Saturday, May 17, 2014

রূপকথার র‍্যাম্বো

রূপকথার র‍্যাম্বো

বোম্বে প্রেসিডেন্সির এক কোনায় ভাদনগরের রেল স্টেশন। সেখানে ঘাঞ্চী তেলী মূলচাঁদের ছেলে দামোদরের চায়ের দোকান। দামোদরের চার ছেলে, দুই মেয়ে। সমু, নরেন, প্রহ্লাদ, পঙ্কজ এই চার ছেলে, আর দুই মেয়ের নাম অম্রূত আর বাসন্তী। এর মধ্যে সমুর দোকান টোকানে মন নেই, সে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। নরেন আর প্রহ্লাদ বাবার চায়ের দোকানে পালা করে হাত লাগায়, আর পঙ্কজ? সে তো অনেক ছোট।

নরেন মেজো।

একদম ছেলেবেলা থেকেই রাম আর রামের ধনুকের প্রতি তীব্র টান। পাড়ায় এক বিলেত ফেরত সাহেবের ছেলে ছিল, সে নরেনের বন্ধু। আমেরিকায় জন্ম, তাই দেশি ভাষায় ভয়ঙ্কর অনীহা। সে তার ইংরেজির ভাঁড়ার ঘেঁটে নাম দিয়ে দিলো রামস বো। সাহেব দের তো আ বলতে খুব কষ্ট হয়, তাই তারা ইংরেজি এ কে বলে অ্যা। তাই রামস বো, ধীরে ধীরে র‍্যামস বো, এবং শেষে র‍্যাম্বো তে পরিণত হল।

তারপরে সে অনেক কথা।

র‍্যাম্বো বড় হচ্ছে তখন। বাবার দোকান ছেড়ে দাদার সঙ্গে দোকান দিল। সেই চায়ের দোকান। সেই কোন ছোট্ট বেলায় তেরো বছর বয়সে নমো নমো করে বিয়েটা সেরে ফেলেছিল। তখন ভাবে নি, যে এক সময়ে মানুষজন তাকে নমো বলেই ডাকবে। দুধের রাজ্যে বেশ ছিলো চায়ের দোকান দিয়ে, হঠাৎ পাগলামি চাপলো মাথায়।

বিদেশের সঙ্গে এদেশের তফাৎ হল বিদেশে শুধু এক ধরনের, কিন্তু এখানে দু ধরনের আর এস এস ফিড হয়। একটা আসে ইন্টারনেট দিয়ে, আর অন্যটা হাতে হাতে, সেবক দের হাত ধরে। চা ওয়ালার ছেলে, সে ইন্টারনেট কোথায় পাবে, তাই অন্য আর.এস.এস ফীড টাই নিয়ে কাজ করতে লাগলো র‍্যাম্বো। বউটা তেমন জমেনি, আর তার দেশে বৌ আর বোন একই রকম, কারন সব মহিলাই নিজেদের বে(হে)ন বলেন, তাই র‍্যাম্বো চলে গেলো বউ কে ছেড়ে, তীর্থ করতে। মাস দুই বাদে ফেরত এলো অবশ্য, কারন সেই ফিডের আকর্ষণ, আর পয়সাও ফুরিয়ে গেছে। র‍্যাম্বো ততদিনে বুঝে গেছে, পয়সাই সব। বৌ এর কাছে ফেরৎ যায়নি আর। বৌ যে আছে, সে কথা সে প্রথম বলল এই দু হাজার চোদ্দো সালে।

সঙ্ঘ থেকে দলে চলে এলো র‍্যাম্বো। ডেপুটেশান। পাল্টাতে থাকলো সে। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি শরীর সব সময়েই ফিট ফাট, পরিষ্কার করে কাটা চুল দাড়ি, পাকতে শুরু করেছে যদিও। পরিস্কার করে কাচা জামাকাপড় - দরকারে কুর্তা, আরো বেশী দরকারে থ্রি পিস স্যুট। নো স্মোকিং, জল আর দুধ ছাড়া অন্য কিছু পান করে না। নারী সংসর্গ প্রায় নেই বললেই হয়। অসম্ভব মাতৃভক্ত। তীব্র স্বাধীনচেতা, কারুর কথা শোনে না, কাউকে বলতে দেয় না, তার কথাই শেষ কথা। দরকার ছাড়া কথাও বলে না, ইন্ট্রোভারট। আমেরিকায় করে আসা তিন মাসের ইমেজ ম্যানেজমেন্ট কোর্স গুলে খাওয়া হয়েছে, র‍্যাম্বো কে নিয়ে উন্মাদনা শুরু হল। পুরুষরা বললেন এই তো, রাজা এসে গেছে, মেয়েরা বললেন কিত্নে সেক্সি ছে। এরকম করতে করতেই র‍্যাম্বো এক সময়ে গাঙ্গু তেলী থেকে রাজা ভোজ। একটা রাজ্যের রাজা হয়ে গেল সে।

আমাদের বাবাই যে গ্রামে থাকে, তার নাম বোধ্‌রা। ভারি সুন্দর গ্রাম, তার থেকেও ভালো মানুষজন। তার সঙ্গে নাম মিলিয়ে দেশের পশ্চিম প্রান্তে আছে আরেকটা জায়গা, কিন্তু দু যায়গায় মিল খুবই কম। সেই পশ্চিমের গ্রামে মানুষ থাকে না, থাকে কিছু হিন্দু আর কিছু মুসলমান। তারা একবার খুব কামড়াকামড়ি করেছিল করবেই তো, মানুষ তো আর নয় তো কেউ কেউ বলতে শুরু করলো যে র‍্যাম্বো নাকি এসব ইচ্ছে করে করিয়েছে। ভাগ্যিস দেশে এখনো আইন আছে, তাই কোর্টে গিয়ে প্রমান করিয়ে আনা গেলো যে ওসব বাজে কথা। যারা বলেছিল, তারা এখন নেই, কিম্বা তারা কথা বলে না।

মার্কিন মুলুকেও আলোড়ন উঠেছিল বার তিনেক ভিসা ক্যান্সেল হল, কিন্তু র‍্যাম্বোর কিছু আসে যায় না তাতে। তার দেশে মদের দোকান নেই, লোকজন মদ খেতে পাশের রাজ্যে যায়। রাস্তা ঘাট চকচকে, চারিদিকে কারখানা, সবুজ খেত, পাকা বাড়ীর ফাঁকে কাঁচা বাড়ী চোখেই পড়েনা প্রায়। সারা দেশ নড়ে চড়ে বসলো। এমন উন্নতি তো দেখা যায়নি অনেকদিন? রতন টাটা দিদির খেলায় তাল সামলাতে না পেরে চলে গেলেন, তাঁর পাশে দাঁড়াল র‍্যাম্বো। আদানি রা তো নিজের দেশের লোক। ফিল গুড ফ্যাক্টার কাকে বলে, র‍্যাম্বো দেখিয়ে দিল চোখে আঙ্গুল দিয়ে। ঠিক যেভাবে শেয়ার বাজারে দাম বাড়তে থাকে মানুষ যখন ভাবে নিজে ভালো আছি, সেই "ভালো থাকবো", এই আশাতেই মনটা ফুরফুরে হতে থাকল দেশের মানুষের।

এমন করতে করতেই শাহাজাদার মুর্খামির ভার যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে দেশবাসীর কাছে, র‍্যাম্বো উঠে এলেন জন র‍্যাম্বোর মতোই একটা ইমেজ নিয়ে। সঙ্গে মিডিয়া, পেছনে সঙ্ঘ, আর অগ্রে বর্শার ফলার মতো চকচকে এক মানুষ এতো ডিটেলে ক্যাল্কুলেটিভ ইমেজ তৈরি এই ভারতে এর আগে আর হয়নি। দেশবাসীর চোখে ধাঁধা লেগে গেল।

সময় এলো দেশের মানুষের রায় দেওয়ার। দেশের পরিবর্তনের ভার যে কি ভার, বঙ্গবাসী তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বছর তিনেক আগে, তাই বাংলাদেশ রাজী হয়নি আবার একটা পরিবর্তন দেখতে, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ-বিহার-পাঞ্জাব-রাজস্থান-কর্নাটক ভারতবর্ষের বেশীর ভাগ টাই কমলা হয়ে গেল, এন ডি টি ভি তে গ্রাফিক্যাল রিপ্রেজেন্টাশানে দেশটা একটা বড় পদ্ম পুকুর বলে মনে হয় যেন। দিদি বললেন বটে পোটেস্ট করুন, কিন্তু কেউ করলো না। দক্ষিনে কাণীমোঝির বাবা বললেন তাঁর কিছুই বলার নেই। চন্দ্রবাবু সীমাধরায় ফেরত এলেন দশটি বছর পরে, তিনিও র‍্যাম্বোর সাথে। আম্মা যদিও তাঁকে আর দরকার নেই র‍্যাম্বোর, তিনিও সাথে। যে র‍্যাম্বো চা বেচা দিয়ে শুরু করেছিল, ভাদনগরের স্কুলে অ্যাভারেজের বেশী নম্বর কখনই পায়নি, সেই নাটক আর ডিবেটের ফ্যান নিজের পাঁচশো কোটি ফ্যানের হাওয়ায় আজ দেশের রাজা।

সারা দেশ আবেগে ভাসছে। সবারই মনে হচ্ছে কি ভালো, কি ভালো! কাল থেকে চাল পনেরো টাকা, আর ডাল ৫ টাকা কিলো হয়ে যাবে। আর না হলেই বা কি, মনটা ভালো আছে তো, সেটাই শেষ কথা। বামপন্থা বলে আবার কিছু হয় নাকি? ধরমনিরপেক্ষতা? এদেশে তো ধর্ম একটাই, তাহলে সেখানে আবার নিরপেক্ষতা টা ঠিক কি জিনিস? যাঁরা একটু চিন্তাশীল, তাঁরাও বলছেন ইকনমি টা তো ভালো হবে? মার্কিন মুলুক কি অজুহাত দেখিয়ে ভিসাটা এবারে অন্ততঃ দেওয়া যায়, সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছেন। খুব হিসেব করে যাঁরা চলেন, তাঁরা বলছেন কিছু ভালো জিনিস তো দেখেছি গুজরাটে, দেখা যাক না কি হয়। চারিদিকে আশায় ভেসে আছে মানুষ।

র‍্যাম্বোর সোমবার অভিষেক। সারা দেশ চেয়ে আছে তার দিকে। আশা অনেক। ভরসাও করেছে দেশবাসী। চিন্তা একটাই। র‍্যাম্বোর দলের এক রাজা কবিতা লিখতেন, তাঁর একটা লেখায় এরকম একটা কথা ছিল - (এটা ভাব চুরি শুধু, কবিতার দায় লেখকের, রাজার নয়)

উচ্চতার ওপরে

ভগবান, যা কিছু করেছি সব, ওপরে ওঠার জন্য।

এখান থেকে পৃথিবী টা বড়ই সুন্দর।
দুঃখ গুলো সব ছোট হয়ে গেছে,
ব্যাথা দেওয়ার মতো কাছে কেউ নেই এখানে।
কারো কান্না শোনা যায় না আর।
হাসিগুলো ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু মুখ দেখে সুখ পাই।

সবার মাথা দেখতে পাই আমি,
সব্বাই আমার পায়ের নিচে দিয়ে যায়।
মাথার ওপরে যাদের পা ছিল
তারা সবাই আমার নিচে এখন।
আমার মাথায় কারো পায়ের ধুলো পড়েনা তাই আর।

তুমি ছিলে সঙ্গে, তাই উঠেছি, ওপরে, আরো ওপরে।
আরো উঠতে চাই।
জানতে চাই যেখানে কেউ যায়নি, কেমন লাগে সেখানে?
সেখানে কি পাখি আছে? তারা কি গান গায়?
গাছ আছে? ফুল ফোটে সেই গাছে? কি রং তার? নাকি সাদা?
সেখানে মেঘেরা কি স্নান করাবে আমাকে?
চাঁদ কি গল্প বলে যাবে?

তুমি থেকো সঙ্গে, উঠতেই থাকবো আমি
আরো, আরো ওপরে।
থামবো না, ভগবান।
শুধু একটাই জিনিষ চাই তোমার কাছে।
তুমি ভগবান, আমার
সঙ্গে থেকো। আর তখন আমায় মানা কোরো আরো ওপরে উঠতে,
যখন নিচের কিছুই দেখা যাবে না আর,
ওপরে উঠে নিচের কথা ভুলতে চাই না আমি।
নয়তো আমার অমরত্ব চলে যাবে।

র‍্যাম্বো, নিচের কথা ভুলে যাস নে ভাই। নিচের কথা ভুলে গেলে দেশের মানুষ তখন ফের বলবে নমো, ঢের হয়েছে, এবার নামো। সে কি কারোরই ভালো হবে?

১৭ মে, ২০১৪


No comments: