চেন্নাই ও এক বন্ধু
মায়ান সভ্যতার ২০১২র
গল্পটা তখনো লাইম্ লাইটে আসেনি, বিংশ শতাব্ধীর শেষ দিকে পৃথিবী তখন কম্পমান অন্য
ভয়ে – তার নাম ওয়াইটুকে মিস্। অতিহিসেবি মার্কিনরা ডেট
ফিল্ডের দু খানা বাইট বাঁচাতে গিয়ে সারা দুনিয়াকে প্রায় শেষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে,
নাকি নতুন ব্যাবসার দিগন্ত খুলে দেবে বলেই এমন করেছিল, তাই নিয়ে পৃথিবী তোলপাড়।
এমন একটা সময়ে, ১৯৯৮ এর ১৯ জানুয়ারি, আমি চল্লাম চেন্নাই। মাদ্রাজ এর আগেও গেছি,
একবার নয়, দুবার। ১৯৯০ তে আমাদের ফুল ফ্যামিলি আর মেজোজেঠুর ফুল ফ্যামিলি দক্ষিন
ভারত ভ্রমণে গেছলাম, সেবার এক রাত্রি ছিলাম, কিছুই দেখিনি প্রায়, শুধু দুটো
উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলাম। তার একটা হল মিলিটারি হোটেল খুঁজে বের করেছিলাম যেখানে
পরোটা আর মাংস আমাদের এখানের মতোই খেতে, আর অন্যটা হলো, রাত্রে বেলায় আমি আর বাবা
একটা রুমে ছিলাম, সেই রাত্রেই বাবাকে জানিয়ে ছিলাম যে আমি একজনকে নিয়ে সংসার করার
প্ল্যান করছি ফিউচারে, মা কে যেন ম্যানেজ করে নেয়। এর পরে সেবছরই আরেকবার গেছলাম
মার্চে, শঙ্কর নেত্রালয়ে, একদিন থেকে ডাক্তার দেখিয়ে পরের দিনই ফেরার ট্রেনে চেপে
বসেছিলাম। কিন্তু চেন্নাই, অর্থাৎ নাম বদলের পরে, সে এই প্রথমবার, তাও আবার একা।
অফিসের পেটি ক্যাশ
যিনি দেখতেন, ঘোষবাবু, উনিও মার্কিনীদের মতোই হিসেবি মানুষ, ফান্ড নিয়ে সদাই
চিন্তিত, এমনকি একবার কেউ ওনার পুরো নাম জিগ্যেস করাতে আনমনে বলেছিলেন “এখন তো ফান্ড নেই ভাই, না এলে কিচ্ছু বলা যাবে না”। অতএব পাছে ফান্ড আগে বেরিয়ে যায়, সেই ভয়ে টিকিটটা মোটেই সময়ে কাটা হয়নি। তখন
কলকাতা-মাদ্রাজ ডাইরেক্ট ফ্লাইট একখানাই, আর তাতে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ঘেমো
মাসীমারা গোমড়া মুখে দয়া করে কিছু আধবাসি খাবার দাবার দিয়ে থাকেন বটে, কিন্তু ও
ছাড়া উপায় নেই বলে সে ফ্লাইট সবসময়েই ওভার বুকড্। শেষ মুহূর্তে সঞ্জীবদা অনেক
চেষ্টা চরিত্র করে জেট এয়ারলাইন্সে একখানা টিকিট যোগাড় করে দিলো, কলকাতা-হায়দ্রাবাদ-চেন্নাই,
হায়দ্রাবাদে প্রায় পৌনে দু ঘন্টার ব্রেক। যাকগে, এক ট্রিপে দু খানা প্লেনে চাপা
হবে, এ আর মন্দ কি, এই ভেবে বেরিয়ে পড়লাম, পকেটে হাজার পাঁচেক টাকা, ঘোষবাবু অনেক
কষ্ট করে দিয়েছেন। অসুবিধে নেই, ক্রেডিট কার্ডও আছে, উনিশ হাজার টাকা ক্রেডিট
লিমিট, তাতে সপ্তাহ দুয়েক আগে তন্দুর হাটে শ চারেক টাকার খেয়েছিলাম, বাকিটা
পুরোটাই আছে, তাই নিজের মাপকাঠিতে বড়লোক আমি।
অফিস থেকে যখন
বেরিয়েছি, তখনো কন্ট্যাক্ট ডিটেলস আসেনি, তাই হায়দ্রাবাদ পৌঁছে এস টি ডি বুথ থেকে ফোন
করলাম একটা, ক্লায়েন্ট অফিসের ঠিকানা ফোন সবই পাওয়া গেলো। থাকার ব্যাপারটা ওরাই
জানিয়ে দেবে, তাই নিশ্চিন্ত। হায়দ্রাবাদ থেকে প্লেন যখন উড়লো, সূর্য তখন দিগন্তের
খুব কাছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই আকাশ, নিচে মেঘ, পাঁশুটে রঙের, তাতে হাল্কা কমলা রঙ
ধরেছে দিগন্তের ধারে, তারপরে আসতে আসতে সিঁদুরে লালের দিকে চলে গেছে। আমার পায়ের
কাছের মেঘ গুলো কিন্তু সাদা। মাথার ওপরে আকাশটা পুরো কালো। সূর্যটা খুব ছোট, মনে
হয় যেন অনেক দুরে, কিন্তু তার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না, এত উজ্জ্বল। পুরো
জিনিসটায় কোথাও শুরু নেই, শেষও নেই। মঙ্গলগ্রহের কাল্পনিক ছবির সাথে কোথাও অমিল
নেই। হাত নিস পিস করছে ক্যামেরাটা আনিনি বলে। গাড় নীল পোষাক পরা দারুণ সুন্দরী এক সেবিকা
শরবৎ দিয়ে গেলো স্মিত হেসে, গায়ের রংটা নির্ঘাত ফোটোশপে বানানো, ঢক ঢক করে খেয়ে
নিলাম এক মিনিটে, নাহলে অভিমান করতে পারে, আদর করে দিয়েছে না? ঘন্টা খানিকের
মধ্যেই প্লেন ল্যান্ড করলো, ঘোষনা হল –কামারাজ এয়ারপোর্ট,
চেন্নাইমে আপকা স্বাগত হো। হমে আশা হ্যায় কি আপকা ইয়াত্রা সুখদ রহি। বাহার কা
তাপমান ত্যাঁয়ত্রিস ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্যায়।
ত্যাঁয়ত্রিস? পাঁয়তাড়া
হচ্ছে? জানুয়ারির উনিশ তারিখে ত্যাঁয়ত্রিস? গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা লিমিট আছে
তো, নাকি? ফারেনহাইট বলতে গিয়ে সেলসিয়াস বলল? প্লেন থেকে নেমেই সব আশঙ্কা সত্যি হল
– প্যাচপ্যাচে গরম, ফুর ফুর করে ভারি ভারি একটা হাওয়া দিচ্ছে, লাউঞ্জে এসি নেই,
বড় সাইজের দু ব্লেডের ফ্যান ঘুরছে ভোঁ ভোঁ করে, আর সব জায়গাই লেখা আন্নাদুরাই এয়ারপোর্ট,
কামারাজ লেখা খুব কম যায়গায়। সামনে প্রি পেড ট্যাক্সি বুথের ডানপাশে একখানা এসটিডি
বুথ, তাতে এক নিকষ কালো স্বাস্থ্যবতি ভদ্রমহিলা কুকুর বাঁধার চেনের মতো মোটা একটা
হলদেটে সোনার হার পরে মাথায় মাফলার বেঁধে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। বছর দশেক আগে শেষ
যেবার চেন্নাই এসেছিলাম, সেই ট্রিপের লার্নিং হল, এখানে আমার চেনা কোন ভাষাতেই
পুরো সেন্টেন্স বলতে যাওয়া বৃথা, জাস্ট দরকারি শব্ধগুলো বলো, আর বাকিটা সাইন
ল্যাংগুয়েজ। “ফোন?” বলে ভুরু কোঁচকাতেই
ভদ্রমহিলা ‘না’ সুচক মাথা নাড়লেন,
অর্থাৎ হ্যাঁ।
ঘড়িতে বাজে ৬টা, বুথে
ঢুকে পড়ে ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন লাগালাম। ওপাশে ফোনটা ধরতেই জিভটা একটু দাঁত দিয়ে
কুরে নিয়ে খুব স্টাইলিশ ভাবে বললাম “মে আই স্পিক টু
মিস্টার এস রামাকৃষ্ণান?” তখনো জানতাম না, মাদ্রাজের যেকোনো বড় অফিসে অন্ততঃ
সাতষট্টি জন রামাকৃষ্ণান থাকেন, তাদের মধ্যে অন্তত বাইশ জনের প্রথম নাম এস। উত্তর
এলো “রামাকৃষ্ণান ওয়ানদে?” সিকিওরিটি ফোন ধরেছে,
অফিসে ওরাই ফোন ধরে ওখানে, তাদের বললাম “অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার
রামাকৃষ্ণান”। না। তিনি নেই। অন্য কোন রামাকৃষ্ণান? না, তাঁরাও
কেউ নেই। এল্লা রামাকৃষ্ণান ইল্লে সার। অফিসে কেউ নেই। কারুর নাম্বার দাও?
মুড়িয়াদে সার। মরিয়া হয়ে সিকিওরিটিদের হেডকেই ধমকাতে লাগলাম “মোবাইল নাম্বার? আদার নাম্বার? নো নাম্বার? কন্ট্যাক্ট হাউ? হু স্পিক্স?
পুলিশ? ফাইন? পেনাল্টি? পানিশমেন্ট?” – এসব বলে। পানিশমেন্ট শুনে ভদ্রলোকের কি হল জানিনা, একটা ল্যান্ডলাইন নাম্বার
দিয়ে দিলেন। সতেরো টাকা সত্তর পয়সা বিল হয়ে গেছে ততক্ষনে, এবার অন্য নাম্বারটায়
ফোন করলাম। কপাল ভালো, ধরলেন এক মহিলা যিনি ইংরেজি বলেন ভালই, তিনি রামাকৃষ্ণানের
স্ত্রী, কারন নাম্বারটা রামাকৃষ্ণানের বাড়ীর, তবে ওনার নাম শ্রীবিদ্যা, সারদামনি
নয়। তিনি জানালেন রামাকৃষ্ণান অফিসের একটা পার্টীতে গেছেন, রাত এগারোটার আগে
ফিরবেন না। তাহলে আমি কি করবো? উনি সাজেশন দিলেন, আজকের রাতটা কোনো হোটেল এ ঢুকে
পড়ে ওনাকে সেখানের নাম্বারটা জানিয়ে দিতে, যাতে রামা বাবু ফিরে ফোন করতে পারেন
আমাকে। ভালো কথা, কিন্তু থাকবো কোথায়? সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে গ্রেট হোটেল আছে শ
খানেক টাকায়, কিন্তু সেখানে থাকা কি এই অধুনা একজিকিউটিভের শোভা পায়? বলতে হয়নি
সেকথা, শ্রীবিদ্যা নিজেই জানালেন ক্লায়েন্ট অফিসের পাশেই এক খানা ভালো হোটেল আছে,
নাম হোটেল রঞ্জিৎ, সেখানেই থাকতে, কারন তাতে আমার যাতায়াতের সুবিধে হবে। অতীব সুপরামর্শ,
অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন টা রাখলাম, তারপর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম প্রি-পেড
ট্যাক্সির লাইনে।
রঞ্জিতের ভাড়া দাঁড়ালো
একশো সত্তর, স্লিপে গাড়ীর নম্বর দেখে খুঁজে নিয়ে সটান উঠে পড়লাম ব্যাগ সুটকেস
নিয়ে। ড্রাইভার নেই, হয়তো হিসু করতে গেছে। বসে আছি, আর মনে মনে গাল পাড়ছি দুনিয়ার
সবাইকে, বাঁ দিকের জানলা দিয়ে সাদা জামা খয়েরী প্যান্ট পরা একটা লোক এসে বলল “সোলুঙ্গে সার”। আমি কিচ্ছু কিনবো না, আমার গাড়িও বুক করা, আমি বুক
চিতিয়ে বললাম “থ্যাঙ্ক ইউ, নট নীডেড”। লোকটা আবার হেসে আরো
একটু নরম সুরে বলল “ইন্না স্যার, সোলুঙ্গে?” আমি এবারে বিরক্ত। শালা, আচ্ছা জ্বালা তো? নেব না বলছি, তাও খোঁচাচ্ছে?
খেঁকিয়ে উঠলাম “আই টোল্ড ইউ আই ডোন্ড নীড এনিথিং, ডিড্ন্ট আই?” লোকটি হাতের ঝাড়নটা লম্বা ভাঁজ করে কলারের ওপরে চাপালো, তারপর ড্রাইভারের
দরজা খুলে, গাড়ীর চাবি পকেট থেকে বের করে চাবির খোপে লাগিয়ে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার
বলল “সোলুঙ্গে সার?”। আমি মিনিট খানেক
নিলাম ব্যাপারটা বুঝতে, তারপর একবার মুচকি হেসেই আবার গম্ভির হয়ে গিয়ে বললাম “হোটেল রাঞ্জিৎ”।
সোলুঙ্গে সার এর বয়স
বছর পঁয়ত্রিশ, নাম যথারীতি রাজু – আমি এর আগে দুবার, আর
পরে অসংখ্য বার দক্ষিন ভারতে গেছি, অন্ততঃ দুশো বার গাড়ী নিয়েছি, এর মধ্যে বেশ
পাঁচ ছয় বার ছিল রহিম, একবার আলতাফ, বার দুয়েক রঘু, একবার মুরুগান আর একবার
মীনাসুড্ডি, কিন্তু বাকি সব বার আমার বাহন চালকের নাম রাজুই হতো। এই রাজুদের
গেঞ্জি-জাঙ্গিয়াই আমাদের এখানে পরা হয় কিনা তা বলতে পারবো না, কারন এরা গেঞ্জি
পরেনা, সবাই নেটের ছকোনা ফুটো ওয়ালা হাত কাটা অন্তর্বাস পরে, ওপরে ইনভ্যারিয়েব্লি
সাদা জামা, সামনে পকেট। নিম্নাঙ্গে কেউ ফুল প্যান্ট, কেউ বা মালকোঁচা মারা লুঙ্গির
মতো করে পরা সাদা ধুতি। রাজু সারা রাস্তা গল্প করলো, আমিও করলাম, যদিও একে অপরের
কথা বোঝার ঝামেলা দুজনেই করিনি। বরং রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম মন দিয়ে। চওড়া
রাস্তা, কোথাও ভাঙ্গা নেই, কুচকুচে কালো পিচ, ধুলো নেই, মাঝে সাদা লাইন দেওয়া,
সবাই নিয়ম করে লাইনের এপার দিয়ে যাচ্ছে। ত্যাঁয়ত্রিস ডিগ্রীতেও স্কুটারের পিলিয়ন
রাইডারের মাথায় উলের স্কার্ফ, ট্রামের মতো দু খোপ ওয়ালা বাস, এমনি বাস ও আছে, সবুজ
রঙের, তাতে জানলায় কাঁচের বদলে তাঁবুর কাপড়ের খড়খড়ি লাগানো। আর আছে অসংখ্য অটো,
মিটার দেওয়া। বেশ কিছু লম্বা আর উঁচু বাস গেলো, তার চারিদিকে লাইট দেওয়া, লং রুটের
হবে, ঝকঝকে। গোটা কয়েক ট্রাক পেরিয়ে গেলো, মস্ত লম্বা, অশোক লেল্যান্ডের, তাদের
একটার সামনে ইংরেজিতে লেখা ইয়েস উই ইয়েম ট্রান্সপোর্ট (Yes Wee Yem) – বুঝলাম মালিকের বা তার ছেলে-মেয়ের, অথবা শ্বশুরের,
শর্ট নাম SVM, তার নামেই
নাম। অনেক দোকান দুপাশে, কোনো দোকানেই ঠিকানা, যায়গার নাম, কিছুই দেওয়া নেই। একটা
সিগারেট বের করেছি, ধরাতে যাবো, রাজু বলল “সার, রাঞ্জিথা হোটেলা
ইঙ্গে সার”।
রাজুকে টা টা করে
রাঞ্জিথাতে ঢুকলাম। ভালো হোটেল, ঝকঝকে চকচকে। ডবল বেড সিঙ্গল অকুপ্যান্সি, ইয়েসি
বারশো, নন ইয়েসি আটশো। ইয়েসিই নিলাম, যা পচা গরম! কার্ড অর ক্যাশ? কার্ড। কার্ড টা
চাইলো একবার, কি সব দেখে কাকে একটা ফোন করে কি সব বলল, তারপর ফেরত দিয়ে দিলো। রুম
এ ঢুকলাম – বেশ ভালো রুম – এমাথা থেকে ওমাথা
কার্পেট, সুন্দর সাদা চাদর, বালিস, বাথরুমে বাথটাব, ঘরে সোফা, টি টেবিল। চা চলে এলো
একটু পরেই, খেতে খেতে প্রথমে বাড়িতে খবর দিলাম, তারপর শ্রীবিদ্যাকে ফোন করে জানিয়ে
দিলাম আমি রঞ্জিৎ-এই উঠেছি, রুম নাম্বার দুশো বারো। রাতের খাবার আনিয়ে নিলাম,
ফ্রায়েড রাইস, ব্ল্যাক ডাল, চিকেন চেট্টিনাড, স্যালাড। রাত সাড়ে এগারটায় রামাকৃষ্ণান
ফোন করলেন। উনি কালকে থাকছেন না, কিন্তু অফিসে জি নাগারাজু থাকবেন, তিনিই সমস্ত
বন্দোবস্ত করবেন। সে নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে হল না তখন, কালকেই দেখা যাবে, কারন
স্টার মুভিসে একটা অদ্ভুত ভালো ছবি প্রথমবার দেখছিলাম তখন, কিয়ানু রীভসের – নাম “আ ওয়াক ইন দ্যা ক্লাউডস”। ছবি শেষ হল, মনটা উদাস হয়ে গেলো, বউকে ফোন করতে ইচ্ছে হল কিন্তু এতো রাতে
সামনের দোকান ডেকে দেবে না বলে ক্ষান্ত দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে
নিত্যকাজ সেরে ‘আ ওয়াক ইন ইন দ্যা ক্রাউডস’ শুরু হল। এক হাতে একটা ফাইল, অন্য হাতে একটা চিরকুট, তাতে লেখা এপেক্স প্লাজা,
নুঙ্গাম্বক্কম। যাকেই দেখিয়ে জানতে চাই এটা কোথায়, সবাই এমন করে পালায় যেন ভিক্ষা
চাইছি। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেলো তো? একটা দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলাম।
দোকানদার তিনবারে “উইলসা?”, “প্যাকেটা?”, “ঊর প্যাকেটা?” জিগ্যেস করে তবে সিগারেট দিল, কিন্তু চিরকুটটা দেখাতেই এক গাল হেসে বলল “ইংলিস তেরিয়াদে সার”। শালা, ইংলিশ, সেটা বোঝে, কিন্তু জানে না? ন্যাকামি
যত্তো! ভাবছি হোটেলে ফিরে গিয়ে অফিসে ফোন করবো, সামনে ল্যান্ডমার্ক বলে একটা দোকান
দেখে ঢুকে পড়লাম। বেশ বড় দোকান, একদিকে তার মিউজিক স্টোর, অন্য দিয়ে খেলনা, বই
ইত্যাদি। সেখানে একটি মেয়েকে জিজ্ঞ্যেস করলাম – এপেক্স প্লাজা চেনো?
মেয়েটি বলল হোয়াই নট? দিস ইস এপেক্স প্লাজা ওয়ানলি সার! বোঝো ব্যাপার!
ওই বিল্ডিং এর দোতলায়
অফিস আমার ক্লায়েন্টের। সিঁড়ি দিয়েই উঠলাম। সেখানে আবার তামিলভাষী সিকিওরিটিদের
টপকে একজন বছর চল্লিশের কড়া ধাতের রিসেপ্সনিস্ট মহিলার কাছে গিয়ে খোঁজ করলাম – “মিস্টার জি নাগারাজু?” ঊনি ইন্টারকমে ডেকে
দিলেন, মিনিট খানিকের মধ্যে হাজির হলেন গাজুলা নাগারাজু, আই টি অফিসার। আমার সাথে
করমর্দন করে নিয়ে গেলেন নিজের ডেস্কে। মাঝে একটা দরজা ছিল, সেখানে উনি পার্সটা
পকেট থেকে বের করে তুলে ধরতেই দরজার লক্ খুলে গেলো, আমরা ঢুকে যেতেই ফের বন্ধ। কাজ
শুরু হল। মাঝে আমি একটা সিগারেট খেতে গেছলাম, ফেরার সময়ে দরজায় এদিক ওদিক চেয়ে লুকিয়ে
আমার পার্স দেখালাম, কাজ হল না, তাই বাধ্য হয়ে আবার রাজু কে ইন্টারকমে ডাকলাম।
রাজু দরজা খুলে দিয়ে এবারে আমাকে একটা কার্ড দিলেন আমার নিজের ব্যবহারের জন্য, তখন
বুঝলাম এ দরজা মানিব্যাগে খোলে না, ব্যাগে কার্ড থাকলে তবেই খোলে। সেই প্রথম
প্রক্সিমিটি কার্ড কাকে বলে দেখলাম।
কাজ শুরু করেছিলাম,
কিন্তু খানিক্ষন পরে বোঝা গেলো, আমি যে কাজের জন্যে ওখানে গেছি, ওনারা তার জন্য
এখনও তৈরি নন। তিন চার দিন সময় লাগবে। রাজু সাজেস্ট করলেন, আমি বরং এই ফাঁকে
পন্ডিচেরির কাজটা সেরে আসতে পারি। আমি ভাবলাম, সেই ভালো। একটু পরে ফাইল পত্র
গুছিয়ে “ওকে, সি ইয়ু নেক্সট মান্ডে” বলে বেরিয়ে এলাম, কালকের গণেশ ট্রাভেলসএর গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দিয়েছে এরাই, যদিও
পয়সা আমাকেই দিতে হবে। অফিসে ফোন করেছিলাম, খরচাপাতি কিভাবে করবো সেটা জানতে। বস
বলল পন্ডিচেরিতে ক্লায়েন্টের তরফের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আসবেন। উনি ব্যাঙ্গালোরের
বাঙালী, নাম পিয়া রায়। ওখানের খরচা উনিই দেবেন, সো নো চিন্তা। মহানন্দে একটা
পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা কিনলাম পাশের দোকান থেকে, রোল ভরে নিলাম – ক্রেডিট কার্ডে। পরের দিন ভোরে পন্ডিচেরি। হোটেলে পেমেন্ট করার সময়ে ক্যাশেই
করে দিলাম, অল্প টাকার মামলা!
পন্ডিচেরির দিন কটা
ঘটনাবহুল নয়। পিয়া এলেন, আদতে কলকাতার মেয়ে, বালিগঞ্জের, চাকরিসুত্রে ব্যাঙ্গালোরে
থাকেন, বাবা মা কলকাতাতেই। এখনো বিয়ে করেন নি। আমারই বয়সী, ইন ফ্যাক্ট একটু ছোটও
হয়তো, বেশ বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেলো। ওখানে থেকে চেন্নাই এলাম একসাথেই। ফেরার পথে
মহাবলিপুরম, ওদের ভাষায় মামাল্লাপুরম, সেটাও দেখে নিলাম চট করে। দিন তিনেকে
চেন্নাইয়ের কাজ গুছিয়ে আমার কলকাতায় ফেরার দিন চলে এলো। অফিস থেকে হোটেলে ফেরত
এলাম, চেক আউট করতে হবে এবারে। পিয়াও ফেরত গেলেন গেস্ট হাউসে, ওনার ফ্লাইট পরের
দিন ভোরে, তাই সন্ধ্যেয় একটু কেনা কাটা করবেন বললেন। সন্ধ্যের মুখে গাড়ী এসে
রিপোর্ট করলো, ব্যাগপত্র নিয়ে নিচে নামলাম, ফাইন্যাল পেমেন্ট করে বেরিয়ে পড়বো
এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। হাজার ছয়েক বিল হয়েছে তিন দিনে, পামেন্ট করবো ক্রেডিট
কার্ডে। রিসেপশনের ভদ্রলোক বার কয়েক চেষ্টা করলেন কার্ড টা নিয়ে, তারপর বললেন “সার্ভিস ডিনায়েড সার!” বলে কি রে? টাকা পাবো কোথায়? খুব জোর হাজার টাকা
ক্যাশ আছে পকেটে। আগের বার থাকার সময়েও তো ক্যাশ দিয়েছি, পন্ডিচেরি যাওয়ার গাড়ী
ভাড়াও দিয়েছে, পাঁচ হাজার টাকাই তো, কতদিন আর যাবে? একবার ভাবছি ঘোষ বাবুর মতো
বলবো নাকি - ভাইটি, ফান্ড নেই, আর ফান্ড না এলে কিচ্ছু করা যাবে না - কিন্তু সে
কথা এরা শুনবে কেন?
অনেকদিন পরে
জেনেছিলাম, হোটেলে যতবার আমার কার্ড দেখতে চেয়েছে, ততবারই পাঁচ হাজার টাকা করে ব্লক
করে রেখেছিল, তাই ব্যালেন্স ছিল না আর – তখন তো আর এখনকার মতো
অনলাইন ডেবিটের সুবিধে ছিল না। যাই হোক, সে তো পরে। তখন তো নাজেহাল অবস্তা। কি করি?
ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন করলাম, নাগারাজু ধরলেন না। রামাকৃষ্ণান তখনো ট্যুরে। পিয়া
বেরিয়ে গেছেন অফিস থেকে। কি করবো? ঘামছি আর ভাবছি। কলকাতায় আমার অফিসে ফোন করলাম।
সবাই বেরিয়ে গেছে। আবার ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন করলাম, শেষ চেষ্টা। আপনাদের গেস্ট
হাউসের নাম্বার আছে? মহিলা বললেন চেন্নাইতে ওনাদের তিন খানা গেস্ট হাউস, কোনটা চাই।
তিনটেরই নাম্বার নিলাম। সৌভাগ্য আমার, প্রথমটাতেই যিনি ধরলেন, তিনি হিন্দি বোঝেন।
তিনি কনফার্মও করলেন পিয়া রায় ওখানেই উঠেছেন, এবং এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন, পায়ে
হেঁটে। সর্বনাশ! ভাইয়া, থোড়া বুলা দো ঝটাপট্, হিঁয়া আগ লাগ গেয়া! উনি ফোন নামিয়ে
রেখে ছুটলেন, পিয়াকে ধরে আনলেন ফোনের কাছে। বললাম সব বৃত্তান্ত, পিয়াকে। উনি বললেন
টাকা নিয়ে চাপ নেই, কিন্তু গাড়ী নেই, আসবেন কি করে? আমি হোটেলের লোকদের সবিনয়
অনুরোধ করলাম, সুটকেসটা বন্ধক রেখে আমাকে কি একটু ছাড়া যায়? ওনারা কিন্তু কিন্তু করছিলেন,
কিন্তু তারপর কি ভেবে যেন ছেড়ে দিলেন যাহোক। আমি গাড়ী নিয়ে রাস্তা চিনে গেস্ট
হাউসে পৌঁছলাম, পিয়া অপেক্ষা করছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন। হোটেলে পৌঁছে নিজের
ক্রেডিট কার্ড দিলেন, পেমেন্ট হল, আমি ওই গাড়ী নিয়েই বেরিয়ে গেলাম, পিয়াকে নিজের
দায়িত্ত্বে রেখে। যোগাযোগ নেই আজকাল আর, কিন্তু সত্যি বন্ধু বললে লিস্টে একদম
ওপরের দিকে পিয়ার নাম থাকবে, সেটা হলফ করে বলতে পারি।
চেক ইন কাউন্টারে যখন
পৌঁছেছি, তখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেন ছাড়তে আর মাত্র দশ মিনিট দেরি। আমাকে
পাত্তা দেওয়ার কথা না, কিন্তু অল্প ডিলেড ছিল বলে এক ভদ্রলোক টিকিট টা হাতে নিয়ে খুব
ধমকা ধমকি করতে লাগলেন। আমি দেখলাম উপায় নেই, কাঁদো মুখ করে পরিস্কার বাংলায় বলতে
লাগলাম “কাকু, খুব ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না, বিশ্বাস করো!” ভদ্রলোক একটু থমকে গিয়ে বললেন “নো ইংলিসা?” আমি আবার বাংলায় ফুল ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান দিয়ে বললাম “জানলে কি আর এই অবস্থা হয়? তুমিই বল?” ভদ্রলকের কিছু বুঝলেন
কিনা জানিনা, কিন্তু বাংলা শুনে রাগ কমে গেলো ঝপ করে, বললেন “ঊও কে, ওয়ানলি লাস্ট টাইম, আদার টাইম বোরডিং মুড়িয়াদে!” তারপর বোর্ডিং কার্ড প্রিন্ট করে ধপাস করে একটা স্ট্যাম্প মেরে বললেন “রান, দাউরো!” আমি ‘দাউরাতে’ ‘দাউরাতে’ বাসে উঠলাম, বাস ছেড়ে
দিল। প্লেনে উঠে যখন বসলাম সিটে, তখনো ঘামছি। কলকাতায় ল্যান্ড করার পরে মনে হল যেন
তিন দিন বাথরুম চাপা ছিল, এই রিলিজ হল।
তখন কে জানতো যে তার
এক মাস পরেই আবার সেই চেন্নাই যেতে হবে? আর সেই চেন্নাই ভালোও লাগবে? সে গল্প এর
পর।
6 comments:
Duronto..porer Chennai tar jonno wait kore roilam...
Thanks Riju!
Hooked on to your blog Bijit da.
Darun! Got the link of your Blog from a friend… superb… Cheers!
What an experience!
Reminds me of one of my visits to Assam Tea Gardens when I was escorted to Airport disguised as a patient in an ambulance during a curfew.
Good read. Excellent description.
Post a Comment