কামাখ্যায় ক্যারামতি
১৯৯৬ এ আমি যে
কোম্পানি তে চাকরি করতাম, তার পোষাকী নাম অন্য হলেও হরিবাবু কা দুকান নামেই তা বেশি
পরিচিত কলকাতার মাড়োয়াড়ী গুজরাটি ব্যবসায়ী মহলে। তা সে ওনাদের কি দোষ? হরি দার
পুরো নাম বালাসুব্রামানিয়াম হরি, আমরা দাদাই বলতাম, উনি শিবপুরের ইলেক্ট্রিক্যাল,
আমার দেখা সেরা মানুষদের মধ্যে একজন। কিন্তু তাঁর অন্তপ্রেনেউরিয়াল মাইন্ড নিয়ে
কলকাতার ব্যবসায়ী মহল সেই সময়ে তেমন উদ্বেলিত ছিল না। কম্পিউটার মা বিজনেস ছে,
অতএব দুকান তো ছে বটেই। তাই মাঝে মাঝেই ফোন আসতো – ইয়ে হারিবাবুকা দুকান
হ্যায় না?
সেই দোকানে আমি সিনিয়র
প্রোগ্রামার হয়ে ঢুকেছিলাম, ক্রমে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট আর কন্সাল্টিং পদে
উন্নতি হয়েছে। একবার গেটওয়ে নাইন্টি ফাইভ বলে একটা শো হল, ১৯৯৫ এ। সেখানে জন্যে অনেক
খেটে একটা ব্রোশিওর তৈরি করা হল, তার সামনের পাতায় সুদীপ সেন এক খানা ফাটাফাটি
বাস্কেটবল নেট করার ওয়াটারকালার ছবি এঁকে দিল, নিচে লেখা হল স্ট্রেচ। দুর্ধর্ষ মেসেজ, দারুণ লেখা, কেউ
পড়লেই ফটাফট আমাদের সফটওয়্যার কিনে ফেলার কথা। কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ছাপা হচ্ছিল,
হরিদা বললেন কালো অপয়া রঙ, আমরা বরং ওটা ডার্ক ব্রাউনে ছাপাই, তাই হল, দেখলাম মন্দ
লাগছে না। আমরা সবাই সেখানের স্টলে কম্পিউটার সাজিয়ে বসলাম, কিন্তু আমাদের অতি
প্রিয় অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার সেখানে এক কপিও যে বিক্রি হল না, তার থেকে বড় দুঃখ,
বেশ কয়েকজন এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন “ও স্টেরচ কিত্নে কা
হ্যায়?” হরি দার তাতে বিকার নেই, জ্যোতিবাবু উদবোধন করতে
এসেছিলেন, হরিদা তাতেই খুশি, ইউরিন্যালে আমার পাশে দাঁড়িয়ে চাপ ত্যাগ করতে করতে
বললেন “স্কিন টা দেখেছ? পিওর স্কচ ছাড়া ওটা হয়না!”
তা এমন নির্বিকার
মানুষের ও কয়েকটা দুর্বলতা ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক। হরি দার
ফ্যামিলি কলকাতায় আছে ওনার বাবার সময় থেকেই, কিন্তু কিছু শুদ্ধ তামিল বিশেষত্ব
বংশগত কারনেই বোধহয় ওনার মধ্যে রয়ে গেছে। উনি এইচ কে হেচ বলেন ইউরোপীয়দের মতো,
বাংলায় বোতাম বলতে গিয়ে বোতুম বলেন, অন্য তামিলিয়দের মতোই ভীষণ ধর্মভীরু এবং
তামিলনাড়ুর সাথে যুক্ত সবকিছুর ওপরেই অগাধ ভালবাসা। ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের
হেডকোয়ার্টার চেন্নাই তে, অন্যান্য জায়গাতেও মুলতঃ তামিলরাই মুখ্য আধিকারিকের পদে
আসীন, তাই এই ব্যাঙ্কের ওপরে হরিদার অগাধ আস্থা। সেই ব্যাঙ্কের একবার একটা কাজ
এলো।
কাজটা সামান্য।
ব্যাঙ্কে তখন কম্পিউটার ঢুকছে হুড়হুড়িয়ে, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কও সে দলে ভিড়েছে।
গুয়াহাটিতে ওঁদের আঞ্চলিক শাখা, সেখানেও এইচ সি এল পারসোন্যাল কম্পিউটার বেচেছে।
যে যাবে, তার কাজ হল রিজিওন্যাল ম্যানেজার ও অন্যান্য আধিকারিকদের একটা
প্রেজেন্টেশান দেওয়া “দৈনিক ব্যাঙ্কিং জীবনে মাইক্রোসফট অফিসের
প্রয়োজনীয়তা” এর ওপরে। একটু বাতেল্লা দিতে হবে, আর একটু অফিস আর
এক্সেল শিখিয়ে দিতে হবে, এক দিনের মামলা।
তখন আমার বিয়ে হয়েছে
বছর তিনেক, কিন্তু ছুটির অভাবে হানিমুন টা করা হয়ে ওঠেনি। আমার বউ ও মোটামুটি মেনে
নিয়েছে যে ওটা পরের জন্মে হলেও হতে পারে, এই জন্মে ওটার কোন চান্স নেই। কিন্তু
হঠাৎই একটা সুযোগ পেলাম। হরিদা একদিন আমাকে ডেকে বলল “বিজিৎ বোস, তুমি ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের কাজটা করে এসো”। এ কাজ যে কোনো কচি ছেলেও করতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার ব্যাঙ্ক, তাই একটু
সিনিয়ার লোক না পাঠালে কেমন দেখায় না? হরিদা আমার পদবী ধরে ডেকেছে মানে মুডও খুব
ভালো। আমি দেখলাম, এই সুযোগ, বললাম “যেতে পারি, কিন্তু তার
আগে তিন দিন ছুটি দিতে হবে”। অন্য কোনো সময়ে এক কথায় যেটা নাকচ হয়ে যায়, সেটাও
এবারে পাস হয়ে গেলো, আমিও ঝপ করে তিন দিন বৌকে নিয়ে দীঘা ঘুরে চলে এলাম, সেই
প্রথমবার – হানিমুন না হলেও, স্যাকারিন মুন তো বলাই যায়। আর
দীঘা থেকে ফিরেই আমি আবার স্যুটকেস গুছিয়ে ফেললাম। গুয়াহাটি।
বাড়ির ছেলে জীবনে
প্রথম প্লেনে চাপবে। খবরের কাগজের ক্লাসিফায়েডে বিজ্ঞাপন ছাপানোর মতো ব্যাপার না
হলেও বেশ বড়সড় ব্যাপার একটা। যদিও সকাল পৌনে দশটায় ফ্লাইট, বাবা আগের দিন হাফ কিলোমিটার
দুরের এক আধচেনা ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ী গিয়ে তাকে দাওয়াত দিয়ে এলো, পাছে
ট্যাক্সি পেতে অসুবিধে হয়। তিনি বললেন কুড়ি টাকা বেশি, আমরা তাতেই রাজী। বউ পাড়ার
ওষুধের দোকান থেকে কিছু ক্যালপল, ডিস্প্রিন, মেট্রোজীল আর দু পিস অ্যাভোমিন কিনে
আনলো। বোন ঈর্ষাভরা চোখে তাকাতে লাগলো আর বলতে লাগলো “অ্যাটলিস্ট কিছু একটা গিফট আনিস আমার জন্যে”। মা বলল “দেখিস বাবা, উল্টোপালটা কিছু খাস না যেন!”
আটই আগস্ট, ছটার সময়েই
ঘুম ভেঙ্গে গেছে, সাড়ে সাতটায় বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আমি প্লেনে চাপবো,
কেউ সী অফ করবে না, তা কি করে হয়? তাই সঙ্গে বাবা, বৌ আর বোন। কুড়ি টাকা করে টিকিট
কেটে ভেতরে ঢুকল বাকি সবাই, আমি খুব কায়দা করে আমার টিকিটটা সি আই এস এফ কে দেখালাম, সে আড়চোখে দেখে বলল “যাও যাও!” কিন্তু ভেতরে ঢুকেই একটু কেলো হল, প্লেন নাকি কোথা
থেকে আসবে, সে এসে পৌঁছয়নি, তাই ফ্লাইট ডিলেড। ভালই হল, বেশ অনেক্ষন সবাই
এয়ারপোর্টে ঘুরে বেড়ালাম, এগারো টাকা করে সিঙ্গাড়া খেলাম, তারপর ডিসপ্লেতে আমার
ফ্লাইটের পাশে “চেক ইন” দেখাতেই আমি সবাইকে
টাটা করে ঢুকে পড়লাম সিকিয়োর্ড এরিয়া তে।
কাউন্টারে মাসিমা,
তিনি বললেন সুটকেস বড়, তাই ক্যাবিন লাগেজে না নিয়ে ব্যাগেজে দেওয়া ভালো, নাহলে পরে
আটকে দিতে পারে। পরে জেনেছি ওটা ডাহা মিছে কথা, কারন ওই একই স্যুটকেস আমি পরে
অন্ততঃ একশো বার ক্যাবিন লাগেজে নিয়ে গেছি। কিন্তু সে তো তখন জানিনা, তাই আবার
এক্সরে মেশিনের ওখান থেকে ঘুরে আসতে হল, ওরা একটা সাদা মোটা প্লাস্টিকের ফিতে
লাগিয়ে সীল করে দিলো, হ্যান্ডেলে একটা ট্যাগ ঝুলিয়ে দিল, আমি সেটাতে তৎক্ষণাৎ নাম
ঠিকানা লিখে ব্যাগেজে চালান করে দিলাম। আকাশী বোর্ডিং পাস পকেটে নিয়ে মাসীমা কে
থ্যাঙ্ক ইয়ু জানিয়ে আমি আবার ঘুর ঘুর করতে লাগলাম – একটু কফি খেলাম, একটা
সিগারেট, তারপর বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা দেশ, একটা টাইমস জার্নাল আর বউকে কদিন ছেড়ে
থাকার দুঃখ ভুলতে একটা ডেবোনেয়ার কিনে ফেললাম। একটু পরেই অ্যানাউন্স হল “আই সি ২২৯, সিকিওরিটি চেক ইজ অন, প্লিস রিপোর্ট টু গেট নাম্বার ওয়ান” – আমি হন্ত দন্ত হয়ে সেদিকে ছুট দিলাম।
ওপাশে একজন জলপাই
ড্রেস পরা বিহারী পুরুষ পর্দাওয়ালা খোপে ঢুকিয়ে যন্ত্রপাতি টিপেটুপে দেখে নিলেন,
আর তার পরে এক মহিলা ব্যাগ চেক করতে গিয়ে ম্যাগাজিনের নামটা দেখে চট করে আবার
ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। পুরো ঢুকল না, আধখানা বেরিয়ে রইল। আমি নির্বিবাদে সেসব
অত্যাচার সহ্য করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে একটা সোফায় বসবো বসবো করছি, এমন সময়ে একজন সাদা
শার্ট নেভী ব্লু প্যাট পরা নিপাট বাঙালী ভদ্রলোক আমার পথ রোধ করে বললেন “স্যার, প্লিজ চেক ইওর ব্যাগেজ” - তাঁর ডান হাত টা
একটা খোলা দরজার দিকে বাড়ানো। দরজা দিয়ে বেরোলাম, এটা একদম বাইরে, খোলা যায়গা।
সেখানে অসংখ্য স্যুটকেস রাখা আছে, আরো কিছু রাখা হচ্ছে। একটু খুঁজতেই আমার
স্যুটকেসটা পেয়ে গেলাম। ভালো করে দেখে নিলাম, ওটা আমারটাই কিনা – হ্যাঁ, এই তো, আমার নাম টাও লেখা আছে ট্যাগে। হৃষ্ট চিত্তে ফেরত এলাম।
ভদ্রলোক আবার জানতে চাইলেন আমি ব্যাগেজ আইডেন্টিফাই করেছি কিনা, আমি একটা স্মিত সবজান্তা
হাসি দিয়ে বললাম “ইয়েস প্লিস!”
