পুরী পুনরায়
দিনকয়েক আগে পুরী চলে গেলাম হঠাৎ। পুরী
যাওয়া নতুন কিছু নয়, বুবুদা এর আগে সতেরো বার পুরী গেছে, ইনক্লুডিং তিন বার
হানিমুন – হ্যাঁ, মানে এরকম নয় যে বুবুদা বার বার
বিয়ে করে আর পুরী যায় – প্রথম দু বার
মীরা কাকিমা আর কাকুও সঙ্গে গেছলো কিনা, তাই হানি আর মুন দুই থাকা সত্ত্বেও সন্ধি
হয়নি, তাই তৃতীয়বার। বাকি বার গুলো অন্যান্যবারে যা যা দেখা হয়নি সেগুলোর জন্য এবং
বিভিন্ন লোকের সঙ্গে। এবারে গেল আমার সঙ্গে যায়নি আগে কখনো, তাই।
পুরী আমিও কম যাইনি। আমার জন্মের আগেই আমার
পিতৃমাতৃকা আমার ঠাকুমা ও সেজজেঠু-জেঠিমার সঙ্গে ঘুরে এসেছে পুরী – তখন মধুচন্দ্রিমা অমনই হতো। আমার ছোটবেলায় যাওয়া হয়নি
ঠিকই, কিন্তু সেই কোন কলেজে পড়ার সময়ে ডিক্, উজ্জ্বল আর অমিতের সঙ্গে গেছলাম – সে ভারি মজার ট্রিপ হয়েছিল, বলবো একদিন সময় করে। তারপর
সত্যজিৎ রায়ের হত্যাপুরীর হাত ধরে বার বিশেক তো হবেই। শেষমেষ এই সেদিন, ২০০৯ এ
গেলাম বৌ আর ছেলের সাথে, সেবারে শুধু গিয়ে ক্ষান্ত হইনি, বাঁ ঠ্যাং টাও ভেঙ্গে
এসেছিলাম – সে গল্প অন্য সময়ে। কিন্তু এবারের টা
সত্যিই স্পেশাল, কারন সঙ্গে বুবুদা।
রোববার, সন্ধ্যায় বাড়ীতে বসে ই-বে তে
কিছু কেনা যায় কিনা খুঁজছি, বুবুদা ফোন করলো। গুড ফ্রাইডের ছুটিতে শিলং যাবি? অর্থাৎ
পরের শুক্রবার। আমি এক কথায় নাকচ করে দিলাম। শুক্রুবার গিয়ে রোববার ফিরব, গায়ের
ব্যাথা মরবে না, পয়সার শ্রাদ্ধ। বরং নর্থ বেঙ্গল যাই? টিকিট নেই তো! তাহলে আমাদের
ঘরকা মুরগি দীঘা, কিম্বা তার আশেপাশের কোথাও? বুবুদা “ঠিক আছে, হোটেল খুঁজি তাহলে” বলে ফোন রেখে
দিল। একটু পরে আবার ফোন – বাবু, পুরী যাবি?
আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল। বুবুদা+সী বিচ = পুরী ছাড়া আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আমি বললাম, যেতেই পারি, কিন্তু টিকিট কই? বুবুদা বলল সেটা হয়ে যাবে, কে একজন
এজেন্ট আছে, সে কেটে দেবে। হোটেল? সেও বুবুদা দেখবে। ব্যস, আর কি, যাত্রী গণ দয়া
করি ধান দিয়ন্তি, হাওড়া-পুরী শতাব্ধী এক্সপ্রেসো চারি নম্বর প্ল্যাটফর্ম উপরে
আসিব।
বুবুদার মেয়ে মেঘাই, বুবাই এর থেকে জাস্ট
আড়াই মাসের ছোট কিন্তু আড়াই গুন ডানপিটে। তার পোষাকী নামও শতাব্ধী। কিন্তু তার
নামের ট্রেন মোটেই ডানপিটে নয় – ধীরে সুস্থে চলতে
চলতে পুরী পৌঁছল যখন, রাত তখন অনেক, সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। ভাগ্য ভালো, ভোটের
দিন হওয়া সত্ত্বেও এক খানা মারূতি ভ্যান ছিল, যদিও আমরা বলেছিলাম ইনোভা। হোটেলটার
নাম সোনার বাংলা, লাইট হাউসের পরেই, সমুদ্রের ওপরে একদম। সেখানে পৌঁছে বুবুদা গাড়ী
নিয়ে কিঞ্চিত বাক বিতন্ডার অবতারনা করার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু এক তো ঘুম পেয়ে গেছে,
তার ওপরে একজন বাঙ্গালী কর্মচারী যখন বললেন পুরীতে নাকি মাত্র চারটে ইনোভা আছে,
বুবুদা ক্ষান্ত দিল, কারন অতটা জার্নি করার পরে এটা নিয়ে তর্ক করার দম শেষ তখন।
ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।
পরের সকাল দুপুরটা মনে মনে অনেক বেড়ালাম – ফিসিক্যালি একবার সমুদ্রের ধারে ছাড়া একবার স্পিরিটের
দোকানে গেছলাম শুধু, অন্য কোথাও যাওয়া একটু চাপের হত, বেদম রোদ, তবে বিকেলে
জগরনাথো দরশনো তে আমার না তো ছিলই না, বরং ইন্টারেস্ট ছিল বলতে পারি। পুরীর মন্দির
তৈরি নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি, পুরীর রাজা নাকি রথযাত্রার সময়ে রাস্তায় ঝাড়ু দেয়,
তাও আবার সোনার ঝাঁটা দিয়ে, পুরীর মহাপ্রসাদ রান্না হয় হাঁড়ি স্ট্যাক করে, তাতে নাকি ওপরের হাঁড়ির ভাত
আগে সেদ্ধ হয়, এগুলো তো গেলই। এছাড়াও একবার পড়েছিলাম জগন্নাথ আসলে শ্রীকৃষ্ণ,
সুভদ্রা তার বোন আর বলরাম ভাই, কিন্তু এখানের মূর্তির এই ফর্ম এর কারন নাকি
জগন্নাথ আসলে ট্রাইব্যাল দের দেবতা, অথবা কোনো ট্রাইব্যাল ঠাকুরকেই শ্রীকৃষ্ণে
কনভার্ট করেছিল কোন এক হিন্দু রাজা। পুরীর অতীব ভদ্র পন্ডারা এখন কেমন ব্যাবহার
করেন, সেটাও দেখার ইন্টারেস্ট ছিল।
পুরীর যে কোনো হোটেলেই একজন ম্যানেজার
থাকেন, কিছু বেল্ বয় থাকে, কুক থাকে, ঝাড়ুদার-মেথর থাকে, আর থাকে একজন ফিট করা
পন্ডা, আমরা বাঙ্গালীরা যাকে বলি পান্ডা। এই হোটেলেরও ছিল, এবং সে ঠিক সন্ধ্যে
ছটার সময়ে হাজির হল। বয়স আর চেহারা দেখে একটু সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করায় জানালো যে
সন্দেহের কিছু নেই, সে মোটেই পান্ডা নয়, পান্ডা অনেক ব্যাস্ত মানুষ, সে তাঁর অধীনে
কাজ করে শুধু। সে তার বাইক নিয়ে আগে আগে চলল, পেছনে বুবুদা কে বসিয়ে, আর আমরা
চারজনে, মানে আমি, সুপর্ণা, বৌদি অর্থাৎ উত্তরা আর মেঘাই, পেছে পেছে, অটো তে।
পুরীর এই সব গলি বেনারস কেও হার মানাবে,
এত সরু, কিন্তু বৈচিত্র নেই তেমন। এক বুড়ো বসেছিল একটা পুরনো বাড়ীর বারান্দায়,
হলুদ সোডিয়াম ভেপারের আলোতে তাকে অদ্ভুত মায়াবী লাগছিল, খুব আফশোস হল ক্যামেরা
আনতে দেয়নি বলে, কিন্তু বেশি সময় পেলাম না দুক্ষু করার – এক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সাউথ গেটের সামনে। সেখানে চটি জুতো
জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে প্রথমে পা ধোয়া, তারপরে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের চত্বরে। চত্বরের
দুপাশে নানান ছোট মন্দির আর থান, তারপর বেশ কয়েকটা সিঁড়ি উঠে আবার একটা
প্রবেশদ্বার। সেটা দিয়ে ঢুকলেই মূল মন্দিরটা মাঝখানে আর চারপাশে অনেক অনেক ছোট ছোট
মন্দির।
এক পাক দিলাম, একদিকে প্রদীপ আর মোমবাতি
জ্বালানো হচ্ছে, তার পাশে প্রচুর মানুষ নিচে বসে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম,
ধ্বজা পালটানো হচ্ছে। আবার বাইরের চত্বরে এসে বসলাম, কারন একটু দেরী হবে নাকি। এরই
মাঝে একটু হই হল্লা হল, কয়েকজন খাঁকি পোষাক পরা লোক ছুটে এসে দুজন কে কলার চেপে
ধরে নিয়ে গেল, শুনলাম, যাদের ধরেছে তারা নাকি বি এস এফ এর কর্মী, মন্দির দর্শন
করতে এসে ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পরেছিল, তারপর বারন না মেনে জগন্নাথ এর
স্নান করা দেখে ফেলেছে। কি অন্যায়! সুভদ্রার স্নান করাও যদি দেখে নিত?
