Sunday, November 17, 2013

স্যাম চাচার বিপদ

স্যাম চাচার বিপদ
 তুফানভারতের পবন ৭৪ টা যখন শচীন তেন্ডুলকার অন্তরাস্ট্রিয় বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল, সমুর ঘড়িতে তখন ঠিক সকাল দশটা দশ। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, আর রাতই বা কোথায়, মার্কিন মুলুকে তো তখন দিন, তাই সারাদিন চলেছে খদ্দেরকে নিয়ে ওদের দলের সঙ্গে আলোচনা আর আলোচনা। তারপর সন্ধ্যে নামতেই বিমানে ওঠার সময় চলে এলো। চট করে মায়ের সঙ্গে প্রণামটা সেরে কোনরকমে মুখে একটা স্যান্ডউইচ গুঁজে পাড়ার দুয়েকজন কে টাটা করে লাফ দিয়ে একটা রিকশা ধরে এয়ারপোর্ট। সেজোকাকা এসেছিল সঙ্গে, একই রিকশাতে ফেরত যাবে, শেষ সময়ে জড়িয়ে ধরে হাতে গুঁজে দিলো এক কৌটো কুকী, সেজকাকিমার নিজের হাতে তৈরি। কুলি গুলো বিরক্ত করছিল, সমু বাঁ হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো তাদের তাড়িয়ে লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাক্স প্যাঁটরার সঙ্গে কুকির কৌটোটাও জমা দিতে হল হাজিরা কাউন্টারে, তারপর ধীরে ধীরে বিমানে উঠে যখন অবশেষে বিমানসেবিকাকে জিগ্যেস করে যখন নিজের আসনে আসীন হল, ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের বরফ দেখতে দেখতে হঠাৎই বুঝতে পারলো, কোন ফাঁকে যেন মনটা বড়ই ভার হয়ে গেছে।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে হলেও সমুর ভাগ্যে দেড় দিনের বিমানযাত্রা নিশ্চিত ছিল, কিন্তু এই পবন ৭৪ টা চালু হওয়ার পর থেকে সান ফ্রান্সিস্কো থেকে উন্নাও লাগছে মাত্র চার ঘন্টা। এই বিমান এখনো কেবল মাত্র তুফানভারতের কাছে আছে, তাই সবাই মুখিয়ে থাকে এই বিমানে চাপার জন্য। এবারে এখানে নেমে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ যাবে অধিবাসনের দফতরে, তাও অন্যদের মত অত বেশী সময় নয়, কারন, সমুর তেরঙ্গা পরিচয়পত্র আছে, সে এদেশের অধিবাসী নাগরিক এখন, তাও প্রায় বছর পাঁচেক হল। তারপর স্বাস্থ্য দফতরে টিকা লাগানোর পালা শেষ হলে বিমানবন্দরের বাইরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মারুতি ৮০০০ এর দ্বিয়াসন বিমানে মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যাবে বাঁকুড়া, ভাড়া দু আনা।
এর পরের ঘটনা গুলো ছবির মতো সাজানো আছে সমুর মনে। ঘরে ঢোকা মাত্রই সমুর একমাত্র মেয়ে গিন্নি ছুটে এসে সমুকে জড়িয়ে ধরবে তার পুঁচকি দুটো হাত দিয়ে, মুখে ফোকলা হাসি। একটু দুরে রান্নাঘরের চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে স্বর্ণাভ, সমুর এদেশি বউ, পরনে আটপৌরে করে পরা তুঁতে রঙের ধনেখালি শাড়ির সঙ্গে মেলানো তুঁতে শায়া, সঙ্গে একই রঙের কাঁচুলি, সবে স্নান করেছে, ভিজে চুল, কপালে একটু নামিয়ে পরা সিঁদুর, শ্যামা রঙ, চোখা নাক, বড় বড় খুব কোথা বলা দুটো চোখ, কপালে একটা বিন্দি, মুখে এক রাশ নিশ্চুপ অনাবিল হাসি। খানিক্ষন মেয়েকে আদর করার পরে মেয়ে চলে যাবে ঠাকুমার দেওয়া কুকি নিয়ে তার আদরের লালুকে খাওয়াতে, আর সেই ফাঁকে বউকেও একটু আদর করার সুযোগ হবে। তারপর স্নান সেরে পোস্ত বাটা আর আলুর চপ দিয়ে মুড়িতে জল দিয়ে মেখে, শোঁ শোঁ শব্ধে সারা পাড়া মুখিয়ে জলখাবার শেষ করে এক দফা ঘুম। দুপুরে কুমড়ো শাক আর শুক্তো দিয়ে ভাত হবে, রাতে ফুলকো লুচির সঙ্গে কচি পাঁঠা, সঙ্গে পাটালির পায়েস। আর বাকি সময় হয় ঘুম, নয় আড্ডা। আজ শনিবার, তাই ছুটি।
সমুর জন্মের সময়ে সমুর ঠাকুমা আদর করে নাম রেখেছিলেন স্যামুয়েল। পুরো নাম স্যামুয়েল উইলসন। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিল, পড়াশোনায় মোটেই মন নেই, সারা পেল্টেনাক গ্রামে দাপিয়ে বেড়াতো বন্ধুদের সঙ্গে, তাই বাবা খুব চিন্তায় ছিলেন কি হবে। কোনরকমে একটা পাস দিয়ে সান ফ্রান্সিস্কো গিয়ে কম্পুটারে একটা ডিপ্লোমা করার পরেই ভাগ্য খুলে গেলো সঙ্গে সঙ্গে চাকরি, তারপর তিন বছরের মধ্যেই বিদেশ। সেই থেকে সমু এদেশেই আছে।
এদেশের লোকেরা মার্কিন মানুষদের একটু নিচু চোখে দেখে, আর উচ্চারণের অসুবিধে হয় বলে ওরা যখন ওকে শ্যাম বলে ডাকতে শুরু করলো, স্যামুয়েল একটুও আপত্তি করেনি, কারন শ্যাম মানে সেও জানে, তিনি একজন গড্‌, তাঁকে ওদেশে পপুলার করেছেন প্রাবুপাডা বলে একজন ভারতীয় সমু এখন জানে তাঁর আসল নাম স্বামী প্রভুপাদ।
প্রথম প্রথম যখন এদেশে এসেছে, তখন সমু থাকতো কলকাতা শহরে, সেখানে পাশের বাড়ির অনুজবাবু শ্যামবাজার এর লোক, তিনি স্যাম ই বলতেন, তা তাঁর জিভের দোষের জন্যে হলেও স্যামুয়েলের সেটা ভালোই লাগতো বেশ একটা দেশি ব্যাপার ছিল তাতে। এরপরে দফতরে কাজ করতে করতে স্বর্ণাভর সঙ্গে প্রেম, স্যাম থেকে সমু হয়ে যাওয়া, তেরঙ্গা পরিচয়পত্র পাওয়া এইসব যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হয়ে গেলো, কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। আগে দেশে বছরে একবার যেত, এখন তিন বছরেও একবার যাওয়া হয়না, ছুটি পাওয়া যায়না, পেলেও টাকা পয়সার ব্যাপার আছে, মেয়ের স্কুলের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ অনেক, আর বন্ধু বান্ধব ও সব তো এদেশেই, তাই মা ছাড়া টান টাও নেই তেমন। এবারে সেজকাকা ফোন করে বলেছিল মায়ের পায়ের হাজা টা নাকি খুব বেড়েছে, তাই সমু যদি আসে, তাহলে রামাদেভার আশর‍্যাম থেকে অ্যাইয়ুরভেদার কিছু একটা আনতে। সমু তাক করেই ছিল, হঠাৎ খদ্দের বলল ওদেশে যাবে কাজ পরিদরশন করতে, সমুও ঝুলে পড়লো সঙ্গে। যেদিন ফিরল, দেখে এসেছে, মায়ের হাজা এখন অনেক ভালো, চুল্কানি প্রায় নেই বললেই হয়, রস ও গড়াচ্ছে না। মনটা আবার ভার হয়ে গেলো, মাকে যদি এই দেশে নিয়ে আসা যেত?
