছাড়া নদী হয়না বলেই তাঁর ধারনা, জঙ্গল বলতে
ভবানিপুর আর পাহাড় বলতে ধাপা,
এই নিয়েই থাকেন। মেজ জন কালু, তিনি একটি বাংলা ছায়াছবির অ্যাসিস্ট্যান্ট
ডিরেক্টরের সহকারি ছিলেন, তাই তাঁর চিন্তা ভাবনা অবশ্যই অন্য ধারার। ছোট জন অচিন্ত্য, ওরফে মাধু
বা মাদু, তিনি সখের সাহিত্যিক, বই লেখার সময় তাঁর নাম হয়ে যায় অচিন্ত্যেশ
বসু, একবার একটা হাভানা চুরুট উনি ছ দিন ধরে খেয়েছিলেন, এ আমাদের
অনেকেরই নিজের চোখে দেখা। বোনদের আমি দেখিনি, তেমন বলতে পারবো না, তবে তাদের
ছেলেদের দেখেছি, তাদের নিয়েও ডকুমেন্টারি বানাবার কথা ভেবেছিলাম এক সময়ে।
এরই মাঝে, সেজ জন, অসীম কাকু, কেমন যেন আলাদা। বাকিদের যখন নোহারীর প্রতি
তীব্র বিদ্বেষ, অসীমকাকু নোহারী আর সেখানের দুর্গা পুজোকে একদম আঁকড়ে ধরেছিল
যেন। বাকিরা যে নোহারী কখনো আসতেন না, তা নয়। কস্মিন কদাচিৎ মাতা ঠাকুরানির কৃপা
হলে তাঁরা আসতেন দল বেঁধে, তবে সেই আসা কিছুটা দেখন্দারি আর কিছুটা সার্কাস দেখার মেন্টালিটি
নিয়ে। মাদুকাকা কিছুটা বাইরে এর,
আস্তে আস্তে নোহারীকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল তার, কিন্তু অসীমকাকু? সে অদ্ভুত
ভাবে প্রহ্লাদ এর মতন নোহারী প্রেমিক, আর বাকি বংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা
তার চোখে পড়ার মতো। ডেডিকেশন কি জিনিস, সেটা অসীমকাকুকে দিয়ে উদাহরন দেওয়া হতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা, অসীমকাকু সেনাপতি নয়, কিন্তু সবথেকে বেশী কাজের মানুষ এই অসীমকাকুই।
অসিমকাকু চাকরি করতো কাস্ট্মস এ। তার সুবাদে
নানা ভাবেই কালো টাকা রোজগার এর উপায় ছিল তার। কিন্তু কোনদিন কারুর থেকে অসৎ উপায়ে
এক পয়সাও নেয়নি সে। সিগারেট খেতে ভালোবাসতো খুব। বিদেশি সিগারেট পেলে নিয়ে আসতো ডক
থেকে, নিজেও খেত,
সমবয়সী দাদা ভাইদের খাওয়াতো, একটু বড় ভাইপো/ভাগ্নে দের, মানে আমার
দাদাদেরও খাওয়াতো। বরাবরের সঙ্গী ছিল ষাটের দশকে কেনা একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ, সঙ্গে বাঁধা
একটা জলের বোতল, আর তার সঙ্গে বাঁধা একটা হুইশেল। হুইশেলটা কেন থাকতো সেটা জানতে
চাওয়ায় একবার বলেছিল ওটা নাকি সিকিওরিটি মেজার, কিন্তু কিসের সিকিওরিটি, সেটা কেউ
জানতে পারেনি। অসীমকাকুকে রাগিয়ে দেওয়া যেত খুবই সহজে, আর বিয়ের
কথা বললেই সে আলোচনা চলতেই থাকতো।
আমাদের পুজোর অনেক নতুন জিনিসই অসীমকাকুর
অবদান। নোহারীতে প্রথম একসঙ্গে একশো আট প্রদীপ দিয়ে আরতি করার জন্য অসীমকাকু কলকাতার
থেকে বানিয়ে আনলো একছড়ায় একশোআট প্রদীপের স্ট্যান্ড। ডাকের সাজ কি জিনিষ, তা নোহারীকে
অসীমকাকুই দেখিয়েছে। ঠাকুরের নতুন চামর লাগবে? অসীমকাকুই ভরসা। নতুন ডে লাইট লাগবে? অসীমকে বল।
ঠাকুরের জন্য কিং সাইজ হাতপাখা?
সেও অসীমকাকু। এমনকি আমাদের পুজোতে কুমারী পুজোর চল ও অসীমকাকুই
করেছে, বেলুড় মঠের ঢঙ্গে। কিন্তু এই সবই করেছে নিজে নিজেই – কাউকে কোনদিন
অর্ডার করতে দেখিনি অসীমকাকুকে।
প্রত্যেক পুজোয় আমাদের অ্যাট্র্যাকশান থাকতো
অসীমকাকুর আনা বাজি। মস্ত হান্টার,
রঙ বেরঙের হাউই, তুবড়ি, তারাবাতি, এমনি রঙমশাল – কি না থাকতো
তাতে। আমাদের লাইন করে দাঁড়িয়ে থলের থেকে বের করে দিতো বাজিগুলো, আমরা মহানন্দে
পোড়াতাম। হান্টারগুলো কাজে লাগতো অন্ধকার রাস্তায় বিসর্জন দেওয়ার সময়, দিনের আলোর
মতো আলো হতো তাতে। গাড়ীতে উঠে ঠাকুর ধরার কাজ দুলালদা, দাদা, ছোড়দা – এরা করতো, কিন্তু ঠাকুর
জলে নামানোর পরে সেই অসীমকাকু।
আমাদের বংশে অসীমকাকুর সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই
বসু বাড়ির ইতিহাস সম্বন্ধে তার রিসার্চ – সম্পূর্ণ নিজের টাকায় আর নিজের উদ্যমে সারা
বাংলা ছুটে বেড়িয়ে সংগ্রহ করা সে ইতিহাস, নিজের টাকায় ছাপা সেই বংশলতিকা নিয়ে কেউ কেউ
দশ টাকাও দিতে চাইতো না তার জন্যে। কিন্তু আজকে আমরা এত কথা যে জানি, তার একমাত্র
কারন অসীমকাকু।
অসীমকাকুর ডেডিকেশন এর আরেক নমুনা দিই – আমার ঠাকুমা
মারা গেছেন। শ্রাদ্ধ হবে নোহারীতে। আমি একদিন একটা গরুর গাড়ীতে চেপে এমনিই চলে গেছলাম
বগড়ী রোড। দেখি ট্রেন থেকে নামলো অসীমকাকু। খালি পা, উস্কো খুস্কো না আচড়ানো চুল, গালে খোঁচা
খোঁচা দাড়ি। কোমরে বেল্ট এর বদলে নারকোল দড়ি, কারন চামড়ার জিনিস অশৌচের সময় নাকি পরতে নেই।
এই ছিল অসীমকাকু।
শেষ বয়সটা খুব কষ্টে কেটেছে অসীমকাকুর। সমস্ত
টাকা পয়সা শুনেছি বেহাত হয়ে গেছলো। বছর কয়েক আগে আমার বাবা যখন খুব সিরিয়াস অবস্থায়
অ্যাপোলো তে ভর্তি, এক অসীমকাকু ছুটে এসেছিল বাবাকে দেখতে, বেলেঘাটা
থেকে পায়ে হেঁটে, কারন তার সব টাকা তখন ভাই, ভাইপো আর ভাগ্নেদের কাছে, তারা কেউ
তাকে বাস ভাড়ার টাকাটাও দেয়নি,
কিন্ত দেখা তাকে করতেই হবে, তাই হেঁটেই এসেছে, এমনি তার
ভালোবাসা। শেষ দুবছর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছলো, অনেক সময়ে দেখে চিন্তেই পারতো না। অবশেষে
ঘরের এক কোনায় ভাঙ্গা তক্তপোষে শুয়ে নিতান্ত অনাদরে মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল
পুরন্দর খাঁর অন্যতম সেরা বংশধর। আমরা সেই চলে যাওয়ার কথাও জানতে পারলাম সে চলে যাওয়ার
মাস তিনেক পরে।
এবারে পুজোতে
বিসর্জনের সময় যখন রাস্তার কাদায় জেনারেটার বওয়া ট্র্যাক্টার আটকে গিয়ে আলো পৌঁছল না
পুকুর অবধি, হঠাৎ মনে হল, অসীমকাকু থাকলে ঠিক এই সময়ে জ্বলে উঠতো
একটা হান্টার, আলোয় আলোময়
হয়ে উঠতো চারদিক, আর আমরা অসীমকাকুর
ভাঙ্গা গলার সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠতাম “বলো বলো দুর্গা মাই কি – জয়! আসছে বছর, আবার হবে”। অন্ধকার
পুকুরের পাশে দাঁড়িয়েও গা টা একটুও ছমছম করলো না এটা ভাবতে গিয়ে, শুধু মনটা আমার কেমন যেন ভিজে ভিজে
হয়ে রইল বেশ অনেক্ষন। সেটা মা চলে গেলেন বলে, নাকি অসীমকাকুর জন্য, তা ভেবে দেখিনি আর – কিই বা হবে?