আমি ভীষন মন দিয়ে ধ্বজা পালটানো দেখলে
লাগলাম। মূল মন্দিরের গায়ে অসঙ্খ্য খাঁজ, তাতে পা দিয়ে দিয়ে চুড়ার খুব কাছে উঠে
যাচ্ছে একজন, কিন্তু শেষে একটা মোটকা দশ ফুট উঁচু কুকির মতো বস্তু আছে, টায়ার এর
মতন, সেখানে কোনো খাঁজ নেই। ভাবছিলাম কি করে পেরবে ওটা, তারপরে দেখলাম সেখানে দড়ির
মই লাগানো, সেই ধরে লোকটি উঠে গেল ওপরে। একটু পরে কাজ শেষ হলে নেমে এলো একই ভাবে।
কাজটায় প্রচুর অনুশীলন দরকার, এবং কখনো কোন দুর্ঘটনা যে ঘটেনি সেটা ভগবানেরই কৃপা,
তবে কিষ্কিন্ধ্যা টাও উড়িষ্যাতেই হওয়ায় ট্রেনার পাওয়ার কোন অসুবিধে নেই। ট্রেনারদের
অনেকেই লঙ্কায় মারা পড়েছে যুদ্ধে, কয়েকজনকে গুজরাট, বিহার ও উত্তর প্রদেশের
মন্দিরে মোদীর স্বপক্ষে দাঁড়াতে হয়েছে হাতে গন্ধমাদন নিয়ে, কিন্তু এখানেও দেখলাম
কম নেই। তারা চৌর্য বৃত্তিতেও বেশ পটু, তাই সাবধানেই রইলাম।
আটটা বেজে গেছে, বিরক্তি লাগছে এবারে।
অবশেষে তিনি এলেন, আমাদের মূল পান্ডা। তাঁর নাম বলভদ্র শৃঙ্গারী। বছর চল্লিশের কমই
হবে, প্রায় সাড়ে ছয় ফিট লম্বা, চওড়া মাননসই, চোখে পড়ার মতো ফরসা রং, সুন্দর কাটা কাটা
নাক মুখ। পুরীতে গোটা দশেক বিল্ডিং কমপ্লেক্স হচ্ছে তাঁর টাকায়, তিন খানা কর্মচারী
শুধু মন্দিরের কাস্টমার নিয়ে আসার জন্য। গলাটা জোরালো, মেজাজটা তার থেকেও বেশি।
বুবুদা নিজের সতেরো বারের অভিজ্ঞতা থেকে সাহস নিয়ে একটু তাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিল,
উনি বকে দিলেন। ঠাকুরের কাজ ওরম ঘড়ি ধরে হয় না। দাঁড়ানোর ইচ্ছে না থাকলে পরের দিন
সকালে আসতে হবে। বুবুদা দেখলাম তখনো নরম, তার মানে ভক্তি এখনো একটুও কমেনি। আমি
ভাবলাম একটু গপ্প করা যাক।
বলভদ্র জানালেন তিনি উচ্চস্তরের পান্ডা।
তাঁর পরিবার ও আরো একটি পরিবারেরই শুধু ঠাকুরকে স্নান করানোর ও সাজানোর অধিকার আছে
– তাঁর পদবীও তাই শৃঙ্গারী। আমি ভাবছিলাম বলি স্পারটাকাসে
দেখেছি, ওগুলো রানীর দাসিরা করে আর মাঝে মাঝে রাজা এসে তাদের ওপরে কি সব এক্সপেরিমেন্ট
করে পেছন দিক থেকে, এখানে জগন্নাথ বা বলরাম ওনার ওপরেও তাই করে কি? বাড়াবাড়ি হবে,
তাই চেপে গেলাম। রান্নাঘরের খোঁজ নিলাম একটু – উনি বললেন আজকে
রান্না খতম, আবার কালকে হবে। শেষে একদম কিছু পয়েন্ট না পেয়ে বোকা বোকা মুখ করে
জিজ্ঞেস করলাম, এই যে ধ্বজা লাগাতে একজন মন্দিরের গায়ে পা দিয়ে উঠছে, এতে ওনারা
উষ্মা প্রকাশ করেন না? উনি এই প্রথম হাসলেন, বোকা বাঙ্গালীর কথা শুনে, তারপর বললেন
