Friday, May 23, 2014

খুনে

খুনে

সোনার দেশ আমার। তাসের দেশের থেকেও বেশী নিয়মনিষ্ঠ, রূপকথার দেশের থেকেও সরল। পাপ বললে সব্বাই ভাবে কুকুরের বাচ্চার ইংরেজি। ব্রিটিশদের তাড়ানোর পরের থেকেই আমরা সোনার দেশ। আমরা সব্বাই ভালো। আমরা শুধুই ভালো চাই।  এখানে খারাপ নেই, অত্যাচার নেই, মেদিনীপুর আছে, সিঙ্গাপুর না থাকুক সিঙ্গাপুরি কলা আছে, কিন্তু কামতাপুর নেই। একদম নেই। এখানে অনেক ধর্ম আছে, কি কি, সেটা রাজনীতিকরা ভালো বলতে পারবেন। তবে ওনারাই বলেছেন, এখানের সব ধর্মের মাঝে একটা ধর্মই আছে, যেটা বলতে নেই, বাকিগুলো বলতে আছে।

আমরা শান্তিকামী মানুষ। আজ অবধি দু হাজার দু শো বছরে একজন দেশি বা বিদেশিকেও খুন করিনি, তা সে যতই বজ্জাত হোক না কেন। হর্ষবর্ধনের কথা থাক, ওনার তো মুন্ডুই ছিল না। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উনি কি কখনো কাউকে মেরেছেন? অশোক? একবার যুদ্ধে নেমেছিলেন বলে এমন শান্তি শিখেছিলেন যে এখনো পাঁচশো টাকার নোটে গান্ধীজির ছবির পাশে ওনার থাম্বার ছবি। তারপরে ধরুন গজনীর সুলতান মাহমুদ উনি তো গুজরাটে এসে এমন শান্তির বানী শুনিয়েছিলেন, যে তখন নেহাৎ নোবেল প্রাইজ ছিলো না তাই, নয়তো উনি পর পর উনিশ বার নোবেল পেতেন, শান্তির জন্য।  হিমু বলে এক রাজা ধর্ম গেলো ধর্ম গেলো বলে যুদ্ধ করতে গেলেন, বেঘোরে প্রানটাই চলে গেল। শাহ্‌জাহান অত কষ্ট করে মুমতাজের অমন একটা কবর বানালেন, তা নিন্দুকে বলছে ওটা নাকি কোন রাজার মন্দির ঝেড়ে বানানো। যত্তসব!

আমাদের শান্তিপ্রিয় দেশ। শান্তিই আমাদের শক্তি। এখানে কারোর ওপরে খুব ভালোবাসা হলে তাকে ডাকা হয় শান্তির ছেলে বলে। এখানে সবাই ভাই ভাই, অথবা ভাই বোন, অথবা বোন বোন।  এদেশ ভালবাসার দেশ। তাই গান্ধীজিকে কেউ খুন করেনি। টেগার্ট বা ক্ষুদিরামকেও নয়।  সিম্পসনের সাথে বিবাদ করেছিলেন তিনজন, সেই বিবাদে দুজন বেমক্কা মারা গেছলো আর একজনের ফাঁসি, তা সেই বিবাদের কথা ভেবেই রাইটার্সের সামনেটার নাম বিবাদি বাগ। বাগ টা আসলে বাগবিতন্ডা থেকে এসেছে, পরের পার্টটা বাদ দেয়া দেওয়া হয়েছে বাসের গায়ে বানাম লিকতে অসুবিদে হয়, তাই।  সেই সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পরের থেকেই আমাদের আরো উন্নতি। আমরা বাস ভাড়া বেড়েছে বলে ট্রাম পোড়াবো, এমন বোকা নই।  এই যে পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন হল, সে তো শুধু অভিনয়, দুনিয়াকে দেখানো আমরা কেমন লড়াই-লড়াই খেলতে পারি। সেই সময়ে পশ্চিম বঙ্গে একজন যুবকও খুন হননি - মানুদা নিজে সব্বাইকে বিদেশে ভালো চাকরী খুঁজে দিয়েছিলেন। দু একটা বদ ছেলে শুধু শুধুই পুলিশ গুলির টিপ প্র্যাকটিস করার সময়ে বন্দুকের সামনে চলে এলো, তাই বেঘোরে প্রান টা গেলো। তাদের বোনেদের আমরা কেউ রেপ করিনি। ইমারজেন্সির সময়ে সবাই নির্ভয়ে ছিল, কারন অত্যাচার হওয়ারই ভয় ছিল না, খুন তো কোন ছার। এর পরে ঐ যে নিন্দুকে বলে ভি পি সিংহ দলবাজি করে মোরারজি কে সরিয়ে দিয়েছিলেন, সে সব মিছে কথা - আসলে মোরারজী মুত্র খেতেন বলে সবার গন্ধ লাগতো, তাই ছেড়ে দিতে বলেছিলেন, তাতে মোরারজীর সন্মানে লেগেছিল তাই সরে গেছলেন।  অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে যখন সেনা নামলো, তাদের কামানের মাথায় হাঁড়ি বাঁধা ছিল, যাতে গোলার তেজ কমে যায়। ভিন্দ্রনওয়ালে বলে এক ভদ্রলোক সেই হাঁড়িতে লাড্ডু আছে ভেবে খেতে গিয়ে প্রান হারালেন।  ইন্দিরা গান্ধীকেও কেউ খুন করেনি, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরেও তাই কিছুই হয়নি, বিশেষতঃ দিল্লিতে, সবাই শুধু মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে আর চোখে কালো চশমা পরে  শোক পালন করেছেন, আর যাঁদের হাতে তলোয়ার/ছোরা/বন্দুক ছিল, তাঁরা আসলে কালো চশমা পরে ভালো দেখতে পাচ্ছিলেন না, তাই লাঠির বদলে ওগুলো নিয়ে বেরিয়েছিলেন। যে সমস্ত শিখ ঐ সময়ে চুল দাড়ি কেটে ফেলেছিলেন, সেটা হয় গরমের জন্য কিম্বা মাথায় উকুন হয়েছিল বলে, ভয় তাঁরা মোটেই পাননি। 

আমাদের উন্নত দেশ ও বটে। অনেকেই পাটনা যাননি, তাই জানেন না যে ওখানের গরুরা সত্যিই স্কুটার চেপে ঘুরে বেড়ায়, এবং সেই স্কুটারে ড্রাইভার ও থাকে। আগে গরুদের পায়ে হেঁটে চরতে হতো, সেই দেখে ওখানের মুখ্যমন্ত্রী থাকতে না পেরে ঐ ব্যবস্থা করেছিলেন।  রাজা ভাইয়া বলে একজন আছেন, তিনি আসলে আলোকনাথের ভাই। আরেক রাজা বাবু আছে, তিনি রাজা ভাইয়ার মাসতুতো ভাই নিশ্চয়ই। আর একজন তেলুগু ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি তো সুটকেসে টাকা আছে ভেবে দ্যান নি - আসলে নিজের ব্যবহৃত জাঙ্গিয়া দান করছিলেন এক সুটকেস কারন এখন আর ব্যবহার করেন না, কোন লোভী সাম্প্রদায়িক শক্তির সমর্থক সেই জাঙ্গিয়া চুরি করে নিয়েছে পরবে বলে, আর তার বদলে ঠেসে দিয়েছে টাকা। 


শান্তির দেশ, তাই মেদিনীপুরের গ্রামেও কেউ কখনো খুন হননি - ওগুলো সব আত্মহত্যা, আগেও, এখনো  কিছু ক্ষেত্রে ওগুলো সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দেওয়ার প্রতিবাদে জীবনদান। পশ্চিমবঙ্গে এখনো অবধি যত ধর্ষণ হয়েছে, সবই আসলে সাজানো কিম্বা সামান্য ঘটনা - মুখ্যমন্ত্রীরাই বলে দিয়েছেন, তাই এই নিয়ে প্রশ্ন করা মানে আপনি কিছুই জানেন না অথবা আপনি মূর্খ কিম্বা মাওবাদী। সঙ্ঘও হতে পারেন। পাঞ্জাবেও কেউ কোনদিন খুন হয়না, উগ্রপন্থা বলে ওখানে কিছু নেই, সরকার ও তাই কাউকে কিছুই বলেন না, পুলিশ আর মানুষ ওখানে ইয়ার দোস্ত। কাশ্মীরে তো কিচ্ছু হয়নি কখনো?  ওগুলো সব মার্কিনি দক্ষিন পন্থার কালো হাত, ভাই পাকিস্তান ওদের কথায় এসব দেখন্দারি করতে বাধ্য হচ্ছে, কারন ওরা গরীব আর আমেরিকা ওদের টাকা দিয়ে কিনে রেখেছে। দেখুন না, আমেরিকা টাকার জোরে প্রথমে সাদ্দামকে, পরে বিন লাদেনকেও মেরে দিলো, পাকিস্তানের সাধ্য কি তার মধ্যে বোম্বেতে লোক পাঠায়? টাকা দেবে কে? যার দেওয়ার কথা, সে তো ভারতবন্ধু, তার এদেশ বাসের স্মৃতিতে ধর্মতলায় জুতোর দোকান হয়েছে।

আমরা শুধু নিজেদের দেশেই শান্তির বানী প্রচার করি না, আমাদের আসে পাশেও এর জোর প্রভাব। বাংলাদেশে আমরা তো স্বাধিনতা সংগ্রামে সমর্থন জানাতে কিছু খুন করেছিলাম বটে,কিন্তু আমাদের ওখানে আর কোনো স্বার্থই ছিলনা, শুধুই বন্ধুতা। আমাদের ভদ্রতা দেখে পাকিস্তান, তারাও এত ভদ্র হয়ে গেছে, যে তাদের বর্তমান রাজার নামই শরীফ। আমরা মাঝে মাঝেই ভাবের ঘোরে ওদের সঙ্গে লোক পালটা পালটি করি, যায় কম, আসে বেশী, আর রাতের মেলায় এলে পাসপোর্টও লাগে না, এমনকি অস্ত্র নিয়েও আসা যায়। এই বাংলাদেশের কথাই ধরুন - ওখানেও তো মৌলবাদীরা নিশ্চিহ্ন। ওখানে তাই এখন সবাই হাসেন শুধু। একজন হাসেন না, তো সে তাঁর নাম দিয়েই চেনা যায়, আশা করছি উনিও কোন একদিন চাপতে না পেরে ফিক করে হেসে ফেলবেন। ওখান থেকে যাঁরা আসেন বনগাঁ-গেদে দিয়ে, তাঁরা সবাই আমাদের ভাই, তা তিনি আমার জামাতা হন, বা জামাতের লোক। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের রামায়নের পর থেকে মিত্রতা হয়ে গেছে। যেটুকু খামতি ছিল, সেটা সেই সঙ্ঘমিত্রার সময় থেকে একদম জমে ক্ষীর। আমরা ওখানে প্রতিনিয়তঃ লোক পাঠাই, একবার সেনা পাঠিয়েছিলাম বলে ওদের খুব আনন্দ হয়েছিল, তাই মিছিলে এমন ফটকা ফাটালো যে রাজীবকে চলেই যেতে হল আমাদের ছেড়ে। উনি থাকলে তাও শাহ্‌জাদাকে দেখতে হতো না, সে রাশিয়াতেই বেশ জীবনটা কাটিয়ে দিত।  তা যাই হোক, এখন ওখানে তামিল আর সিঙ্ঘলিরা গলায় গলায় ভাব করে রাস্তায় বেরোয়, এমন, যে একে অপরের দাদের ওপরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে সেলিকল লাগিয়ে সেই হাতেই দই ভাত মাখে, খায়ও। নেপালের তো ঐ বলতে নেই ধর্ম নিয়ে মাতামাতির শেষ ছিল না, কিন্তু কি হল, শেষ অবধি নিজেদের মধ্যেই মারামারি করে ফুল ফ্যামিলি একদিনেই যাকে বলে লাইক অ্যা ডাইমন্ড ইন দ্য স্কাই? আমাদের ওখানে ঢুকতে দেবে না বলেছিল, কিন্তু এখনো দেয় তো। তবে? আর চীন? আরে মশয়, চিনি খেয়েছেন তো? ও কোথা থেকে এলো? চীন থেকেই না? সেই কবেই আমদের ন্যাতা আমা লগে কয়্যা গেসেন চীনা গো চয়্যারম্যান, আমাগো চয়্যারম্যান। অগো লগেই না আমরা আমরা আমদানি করলাম কমিউনিষ্ট? কমিয়্যুন অর্থে সবাই, ইষ্ট অর্থে ভগবান। ওখানে সবাই ভগবান, একদম সবাই না হলেও দলের ওপরের দিকে যাঁরা আছেন, তাঁরা তো বটেই।  বেশ ছিলাম, এর মাঝে শালা বজ্জাতের দল কোত্থেকে ইষ্ট ফেলে নিয়ে এলো অ্যাল। ছোট বেলায় প্যান্ট পরতে ভুলে গেলে বড়রা বলতো অ্যাল দেখা যাচ্ছে তাই এরা যে সবাই ঐ করবে, তা আর বলতে? সে যাকগে, এইবারে ওরাও নেই, এরাও নেই। এরা একটু ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই দুই আর দুই। গ্রেসের গ্রেস দিয়ে পাস পাঁচ। আর আমরা? ভরা যুবতীর বুকের মতো, চৌঁত্রিশ।


এতো কিছু ভালোর পরে একটাই জিনিস ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে - শেষে কিনা দেশের একমাত্র খুনেটা রাজা হয়ে বসবে? যে আমরা এত কালচারে বিশ্বাস করি যে আমাদের কালচারকে কালআট বা পরশুষোলো বলা যায়, যে আমরা শূন্য আবিষ্কার করেছি বলে ঐ না ধুয়ে জল খাই না, সেই আমাদের রাজা এই লোকটা হবে? যে বাংলার সীমান্তে বাংলাদেশ, আর তার বর্ডারে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, সিকিম আর হোয়াট নট, সেই বাংলার থেকে মুকুল, আম ও হয়নি সে এখনো, কচি, সে মুকুল পাঠাতে হবে দরবার করার জন্য? পতিবাদ করলে হয় না? বিধানসভায় এখনো কিছু চেয়ার টেবিল গোটা আছে, চিন্তা নেই। বিগেডে চলে আসুন, তারপর যাওয়া যাবে একসাথে।

আপনি আচ্ছা লোক তো মশয়? পুরো লেখাটা পড়লেন? না না, শ্লেষ নেই, বিশ্লেষন করে দেখুন। আপনি নিশ্চয়ই খূঁজছেন লেখক কোন দলের? বাম? দক্ষিণ? সঙ্ঘ? সিমি? হতেই হবে? এ যেন সেক্স এর মতো পুরুষ, নারী, উভকামী, সমকামী সব চলতে পারে, কিন্তু কিছুতেই লিখতে পারবেন না নির্লিপ্ত অথবা অতিকামী সে আপনি যতই আঠেরো বা আশী, যাই হোন। আর আপনি যদি এখনো সেটা না খোঁজেন, যদি আপনার মনে হয় নিরপেক্ষ বলে কিছু হয়, তাহলে লেখক আপনার বন্ধু হলেও আপনি বড়ই একা, কিম্বা আপনি আজকে বউ বাড়ী নেই বলে ভরপেট্টা মদ খেয়েছেন।  বরং যদি লেখক কে ফোন করে ধমকাতে পারতেন, কিম্বা পুলিশ দিয়ে হুড়কো, নিদেন পক্ষে হাতে ধরে বেধড়ক মার, তাহলে আপনি মানুষের সাথে আছেন। নয়তো আপনি ভেড়া। দলে ভিড়ে যাওয়াটাই এখানে নিয়ম।  ছেলের স্কুলের একটা ফর্মে কাস্ট জানতে চেয়েছিল। আমি লিখেছিলাম নট অ্যাপ্লিকেবল। একজন শিক্ষিকা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে খুঁজে নিয়ে বললেন এ সব অনাচার চলবে না, কাস্ট ইজ মাস্ট। আমি লিখে দিয়ে এলাম আদিভৌত-জ্বরাথ্রুঠ। ওনার চোখে জিজ্ঞাসা তারপরেও ছিল, কিন্তু শেষ অবধি খুব নিপীড়িত কোনো দলের লোক ভেবে চলে গেলেন।

ধর্ম থাকলে ক্ষতি কি বলুন তো? না থাকলেই বা কি হয়েছে? ধর্ম আছে বলে কি জিরাফ নেই? আচ্ছা, জিরাফের ধর্ম ছাড়াও তো তাকে চেনা যায়, তাই না? মানুষকে যাচ্ছে না কেন? কর্ম আর কাজ তো ভুলেই মেরে দিয়েছি, ধর্ম আছে সেটা না ভুল্লেও চলে, আবার ভুল্লেও ক্ষতি নেই। আমার ধর্ম আমার, আপনার ধর্ম আপনার, কিন্তু আমি আর আপনি আগে তো জন্মালাম, তার পরেই না ধর্ম এলো? আমি ধারমিক হয়ে মন্দিরে বা মসজিদে যেতে পারি, কিন্তু সেই আমিই আবার আপনার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গর্তে আটকে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্স ঠেলতে পারি সে ব্যাটা বুঝবেও না আমি কোন ধর্মের আর আপনি কোন, সে শুধু আমাদের দুয়ের হাতের জোরে গর্ত থেকে উঠে পড়বে, বাঁচবে রূগীটা। 

1 comment:

Amitabha Gupta said...

Eta too Good hoyeche.... Too Good.