... ... ...
কিন্তু এমন তো সেদিনও ছিলনা। মার্কিন দেশে যৌনক্ষুধায় তালকানা এক রাষ্ট্রপতির সময়েও দেশ চালাতো কিছু সলিড কূটনীতিক, তাই অসুবিধে হয়নি তেমন, জাস্ট একটু বদনাম হয়েছিল এদিক ওদিক এই যা। এরপরে বড় ঝোপের ছেলে বোকা ঝোপের সময়েও গেলো-গেলো রব কে তুচ্ছ করে যুদ্ধ ঝগড়া করে ভালই ছিল দেশ। তেল এর দাম হু হু করে বাড়ছিল সারা বিশ্বে, কিন্তু আমেরিকানরা গ্যালন ছেড়ে লিটারে নামেনি কখনো। এরপর একজন রঙিন চামড়ার রাষ্ট্রপতি এসেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর কান্নাকাটি ছাড়া তেমন ঝুটঝামেলা ছিল না ওদেশে। একবার সরকার বন্ধ হয়ে গেছল বটে সাংসদদের চক্রান্তে, কিন্তু তাও সে অল্প দিনের ব্যাপার। তখনো অবধি ভারতকেই আউট-সোরসিং করতো ইউ এস এ। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ করে ঘুরলো চাকা।
এদেশে সরকার বলে এক সন্ন্যাসী হঠাৎ ঘোষণা করলেন, উন্নাও গ্রাম এর ফোর্ট এরিয়া তে নাকি সোনা আছে। তা সে অনেক সোনা। তখন এদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মৌনীবাবা। তাঁর কোন এক মন্ত্রী নাকি ঐ সরকারের শিষ্য, তিনি বিধান দিলেন, আর ওমনি আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া শুরু করলো খোঁড়াখুঁড়ি। আর লাগবি লাগ, ইন্ডিয়ার ভাগ্যে লেগে গেলো লটারি উন্নাওতে সত্যিই পাওয়া গেলো সোনা একটু আধটু নয়, একদম দেড় হাজার টন। সারা দেশ মেতে গেলো তাতে। সোনা নিয়ে পাগলামি চুড়ান্ত হল। দেশটা বড়লোক তো হলই, তার সঙ্গে সব বিষয়ে সোনা ঢুক্তে লাগলো। এমনকি সবার নামের মধ্যে সোনা কথাটা রাখা একটা ফ্যাশন হয়ে উঠল, স্বর্ণাভও সেরকমই একটা নাম।
সরকারবাবা দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন। ওদিকে মৌনিবাবাকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন গুজরাটি বুকনিবাবা, উনি ইন্ডাস্ট্রি বানানোরও জাদুকর। বালকবাবা হতে পারেননি, তাঁর মাও চলে গেলেন অকালে, তাই তিনি অবসর নিয়ে চলে গেলেন রাশিয়াতে। বুকনিবাবার সঙ্গে ভিড়ে গেলেন রঘু নামের এক আমেরিকায় শিক্ষিত দক্ষিন ভারতীয়, উনি রুপির জাদুকর। ভারতের নতুন রুপকার হলেন শচীন তেন্ডুল্কার ক্রীড়ামন্ত্রী হলেন উনি, ক্রিকেট ভারতের জাতীয় খেলা বলে ঘোষণা করা হল। এরই মাঝে রূপির দাম বাড়তে লাগলো লাউডগার মতো, ডলার কমতে কমতে হয়ে গেল চারআনা, আর পৃথিবীর সব লোক এসে আড্ডা গাড়লো ভারতে।
ভারতরত্ন সি এন আর রাও এর নাতিও বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, তিনি পবন বিমান সংস্থা প্রতিস্থাপন করলেন, তাঁর কারখানা থেকেই বেরোল আশ্চর্য বিমান পবন ৭৪, সচিনের শেষ ইনিংসের নামে তার নাম। লক্ষ্মী মিত্তালের নাতির বিলেতে সর্দি হচ্ছিল প্রায়ই, তাই তিনি সব ইস্পাত কারখানা এদেশেই করবেন বলে দেশে ফিরে এলেন। অডি কে কিনে নিলেন মাহিন্দ্রা বলে এক ভারতীয়, নাম পাল্টে হয়ে গেলো আদি, ভল্ভো কে কিনলেন মাদ্রাজের হিন্দুজারা, সে নাম পাল্টে হয়ে গেলো রুদ্রাংশম। সোনি ইলেক্ট্রনিক্স এর ব্যাবসা গুটিয়ে এইটুকু হয়ে গেলো কলকাতার কেজরিওালদের সন্তোষ রেডিও প্রোডাক্টস এর রমরমায়। দত্তগুপ্তদের কোম্পানি একসঙ্গে কিনে নিলো ফাইজার, গ্ল্যাক্সো, জন্সন এন্ড জন্সন, অ্যাবট আর এলাই লিলি। রায়ান বন্ধোপাধ্যায় থাকতেন ন্যাশানাল ইনস্ট্রুমেন্টস এর পাশেই, একদিন বাবাকে বললেন ওটা কিনে দিতে, বাবা উৎসাহে আহ্ললাদিত হয়ে ওটা তো কিনে দিলেনই, সঙ্গে জাপান থেকে পেন্ট্যাক্স, ফুজি, ওলিম্পাস, নিকন আর ক্যানন এগুলোও কেনা হয়ে গেলো। ক্র্যাফট ফুডস কিনে ষোলো আনা বাঙ্গালীর ঝাল চানাচুর এর সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি শুরু করলো ঋভু বোস। রাতুল তালুকদারের মেয়ে কিনে নিলেন মিতসুই লাইন আর মেয়ারস্ক লাইন যাতে বাবা আর জাহাজে মাস্তুল পরিস্কার করার নামে বাড়ী থেকে পালাতে না পারে। অরিত্র সেন অভিষিক্ত হলেন উন্নাও এর অন্তরাস্ট্রিয় স্টক বাজারের সভাপতি হিসেবে। ম্যাগনামের নাম চলে গেলো, ভারতীয় সংস্থা ছবিওয়ালার হাত বদল হল, নতুন মালিকরা বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীকে নিয়ে তৈরি করলেন বদনামবঙ্গীয় দুঃস্থ নামিচিত্রকার মহলের স্বল্পরূপ সেই বদনাম, সেখানের পঞ্চাশ জন সদস্য, তার মধ্যে আটতিরিশ জন কলকাতার, বাকি মাত্র বারোজন অন্য যায়গার ও দেশের।
