Sunday, November 17, 2013

যাত্রা শুরু

যাত্রা শুরু
নোহারীতে পুজোর সময় যাত্রা হবেই। তখন হতো, এখনো হয়। কিন্তু যেটা এখন হয় না, সেটা হল রামযাত্রা। রামযাত্রা, বা কেষ্টযাত্রা কি জিনিস সেটা যাঁরা জানেন না, তাঁদের জানিয়ে রাখি, ওঁটা হোল রিসোর্স ইউটিলাইজেশনের শেষ কথা। পাঁচ থেকে ছজনের দল। যে চাঁদ সওদাগর, সেই প্রম্পটার, আবার সে যখন স্টেজে, তখন যে প্রম্পটারি করছে, একটু পরে সেই একটা ক্ষুর, দুটো কাপড়ের পুঁটলি, একটা পরচুলা, একটা শাড়ি-ব্লাউজ, আর একটু ফেস পাউডারের ভরসায় হয়ে গেলো বেহুলা। মনসার যেই সিনে দরকার নেই, সেই সিনে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে রোশনাই বাড়ানোর জন্যে ক্ল্যারিওনেট বাজিয়ে নিলো, কিম্বা নিদেনপক্ষে মাউথ অরগ্যান। বাসরঘরে লখিন্দর ঘুমচ্ছে, বেহুলা গান গাইছে, সনকার ওই সিনে আসার দরকার নেই তাই সে প্রম্পটার, চাঁদসওদাগরও ছেলেবউমার বাসরঘরে থাকতে পারে না, তাই একটা কালো কাপর মুড়ি দিয়ে মাথায় একটা সাপের কিং সাইজ ফনা লাগিয়ে কালনাগ হয়ে গেলো। উপরি পাওনা, স্টেজে ঢোকার সময়ে ওই কালো কাপড়েই পা হরিয়ে আছড়ে পড়লো, অতএব বিষ ছোবলের এফেক্টটাও খুব রিয়েলিস্টিক হল। কেবল একজন, যে ওই দলের মালিক, তার কোন অ্যাপারেন্ট রোল নেই। কিন্তু তার রোলটাই সবথেকে ইম্পরট্যান্ট। মেন স্টেজের এক কোনায় বসে সে হারমোনিয়াম বাজাবে, ব্যাকগ্রাউন্ডের গানগুলো গাইবে, মাঝে মাঝে ট্রাম্পেট বাজাবে, বখশিশ্ এর পয়সা কুড়োবে। যদি বখশিশ্‌ খুব কম পড়তে থাকে, তাহলে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হদ্দ নোংরা ধুতি-ফতুয়া পরেই বিবেক হয়ে গেয়ে উঠবে পিথিবি আমারে চায়, রেখেচে বেঁধে ইয়ামায়, খুলে দাও ভগবান, জনতার ভরসায়। আর ওমনি ১ টাকা, বা ২ টাকাও পড়তে পারে বখশিশ্‌ হিসেবে।
তা এই আটচালা ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। আটচালা মানে তাতে আটটা চাল থাকবেই, প্রথম লেয়ারে চার কোনায় চারটে খুব উঁচু শালখুঁটির উপরে আড়কাঠ লাগিয়ে তার উপরে পিরামিড শেপ এর খড়ের চালা, চারটে ট্রায়াঙ্গেল দিয়ে বানানো, তার বাইরের পেরিফেরিতে আরো চারটে শাল খুঁটি, একটু বেঁটে, মেন পিরামিডের এক্সটেনশন ছাদটা তার উপরে বসানো, তার মানে আরো চারটে চালা, মোট আটটা। পেছনে দুর্গামন্দির, যাকে আমরা বলি দুগগাদালান। শ দুই বছর এর পুরনো, ইসলামিক ঘরানার প্যালেস এর আদলে ক্লাস্টারড পিলার এর উপরে আর্চ দেওয়া দ্বিস্তর মন্দির, কোন চুড়ো নেই, ফ্ল্যাট রুফ। ছাদের উপরে খাটো দেড়-হাতী পিলার দেওয়া ব্যালকনি, সেখানে সাধারন ভাবে ওঠা যায় না, কিন্তু মন্দিরের ডানদিকে একটা চেম্বার আছে, যেখানে লক্ষ্মী বসে থাকেন নিজের পুজোর দিন আসার অপেক্ষায়, সেখান দিয়ে ওঠা যায় একটু কষ্ট করে। সামনের ফ্যাসাডের দুই কোনের দুটো আর্চ সমান, কিন্তু মাঝের বড় আর্চ গুলোর মধ্যে বাঁ দিকের টা একটু বেশি বড়। মা এর মূর্তি ওইটা বরাবর বসনো পেছনের মেইন অ্যাট্রিয়াম এর ভেতরে। একচালা, কিন্তু চালার বাইরেও দুজন আছেন, যাঁদের নাম জয়া ও বিজয়া। মা যাত্রা দেখবেন, তাই আটচালার মাঝের চারটে খুঁটি দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘিরে দিয়ে স্টেজকে আইসোলেট করে দেওয়া হতো। আর আউটার পেরিফেরিটার নাম হয়ে গেলো আসর। রামযাত্রার সময়ে বিশেষ আলোর দরকার নেই, কারন ওটা বাড়ীর পূজোর দেখনদারির মূল উপাদান নয়, সেটার জন্যে সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর দিনগূলোতে আসল যাত্রা আছে, যার দল বাস ভাড়া নিয়ে আসে আরামবাগ থেকে, যাত্রার থেকে কত লোক হল সেই নিয়েই বেশি চিন্তা বাড়ীর লোকজনের। কিন্তু রামযাত্রা না হলে পুজো পুজো ভাব টা ঠিক আসে না, প্লাস রামযাত্রায় শুধু খাবারের খরচ দিলেই হয়, বাকি খরচা ওরা বখশিশ্ থেকেই তুলবে, এই চুক্তিতেই ওদের আনা হতো। অতএব পঞ্চমী আর ষষ্ঠীর দিন এক বা দুটো হ্যাজাক জ্বালিয়ে রামযাত্রা হতো। যাত্রার মূল প্যাট্রন মোট তিনজন আমার বড়জেঠুমনি, ভঁদুজেঠু আর কার্ত্তিকজেঠু।
ঠাকুরদারা ছিলেন পাঁচ ভাই। বড়জন আমার ঠাকুরদা, চারের বেশি যেতে পারেননি ভগবানের ডাক তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছলেন বলে, মেজোর দুই ছেলে তিন মেয়ে, সেজোর দুই প্লাস এক, ন এর চার প্লাস এক। কিন্তু ছোট জন ছোট বলে থেমে থাকেননি, সবাইকে টেক্কা দিয়ে নিজেই নোহারী বড় বসু বাড়ির ফুটবল টিমের বেশিরভাগটাই যোগান দিয়েছেন। উনি আট প্লাস এক, প্লাস আরও একটি, যাকে ভগবান ডেকে নিয়েছিলেন তার ছোটবেলাতেই। বড়টি অকালে চলে যাওায়ায় দ্বিতীয় জন কে ক্ষুদ এর বিনিময়ে মাতৃত্ব বদল করানো হল, তাই তার নাম ক্ষুদু, বা খুদু। তারপর ভগবান এর নজর যাতে না পড়ে, তাই পরেরটি খাঁদু। এর পরেরটি দেখতে অপরুপ সুন্দর, দুধে আলতা গায়ের রঙ, এক মাথা কালো চুল, তাই তার নাম কার্ত্তিক। তার পরের গুলির নামকরন নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার সময় ছিলো না, তাই অশোক, সুনীল, শোভন, অরুণ আর শিশির। মাঝে মঞ্জু, ওরফে আমাদের দুঃশ্বলা। এদের ডাকনাম নিয়ে গৌতম অ্যাব্ব্রিভিয়েশন করেছিল খুদ-খাঁদ-গগ-সুন-শো-মন-অর-শিশ। আসলে অশোককাকু ছোটোবেলায় খুব পরিষ্কার করে কথা বলতে পারতো না বলে শুনেছি, তাই গোঁ গোঁ থেকে গগো বা গগ। সঙ্গে নাম মিলিয়ে সমবয়সী আরেক পিসির নাম হয়ে গেলো অঞ্জলি থেকে গুগি। নাম নিয়ে নোহারীতে যা যা কুকর্ম হয়েছে, এটা তারই একটা উদাহরন। আরেকটা উদাহরন চৌধুরীবাড়ীতেও আছে বোকা আর পোকা। নোহারীর ভাষায় বকা আর পকা। আমার সেজোজেঠুর ডাকনাম আর ভালোনামের মধ্যে আজীবন সংঘর্ষ চলেছে, কারন ভালো নাম অহি ভূষণ (অর্থাৎ কিনা শিব) কিন্তু ডাকনাম নেউল একদম সাপে নেউলে ব্যাপার। আরো আছে, তার কথা পরে হবে।
তো আরামবাগের যাত্রা দল যখন সপ্তমির দিন স্টেজে উঠল, তখন চারিদিকে থিক থিক করছে লোক। আসরের ফার্স্ট আসনে বড়জেঠুমনি। কাতুজেঠুতো সেদিন সকাল থেকেই যার তার পেটে চিমটি কেটে বলত এবারে যাত্রাটা কেমন করছি বল?” “দেখে বলব বললে বলতো দেখবি দেখবি, আর ভাল না বোধহয় বললে খুব উত্তেজিত হয়ে সেখান থেকে চলে যেত হুঃ হুঃ করতে করতে। যাত্রা দেখতে বসবার সময় আসরেই বসতো, ঘুমতও। ভঁদুজেঠুও আসরে বসতো, কিন্তু মেইন টারগেটটা অন্য। যাত্রার সময়ে হ্যাজাকের বদলে লাগানো হতো ডে লাইট। ডে লাইট অনেকটা উল্টানো হ্যাজাকের মতন ব্যাপার, কিন্তু ছায়া পড়ে না, কারন তেল টা উপরে থাকে, ম্যান্টেল টা নিচে। একটা জার্মান ডেলাইট ছিল, সেটার জ্বালানো একটু শক্ত, কিন্তু এত আলো যে আর অন্য কিছু জ্বালাতে হতো না। ওদিকে সিরাজৌদ্দলাকে ব্রিটিশরা তাড়া করেছে, ভঁদু জেঠু একদম কুল, স্টেজের মাঝে ক্লাইভকে কাটিয়ে গিয়ে ডে লাইট পাম্প করতে শুরু করল, তারপর চারপাশ ভালো ভবে মেপে নিয়ে কত লোক হয়েছে দেখে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার বসে পড়তো। ওটাই আসল উদ্দেশ্য। আরেকজন ছিল, যার গোপন যাত্রাপ্রেম বোঝা যেত তার কিছু অ্যাক্টিভিটি দিয়ে।
বাবার ছোটকাকা ছিলেন পাশ করা কম্পউন্ডার, নিজের একটা ডিস্পেন্সারি ছিল তাঁর। দাদু মারা যাওয়ার পরে কাতুজেঠু সেটাতে প্র্যাক্টিস করতো কম্পাউন্ডারী, কারন পাস করা না হলেও বেসিক জ্ঞান খুব ভালো ছিল, ওষুধে খুব ভালো কাজ হতো। যাত্রার সময় ওই ডিস্পেন্সারিটাই হয়ে যেত গ্রীন রুম, আর জেঠুর হাতল ওয়ালা চেয়ারটা হয়ে যেত রাজার সিংহাসন। যাত্রা শুরু হওয়ার দশ পনেরো মিনিট আগে ওই চেয়ারে গিয়ে বসে পড়তো খাঁদুজেঠু। যতক্ষণ না যাত্রাপার্টীর কেউ এসে বলছে দাদা ভাই, এখন শুরু না করতে পারলে ভোরের আলো ফোটার আগে শেষ করা যাবে না, উঠুন দয়া করে, ততক্ষন বসে থাকতো।
এই যাত্রাদলগুলোর পুরো মিউজিক ব্যান্ড থাকতো, পুরো কস্ট্যুম ভাড়া করে আনতো, সত্যিকারের মেয়ে থাকতো, এবং একজন মেয়ে থাকতো, যে নায়কের যাত্রা-বউ। বোমা বা বন্দুক এর আওয়াজ এর জন্যে ছোটবেলায় দেখতাম বাচ্চু বোম বা চকোলেট বোম ফাটানো হতো, কিন্তু অনেক সময় ভিলেন পুরো ডায়লগটা বলার আগেই বোমা ফেটে গেলে সিন পুরো ফেল, তাই পরের দিকে জোরে আওয়াজ করার জন্য ওরা একটা স্পেশাল যন্ত্র আনত একটা লোহার রড ইংরেজি ইউ এর মতো ব্যাঁকানো। তার এক মাথায় একটা দু ইঞ্চি পাইপ আড়াআড়ি লাগানো, তার একটা মুখ আবার বন্ধ করা। অন্য মাথায় একটা দু ইঞ্চি ছোট রড আড়াআড়ি লাগানো। পাইপের মধ্যে গোটা কুড়ি ক্যাপ ঢুকিয়ে দাও, তারপর অন্য মাথার ছোট রডটা পাইপের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখো। ঠিক সময়ে ওটা ধরে মাটির ওপরে জোরে ঠোকো দুম! মাঝে মাঝে যাত্রা থামিয়ে ঘোষণা হতো – “নায়কের অভিনয়ে খুশি হয়ে শ্রী মন্টু তেলি নায়ককে পাঁচ টাকা পুরোসকার এ পুরোসকৃত করলেন তারপর একজন সেফটি পিন (আমরা বলতাম সেপ-টিপিন) দিয়ে ৫ টাকার একটা নোট নায়কের বুকে লাগিয়ে দিতো। আর নায়িকা হলে পাঁচ বার ১ টাকা করে পুরস্কার, অনেকে খুচরো করিয়ে আনত আগের থেকেই। নোট টা সেফটি পিন দিয়ে লাগানোর সময় একটুকু ছোঁয়া ইন্সটলমেন্ট নেওয়ার গল্প সেটা। 

যখন আমি বেশ ছোট, তখন বেশিরভাগ যাত্রা হতো পৌরাণিক, আর কিছু ঐতিহাসিক। পরের দিকে কস্টিউমের খরচা বাঁচাতে একদিন করে সামাজিক পালা। মোটেই ভালো লাগত না। ঝলমলে ড্রেস নেই, বন্দুক নেই, তরোয়াল নেই, রাজা নেই, যুদ্ধ নেই, ঝম করে চমকে দেওয়া বাজনা নেই, শুধু লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে নায়কের মা কাঁদছে। যাত্রা দেখে পরের দিন রতনদা কে ধরে বাঁশের বাতা কেটে তলোয়ার বানাতে বলার ইচ্ছেটাও কমে গেলো আস্তে আস্তে। রাত সাড়ে তিনটের সময় যাত্রা শেষ হওয়ার পরে লাল ডাঙ্গা যাওাটাই তখন মনে হতে লাগলো অনেক বেশি আকর্ষণীয় বস্তু। পাল্টে যেতে থাকলো সবকিছু। খাঁদু জেঠু গেছে সবার আগে। চেয়ারটার একটা হাতল আগেই গেছল, তারপর এক পুজোয় গিয়ে দেখলাম বাকিটা উই এর খাবার হয়ে গেছে। সামাজিক পালাতে সিংহাসনের দরকার হয় না, তাই নতুন চেয়ার আর আসেনি। বড়জেঠুমনিও চলে গেছে অনেকদিন। ভঁদুজেঠুর অনেক বয়স এখন, হ্যালোজেন এর আলোতে পাম্প করারও দরকার হয়না আর। বছর কয়েক আগে চলে গেলো কাতু জেঠু। আমিও যাত্রা দেখিনা আর।

No comments: