বগড়ী রোড
আমার ঠাকুরদা চাকরী করতেন পুলিসের অফিসে।
আদ্রা-খড়গপুর রেল লাইন যখন পাতা হচ্ছে, অনেক তদ্বির করেছিলেন যাতে রেল লাইনটা যায়
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে। সেটা আটকে গেলো একটাই কারনে – শীলাবতী
নদী আমাদের গ্রামের কাছে খুব চওড়া,
অথচ একটু পরেই তা আবার সরু হয়ে গেছে, আর সেখানে
দুদিকের জমিও বেশ উঁচু। ব্রিজ বানানোর খরচা কমাতে রেল কোম্পানী রেল লাইন নিয়ে গেলো
এক্সট্রা ১০ কিলোমিটার ঘুরিয়ে গড়বেতা থেকে পিয়ারডোবা। ঠাকুরদার কথা রাখতে অবশ্য মাঝে
একটা স্টেশন হল, তার নাম বগড়ী রোড। রোড, কারন রেল মাইনের পাশ বরাবর লাল মাটির রাস্তা, আর সেই ব্রিজের
স্লিপার জূড়ে বসানো হল লোহার পাত,
যাতে মিলিটারির গাড়ী তার উপর দিয়ে পেরোতে পারে। যদিও বেশ অনেকটাই
দূরে গ্রাম থেকে, কিন্তু তা হলেও সে আমাদের নিজেদের স্টেশন। সেই স্টেশনে যেদিন
প্রথম রেলগাড়ী দাঁড়ালো, দাদু তার উদ্বোধন করে ট্রেনে চাপলেন মেদিনীপুর যাবেন বলে, যাবার সময়
বলে গেলেন এবারে ঘন ঘন আসাটা সহজ হবে, নিজেদের স্টেশন হয়ে গেছে যখন। দুই সপ্তাহ
বাদে তিনি এলেন বটে, তবে খাটে শুয়ে, প্রাণহীন। আমার বাবার জন্ম তার ও মাস চারেক
পরে।
এই বগড়ী রোড কেন রোড, সেটা তো
বললাম, কিন্তু বগড়ী টা আমি ছোটবেলায় ভাব সম্প্রসারণ করে নিয়েছিলাম খুবি
সহজে। রেললাইনের পাশের ঢালু জমিতে সবুজ ঘাস, সেখানে অনেক গরু ছাগল বাঁধা থাকতে দেখেছি।
সেই ছাগল, যাকে ঈন্দার সিং বকরি বলে, তার থেকেই শিওর এই নাম। রেললাইন ধরে ছশো মিটার
গেলেই শীলাবতী নদী, পেরলেই ওপারে বাঁদিকে ইন্ডিয়ান গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, যার নাম
গণগণী ডাঙ্গা। ঠাকুমার কথায়,
ওখানেই নাকি পাওয়া গেছলো বকাসুর এর বুকের হাড়। আরেকটু বড় হতে
বক-আর-রী থেকেও যে বগড়ী হতে পারে সেটাও ভেবেছি। অনেকদিন পরে জেনেছি, ওদিকের খুব
জাগ্রত দেবতা হলেন বগড়ী কৃষ্ণরায় জী, ওনার নামেই এই নাম।
দাদুর সময়ে যতই ঘটা করে স্টেশনটা খোলা হোক, আর প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের যতই ইম্পরট্যান্স থাকুক ওই ব্রিজের, দেশ স্বাধীন হওার পরে নানাবিধ অসুবিধে দেখা
দিল। গড়বেতা বিষ্ণুপুর এর মাঝে তৈরি হল রোড ব্রিজ, তাই গাড়ী আর এদিক দিয়ে যেত না। স্টেশনের সামনে
শুধুই ধানক্ষেত, তার একটু পরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে আরাবাড়ী রেঞ্জ। নিয়ারেস্ট গ্রাম
একাড়ে, কিন্তু সেখানে নাকি অনেক ঘর ডাকাতের বাস। স্টেশনে প্রায়ই ডাকাতি
হতে লাগলো। আবার মাঝে মাঝে হাতির আক্রমন। শেষে এমন হল, কোন স্টেশন
মাস্টারই পোস্টিং নিতে চায় না। এইভাবেই, দিন কে দিন অনাদরে থেকে থেকে ষাটের দশকের
প্ত্রথম দিককার কোন এক সময়ে উঠে গেলো স্টেশন, বগড়ী রোড হয়ে গেলো হল্ট। প্লাটফর্ম নেই, ঘন্টা নেই, শেড নেই, আলো নেই, কুলি নেই, টি টি নেই, টিকিট নেই, এমনকি জল
ও নেই - রয়ে গেল কেবল আধভাঙ্গা একটা স্টেশনঘর, আর নিচে, রাস্তার ওপাশে একখানা
কুঁয়ো।
এই যখন স্টেশন এর অবস্থা, তখন দিনের
বেলাতেই যে যাওয়া হবে, সেটাই নিশ্চিত। হয় সকালবেলার আসানসোল-পুরী প্যাসেঞ্জার, অথবা একটু
পরের আদ্রা-খড়গপুর প্যাসেঞ্জার ধরে বাঁকুড়া থেকে প্রচুর সবজি কিনে উঠে পড়তাম আমরা।
ভানুকাকু মাঝে মাঝে সাহস করে বিকেলের গোমো প্যাসেঞ্জার এও গেছে। পুরি প্যাসেঞ্জার এর
টাইমিং টা আমার সবথেকে ইন্টারেস্টিং লাগতো, কারন ওটা যে সময়ে বগড়ী রোডে পৌছয়, তার আশেপাশেই
খড়গপুর-আদ্রা প্যাসেঞ্জার ও পৌঁছয়। নোহারীর যারা বাইরে থেকে আসে, তাদের বেশীরভাগ
লোকজন আসে কলকাতা, খড়গপুর আর রাউরকেল্লা থেকে – এদের সবাইকেই ওই
খড়গপুর আদ্রা প্যাসেঞ্জার ধরতে হয়। অতএব সবার সঙ্গে এডভান্স দেখা হয়ে যাচ্ছে স্টেশনেই।
যে স্টেশনে অন্য সময়ে দিনের বেলাতেও দু একজন লোক দেখা যায়না, সেখানে ষষ্ঠীর
দিন একসঙ্গে দেড়শ লোক। ১২-১৪টা গোরুর গাড়ী। ২০-২২জন মুনিষ। ট্রেন স্টেশনে ঢুকবার আগের
থেকেই প্রথমে বাবারা, পাশ দিয়ে দাদারা, আর নিচে দিয়ে আমি মুখ বার করে রাখছি। রত্না, খকনা, বদ্যিনাথ
অথবা নিদেন পক্ষে ফ্যারাং, এদের কাউকে দেখতে পেলেই হই হই করে উঠতে হবে। ভানুকাকু আগে নেমে
চলে যাবে টি টি কে হড়কাতে, আর বাকিরা একটা করে ব্যাগ/স্যুটকেস/হোল্ডল/বস্তা বাড়িয়ে ধরবে, সেটা নামাবে
কোন একজন মুনিষ, তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে বাবা জিজ্ঞেস করবে “তুই কার
ছেলা?”, আমি নামবো মা আর দিদি দের সঙ্গে, একটু বড়
হওয়ার পর একা একাই, অন্য দরজা দিয়ে। সবাই নেমে যাওয়ার পরে ভানুকাকু টি টি কে হাত
নাড়বে, আর ট্রেন ছেড়ে দেবে। কখনো যদি ট্রেন আগে ছেড়ে দেয়, তাহলে কেউ
চেন টানবে, টি টির বাবা,
মা ও বোন এর যৌনজীবন নিয়ে ভানুকাকুর নেতৃত্বে উচ্চস্বরে আলোচনা
শুরু হবে যতক্ষণ না উনি ক্ষমা চাইছেন, এবং সবার শেষে ভানুকাকু হেসে হাত নাড়লেই ট্রেন
আবার ছাড়বে।
ট্রেন যখন বাঁক নিয়ে শীলাবতীর উপরে উঠছে, তখন তার
আবছা হয়ে যাওয়া লেজ আর আকাশে হাল্কা হতে থাকা স্টিম ইঞ্জিন এর ধোঁয়া দেখতে দেখতে আমরা
রেল লাইন পেরিয়ে উল্টোদিকের মিনি মাউন্টেনিয়েরিং ট্রেনিং করতে করতে ঢালু জায়গা দিয়ে
লাল মাটির রাস্তার দিকে নামবো। এর মাঝেই কেউ আমার গাল টিপে দেবে যেটা আমার মোটেই ভালো
লাগবে না কিন্তু নোহারীর কথা ভেবে মেনে নেবো, কেউ কাউকে প্রনাম করবে, কেউ তার
গত পুজোর হার্টথ্রবকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসবে, আর ছোড়দা চলে যাবে ভাঙ্গা স্টেশন ঘর এর পেছনে
গিয়ে চট করে একটা সুখটান দিয়ে নিতে,
সঙ্গে শান্তনু কিম্বা ভ্রমরদা। এরপর বাবা আর দাদারা প্যান্ট
গুটিয়ে নেমে পড়বে আল এর উপরে,
শর্টকাটে বাড়ি পৌছনোর জন্য, আর আমরা উঠে বসব গরুর গাড়ীতে।
এ হেন নোহারী যাত্রায় একবার বাধা পড়ল ১৯৭৮
এ। পুজোর কিছুদিন আগেই দু দুবার ভয়ঙ্কর বন্যা হল, সমস্ত সাবধানতার রেকর্ড ভেঙ্গে বাবা সেবার
পুজোর আগে আমাদের নিয়ে ঘুরতে গেছে নর্থ ইন্ডিয়া, চতুর্থীর দিন ফেরত এসে শুনলাম বড়জেঠুমনি চিঠি
দিয়েছে যে “প্রচন্ড বন্যায় সমস্ত রাস্তা ঘাট ধুইয়া গিয়াছে, বাড়ী ভগ্নপ্রায়, খাদ্যসামগ্রি
বিশেষ পাওয়া যাইতেছে না, তোমরা আসিলে থাকিবার বন্দোবস্ত করিতে আমি অপারগ”।
মনটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেলো। যাওয়া হবে
না? শুনলাম বাবা,
সেজোজেঠুমনি যাচ্ছে। জেবুলির (মানে আমার মেজোজেঠু) সঙ্গে মেজমাও
যাচ্ছে, কারন দাদা আসবে মেসরা থেকে, মেজমা না গেলে একা খুব বিভ্রাটে পড়বে। অনেক
রাত্রে সেজমাও বলল যাবে। শেষে সকালে দেখি ফুলদি আর ছোড়দিও রেডি হয়ে হাজির। মা বলল, তাহলে আমরাই
বা বাদ থাকি কেন? শেষ অবধি সবাই গেলাম, গেলো না কেবল ছোড়দা।
তার এক সপ্তাহ আগেই দুর্গাপুর ব্যারেজ এর
কাছে রাস্তা বন্যায় ভেসে গেছে,
তাই ওই রাস্তায় আর বাঁকুড়া যাওয়া যাবে না। ট্রেনে করে আসানসোল
– বার্নপুর –
আদ্রা - বাঁকুড়া হয়ে যেতে হবে। স্টেশনে পৌঁছে দেখি বাবুনরা, শর্বাণীরা
– সবাই হাজির। অ্যান্ড হাজির ভানুকাকু। ব্যাস, খেলা জমে
গেল। প্রচণ্ড হুল্লোড় করতে করতে সারাদিন ধরে ৩ বার ট্রেন পালটে ট্রেন যখন ছাতনা স্টেশন
ছাড়ছে, সূর্য তখন অনেক দূর এর গাছগুলোর ঠিক মাথার উপর দিয়ে তুপ করে
নেমে গেলো, আমার শুকতারাটা আর পড়া হল না, কারন ট্রেনে আলো জ্বলছে না। সেই অন্ধকারে
ট্রেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলতে চলতে যখন বগড়ী রোড পৌঁছল, তখন রাত
দশটা।
দেখি হ্যাজাক নিয়ে খোকনদা আর রত্নাদা দাঁড়িয়ে
আছে। বড়জেঠুমনি খুব একটা সিওর ছিল না চিঠি পৌঁছেছে কিনা, তাই লোক
আর হাম্বাস্যাডার পাঠিয়েছে ঠিক। সেবারই প্রথম বাবাও দেখলাম গরুর গাড়ীতে চড়লো, কারন বন্যায়
আল আর জমি এক হয়ে গেছে। আমরা নেমে গাড়ীতে উঠতেই হ্যাজাক নিভিয়ে দেওয়া হল যাতে
ডাকাতরা আমাদের অন্ধকারে দেখতে না পায়। দুটো গরুর গাড়ী চলা শুরু করল, পেছনে একজন
করে হেল্পার হেঁটে আসছে, নিঝুম রাত্রি, আলো বলতে শুধু দেখতে পাচ্ছি পেছনে বাবাদের
গাড়ীটার নিচে ঝোলা লন্ঠন এর দুলতে থাকা আলো, আকাশে কিছু তারা আর অনেক দূরে গড়বেতা শহরের
উপরের আকাশটা বেশ আলো আলো। চাঁদ একটা আছে বটে, কিন্তু সে বড়ই মৃদু। মেজমা হঠাৎ বলে উঠল “এই খগনা, একাড়ে পেরিয়ে
গেছি তো?” খোকনদা বলল “এই তো,
এখন পেরচ্ছি”। ব্যাস, মেজমা প্রথমে
মৃদু স্বরে, তারপর জোরে জোরে, শেষে প্রায় গলা ফাটিয়ে বলতে শুরু করল “জয় গুরু
জয় গুরু”। মেজমার খগনা একবার বলল “এমন গোল
করলে হবে নি”, কিন্তু মেজমা কে কে থামায়? শেষে রাস্তার ধারে কেউ একজন যেই বলেছে “অ্যাই, কে রে, এত গোল করতে
করতে জাচ্চু ক্যানে? মানুষের পেচ্ছাপ বাঝ্যি বন্ধ করে দিবে নাকি?” ওমনি মেজমা চুপ। খালে পৌঁছে আমাদের গাড়ী থেকে নামতে হল, কারন পাড়
গেছে একদম ভেঙ্গে, খুব সাবধানে গাড়ী পার করে, আমরা প্যান্ট আর জুতো ভিজিয়ে ওপারে পৌঁছে
আবার গাড়ীতে উঠলাম। এগারোটাই সময়ে আমরা অবশেষে বাড়ি ঢুকলাম। দেখি এত বন্যার গল্পের
মাঝেও রামযাত্রা হচ্ছে হ্যাজাক জ্বালিয়ে। ফার্স্ট রো তে, হ্যাঁ, বুবুদা।
এবারো আমার আগে পৌঁছে হাঁ করে বুকে কাপড়ের পুঁটলি গোঁজা মনসারূপী একজন পুরুষকে দেখছে
এমনভাবে, আমি ওইভাবে নীলমকেও দেখি না, ভারতী সাহা তো দুরের কথা।
No comments:
Post a Comment