ছায়া-চিত্র
১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীন হল, নকশাল্বাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে উঠল, আমি চার বছরে পা দিলাম, আমার চিকেন পক্স হল
– এসব তো হলই, কিন্তু আরো দুটো খুব
মনে রাখার মতন ইভেন্ট হল। একটা হল আমার স্কুল এ ভর্তি হওয়া, আর আরেকটা হল বিয়েবাড়ি। জীবনের প্রথম মনে থাকা বিয়েবাড়ি, তাও আবার একটা নয়, দু দুটো। একটা আমার
জেঠতুতো দিদির বিয়ে, আরেকটা আমার মাসিমনির।
জেঠুর বাড়িতে একটা ঠাকুর এর মশারি টানানোর
স্ট্যান্ড ছিল, সেটা একটা ২ ফুট বাই ২ ফুট কাঁচির মতন জিনিস
– ভাঁজ করে দিলে ঘরের কোনায় লাঠির মতন দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, আবার খুললেই ইংরেজি এক্স এর মতন – সেটা ঠাকুরএর সিঙ্ঘাসনের দুই পাশে দুটো গুঁজে দিয়ে ঠাকুর এর
ছোট্ট মশারী টানাতো আমার মেজোমা, মানে আমার দিদির মা।
দিদির বরকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি, তাই ওই স্ট্যান্ডটা
দিয়ে পায়ের দিকটা কেটে দেওয়ার চেষ্টা করে বেশ বকা খেয়েছিলাম, কারন ভদ্রলোকের বোধহয় রক্ত জমে কালসিটে পড়ে গেছলো। কিন্তু মাসিমনির
বিয়ে হল যার সঙ্গে, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অপুর পিসতুতো দাদা, অমায়িক ও মজাদার লোক, চুটকির বাদশা, তাই তার উপরে একটুও রাগ হয়নি। তবে মেসো বলে ডাকিনি কখনো, এখনো অমলদা বলেই ডাকি। ওদিকে দিদির সেই বর এখন বিদায় হয়েছেন
ভালোয় ভালোয়, এখন ওখানেও ফ্রেশ জামাইবাবু, দারুন লোক।
দিদির বিয়েটা কোন ফাঁকে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম
না, কিন্তু মাসিমনির বিয়েটা বেশ একটা অনেকদিন এর অনুষ্ঠান হল। অপুরা
থাকতো আমাদের পাশের কোয়ার্টারটাতেই, কিন্তু বিয়ে আর বৌভাত
হল দুটো বাংলো ভাড়া নিয়ে। খুব মজা হল, আমাদের বাড়িতেও অনেক
লোক, অপুদের বাড়িতেও তাই, আর সবাই খুব খোশমেজাজে
আছে, তাই অনেক কিছু করলেও বকা দেওয়ার সময় নেই কারু।
অপুর জ্যাঠামশাই এলেন, জেঠুর নাম ছিল মনোরম, কিন্তু দেখতে মোটেই
তা নয়,
সেটা বোধহয় বলার দরকার নেই। বিশাল মোটা, নাকের উপর ইয়াব্বড় একটা আঁচিল, অপু ডাকতো জ্যাজা বলে, আর জেঠিকে সুর মিলিয়ে
বলতো আজা। মানুষটি কিন্তু খুব ভালো, খুব ভালো লেগে গেল
তাঁকে। তিনি এসেছিলেন একটি উইলিস এর জীপ নিয়ে, আর খেতেনও উইলস ভার্জিনিয়া, তাই তখন থেকেই জানি ওটা খুব বড় কোম্পানী। জীপটার হর্নটা বাজছিল
না, তখন আমি বলেছিলাম মাসিমনির হারমোনিয়ামটা তো ওরাই নিয়ে যাবে, তো সেটা সামনের সিটে বসে বাজালেই হয়। সবাই বিশ্রী ভাবে খ্যাঁক
খ্যাঁক করে হাসল, আর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে আমি আর কোনদিন
কোনো সাজেশ্ন দেবোনা।
বৌভাতের পরের দিন দুপুরে সবাই দেখলাম বলছে
বই দেখতে যাবে। বই আমার অতি প্রিয় জিনিস, ছোটদের ছবিতে রামায়ন
আর মহাভারত মুখস্ত তখন, লেখা কিছুই পড়তে পারিনা, কিন্তু লেখার ছবি দেখে বলে দিতে পারি ওখানে কি লেখা আছে, এমন মুখস্ত। ছবির বইতে পড়া কবিতাও মুখস্ত – “বল্লে শশক, এমন কেন, আঁধার আঁধার লাগছে যেন? সূর্যটা কি হঠাৎ গেলো
ডুবে?”।
আমি মহানন্দে কাউকে কিছু না বলে পেছন পেছন
হাঁটা দিলাম। সবাই যখন অনুরাধা হলে ঢুকছে, জ্যাজা আমাকে দেখতে
পেয়ে “একিরে, বাবু, তুই কখন এলি?” বলে সঙ্গে ঢুকিয়ে নিল, দেখলাম আসলে এরা সিনেমা দেখতে এসেছে।
ছবির নাম অমানুষ। একটা আধমোটা লোক, নাম মধু, হাড় বজ্জাত, শুধুই মদ খাচ্ছে আর চুকলি কাটছে। আর রেখা বলে একটা মেয়ে শুধুই
লজ্জা পাচ্ছে। আজা বলল শর্মিলা কিন্তু ফিগারটা একরকমই রেখেছে, আমি ভাবলাম যাহ্ শালা, এটা তো আমিও জানতাম, এটা তো অপুর বোন বনির মতই দেখতে, আর বনির স্কুল এর নাম তো শর্মিলা। ওকে নিয়ে এরা সিনেমা বানালো? কিন্তু সিনেমাটা চলতে থাকলো, আর দেখলাম মধু লোকটা
আর তেমন বাজে নেই। একবার কি একটা কারনে স্টিমারে উঠে গানও ধরল – বেদানার বালু চরে। কিছুদিন আগে ছাগল চরতে এসে আমাদের বাগানের
গ্যাঁদা ফুলের গাছগুল মুড়িয়ে খেয়ে নিয়েছিল, আর আমি তখন বাবার একটা
ধুতি নিয়ে লুঙ্গি পরা প্র্যাক্টিস করছিলাম, তাড়া করতে গিয়ে মুখ
থুবড়ে পড়ে একটা দাঁত ভেঙ্গেছিলাম। আমি ভাবলাম বেদানার তো খুব দাম বাবা বলে, আর তাই বোধহয় বালু চরতে এসে সেই বেদানা গাছ খেয়ে নিয়েছে বলে
মধু দুঃখ করছে, খুব গরীব মানুষ তো, তাই। কিন্তু বালু তো বালি, সেটা চরবে কি করে, সেটা বোধগম্য হল না। ফিরে এসে অপুকে উল্টো অনুবাদ করে দেখালাম
– মৌমাছি পেরেক বিজিৎস্ রীজন জুতো লা (মানে ডো-রে-মি-ফা-সো-লা-টি
থেকে ধা এর রিপ্লেসমেন্ট), অর্থাৎ বিপিন বাবুর
কারন শু ধা, অপু একটুও ইম্প্রেসড্ হল না, বলল ওর স্থির বিশ্বাস আজকে বকা না খেলেও পরে বকা খাবই। ওদিকে
দেখলাম ফুলদি ছোড়দিকে বলছে, আরে ওটাই তো উত্তমকুমার, বুঝলাম মধুর আরেটাও নাম আছে, আর সেটাই বেশি চলে।
শোলের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু দেখতে দেয়নি বলে উত্তেজনার কারণটা বুঝতাম না। অপুর বাবা
রাখুদা কালীপূজোর দিন সকালে বাজি কিনতে আসানসোলে যেত, হয়তো কোনো যোগাযোগ আছে, এটাই ভাবতাম। তারপর
একদিন ছোড়দাকে ধরে গল্পটা দু বার শুনলাম, খুব জমাটি লাগলো। জামার
ভেতরে হাত ঢুকিয়ে রেখে ঠাকুরসাব এর মতো শুধু পা দিয়ে মারপিট এর চেষ্টা করেছি অনেকবার।
এরপর ফুলদি লালকুঠি দেখতে গেলো, আমিও ঝুলে পড়লাম সঙ্গে।
পরের দিন পেয়ারাগাছের ডাল ধরে অপুকে একটা ড্যানি স্টাইলে উড়নকিক্ মারতে গিয়ে ডালটা
বেয়াদপি করল, হাঁটু তে নিবাসালফ লাগিয়ে ঘুরতে হল এক সপ্তাহ।
আরো একটা ছবি বাবা দেখতে দেয়নি, সেটা হল এন্টার দ্য ড্র্যাগন। কিন্তু ক্লাস নাইনে পড়ার সময় চিত্রালয়তে
এলো রিটার্ন অফ দ্য ড্র্যাগন, সেটি দেখার অনুমতি
মিলল। ব্রুস হয়ে গেলেন অনুপ্রেরণার চূড়ান্ত। সেবার পুজোর সময় গ্রামে গিয়ে তারাপদ মিস্ত্রির
বাড়িতে হাজির হলাম, তৈরি হল মোল গাছের ডাল কেটে আমার প্রথম নান্চাকু, শিকল পাওয়া গেলো না বলে কাঠ দুটো জোড়া হল নাইলনের দড়ি দিয়ে।
অনেকদিন সেটা ব্যবহার করেছি, আর ঝুমা, আমার বোন, ম্যাক্সিমাম ঠ্যাঙ্গানি
খেয়েছে ওটার। পরে কাপড় ভেজানোর সময়ে মা নান্চাকু দিয়ে কাপড় গুলো সাবানজলে ভালো করে
চোবাতো।
সেই শীতে দেখলাম হোয়েন দ্য নর্থ উইন্ড ব্লোওস, আমার দেখা সেরা ছবিগুলির মধ্যে একটা। বিধান ইন্সটিটুশনে ভর্তি
হয়েছি তখন, দুটো জেমস বন্ড এর ছবি দেখলাম, নেভার সে নেভার এগেইন আর অকটোপুসি। জীতেন্দ্রর একটা ছবি দেখলাম, নাম ইন্সান। চিত্রালয় টা আড্ডা আর সিগারেট খাওয়ার জায়গা হল।
মিঠুন এর অসংখ্য ছবি দেখলাম, জুলপি কেটে চুল পেছনের
দিকে বড় করলাম। আড়াই টাকায় ভিডিও হলে বেশ কিছু বড়দের ছবিও দেখলাম। এমনকি পেয়াসা দুলহন্ দেখতে গিয়ে হিমাদ্রির বাবা
দেখে ফেলল, আর আমি কি লুকবো, কাকু নিজেই লুকোতে গিয়ে দিশেহারা।
কিন্তু টুয়েল্ভে উঠে যেই ইজাযৎ দেখলাম, মনটা যেন কেমন একটা হয়ে গেলো। এরকম ও ভাবা যায়ে? একলা ছাতায় দুইয়ে আধা আধা ভিজেছে, সেই সিক্ততা পড়ে আছে খাটের পাশে, তাকে কে ফেরৎ দিতে পারে? আশেপাশের সব মেয়ে কে
অনুরাধা প্যাটেল মনে হতে লাগলো। এর বেশ কিছুদিন পরে, হল এর অন্ধকারে যখন
পাশের জনের হাত নিজের থেকেই উঠে এলো আমার হাতে, সেদিন বুঝলাম সিক্ততা
মনেও হয়, আর সে ছবির নাম “কাশ্”।
No comments:
Post a Comment