গানের গুঁতো
সেটা ১৯৭১, তখনকার জমানায় যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল ট্রাঞ্জিস্টার
রেডিও – অনেকটা পরবর্তী কালের নোকিয়া ৩৩১০র মতন। তো জেঠুর বাড়ির থেকে
নিজেদের কোয়ার্টারে আসার পরে বাবা অনেক কষ্ট করে টাকা বাঁচিয়ে কিনে ফেলল একটা – সেই একটা
কেনা মানে এখনকার স্যামসাং এস ফোর কেনার মতন, রেশন কার্ড দেখালে ভালও হয় টাইপের ব্যাপার
– সেটার নাম ছিল বুশ ব্যারন, সেটাতে গান, খবর সবই
শোনা হতো। বাংলা স্টেশন মিডিয়াম ওয়েভ, হিন্দি/ইংরেজি শর্ট ওয়েভ, কিন্তু লং
ওয়েভ বলে কিছু ছিল না, এখনো নাকি নেই। তাতে খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্ধপাধ্যায় ও তরুণ
চক্রবর্তী – পরের জন বেশি স্টাইলিস্ট, বলতেন “খবর পড়ছছি তরহূন ছক্রবর্তী”, কিন্তু প্রথম
জন বেশি পপুলার ছিলেন। সংবাদ বিচিত্রা বলে রাত ১০টা থেকে ১০।৩০ অবধি একটা অনুষ্ঠান
হতো, অনেকটা পরের দিকের দূরদর্শন এর “দ্যা ওয়ার্ল্ড
দিস উইক” এর অডিও ভারশনের মতো, সেটা খুব মন দিয়ে শুনতাম।
তখন একদিকে ভারত-পাক যুদ্ধ, বিধান রায়ের
দুর্গাপুরে পাক বিমান বোমা ফেলতে পারে, তাই দেবদুলাল একদিন জানালেন সমস্ত গাড়ির কাঁচ
অর্ধেক কালো করে দিতে হবে, সমস্ত বাড়ির জানলাও ঢেকে দিতে হবে। আমাদের গাড়ি ছিলও না, মাথা ব্যাথাও
ছিলনা। ভবানীকাকুর ছিল, কিন্তু সে আমার জেবুলির, মানে আমার মেজজেঠুর, অফিসের গাড়ি।
আমাদের কিন্তু কোয়ার্টার ছিল,
জানলাও ছিল,
কাঁচ ও ছিল,
তাই একদিন বাবা কারখানা থেকে ব্যবহৃত কার্বন পেপার নিয়ে এল, আমি আর মা
চরম উৎসাহে ময়দার আঠা বানিয়ে সেগুলো জানালার কাঁচে সাঁটিয়ে ফেললাম। তখন পাওয়ার কাট
এর নাম ছিল “ব্ল্যাক আউট”
– পাক প্লেন আসার খবর থাকলেই সেটা হতো, কিন্তু আমাদের
জানালার কাঁচে কাগজ লাগানো তাই আকাশ থেকে দেখতে পাবেনা, সেই ভেবে
মনে খুব শান্তি পেতাম। অন্যদিকে নকশাল আন্দোলনও তখন চরমে, খুন শব্দটা
রোজই শুনি, একদিন ঘুম থেকে উঠে জানলাম সামনের মাঠে পড়ে আছে মুন্ডুহীন দেহ
একটা, তাই বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ সেদিন। এই দুটো বড় জিনিস বাদ দিলেও
তখন আমার বড়জেঠুমনি ছিল, সাংঘাতিক রাগি, মাঝে মাঝেই নোহারী থেকে আসতো, আর আমার
ভয়ে জীবন ওষ্ঠাগত হতো, যদিও আমাকে কোনদিন বকেনি, একবার ছাড়া, সে গল্প পরে।
নোহারীতে ষষ্ঠী খ্যাপা ছিল, আনপ্রেডিকটেবল, তাই একটু সমীহ করে চলতাম। বাড়ীতে কিছু
ওয়াইল্ড লাইফ ছিল, তাদের মধ্যে বেড়াল বাদ দিলে ছিল দেওয়ালে টিকটিকি আর বাথরুমে আরশোলা।
এখন আমি আরশোলাকে একটুও ভয় পাইনা, বুকে হাত রেখে বলতে পারি। তবে ওদের যখন পাখি
হওয়ার ইচ্ছা হয়, তখন এয়ারবোর্ণ হলে আমার হাতটা বুক থেকে একটু সরে যায় আর আমার একটু
বডি ফিট রাখার ইচ্ছা হয়, এই যা। আর টিকটিকি তো ডাইনোসর এর জাতভাই, তাই একটু সম্মান
দিই, এই আরকি। এইসবের মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর ছিল ইঞ-পিঞ, সে নাকি
এক চাইনিজ দানব, তাকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি কখনো, কিন্তু তার
ভয়াবহ এয়ার-লকড ঝুলিতে যে কত দুষ্টু ছেলে ঢুকে আছে, তার হিসেব প্রায়ই নিতাম ছোড়দি আর মাসিমনির
কাছে। কোন সন্দেহ নেই যে সেই দিনগুলো ছিল বেশ ভয়ের। আরশলাকে বেশি ভয় পাওয়ার কারন
অবশ্যই ডেইলি এনকাউন্টার।
চেঁচিয়ে গান গাওয়া শুরু করেছিলাম সেই ১৮/১৪
ট্রাঙ্ক রোড থেকেই। চার বছর বয়স অবধি দুটো থান ইঁট আর একটা পুরনো খবরের কাগজ, এই নিয়ে
বড়ই শান্তিময় জীবন ছিলও আমার –
গামছা পরে বাড়ির পেছনের উঠোনে বসে পড়ো, মা আর ঠাকুমা
ছাড়া দেখার কেউ নেই, কাজ শেষ করে কাগজ তা মুড়িয়ে বাড়ির থেকে একটু দূরে মেন ড্রেন
– একটুও উঁচু নয়, কিন্তু তাও নাম হাইড্রেন - তাতে ফেলে দাও, কাজ শেষ, শেষে বাইরের
কল থেকে মগে জল নিয়ে স্যাটাস্যাট্ পরিস্কার। স্কুল এ যাওয়ার বয়স হল যখন, একদিন ইঁটগুলোও
হাওয়া হয়ে গেল, আর আমার দুর্দিন শুরু হল। মস্তবড় প্যান ওয়ালা একটা টয়লেট ছিল, যেটাকে এখন
বলে পটি, আর আগে বলতো পায়খানা, সেখানের আরশোলাদের চেঁচিয়ে তাড়াতে হবে, কিন্তু শুধুই
ভাগ, হ্যাট্ - এসব বলে চেঁচালে সবাই ভাববে ভিতু, তাই গান
গাওয়াটাই শ্রেয়, এই ভেবেই গান গাইতে শুরু করলাম।
কি গান গাওয়া যেতে পারে সেই নিয়ে কন্সালটেশন
এর উপায় নেই – আমার বেস্ট ফ্রেন্ড্ অপু গান এর ব্যাপার এ মোটেই উৎসাহী নয়, কোন সাহায্য
পাওয়া যাবে না। প্লাস্ অপু শুঁয়োপোকা কে ভয় পায়, আরশোলা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তখন সবে “জন গন মন” টা শিখেছি,
কিন্তু সেটা দাঁড়িয়ে গাইতে হয়, আর ইন্ডিয়ান
টয়লেট এ দাঁড়িয়ে গান গাওয়া যেতে পারে, আরশোলা দের থেকে একটু দুরত্বও বাড়ানো যেত, কিন্তু তাহলে
সঙ্গের আসল কাজটা করতে গিয়ে খুব বাজে ল্যাপ্টালেপ্টি ব্যাপার হবে, মা কেলিয়ে
বৃন্দাবন দেখাবে, তাই সেটা বাদ দিয়ে দিলাম।
একদিন “আন অন্ধ লোকে, মঙ্গল আ
লোকে” গেয়ে দেখলাম কাজ হচ্ছে, কিন্তু মঙ্গলদা কে অন্ধ বলাটা ঠিক নয়, সেটা বাথরুম
এ হলেও নয় – হাজার হলেও সে আমার জেঠতুতো দাদা, মাথায়
একটু চুল কম, কিন্তু আমাকে খুব ভাল বাসে। “গামছা রা ওই রাঙা মাটির” ঠিক স্যুট করল না, যদিও সেটাতে একটা সামঞ্জস্য ছিল, গামছা পরে
অনেকেই বড় বাড়ি যায়, আমিও যেতাম,
রাঙা মাটি দিয়েও হাত মাটি করা যায় - সাবান না থাকলে গ্রামে মাটি
ব্যাবহার করে, সেটা আমার গ্রাম এর বাড়িতে পুজোর সময় গিয়ে দেখেছি, সেটাকেই
বলে হাতমাটি – কিন্তু মনে হল না আরশোলারা এই গানটাতে খুব একটা বিব্রত হচ্ছে।
অনেক ভেবে দেখলাম ভয় যদি দেখাতেই হয়, সাহস যদি
আনতেই হয়, যুদ্ধের গান গাইলে একটা দ্রুত লয় থাকবে, দম থাকবে
– বেশ ভালো হবে সেটা। “শঙ্খ ছেড়ো বিউগল তায় নিজেরে অপমান” - এটা যুদ্ধের গান বলেই জানতাম, মানে যুদ্ধের আগে শঙ্খ ছেড়ে বিউগল বাজাচ্ছে
সেনাপতি, নিজের দেশের অপমান এর বদলা নেবে। সঙ্গের "আহ, হা আ আ আ
আ আ" টা গাইতে সবথেকে ভালো লাগত, কারন ওটাতে কোনো বাংলা শব্দ মনে রাখতে হত
না। ওটাকেই পটি করার সিগনেচার টিউন বানিয়ে ফেললাম।
কিছুদিন পরে একটু মোনোটনি চলে এলো, গান পাল্টাবার
সময় এলো। একটা কাউন্টিং এর গান ছিল,
অঙ্ক তে ভয় বলে সেই গানটাকে বেশ সমীহ করতাম – “তুমি কেমওওন করে গাআন কর হে, গুনি” – বেশ একটা যে যত গান গাইবে, তার তত নাম, এমন একটা
ব্যাপার। সেটা কিছুদিন গাইলাম। তারপরে আবার পাল্টাবার সময় এলো – ঠিক করলাম
কিছুদিন ছাড়াছাড়াই পাল্টাতে হবে। ওখানের মগ এর সাথে জগ মিলিয়ে কখনো গাইলাম “জগ হতে আনন্দ, জগ এ আমার
নিমন্ত্রন”, কোনদিন বা ঝরিয়ার কয়লা মাফিয়ার গান “আয়তো বে
সাহচরি, হাতিয়াতে ধরাধরি”,
আবার কোনদিন বা নেপালি গান “এই মোমজো ছোনায় অঙ্গভি দিয়ে, এ সোনা গল্পকো
কারি”।
এইভাবেই গান
গাইতে গাইতে একদিন দেখলাম শুধু ওই ছোট্ট ঘরটাতেই না, বাইরেও গান গাইছি, আর একটু একটু বুঝতেও পারছি। তারপর থেকে অনেক যায়গাতেই গেয়েছি, অনেক সময়েও, কিন্তু কালি খাওয়ার ব্যাপারটা জমেনি
বলে “এবার কালী
তোমায় খাবো” বিশেষ গাইনা। এছাড়াও আরো কিছু গান আমি এখনো গাই না, তবে সেগুলোর কথা আরেকদিন।
No comments:
Post a Comment