কিন্তু সবথেকে ওপরে উঠে গেলো মারুতি সিদ্ধার্থ মাল্য বলে এক ভদ্রলোক মারুতিকে কিনে নিলেন জাপানীদের কাছ থেকে, আর মারুতি গাড়ী ছেড়ে প্লেন বানানোতে মন দিলো, এমন প্লেন, যাতে পাইলট ছাড়া আর দুজন ঢুকতে পারে, জায়গা খুবই কম, তাই নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে অক্সিজেন টিউব নাকে লাগিয়ে বসতে হয়, সে প্লেনে ওঠার আগে নী ক্যাপ দেওয়া হয় যাতে হাঁটু সামনের সিটে ক্রমাগত ঘষা ও ধাক্কা লাগা সত্ত্বেও অক্ষত থাকে, ভলিনি জেল দেওয়া হয় নামার পরে কোমরের ব্যাথা কমাতে লাগানোর জন্যে, কিন্তু সেই প্লেন এক লিটার ডিজেলে ঝাড়া পঁয়ত্রিস মিনিট সতেরো সেকেন্ড উড়তে পারে, তার স্লোগান – “ইৎনা দেতি হ্যায়
ড্যাশবোর্ডে একটা স্পেশ্যাল সুইচ, ডিজেল না পেলে যাতে কাঁটা তেলে চালানো যায়, সঙ্গে SMG-HAI এর তৈরি দুষন নিবারনী ক্যাটালিটিক কনভার্টার। এ যে সে প্লেন নয়, এতে এমনকি রাম দিয়ে চালানোর ও বন্দোবস্ত আছে, শুধু ম্যাকডাওয়েল ছাড়া অন্য কিছু হলে একটু বেশী ফট্‌ ফট্‌ করে আওয়াজ করে, এই যা, আর রাম দিয়ে চালানোর সময়ে বার দুয়েক রায়পুরের বদলে রায়গঞ্জে চলে গেছল, কিন্তু নিন্দুকে বলে সেটা নাকি চালক ট্যাঙ্কের বদলে রাম পেটে চালান করে দিয়েছিল, তাই। সেই প্লেন নিয়ে শুরু হল ভারতের প্রথম শেয়ার অটো উড়ান, নাম তার মাছরাঙা এয়ার অটো সার্ভিস।
রতন টাটা বলে এক ভদ্রলোক এর মাঝে তেমন কিছু করতে পারলেন না, বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি, তাঁর ন্যানো নিয়ে উন্মাদনা তখন কমে এসেছে, বাংলায় তখন যিনি রাজত্ত্ব করছেন, আগে দিদি বলে ডাকত তাঁকে সবেই, এখন দিদাভাই বলে ডাকে বয়স হয়েছে বলে, সিঙ্গুর নিয়ে সেই দিদাভাই এর সঙ্গে রতনবাবু কিছু একটা করার প্ল্যান করছেন, কিন্তু বয়সের কারনে হয়ে উঠছে না, এমন সময়ে বাঁকুড়ার ভেদেশোলে এক ভদ্রলোক ভ্যান রিকশার মডিফিকেশন করে তাতে বসালেন জেনারেটার, মাথার ওপরে বসলো চাঁচ, তার ওপরে পলিথিনের ঢাকা, সামনে স্বচ্ছ পলিথিন, তাই দেখতে অসুবিধে নেই, বৃষ্টির মধ্যেও গামছা দিয়ে একটু মুছে নিলেই আবার পরিস্কার, ড্রাইভারের পেছনে ছোট ফ্রিজ, জেনারেটারেই চলবে, দরজা খুলে দিলেই ঠান্ডা হাওয়া, নাম দিলেন ভ্যানো। এর পরে সাইকেলেও তিনি একই রকম মডিফিকেশন করলেন, হ্যান্ডেল থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল রেডিও, পেছনের ক্যারিয়ারে গদি লাগলো, মাঝের রডে সিট তো ছিলই, সিট বেল্টও চলে এলো এবারে, এর নাম দেওয়া হল আমাদমিনো আম আদ্‌মির গাড়ী, তাই এমন নাম। ব্যাস, বাংলায় শুরু হল নবজাগরণ, কিন্তু রতন বাবুর সর্বনাশ হয়ে গেলো। হিন্দি, তামিল আর বাংলা সব জায়গায় ইংরেজিকে পাল্টে ঢুকে পড়লো। বাঁকুড়ায় গড়ে উঠতে লাগলো কারখানার পর কারখানা, কিন্তু সিঙ্গুরে চাষিরা কুমড়োর চাষ বন্ধ করতে চাইলো না, তাই সবুজ সিঙ্গুর সততই সবুজ হয়ে গেলো আবার, কুমড়োপাতায় ঢেকে গেলো তার কারখানার যন্ত্রপাতি, রতনবাবুও ক্ষ্যামা দিলেন এবারে, কারন জামশেদদাদুর কাছে জবাব্‌দিহি করার সময় তাঁর আসন্ন তখন।