“জৌণ বানাইথিলা, সেও তো পাদো দিয়কিরি উঠিথিলা, না কৌণ?” তারপরে আরেকটু প্রাঞ্জল করার জন্যে জানালেন, উনি যখন স্নান
করান, তখনো তো ঠাকুরের গোপন অঙ্গে হাত লাগাতে হয়, তাতে কি পাপ হয়? মনে পাপ না
থাকলেই হল। ঠাকুর রাগ করেন না। “নেড়ে দে” মনে পড়তেই পাপী মন বলছিল ঠাকুরের তো খুশি হওয়ার কথা, পাপ
কে চাপ দিলাম যাতে এসব কথা মনে না আসে, আমি তীর্থ করতে এসেছে, রঙ্গরসিকতা করতে নয়।
ফিলসফিটা সম্যক বুঝলাম, সঙ্গে বুঝলাম সেই বিএসএফ ছেলে দুটি কি সাংঘাতিক অন্যায়
করেছে।
পৌনে দশটা বাজে, আমি টোকেন টা বুবুদার
হাতে দিয়ে খালি পায়েই হোটেলে ফেরত যাব ভাবছি, বুবুদা মেঘাই আর বুবাই কে নিয়ে পাথর
পাথর খেলছে – মানে এই খেলায় বলতে হবে সামনের পাঁচিল
অবধি কটা পাথর পাতা, তারপর গুনে আসতে হবে প্রত্যেকটায় পা ফেলে, পাশে বসে একটা
দিল্লিবাসী গুজ্জু পরিবার নিতান্ত বেসুরে কি একটা ভজন গাইছে আর তাদের পান্ডা বাঁদর
তাড়াচ্ছে, মন্দির প্রায় ফাঁকা, এমন সময়ে ডাক পড়লো। মূল মন্দিরে ঢুকতে যাচ্ছি, একজন
গেরুয়া পরা বছর পনেরোর ছেলে ভিক্ষা চাইলো, আমি যথারীতি দিলাম না। একজন টাকমাথা
পান্ডা জানতে চাইলেন “ভি আই পি দরশনও?” তারপর বলভদ্র বাবুকে দেখে রাস্তা ছেড়ে দিলেন। আমরা গর্ভগৃহে
ঢুকলাম। বলভদ্র বাবুর পেছন পেছন। মৌনী সেজে।
গর্ভগৃহ খানা অনেক মন্দিরের তুলনায় বেশ
বড়। কিন্তু তার দেওয়াল, প্রদীপের কারনেই হয়তো, কালো। সেখানে বাল্ব জ্বলছে, টিউবও,
কিন্ত তাতেও বেশ অন্ধকার অন্ধকার ব্যাপার। মেঝে জলে আর দুধে ভর্তি – হয়তো স্নান করানো হয়েছে কিছু আগে, তাই। সামনে মস্ত দুই
কাঠের মূর্তি – ফুট দশ বারো হবে, বাঁয়ে জগন্নাথ, ডাইনে
বলরাম। মাঝে সুভদ্রা, সে সামান্য ছোট। দুই ভাইয়ের হাত আছে, সামনে প্রসারিত, তাতে
আঙ্গুল নেই। সুভদ্রার হাত চোখে পড়লো না। মূর্তি গুলি একখান ফুট চার উঁচু বেদির
ওপরে বসানো, তার প্রত্যেক জনের সামনেই বসে আছেন একজন করে পান্ডা। কেউ প্রণাম করলেই
মুখস্তের মতন বলে যাচ্ছেন “প্রনামি দিয়, না
দিয়ে জিও নি” আবার কম দিলে বকাও দিচ্ছেন। বলভদ্র
আমাদের বাঁ দিকের কোনায় দাঁড় করিয়ে মন্ত্র পাঠ করালেন তারপর বললেন পরিক্রমা করে
নিতে। পরিক্রমা করতে ঢুকলাম বাঁ দিক দিয়ে - ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানেও একজন পান্ডা
আছেন, প্রনামী না দেওয়ায় বাপান্ত করলেন আমার, কিন্তু আমি তো মৌনী, তাই বেশিক্ষন
গাল পাড়লেন না। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, পরিক্রমা করতে গিয়ে একঝলক মনে হল যেন
ক্যাওড়াতলার ইলেক্ট্রিক চুল্লির পেছনে অস্থি নিতে গেছি – একটা অদ্ভুত অস্বস্তি, একটা অদ্ভুত গুম ধরা হাওয়া সেখানে।
যখন বেরচ্ছি, একজন পান্ডা মাথায় লাঠির হাল্কা বাড়ী মেরে প্রনামী চাইলেন, না দেওয়ায়
যা ভাষায় অভিশাপ দিলেন, বুঝলাম এই জীবনে দ্বিতীয় বার পিতা হওয়ার চান্স কমে গেলো, হোটেলে
ফিরে দেখতে হবে কিছু আছে নাকি সবই গেলো। বুবুদা প্যাকেজে পুজোও দিল, আমি মর্যালি
সেটা শেয়ার করলাম, যথার্থ বঙ্গসন্তানের মতো।
পরের দিন সকালে উঠেই কোনার্ক গেছলাম,
সঙ্গে চন্দ্রভাগা বিচ। সেখানে নতুন কিছু দেখিনি, বরং দেখলাম গত পাঁচ বছরে আরো
ভেঙ্গে গেছে মন্দির। উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে একটা খুব সুন্দর ছেলের সঙ্গে আলাপ
হলো, তার নাম পরশ। আফ্রিকান ফিচার, কৃষ্ণবর্ণ, কোঁচকানো চুল, কিন্তু সবথেকে দেখার
মতো তার চোখ – যেন কথা বলে। সে কাছেই থাকে, একখানা মুদিখানায়
চাকরি করে, মালিকে সঙ্গে এসেছে, বাইকে চেপে, সঙ্গে যাবে কিছু একটা হাতে ধরে নিয়ে। কথা
বলে অদ্ভুত ভালো লাগলো। তার একটা ছবি তুলে জানতে চাইলাম – কি রে, তোর অন্য ছবির থেকে এটা ভালো লাগলো? পরশ বলল আজকেই
তার প্রথম ছবি তলা হলো। কিন্তু কোনো দুঃখ নেই তার জন্য, সব সময়ে হাসি খুশী। এরকম
মানুষের জন্যেই বোধহয় আমাদের বেঁচে থাকা।
আরেকটা হল মন্দিরের ভেতরে। এক উৎকল
গ্রাম্য ঠাকুমা একটা অদ্ভুত পোজে দাঁড়িয়ে পশ্চাদদেশে অঙ্গুলি হেলন করছিলেন, আমি
ছবি তুলবো, এমন সময় সুপর্ণা কোথা থেকে উদয় হয়ে বলল “কি গো তুমি নামবে
না নিচে?” ওমনি আঙ্গুল সরে গেল, আমি মনে মনে খুব
হতাশ হলেও মুখে একটু হেসে বললাম “যাও, যাচ্ছি,
ঠাকুমার একটু ছবি তুলি। যাচ্ছি তারপর”। ওদের সঙ্গেই
ছিলাম কিছুক্ষন। একটু পরেই পার্ট অফ দ্য পার্টি হয়ে গেলাম, ওরা ভুলে গেলো আমি ওদের
লোক নই। ঠাকুমার ছেলে আধ খাওয়া বেলে পাথর দেখিয়ে শেষে রায় দিল যে সব পাথরই উই লেগে
এই অবস্থা। তার বউ একবার মিউ মিউ করে বলছিল যে পাথরে উই হয় না, ভদ্রলোক গর্জন করে
উঠলেন – দেখছিস না, মাঝে হলদে হয়ে আছে? এর পরে সত্যিই
আর কোন কথা হয়না, আমরা তাই সব্বাই মেনে নিলাম। আমার দিকে জিজ্ঞ্যাসু দৃষ্টিতে
ভদ্রলক তাকিয়েছিলেন ফর সাপোর্ট, আমি সাপোর্ট দিয়ে মাথা নাড়লাম। মাঝে হলদে আমিও
দেখেছি। ঊনি দ্বিগুন উৎসাহে আরো অনেক কিছু বোঝাতে শুরু করলেন – আমার উড়িয়া জ্ঞান সীমিত, বুঝতে তাই সময় লাগছিল, কারন ওনারা
গ্রাম এর লোক। আরো একটু থাকতাম, মনি মুক্তা ভালই পাচ্ছিলাম, কিন্তু পাথর তেতে উঠেছে
ততক্ষণে, তাই আর থাকা গেল না, নেমে এসে রওনা দিলাম পুরীর দিকে।
আর কোথাও যাইনি, আর কিছু করিনি।
বিকেলে-সন্ধ্যায় বিচে বসা, সে নতুন কিছ নয়। কটকী শাড়ি কেনা – সেও নতুন কুছ নেহি, কলকাতাতেও ওরকম কতো কিনতে হয়। পরের দিন
দশটায় বেরিয়ে পড়লাম আবার, কলকাতার দিকে।
দু খানা জিনিস না জানালে অবশ্য অন্যায়
হবে পাঠকদের প্রতি। একটা হল ফেরার আগের দিন সন্ধ্যায়। বিচে চায়ের অর্ডার দিয়ে
চেয়ারে বসেছি, পয়সা দেওয়ার সময় বুঝলাম চায়ের পয়সায় চেয়ার ধরা নেই, ওটা আলাদা, দশ
টাকা, কিন্তু একবার উঠে গেলেই টেনিওর শেষ, পরের বার বসলেই আবার দশ। বউ ও বউদি একটু
পরে শপিং করতে চলে গেল, বুবুদা আমাদের দুই বড় বাচ্চাদের নিয়ে উটের পিঠে চাপাতে
গেল, আমি বসে বসে চেয়ারের পয়সা উশুল করছিলাম। কিন্তু বড্ড মশা। এতোই বেশী যে এক
ভদ্রমহিলা পায়ের মশা মারতে গিয়ে উল্টে পড়লেন চেয়ার সমেত, আর ওমনি হূলুস্থুল বেধে
গেল। আমি দেখলাম শান্তি নেই, তাই উঠে পড়ে বিচের দোকান গুলোর মধ্যে একটু হাঁটাহাঁটি
করছি, এমন সময় এক মস্ত লম্বা ভদ্রলোক কোলে বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে এসে থমকে
দাঁড়ালেন এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন “এটা কত এক্স জুম?” তর্জনীটা আমার গলায় ঝোলা ক্যামেরার দিকে। আমি একটু গম্ভীর
হাসি দিয়ে বললাম “এটা তো ডি এস এল আর, এতে এক্সে মাপ হয়
না, এখানে ওয়াই তে হয় – তা এটা
থার্টিফাইভ ওয়াই”। ওনার চোখে একটা বিদ্যুৎ চমকের মতো দেখা
গেল যেন – আবার আঙ্গুল তুলে বল্লেন “একজ্যাক্টলি! বাঃ! দারুন জিনিস!” তারপর পকেট থেকে ফোন বার করে কাকে ফোন করতে করতে চলে গেলেন।
শেষ ঘটনা টা ট্রেনে। নীলাচল এক্সপ্রেসে
খড়গপুর এসে ট্রেন পাল্টাতে হবে। একটা সাইড লোয়ারে ঘুমোনোর তাল করছি এইলের দিকে
পেছন ফিরে, হঠাৎ পিঠে একটা বিরাশী সিক্কার থাপ্পড় পড়লো। পেছন ফিরে দেখি একজন হাসি
হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই হাসি টা উবে গেলো, বলল “সোচা থা দোস্ত হ্যায়”। কোন দুঃখ প্রকাশ
নেই, কোনো লজ্জা নেই, বলে দিয়েছে কি ভেবেছিল, অতএব আমার পিঠের দায়িত্ব তার নেই
এখন। যেই পেছন ফিরেছে, আমি তার পেছনটা দেখলাম বেশ হাতের কাছে – জমিয়ে একটা চাপড় দিলাম। ছেলেটি ঘুরে তাকিয়েছে, থতমত – আমি এক গাল হেসে বললাম “মুঝে ভি লাগা
দোস্ত হ্যায়। চলিয়ে, কোই বাত নেহি”। আমি খড়গপুরে
নেমে গেলাম, ছেলেটি তখনো আমাকে উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছে।
No comments:
Post a Comment