একটু পরে ফ্লাইট
নাম্বারের পাশে “বোর্ডিং” লেখা পড়লো আর দুটো
কমলা লাইট ঘুরতে লাগলো, আর ওমনি একটা হই হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। সবাই হুড়মুড় করে
লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঠেলাঠেলি হতে লাগলো, কেউ কারুর পা পাড়িয়ে দিল, বাচ্চারা
ক্যাবলামির জন্য বকা খেলো, সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, পেছনের
ভদ্রলোক টেরিয়ে টেরিয়ে আমার ম্যাগাজিন
গুলো দেখার চেষ্টা করছিলেন, ট্রেনের স্বভাব বোধহয়, আমি একটু গার্ড করে দাঁড়ালাম।
বাস চলে এলো একটু পরে, পর পর দুটো, বাস ছাড়ার ঠিক আগে এক ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন
তাঁর দিল্লী টিকিট আর এটা গুয়াহাটির ফ্লাইটে তুলবে, তাই হন্তদন্ত হয়ে নামতে গিয়ে
বকা খেলেন অ্যাটেন্ড্যান্টের কাছে। শেষ অবধি দরজায় শেকল লাগিয়ে অ্যাটেন্ড্যান্ট
বাসের গায়ে দুবার চাপড় মারলো ঠিক ফরটিওয়ান বির কন্ডাক্টারের মতো, আর ওমনি বাস ছেড়ে
দিলো।
প্লেনের সামনে বাস
থেকে নেমে দেখি ওখানেও লাইন। মস্ত প্লেন, বোয়িং নয়, এয়ারবাস এ ৩০০। সিড়ির সামনে
আরেকবার টিকিট আর বোর্ডিং পাস দেখা হল। তারপর উঠে সীট খুঁজে বসে পড়লাম। বড় প্লেন,
তাই ২ বাই ৩ বাই ২ সিটিং, আজকের দিশি ফ্লাইটে খুব একটা দেখা যায়না। জানালা পাইনি, কারন চাইতে ভুলে গেছলাম। পাশের
ভদ্রলোক কে অনুরোধ করলাম, রাজী হলেন না। বাঙ্কের ওপর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে, আসলে ওটা
অক্সিজেন। দেখলাম একটা করে লাইট আছে ওপরে, পাশে ছোট্ট ফ্যান একটা, আর ওপাশে একটা
বোতাম, এয়ারহোস্টেসকে ডাকার। গরম লাগছিল একটু, ফ্যানটা বাড়িয়ে দিলাম পুরো। একজন
এয়ার হোস্টেস এসে হাসি মুখ করে আমার কোল থেকে ব্যাগটা নিয়ে বাঙ্কে তুলে দিল, আমার
দেখে মনে হল এটা ছোটমাসী বা দিদি হতে পারে, সো কল্ড মাসীমা নয় মোটেই, তাই রাগ
করলাম না।
দেখছি, লোকজন উঠছে,
কেউ নিজেই সীট খুঁজে নিচ্ছে, কেউ বা আবার এয়ার হোস্টেস কে জিগ্যেস করছে। একজন
মুসলিম ভদ্রলোক উঠলেন, দাড়ি আছে, মেহেন্দি দিয়ে রাঙ্গানো, গোঁফ নেই। মানুষের যদি
দাড়ি ছাড়া গোঁফ থাকতে পারে, তাহলে উল্টোটা হলেও ক্ষতি কি, এমন ভাবাই যেতে পারে,
কিন্তু কেন জানিনা ওটা দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় “দ য়ে - দোয়াত আছে,
কালি নাই”, তাই খালিই চোখ চলে যায় ওদিকে। ভদ্রলোক বয়স্ক,
মাথায় কুরুশের কাজ করা সাদা তাকিয়া টুপি, চোখে লালচে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে কলার
দেওয়া কামিজ, ঘিয়ে রঙের, নিচে ঘিয়ে সালোয়ার। চোখের ছানি অপারেশন হয়ে গেছে, তাই খুব
মোটা কাঁচ। একটু হাঁপাচ্ছেন দেখলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠেছেন বলেই বোধ হয়। আমার আগের রো
তে বসলেন, মাঝের তিনটে সিটের একটাতে। এক ভদ্রমহিলা একখানা ধুতি বাঁধা পোঁটলা কোলে
নিয়ে বসেছিলেন, এয়ারহোস্টেস ধমক দিয়ে সেটা কেড়ে নিয়ে বাঙ্কে রেখে দিল। একজন লম্বা
ভদ্রলোক, বোধহয় বোডো, পাশ দিয়ে চলে গেলেন জিন্স আর বুক খোলা সাদা শার্ট পরে, ঘাম
আর পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে, আড়চোখে দেখলাম ভদ্রলোকের মস্ত নখ দুই হাতেই। সাফারি
স্যুট পরিহিত একজন মাড়োয়াড়ি ব্যাবসাদার সিটে বসেই এমন মন দিয়ে বিজনেস টাইমস পড়তে
শুরু করলেন যে মনে হল উনি ওটা পড়তে পাবেন বলেই প্লেনের টিকিট কেটে গুয়াহাটি
যাচ্ছেন। কয়েকজন সামনের পকেট থেকে বই তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরলো। একজন বমি করার ঠোঙ্গা
টাও। লজেন্স এলো, খামচা খামচি শুরু হল।
এইসবই দেখছিলাম, এমন
সময়ে এক সিনিয়র মাসিমা কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন আমার সিটের কাছে। ওপরের
দিকে তাকিয়ে “২৮ বি, হু ইস বিজিট বোস?” বলে হুঙ্কার দিলেন। আমি সেই স্কুলের মতো হাত তুলে ফেললাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে এক
ধমক – “হোয়াই হ্যাভেন্ট ইউ
আইডেন্টিফায়েড ইউর ব্যাগেজ?” আমি মিনমিন করে বললাম “বাট আই ডিড্?” কিন্তু সে তেমন ধোপে টিকলো না। কড়া ধমকে আমাকে চমকে
চলে গেলেন তিনি, হাতে স্যুটকেসের ট্যাগ টা, অল্প ছিঁড়ে দিলেন কোনাটা। আচ্ছা বলুন
তো, আইডেন্টিফাই মানে ট্যাগের কোনা ছেঁড়া, সেটা আমি কি করে জানবো?
প্লেন ট্যাক্সিইং করে
রানওয়ের দিকে যাচ্ছে, এয়ারহোস্টেসরা হাত পা নেড়ে রোবটের মতো দেখাচ্ছেন বেল্ট কেমন
করে পরতে হয়, আর প্লেনে আগুন লাগলে কোন দিক দিয়ে পালাতে হবে, একটা হই হট্টগোলে
সেসব বন্ধ হয়ে গেলো। দেখলাম সেই বয়স্ক মুসলিম ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে গেছেন, চোখের
পাতা উল্টে আছে, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। প্লেন দাঁড়িয়ে গেলো। একজন ডাক্তার
ছিলেন যাত্রীদের মধ্যে, একজন গলা তুলে “এনি ডক্টর হিয়ার?” বলে চেঁচাতেই তিনি উঠে এলেন সিট ছেড়ে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাট্যাক! উনি একটা
ইঞ্জেকশান দিয়ে বললেন এক্ষুনি প্লেন থেকে নামালে সারভাইভ করতেও পারেন। এ টি সি তে খবর
গেলো, একটু পরে সিঁড়িওয়ালা গাড়ী আর অ্যাম্বুল্যান্স চলে এলো, পেছনের দরজা খুলে
নামানো হল ওনাকে, কিন্তু দরজা বন্ধ করে ফেরত আসার সময় দুজন এয়ারহোস্টেস বলাবলি
করতে করতে গেলেন “এক্সপায়ার্ড!”
প্লেন আবার আসতে আসতে
চলল রানওয়ের দিকে। মনটা এতো খারাপ হয়ে রইল, যে প্রথম ওড়ার উত্তেজনা টাই তখন
মন্দাক্রান্ত। খানিক্ষন রানওয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পরে ঘোষণা হল – “অল হ্যান্ডস অন কন্ট্রোল, টাইম টু টেক অফ!” আমার শরীরটা সীটের সঙ্গে সাঁটিয়ে দিয়ে প্লেন আটশো কিলোমিটার স্পিড তুলে কোন
ফাঁকে আকাশে উঠে পড়লো, প্রথমে একদিকে হেলে একটুক্ষন উড়লো, তারপর সোজা – উইন্ডো সিটের ভদ্রলোকের কানের পাশ দিয়ে দেখলাম, নিচের বাড়ী ঘর দোর সব পুতুলের
মতো লাগছে, কিন্তু গাড়ী চলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, আর অনেক অনেক রুপোলি দাগ – ওগুলো আসলে টিনের চাল। কলকাতা ছাড়িয়ে মেঘের ওপরে উঠে সীট বেল্ট বাঁধার সিগন্যাল
যখন নিভিয়ে দেয়া হল, খেয়াল করলাম আমার মুখটা নিজের অজান্তেই কখন যেন হাসি হাসি হয়ে
গেছলো, তখনো তাই হয়ে আছে।
এবারে মনে হল অনেকেই শুধু
বাথরুমে যাওয়ার জন্যেই প্লেনে উঠেছেন – পেছনের দুটো দরজার
সামনে লাইন পড়ে গেলো, দু একজন ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে দরজাতে নক করেও ফেললেন। কারন টা
বুঝলাম একটু পরে। খাবার এলো। লোকজন ওমনি লাফ দিয়ে পড়লো। সবাই সবকিছু খায়, এই প্রথম
দেখলাম। আমিও নিলাম খাবার। খুব একটা সুস্বাদু তা নয়, কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেলের
ছাপ মারা, তাই পেট ভরে খেয়ে ফেললাম, শেষে কফিটাও। জানালা দিয়ে একটা মস্ত নদী দেখা
যাচ্ছিল, পদ্মা হবে বোধহয়, কিন্তু হাল্কা মেঘ আর কুয়াশা, তাই খুব পরিস্কার নয়।
একটু পরেই প্লেন ল্যান্ড করলো।
গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট
কলকাতার তুলনায় অনেক ছোট, করোগেটেড শীট দিয়ে বানানো একতলা বাড়ী একটা। এ সি নেই, বড়
ফ্যান ঘুরছে শুধু। ব্যাগেজ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম, স্যুটকেসটা
কনভেয়ারে চেপে চলে এলো একটু পরেই, আমি সেটা তুলে রওনা দিলাম বাইরে। খুব শান্ত
নিশ্চুপ লাগছিল প্রথমে, তারপরে গাড়ির দরদাম করতে গিয়ে বুঝলাম কানে তালা লেগেছে।
শীলপুখুরী যাব, অটোতেই যাওয়া যেত, আমি একটা মারুতি ভ্যান ভাড়া করলাম। এয়ারপোর্ট টা
শহরের পশ্চিমে, বেশ খানিকটা দুরে। রাস্তা চকচকে, এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে একটা
ঝিল পড়লো। বর্ষাকাল হলেও বেশ গুমোট - বোরিপাড়া, ইউনিভার্সিটি, জালুকবারি, রেলওয়ে
স্টেশান, গুয়াহাটি ক্লাব, দীঘালি পুখুরি – এসব পেরিয়ে শীলপুখুরি
পৌঁছলাম।
রাস্তার ওপাশে একটা বেশ
বড় গোলাকৃতি পুকুর, সেটাই শীল পুখুরি, আর এপারে একটা গলিতে একটা অফিস বাড়ির
দোতালায় ব্যাঙ্কের অফিস। ঢুকে পরিচয় দেওয়া মাত্র একজন কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক এক
গাল হেসে আমাকে আপ্যায়ন করলেন, জানালেন তাঁর নাম নাগাভুষনম। সকলের সঙ্গে আলাপ
করিয়ে দিলেন। দেখলাম সব্বাই ওনাকে নাগু বলে ডাকছে। ম্যানেজার মেঘালয়ের বাঙালী, নাম
অমিত দেববর্মণ। কথা বার্তা হল খানিক, ওনার সাথেও। ফাইন্যালি, কম্পিউটার টা দেখতে
গেলাম – অফিসের মধ্যেই এক কোনায় একটা ছোট ক্যাবিন বানানো
হয়েছে কাঁচের, তার ভেতরে এ সি লাগানো ভোল্টাসের, সেখানেই তিনি বিরাজ করছেন। এইচ সি
এল এর Busy Bee। অন করে দেখা গেলো উইন্ডোস ইন্সটল্ড আছে, কিন্তু
অফিস নেই। যেটা আছে, সেটা হল অসংখ্য গেমস। জানা গেলো, ওগুলো ওখানের সমস্ত কর্মচারী
নিজেদের মতো নিয়ে এসেছেন। সময় খরচা না করে কম্পিউটার বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম, কারন
পেছনে তখন চিড়িয়াখানার মতো ভিড় লেগে গেছে।
বাড়িতে খবর দেওয়ার
জন্যে পাড়ার নার্সিং সেন্টারে ফোন করে বলে দিলাম। তখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে, অফিস
টাইম পেরয়নি বটে, কিন্তু ক্লান্ত লাগছে খুব, নাগু কে বললাম হোটেলে ঢুকতে চাই
এবারে, কাজকর্ম পরের দিন সকালে করবো, যেমন প্ল্যান ছিল। নাগু অতিশয় ভদ্রলোক, সঙ্গে
সঙ্গে রাজি। আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হোটেলের দিকে। একখানা অটো নিয়ে ওখান থেকে
আবার পশ্চিমদিকে চললাম, যে রাস্তায় এসেছি, সেদিকেই। দীঘালি পুখুরি পেরনোর পরে একটা
ট্যারচা মতো চৌমাথা, সেখান থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে একটু এগোতেই রাস্তাটা খুব
ঘিঞ্জি হয়ে গেলো। থামলাম একটা গুরুদ্বারের সামনে। উলটো দিকের বাড়িটাই হোটেল, নাম
হোটেল নোভা। খুব পুরনো হোটেল, কিন্তু চলনসই। ম্যানেজার ভদ্রলোক তেলেগু। তিন তলায়
একটা ঘর পেলাম, সস্তায়, চলে যাবে, ঢুকে পড়লাম। সন্ধেয় রুটি তড়কা, তারপর ডেবোনেয়ার,
তারপর? ঘুম।
পরের দিন সকাল সকাল
অফিসে পৌঁছে কাজ শুরু। অফিস ইন্সটলেশন খুব একটা চাপের ব্যাপার কখনই নয়, তখনো
ছিলোনা, আমি তাই তৎক্ষণাৎ তাতে লেগে পড়লাম। এর পরেই বিপত্তি! ৫ নম্বর ফ্লপি থেকে
আর রিড করছে না! বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরে একবার হঠাৎ করে বলল উইন্ডোসের দু
নম্বর ডিস্ক টা ঢোকাতে। ঢোকালাম। কিছুই হল না। মিনিট দশেক যাওয়ার পরে বিশ্বরূপ
দর্শন – বিজি বী বন্ধ হয়ে গেলেন। যতবার অন করি, উনি একটু
চেষ্টা করেই ক্ষান্ত দেন, স্ক্রিনে লেখা “নো মাস্টার বুট রেকর্ড”। মনে পড়লো গেম গুলোর কথা – ভাইরাস! সর্বনাশ! এবারে কি করি? নাগুকে খবর দিলাম।
নাগু যেন একটু বেশীই ভেঙ্গে পড়লো। এইচ সি এল কে খবর দেওয়া হল। যিনি এলেন, তিনিও
বাঙালী, নাম শৌভিক সাহা। তিনি বিধান দিলেন, ভাইরাসের দায়িত্ব ওঁদের নয়। তা তো
বুঝলাম, এখন উইন্ডোজ আর অফিস পাই কোথায়? শৌভিক ভেবে নিয়ে বললেন, তিনসুকিয়াতে এক
খানা কপি থাকতে পারে। আমি প্রচন্ড রেগে বললাম, আপনি আসুন এবারে। উনি বললেন, আপনি
রেগে গেলে আমি কি করবো, এটা নর্থ ইস্ট, এখানে এক বাক্স এক্সট্রা ফ্লপি কিনতে গেলে
কলকাতায় যেতে হয়, আপনি কিনা সফটওয়্যার চাইছেন। বরং গুলি বন্দুক বলুন, সেসব এখানে
অনেক সহজে পাওয়া যায়।
অফিসে ফোন করলাম। উপায়
নেই, কুরিয়ারই ভরসা। অফিস জানালো দিন দুয়েক লাগবে কপি পাঠাতে। হতাশ হয়ে বসে আছি,
নাগু দেখলাম প্রায় কেঁদে ফেলেছেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার, আপনি এত ভেঙ্গে পড়লেন
কেন? নাগু জানালেন, উনি দু বছর এখানে আছেন, বউ কথা বলে না, ছেলে চিনতে পারে না,
সব্বাই মাছ খায়, শ্বশুরমশাই একবার এসেছিলেন, তিনি লাঞ্চ টাইমে অফিসে এসে ব্যাপার
স্যাপার দেখে প্রচুর বাওয়াল দিয়েছেন। কম্পিউটার চলতে শুরু করলেই ওনার ট্রান্সফার
টা হয়ে যাবে, উনি শুদ্ধ তামিল মানুষ, এই বিদেশে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ভেবেছিলেন আজকে হয়ে যাবে, কিন্তু সব স্বপ্ন
ভেঙ্গে গেলো মনে হয়। আমি প্রবোধ দিলাম – দুটো দিন ওয়েট করুন,
হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ সন্ধ্যে হয়ে গেছলো, হোটেলে ফিরবো, নাগু বললেন চলুন, আমি সঙ্গে
যাচ্ছি, একা যাওয়া ঠিক নয়। কারন টা বুঝলাম রাস্তায় এসে।
আটটা বাজে খুব জোর,
কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বারোটা। রাস্তা পুরো শুনশান, যেন কারফিউ। অনেকক্ষণ পরে পরে
একটা করে মিনি বাস ঝড়ের বেগে চলে যাচ্ছে, একদম খালি, কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না। এটা সেই
সময়ের কথা, যখন বোডো আন্দোলন তুঙ্গে। প্রায়ই বোমা ফাটে এখানে ওখানে। মানুষ
স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে প্রতি পদে। দিনের বেলাটা তাও চালিয়ে
নিচ্ছে, কিন্তু সন্ধের পরে এখনো সন্ত্রাসই রাজা। অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি, নটা বেজে
গেছে, ঝড় দিচ্ছে সামান্য, লোডশেডিং হয়ে গেলো। নাগুর মুখ শুকিয়ে এত্তটুকু হয়ে গেছে।
আমিও বুঝতে পারছিনা কি করবো। এক খানা আলো দেখে হাত দেখালাম। এক খানা জিপসি এসে
দাঁড়ালো সামনে। পুলিশ না, মিলিটারি। “ক্যা কর রাহে আপ ইতনি
রাত গ্যায়ে?” বললাম, আমি কলকাতার ছেলে, এখানে এসেছি একদিন হল,
আজকে অফিসে একটু দেরি হয়ে গেছে। “বহত গলতি কিয়া আপনে!
আইয়ে মেরে সাথ!” ভাবলাম অ্যারেস্ট হচ্ছি, বোধহয়। যাকগে, দেখা যাবে
খন। জিপে উঠতেই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন,
কোথায় উঠেছি। বললাম নোভা, ফ্যান্সি বাজার। সেই কালো অন্ধকার ভয়ের রাতে ভগবানের
দুতের মতো মিলিটারির গাড়ী আমাকে আর নাগু কে পৌছে দিল আমাদের আস্তানায় – নাগু আগে নামলেন, পরে আমি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে সেই মিলিটারি অফিসার বললেন, “ইয়ে নোভা সে আছছে হ্যায় ডাইন্যাস্টি, আপক উস্মে রহনা চাহিয়ে থা!” বলে হা হা করে হেসে উঠলেন। আমার মুখেও হাসি ফেরত এলো। ভদ্রলোক কে আমি অসংখ্য
ধন্যবাদ দিলাম, তারপর ভিজতে ভিজতে ঢুকে গেলায় নোভার ভেতরে – আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে তখন।
পরের দিন অফিসে গিয়ে
প্রথমেই প্রেজেন্টেশান টা সেরে ফেলার বন্দোবস্ত করলাম। কম্পিউটার নেই, তাই
বাগদেবীই ভরসা। দু ঘন্টা জাস্ট বকে গেলাম। কি কি বকেছি জানিনা, কিন্তু
ম্যানহাট্টান প্রজেক্ট থেকে শুরু করে অ্যাডা লাভলেস – কাউকে বাদ দিইনি। শেষে দেখলাম সবাই ইম্প্রেসড। একজন মহিলা, না সীমা বর্গহাঁই,
নাগুকে চুপি চুপি কিছু একটা বললেন, দৃষ্টি আমার দিকেই। আমি হাসিমুখে এগিয়ে যেতে
নাগু বললেন সীমা আজকে আমাকে অসমীয়া খাবার খাওয়াতে চান, রেস্তোঁরায়। আমি এক কথায়
রাজি, আরো কয়েকজন চল্লেন সঙ্গে। ভালো খাবার বেশ, মাছ মাংস সব একটু অন্যরকমের, সেষে
আবার ওদের ভাষায় “আসার”, দারুন লাগলো। প্রচুর
প্রশ্নের জবাব দিতে হল, তাতে অবশ্য আমার তেমন খারাপ লাগেনি, আমি তো বকবক করতে ভালই
বাসি। খাওয়ার শেষে সীমা বললেন “অভার? হেপি?” আমি দারুন খুশি,
বললাম “থ্যাঙ্ক য়ু, গ্রেট ফুড! ভেরি হ্যাপি!” উনি বললেন “ইউ হেপি, আই এম হেপি। ইউ আর গ্রেট ভাইয়া!” এখনো ভাবলে অবাক লাগে, কি এমন ভাষণ দিয়েছিলাম সেদিন যে এক নিপাট ঘরোয়া
ভদ্রমহিলা আমাকে অতখানি আপন করে ফেলেছিলেন। যে কদিন ছিলাম, ইংরেজি-হিন্দি তেমন
জোরালো নয়, তাই কথা বলতেন না বিশেষ, কিন্তু রোজ দেখা হলেই মিষ্টি হাসতেন, আর একটা
করে টফি দিতেন। সেদিন দুপুরে ডি টি ডি সি তে ফোন করলাম, জানা গেলো, প্যাকেট পৌঁছতে
আরো দু দিন, কারন পরের দিন রোববার। নাগু বললেন, কামাক্ষ্যা যাবে?
যাব না মানে? এনি
টাইম! পরের দিনের প্ল্যান হল, সেদিন নাগুর সঙ্গেই একটু ব্রহ্মপুত্রের ধারে
চিড়িয়াখানা, হাইকোর্ট এসব দেখে এলাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, নাগুদা
হাজির। স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম ওর সঙ্গে। কামাক্ষ্যা এয়ারপোর্টের দিকেই, অর্থাৎ
শহরের পশ্চিমে, কিন্তু অত দুরে নয়, শহরের মধ্যেই নীলাচল পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত
একান্ন সতী পীঠের এক পীঠ, কামাক্ষ্যা। দেবীর জঙ্ঘা পড়েছিল এখানে। দেবী
চীররজঃস্বলা, তাই পীঠের ভেতরে কোনো এক চোরাপথে বয়ে চলে অখন্ড বারিধারা। সারা দেশ
থেকে মানুষ আসেন এখানে তীর্থ করতে। দুর্গা আমার ইটারন্যাল ইন্টারেস্ট, আমার মনের ভীষণ
কাছের দেবী, তাই আমি খুশি মনেই যাচ্ছিলাম বেশ। হাই কোর্টের সামনে থেকে এক খানা
মিনি বাসে উঠে কামাক্ষ্যায় নেমেছি। প্রচুর মানুষ, মন্দিরে ঢোকার লাইন চলে এসেছে
রাস্তার ওপরে। নাগু আমাকে চমকে দিলেন আবার – দু খানা একশো পঁচিশ
টাকার টিকিট কেটে আনলেন। ভালই হল, অনেক আগেই ঢুকে গেলাম মূল মন্দিরে। ভেতরে
অন্ধকার, নিচে নামতে হয় খানিকটা, তাই মাঝে মাঝে সিঁড়ি। ওপরে টিউবলাইট কোথাও, কোথাও
বা বাল্ব লাগানো। পাথরের দেওয়ালে নানা রকম মূর্তি, অপ্সরা অপ্সরীদের। সুযোগসন্ধানী
মানুষজন সেরকমই কিছু মূর্তির গায়ে আর পায়ে সিঁদুর লাগিয়ে পাসে দাঁড়িয়ে আছেন।
গ্রাম্য কোনো মানুষ দেখলেই বলছেন “প্রনাম করো, ইয়ে
বিল্বনাথ জী হ্যায়। বিশ রুপিয়া দো! ইসকো
ভি পরনাম করো, ইয়ে নাগামাণী দেভী হ্যায়” – আর না দিলেই অত্যাচার। ভীষণ রাগ হচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। অবশেষে দর্শন
হল, পবিত্র বারি স্পর্শ করে বেরিয়ে এলাম আমরা। নাগু একটা অটোর সঙ্গে কথা বলে নিয়ে
গেলে দক্ষিনেশ্বরীর মন্দিরে, একই পাহাড়ে, আরেকটু ওপরে। দারুন ভিউ পয়েন্ট সেটা,
পুরো গুয়াহাটি শহর একদিকে, অন্যদিকে দিগন্ত অবধি চলে গেছে ব্রম্ভপুত্র, ওপারে তার
সবুজই সবুজ, সেদিকে কাজিরাঙ্গা। মন ভরাট করে হোটেলে ফিরে এলাম খানিক বাদে।
পরের দিন সকালেই
প্যাকেট গুলো চলে এলো। আমিও ফটাফট সব কিছু ইন্সটল করে ফেললাম, তারপর একটা সেশান
নিয়ে নিলাম, হাল্কা ট্রেনিং যাকে বলে। বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ, পরের দিন দুপুরে
বাড়ী ফিরবো। নাগু প্রস্তাব দিল, আজকে সে আমাকে ডিনার করাতে চায়। নাগু শুদ্ধ
শাকাহারী, আমার মোটেও ইচ্ছে নেই, তারপরে শুনেছি নিজেই রান্না করে, কেমন হবে, কে
জানে? অনুরোধের পর অনুরোধ আসতে লাগলো, ভেবে দেখলাম নাগুর মেসবাড়ী আমার হোটেল থেকে
কাছেই, না বললে খুব বাজে দেখাচ্ছে, তাই শেষে রাজি হয়ে গেলাম। অফিস শেষ, সীমাদিদি আর
অন্যান্যদের বিদায় জানিয়ে সন্ধেয় নাগুর সঙ্গে গেলাম তার মেসবাড়ীতে। সিমেন্টের
মেঝে, কিন্তু ফুট তিনেক অবধি বাঁধানো। তার ওপর থেকে চাঁচের দেয়াল, ছাদে টালি। দুখানা
ঘর, তাতে মোট চারজন থাকেন। খুব অবাক লাগলো দেখে - রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের একজন
অফিসার এরকম বাড়িতেও থাকতে পারেন? একটু পরেই আরো কয়েজন তামিলভাষী চলে এলেন, এনারা
সবাই নিমন্ত্রিত – কেউ ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক, কেউ সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক, কেউ
ক্যানারা। গল্প চালু হল, একটু পরেই গল্পের ব্যাপারটা তামিলে শিফট করে গেলো, তবে মাঝে
মাঝে একজন বলে উঠতে লাগলেন “ইংলিশ, ইংলিশ” – সেটা আমার কথা ভেবে। আমার যে খুব উৎসাহ নিয়ে শুনতে ইচ্ছে করছিল, তা না, কারন
তখন আমার হোম সিকনেস চালু হয়ে গেছে। তার ওপরে রাতের মেনু – খিঁচুড়ি, সাম্বার, পায়াসাম – আমার ঘোর আপত্তি এসব
খাবার খেতে। কিন্তু কি আর করা, ভালবাসার খাবার, সে খেতেই হবে, “আই ইট ভেরি লেস” বলে অল্প করে হলেও খেতেই হল সে খাবার। মনের দুঃখ
মনেই রেখে বিস্বাদ নুন ছাড়া খিচুড়িকে বলতে হল গুড ফূড। ১১ টায় হোটেলে ফেরত গেলাম, একটু শেষ আশা ছিল
তড়কা রূটি দিয়ে শুদ্ধিকরন করার, কিন্তু সেখানেও খাবার নেই কিছু আর।
পরের দিন সকালে কয়েকটা
জিনিস কিনলাম, দোকান পাট খোলেনি বেশী, তাই পেলাম না কিছুই তেমন। প্লেনে ওঠার সময়েও
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি, শুধু এবারে আর বাস ছিল না, হেঁটেই উঠতে হল প্লেনে। প্লেনের
দরজার কাছে আটকে দিয়ে একটা মেটাল ডিটেক্টার দাঁড় করিয়ে একবার চেকিং হল, কিন্তু সে
জবরদস্ত কিছু না। জানালার টিকিট এবারে মনে করে চেয়ে নিয়েছিলাম, তাই জানলা দিয়ে দেখতে
দেখতে চলে এলাম কলকাতা।
রাতে শুয়ে আছি, মনে
পড়লো, নাগুকেও আর ঐ খিচুড়ি খেতে হবে না বেশিদিন, চেন্নাইয়ের গরমে বসে সাম্বার দিয়ে
কার্ড রাইস খাবে বউ এর হাতে। ডেবোনেয়ার টা হোটেলে ফেলে না এসে নাগুকেই দিয়ে এলে
হতো, যে কটা দিন আছে...
2 comments:
jobordast hoyeche bijit da........
Besh likhecho ... chaaliye jaao..
Post a Comment