এই সবই সমু ইতিহাসে আর পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়েছে। তার স্কুলে বাধ্যতামূলক ভাবে ভারতের ইতিহাস পড়ানো হয় বলে না, এইসব গুলো পড়তে তার ভালই লাগতো, কারন এই ভারত নামে দেশটার থেকে ওশো রজনীশ এসেছেন। নাগা সাধুতে তার এক সময়ে ছিলো অদম্য উৎসাহ, কিন্তু ঐ কাঁটা লাগানো রিং এর ছবি দেখে সে উৎসাহ কিছুটা কমেছে। কামা বলে এক রকমের সুতো নিয়ে একটা বড়দের বই এর ছবিও দেখে ফেলেছিল একবার, তারপর থেকেই তার জানার ভীষণ ইচ্ছে ভারতীয় নারীদের। তাই অন্য বই মন দিয়ে না পড়লেও ভারত তার ঠোঁতস্থ সেই কোন ছোটবেলা থেকে। দশ বছর বয়সেই তাই সে জানতো, উন্নাওকে ভারতের নতুন রাজধানি করা হয়েছে। বুকনিবাবা আমেদাবাদকেই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়নি। তাই লোকে বেড়াতে গেলে স্ট্যাচু অফ ইউনিটি দেখতে গুজরাট যায় বটে, কিন্তু মূল কাজের জায়গা সেই উন্নাও।
ছায়াছবির বাড়বাড়ন্ত দেখার জন্যে এখনো লোকে মুম্বাই যায় ঠিকই, তবে তার থেকেও বেশী যায় কলকাতায় করঞ্জিৎ কাউর ভোরার মেমোরিয়াল দেখতে, সেই করঞ্জিৎ, যিনি অল্পবয়সে সানি লিওন নামে ছবি করতেন কানাডায়। তাঁকে ভারতে ফেরৎ এনেছিলেন যে মহেশ ভাট, তাঁকে কেউ মনে রাখেনি আর, কিন্তু হরলাল চক্রবর্তীর পাগলুর বৌদি সারদা তে অসাধারন অভিনয়ের জন্যে তিনি আঠেরো খানা প্রোস্কার পেয়েছিলেন সেই প্রোস্কার, যা মার্কিন মুলুক থেকে এদেশে চলে এসেছে অস্কার থেকে নাম পাল্টে। সেই ছবি সমু অনেকবার দেখেছে, কিন্তু সেই সিন যেখানে তোতলা পাগলু দেবকে সারদারূপী করঞ্জিৎ বুকে টেনে নিচ্ছে, আর দেব হারিয়ে যাচ্ছে, মাথার এক্টুখানি চুল ছাড়া কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, সেটা দেখলেই সমুর এখনো গলার কাছটা দলা পাকিয়ে থাকে, মনে হয় স্বর্ণাভটা কেন যে পাঞ্জাবি হল না!
এইসব কারনেই সমু এখন পুরদস্তুর ভারতীয়। একে বউ এদেশি, তায় জীবনটাই কাটাবে এই দেশে, তাই ভারতীয় না হয়ে তার উপায় নেই। মনটা মাঝে মাঝে খচখচ করে বটে, কিন্তু ও পোড়া আমেরিকা তাকে কিছুই দেয়নি, যা দিয়েছে এই দেশ। অর্থ, মান, প্রতিপত্তি সব। তার যে অত্ত সুন্দর ফুলপানা একরত্তি মেয়েটা, সেটাও তো এই দেশেরই। তার জন্ম এখানে, মা ভারতীয়, তাই সে জন্মেই ভারতীয়। নামটা যদিও অ্যামেরিকান, কিন্তু ঠাকুমার দেওয়া জিনি নামটা এদেশে সবাই গিন্নি করে নিয়েছে। অ্যামেরিকান শব্ধ ইংরেজি ভাষা ভুলতে সমুর আগে অসুবিধে হতো, কিন্তু স্বর্ণাভর ক্রমাগত চেষ্টায় সমু এখন পুরোদস্তুর বাঙালী। অফিস বদলে দফতর করতে তার আর অসুবিধে হয়না, এয়ারপোর্ট এখন বিমানবন্দর হয়েই বেরোয় তার মুখ থেকে, হিন্দি বললে হাওয়াই আড্ডা বলতেও তার আর আটকায় না। দফতরে যারা কাজ করে, তারাও তাকে অ্যামেরিকান বলে আজকাল হ্যাটা করেনা আর। প্রথম প্রথম বাংলায় কোড লিখতে অসুবিধে হতো, কিন্তু অভ্র কিবোর্ড এসে যাওয়ার পরে সবই খুব সহজ হয়ে গেছে। দফতরে অনেক উন্নতি করেছে সমু, এখন সে কার্ত্তিক-শ্যাম তথ্যপ্রজুক্তি সীমাবদ্ধ সংস্থার বাঁকুড়া ডেলিভারি সেন্টার এর নায়েব। অ্যামেরিকায় যা কাজ বহির্সুত্র বা আউটসোর্স করা হয়, তার পুরো দায়িত্ত্ব আজ তার ওপরে।
শুধু মাঝে মাঝে শিকড়ের জায়গাটায় ব্যাথা লাগে, যখন এতো কিছু করার পরেও খদ্দের বলে - আমরা অজুত অজুত রূপী তোমাদের দিচ্ছি, তা কি এই সব ষাঁড়ের গোবরের জন্য? তোমাদের ছেলেরা কম্পিউটারের বর্ণিও ভাষা জানে না, একটা দূরভাষে ভালো হিন্দি বলতে পারে না, বাংলা তো দূর অস্ত। কালকের মধ্যেই সব লোক চাই আমার, যেমনটি চেয়েছি, ঠিক তেমন, নাহলে তোমাদের দেশের লিলিপুট সফটওয়্যার তো আমাদের সেদিন ই বলল, ওদের পঞ্চাশ জন বেঞ্চিতে বসে আছে, সব ব্যাবসা ওদের দিয়ে দেবো। সমুকে তখন ভিনি কমেটি কে বৈদ্যুতিন ডাক পাঠাতে হয়, তাতে অ্যামেরিকায় সবাই নড়ে চড়ে বসে, তারপর দে-দন্নাদ্দন এখান ওখান থেকে লোকজন তুলে সমুর খদ্দের কে দিতে হয়, তবে তারা ঠান্ডা হয়, কিন্তু মুনাফায় ঘাটতি হয়াই অতিরিক্ত কিছু পাওয়া যায় না, উল্টে মালকিনের চোখ রাঙ্গানি। তখন বড় ব্যাথা লাগে, মনে হয়, এমন তো হওয়ার ছিল না এই অর্থ, এই প্রতিপত্তি, সবই কি মিছে? এতো কিছুর পরের সে তো একজন চাকরের বেশী কিছু নয়?
... ... ...
এইসবই ভাবতে ভাবতে সমু আস্তে আস্তে অধিবাসন কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছিল। বাঁ দিকে নিঃশুল্ক বিপণি টা পড়লো। সমু কি ভেবে পায়ে পায়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে।
খুব সুন্দর সাজানো দোকান, ছিমছাম, সেখানে থরে থরে সাজান নানারকমের জিনিসপত্র। কাউন্টারে একজন, খুব সম্ভবতঃ পর্তুগীজ, মহিলা এক গাল হেসে বাংলায় বললেন বলুন দাদা, কি সাহায্য করতে পারি? সমু চলে গেলো আলুর কাউন্টারের সামনে মহিলাও ভেতর দিয়ে ওপাশে চলে এলেন, আবারো একবার হেসে বললেন আমাদের দেশের থেকে প্রথম এসেছিল এদেশে, তিনশো বছর আগে, বাটাটা নাম ছিল এর, আপনারা ইংরেজি ভাষীরা যাকে বলেন পট্যাটো, এরা জানি কি করে আলু নাম দিয়ে এর দাম এমন বাড়িয়ে দিলো, যে আপনাদের দেশে তো পাওয়াই যায় না, এখানেও আগুন দাম।
সমু অনেক ভেবে চিন্তে পাঁচশো গ্রাম আলু কিনল। যদিও এটার দাম এখন অনেক, রোজ সকালে আলুর চপ দিয়ে মুড়ি না খেতে পারলে তার দিনটাই কেমন যেন খারাপ যায়। এই পাঁচশো আলুতে অবশ্য অন্তত পক্ষে দশ খানা আলুর চপ হবে, সেটা ও আর স্বর্ণাভ রোজ একটা করে খেলেও আগামী পাঁচ দিন রোজ আলুর চপ খাওয়া যাবে। এরপরের বারেরটা আনবে অ্যান্ডি ও পুরো পরিবার নিয়ে পর্তুগাল গেছে, ফেরার সময় অন্তত তিন কেজি আনতে পারবে। দিদাভাই এবারেও বলেছেন, প্রতিবারের মতো এবারেও আলুর দাম কমাতে সরকার ব্যাবস্থা নিচ্ছে, তাই আশা করা যায় আগামী এক দু মাসের মধ্যে আবার মাচানতলার বাজারে আলু পাওয়া যাবে।
দোকানে টাকা মেটাচ্ছে, এমন সময় সেই পর্তুগীজ মহিলা এসে ফিস ফিস করে বললেন নুন লাগবে নাকি? আছে অল্প, সবাইকে দিই না, কিন্তু আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো, আমার দাদার মতো মনে হল আপনি চাইলে দিতে পারি। সমু তো অবাক উন্নাও তে নুন? শেষ কবে আসল নুন খেয়েছিল, তা মনে পড়ে না আর এখানে ইনি উপযাচক হয়ে দিতে চাইছেন, না করাটা খুব অন্যায় হবে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ঘেঁটে দেখল এখনো কিছু টাকা আছে তানা নানা করে একটু পরে এক ধাক্কায় পঞ্চাশ গ্রাম নুন কিনে ফেলল সমু। মনে একটু পাপবোধ, কিন্তু আনন্দও হচ্ছে এই ভেবে যে স্বর্ণাভ কে একটু চমকে দেওয়া যাবে। একটা পুঁচকে পলিথিন প্যাকে নুন টা দিলেন মহিলা, সমু এদিক ওদিক দেখে ধুতির কোঁচড়ে ঢুকিয়ে দিলো সেটা চুরি হয়ে যাবার চান্স আছে নয়তো।
অধিবাসন আধিকারিক ভদ্রলোক ভালো, বিশেষ কিছুই জানতে চাইলেন না তেরঙ্গা পরিচয়পত্র দেখে একবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন শুধু, তারপর পরিচয়পত্রে ছাপ মেরে দিলেন। স্বাস্থ্য দফতরেও কিছু হল না তেমন, শুধু একজন ডাক্তার যখন পায়ুদ্বার পরীক্ষা করে দেখছিলেন ওখানে নেশাদ্রব্য লুকোনো আছে কিনা, তাতে সমুর একটু কাতুকুতু লাগছিল আর কলেজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একদম শেষে এসেই হল কাল।
সবার শেষে সুরক্ষা দফতর, সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সমু, এখান থেকে বেরিয়েই এয়ার অটোর লাইনে দাঁড়াবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে মনে মনে। একটা সাদা বাচ্চা সমুর পেছনেই ছিল, সে এই প্রথম আমেরিকা থেকে এদেশে আসছে, বাপ টাকে দেখলেই বোঝা যায় একদম গেঁয়ো, টেক্সাসের কোন গ্রাম থেকে এই প্রথম আসছে। সেই বাচ্চাটা হঠাৎ করে সমুর পরিচয়পত্রটা পড়ে বলে উঠল – “সো নাউ আই নো, ইউ আর আঙ্কেল স্যাম!
আর ওমনি, বলা নেই, কওয়া নেই, চারিদিকে কেমন একটা হই হই রব উঠল। বেশ কয়েকজন এসে ঘিরে ধরল সমুকে। একজন সুরক্ষা কর্মী সমু কে নিয়ে গেলেন অন্য একটা ঘরে, আর সেখানে সমু প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে লাগলো। সমু যতই বলে সে ভারতীয় তেরঙ্গা পরিচয়পত্রধারী, আধিকারিক রা জিজ্ঞ্যেস করতে থাকেন সে আমেরিকার কোথায় এই পরিচয়পত্র নকল করেছে। শেষজন একজন জাঁদরেল মহিলা, তিনি কড়া গলায় প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে এলেন, তারপর সমুকে ধাক্কা দিতে লাগলেন। সমুকে ওঠো ওঠো বলছেন, আর সমু বলছে আমি উঠবো না, দয়া করে ছেড়ে দাও।
ভদ্রমহিলা যখন বলছেন যদি উঠতে ইচ্ছা নাই করে, তাহলে রাত জেগে ওসব দেখা কেন, - উঠে পড়ো, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, দেখলাম মুখটা সুপর্ণার মতো। ঘুমটা কাটতে একটু সময় লাগলো। উঠে বসে দেখলাম সামনে চায়ের কাপ, ধোঁয়া উড়ছে, পাশে খবরের কাগজে লেখা, আজকে শনিবার। প্রথম পাতায় লেখা শচীন কি আজকে শেষ সেঞ্চুরি টা করছেন? পাতা উল্টে ভেতরের খবর পড়ছি, একটা খবরে চোখ গেলো এ এস আই উন্নাওতে খনন বন্ধ করে দিচ্ছেন। সে কি? সমুর তাহলে কি হবে?


পুনশ্চ : এই লেখা পড়ে যাদের মনে হচ্ছে এটা তাদের নিয়ে নিয়ে লেখা, তারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তারা ঠিক বুঝেছেন। কিন্তু অপরাধ নেওয়া কঠিন হবে, কারন স্বপ্ন দেখা নিয়ে আদালতেই কেস হয় না, ফেসবুক তো কোন ছার।

ছায়া-চিত্র

ছায়া-চিত্র
১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীন হল, নকশাল্‌বাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে উঠল, আমি চার বছরে পা দিলাম, আমার চিকেন পক্স হল এসব তো হলই, কিন্তু আরো দুটো খুব মনে রাখার মতন ইভেন্ট হল। একটা হল আমার স্কুল এ ভর্তি হওয়া, আর আরেকটা হল বিয়েবাড়ি। জীবনের প্রথম মনে থাকা বিয়েবাড়ি, তাও আবার একটা নয়, দু দুটো। একটা আমার জেঠতুতো দিদির বিয়ে, আরেকটা আমার মাসিমনির।
জেঠুর বাড়িতে একটা ঠাকুর এর মশারি টানানোর স্ট্যান্ড ছিল, সেটা একটা ২ ফুট বাই ২ ফুট কাঁচির মতন জিনিস ভাঁজ করে দিলে ঘরের কোনায় লাঠির মতন দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, আবার খুললেই ইংরেজি এক্স এর মতন সেটা ঠাকুরএর সিঙ্ঘাসনের দুই পাশে দুটো গুঁজে দিয়ে ঠাকুর এর ছোট্ট মশারী টানাতো আমার মেজোমা, মানে আমার দিদির মা। দিদির বরকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি, তাই ওই স্ট্যান্ডটা দিয়ে পায়ের দিকটা কেটে দেওয়ার চেষ্টা করে বেশ বকা খেয়েছিলাম, কারন ভদ্রলোকের বোধহয় রক্ত জমে কালসিটে পড়ে গেছলো। কিন্তু মাসিমনির বিয়ে হল যার সঙ্গে, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অপুর পিসতুতো দাদা, অমায়িক ও মজাদার লোক, চুটকির বাদশা, তাই তার উপরে একটুও রাগ হয়নি। তবে মেসো বলে ডাকিনি কখনো, এখনো অমলদা বলেই ডাকি। ওদিকে দিদির সেই বর এখন বিদায় হয়েছেন ভালোয় ভালোয়, এখন ওখানেও ফ্রেশ জামাইবাবু, দারুন লোক।
দিদির বিয়েটা কোন ফাঁকে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না, কিন্তু মাসিমনির বিয়েটা বেশ একটা অনেকদিন এর অনুষ্ঠান হল। অপুরা থাকতো আমাদের পাশের কোয়ার্টারটাতেই, কিন্তু বিয়ে আর বৌভাত হল দুটো বাংলো ভাড়া নিয়ে। খুব মজা হল, আমাদের বাড়িতেও অনেক লোক, অপুদের বাড়িতেও তাই, আর সবাই খুব খোশমেজাজে আছে, তাই অনেক কিছু করলেও বকা দেওয়ার সময় নেই কারু।
অপুর জ্যাঠামশাই এলেন, জেঠুর নাম ছিল মনোরম, কিন্তু দেখতে মোটেই তা নয়, সেটা বোধহয় বলার দরকার নেই। বিশাল মোটা, নাকের উপর ইয়াব্বড় একটা আঁচিল, অপু ডাকতো জ্যাজা বলে, আর জেঠিকে সুর মিলিয়ে বলতো আজা। মানুষটি কিন্তু খুব ভালো, খুব ভালো লেগে গেল তাঁকে। তিনি এসেছিলেন একটি উইলিস এর জীপ নিয়ে, আর খেতেনও উইলস ভার্জিনিয়া, তাই তখন থেকেই জানি ওটা খুব বড় কোম্পানী। জীপটার হর্নটা বাজছিল না, তখন আমি বলেছিলাম মাসিমনির হারমোনিয়ামটা তো ওরাই নিয়ে যাবে, তো সেটা সামনের সিটে বসে বাজালেই হয়। সবাই বিশ্রী ভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল, আর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে আমি আর কোনদিন কোনো সাজেশ্‌ন দেবোনা।
বৌভাতের পরের দিন দুপুরে সবাই দেখলাম বলছে বই দেখতে যাবে। বই আমার অতি প্রিয় জিনিস, ছোটদের ছবিতে রামায়ন আর মহাভারত মুখস্ত তখন, লেখা কিছুই পড়তে পারিনা, কিন্তু লেখার ছবি দেখে বলে দিতে পারি ওখানে কি লেখা আছে, এমন মুখস্ত। ছবির বইতে পড়া কবিতাও মুখস্ত – “বল্লে শশক, এমন কেন, আঁধার আঁধার লাগছে যেন? সূর্যটা কি হঠাৎ গেলো ডুবে?”
আমি মহানন্দে কাউকে কিছু না বলে পেছন পেছন হাঁটা দিলাম। সবাই যখন অনুরাধা হলে ঢুকছে, জ্যাজা আমাকে দেখতে পেয়ে একিরে, বাবু, তুই কখন এলি?” বলে সঙ্গে ঢুকিয়ে নিল, দেখলাম আসলে এরা সিনেমা দেখতে এসেছে।
ছবির নাম অমানুষ। একটা আধমোটা লোক, নাম মধু, হাড় বজ্জাত, শুধুই মদ খাচ্ছে আর চুকলি কাটছে। আর রেখা বলে একটা মেয়ে শুধুই লজ্জা পাচ্ছে। আজা বলল শর্মিলা কিন্তু ফিগারটা একরকমই রেখেছে, আমি ভাবলাম যাহ্‌ শালা, এটা তো আমিও জানতাম, এটা তো অপুর বোন বনির মতই দেখতে, আর বনির স্কুল এর নাম তো শর্মিলা। ওকে নিয়ে এরা সিনেমা বানালো? কিন্তু সিনেমাটা চলতে থাকলো, আর দেখলাম মধু লোকটা আর তেমন বাজে নেই। একবার কি একটা কারনে স্টিমারে উঠে গানও ধরল বেদানার বালু চরে। কিছুদিন আগে ছাগল চরতে এসে আমাদের বাগানের গ্যাঁদা ফুলের গাছগুল মুড়িয়ে খেয়ে নিয়েছিল, আর আমি তখন বাবার একটা ধুতি নিয়ে লুঙ্গি পরা প্র্যাক্টিস করছিলাম, তাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে একটা দাঁত ভেঙ্গেছিলাম। আমি ভাবলাম বেদানার তো খুব দাম বাবা বলে, আর তাই বোধহয় বালু চরতে এসে সেই বেদানা গাছ খেয়ে নিয়েছে বলে মধু দুঃখ করছে, খুব গরীব মানুষ তো, তাই। কিন্তু বালু তো বালি, সেটা চরবে কি করে, সেটা বোধগম্য হল না। ফিরে এসে অপুকে উল্টো অনুবাদ করে দেখালাম মৌমাছি পেরেক বিজিৎস্‌ রীজন জুতো লা (মানে ডো-রে-মি-ফা-সো-লা-টি থেকে ধা এর রিপ্লেসমেন্ট), অর্থাৎ বিপিন বাবুর কারন শু ধা, অপু একটুও ইম্প্রেসড্‌ হল না, বলল ওর স্থির বিশ্বাস আজকে বকা না খেলেও পরে বকা খাবই। ওদিকে দেখলাম ফুলদি ছোড়দিকে বলছে, আরে ওটাই তো উত্তমকুমার, বুঝলাম মধুর আরেটাও নাম আছে, আর সেটাই বেশি চলে।
শোলের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু দেখতে দেয়নি বলে উত্তেজনার কারণটা বুঝতাম না। অপুর বাবা রাখুদা কালীপূজোর দিন সকালে বাজি কিনতে আসানসোলে যেত, হয়তো কোনো যোগাযোগ আছে, এটাই ভাবতাম। তারপর একদিন ছোড়দাকে ধরে গল্পটা দু বার শুনলাম, খুব জমাটি লাগলো। জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে রেখে ঠাকুরসাব এর মতো শুধু পা দিয়ে মারপিট এর চেষ্টা করেছি অনেকবার। এরপর ফুলদি লালকুঠি দেখতে গেলো, আমিও ঝুলে পড়লাম সঙ্গে। পরের দিন পেয়ারাগাছের ডাল ধরে অপুকে একটা ড্যানি স্টাইলে উড়নকিক্‌ মারতে গিয়ে ডালটা বেয়াদপি করল, হাঁটু তে নিবাসালফ লাগিয়ে ঘুরতে হল এক সপ্তাহ।
আরো একটা ছবি বাবা দেখতে দেয়নি, সেটা হল এন্টার দ্য ড্র্যাগন। কিন্তু ক্লাস নাইনে পড়ার সময় চিত্রালয়তে এলো রিটার্ন অফ দ্য ড্র্যাগন, সেটি দেখার অনুমতি মিলল। ব্রুস হয়ে গেলেন অনুপ্রেরণার চূড়ান্ত। সেবার পুজোর সময় গ্রামে গিয়ে তারাপদ মিস্ত্রির বাড়িতে হাজির হলাম, তৈরি হল মোল গাছের ডাল কেটে আমার প্রথম নান্‌চাকু, শিকল পাওয়া গেলো না বলে কাঠ দুটো জোড়া হল নাইলনের দড়ি দিয়ে। অনেকদিন সেটা ব্যবহার করেছি, আর ঝুমা, আমার বোন, ম্যাক্সিমাম ঠ্যাঙ্গানি খেয়েছে ওটার। পরে কাপড় ভেজানোর সময়ে মা নান্‌চাকু দিয়ে কাপড় গুলো সাবানজলে ভালো করে চোবাতো।
সেই শীতে দেখলাম হোয়েন দ্য নর্থ উইন্ড ব্লোওস, আমার দেখা সেরা ছবিগুলির মধ্যে একটা। বিধান ইন্সটিটুশনে ভর্তি হয়েছি তখন, দুটো জেমস বন্ড এর ছবি দেখলাম, নেভার সে নেভার এগেইন আর অকটোপুসি। জীতেন্দ্রর একটা ছবি দেখলাম, নাম ইন্সান। চিত্রালয় টা আড্ডা আর সিগারেট খাওয়ার জায়গা হল। মিঠুন এর অসংখ্য ছবি দেখলাম, জুলপি কেটে চুল পেছনের দিকে বড় করলাম। আড়াই টাকায় ভিডিও হলে বেশ কিছু বড়দের ছবিও দেখলাম।  এমনকি পেয়াসা দুলহন্‌ দেখতে গিয়ে হিমাদ্রির বাবা দেখে ফেলল, আর আমি কি লুকবো, কাকু নিজেই লুকোতে গিয়ে দিশেহারা।

কিন্তু টুয়েল্ভে উঠে যেই ইজাযৎ দেখলাম, মনটা যেন কেমন একটা হয়ে গেলো। এরকম ও ভাবা যায়ে? একলা ছাতায় দুইয়ে আধা আধা ভিজেছে, সেই সিক্ততা পড়ে আছে খাটের পাশে, তাকে কে ফেরৎ দিতে পারে? আশেপাশের সব মেয়ে কে অনুরাধা প্যাটেল মনে হতে লাগলো। এর বেশ কিছুদিন পরে, হল এর অন্ধকারে যখন পাশের জনের হাত নিজের থেকেই উঠে এলো আমার হাতে, সেদিন বুঝলাম সিক্ততা মনেও হয়, আর সে ছবির নাম কাশ্‌

গানের গুঁতো

গানের গুঁতো
সেটা ১৯৭১, তখনকার জমানায় যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল ট্রাঞ্জিস্টার রেডিও অনেকটা পরবর্তী কালের নোকিয়া ৩৩১০র মতন। তো জেঠুর বাড়ির থেকে নিজেদের কোয়ার্টারে আসার পরে বাবা অনেক কষ্ট করে টাকা বাঁচিয়ে কিনে ফেলল একটা সেই একটা কেনা মানে এখনকার স্যামসাং এস ফোর কেনার মতন, রেশন কার্ড দেখালে ভালও হয় টাইপের ব্যাপার সেটার নাম ছিল বুশ ব্যারন, সেটাতে গান, খবর সবই শোনা হতো। বাংলা স্টেশন মিডিয়াম ওয়েভ, হিন্দি/ইংরেজি শর্ট ওয়েভ, কিন্তু লং ওয়েভ বলে কিছু ছিল না, এখনো নাকি নেই। তাতে খবর পড়তেন দেবদুলাল বন্ধপাধ্যায় ও তরুণ চক্রবর্তী পরের জন বেশি স্টাইলিস্ট, বলতেন খবর পড়ছছি তরহূন ছক্রবর্তী, কিন্তু প্রথম জন বেশি পপুলার ছিলেন। সংবাদ বিচিত্রা বলে রাত ১০টা থেকে ১০।৩০ অবধি একটা অনুষ্ঠান হতো, অনেকটা পরের দিকের দূরদর্শন এর দ্যা ওয়ার্ল্ড দিস উইক এর অডিও ভারশনের মতো, সেটা খুব মন দিয়ে শুনতাম।
তখন একদিকে ভারত-পাক যুদ্ধ, বিধান রায়ের দুর্গাপুরে পাক বিমান বোমা ফেলতে পারে, তাই দেবদুলাল একদিন জানালেন সমস্ত গাড়ির কাঁচ অর্ধেক কালো করে দিতে হবে, সমস্ত বাড়ির জানলাও ঢেকে দিতে হবে। আমাদের গাড়ি ছিলও না, মাথা ব্যাথাও ছিলনা। ভবানীকাকুর ছিল, কিন্তু সে আমার জেবুলির, মানে আমার মেজজেঠুর, অফিসের গাড়ি। আমাদের কিন্তু কোয়ার্টার ছিল, জানলাও ছিল, কাঁচ ও ছিল, তাই একদিন বাবা কারখানা থেকে ব্যবহৃত কার্বন পেপার নিয়ে এল, আমি আর মা চরম উৎসাহে ময়দার আঠা বানিয়ে সেগুলো জানালার কাঁচে সাঁটিয়ে ফেললাম। তখন পাওয়ার কাট এর নাম ছিল ব্ল্যাক আউটপাক প্লেন আসার খবর থাকলেই সেটা হতো, কিন্তু আমাদের জানালার কাঁচে কাগজ লাগানো তাই আকাশ থেকে দেখতে পাবেনা, সেই ভেবে মনে খুব শান্তি পেতাম। অন্যদিকে নকশাল আন্দোলনও তখন চরমে, খুন শব্দটা রোজই শুনি, একদিন ঘুম থেকে উঠে জানলাম সামনের মাঠে পড়ে আছে মুন্ডুহীন দেহ একটা, তাই বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ সেদিন। এই দুটো বড় জিনিস বাদ দিলেও তখন আমার বড়জেঠুমনি ছিল, সাংঘাতিক রাগি, মাঝে মাঝেই নোহারী থেকে আসতো, আর আমার ভয়ে জীবন ওষ্ঠাগত হতো, যদিও আমাকে কোনদিন বকেনি, একবার ছাড়া, সে গল্প পরে। নোহারীতে ষষ্ঠী খ্যাপা ছিল, আনপ্রেডিকটেবল, তাই একটু সমীহ করে চলতাম। বাড়ীতে কিছু ওয়াইল্ড লাইফ ছিল, তাদের মধ্যে বেড়াল বাদ দিলে ছিল দেওয়ালে টিকটিকি আর বাথরুমে আরশোলা। এখন আমি আরশোলাকে একটুও ভয় পাইনা, বুকে হাত রেখে বলতে পারি। তবে ওদের যখন পাখি হওয়ার ইচ্ছা হয়, তখন এয়ারবোর্ণ হলে আমার হাতটা বুক থেকে একটু সরে যায় আর আমার একটু বডি ফিট রাখার ইচ্ছা হয়, এই যা। আর টিকটিকি তো ডাইনোসর এর জাতভাই, তাই একটু সম্মান দিই, এই আরকি। এইসবের মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর ছিল ইঞ-পিঞ, সে নাকি এক চাইনিজ দানব, তাকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি কখনো, কিন্তু তার ভয়াবহ এয়ার-লকড ঝুলিতে যে কত দুষ্টু ছেলে ঢুকে আছে, তার হিসেব প্রায়ই নিতাম ছোড়দি আর মাসিমনির কাছে। কোন সন্দেহ নেই যে সেই দিনগুলো ছিল বেশ ভয়ের। আরশলাকে বেশি ভয় পাওয়ার কারন অবশ্যই ডেইলি এনকাউন্টার।
চেঁচিয়ে গান গাওয়া শুরু করেছিলাম সেই ১৮/১৪ ট্রাঙ্ক রোড থেকেই। চার বছর বয়স অবধি দুটো থান ইঁট আর একটা পুরনো খবরের কাগজ, এই নিয়ে বড়ই শান্তিময় জীবন ছিলও আমার গামছা পরে বাড়ির পেছনের উঠোনে বসে পড়ো, মা আর ঠাকুমা ছাড়া দেখার কেউ নেই, কাজ শেষ করে কাগজ তা মুড়িয়ে বাড়ির থেকে একটু দূরে মেন ড্রেন একটুও উঁচু নয়, কিন্তু তাও নাম হাইড্রেন - তাতে ফেলে দাও, কাজ শেষ, শেষে বাইরের কল থেকে মগে জল নিয়ে স্যাটাস্যাট্‌ পরিস্কার। স্কুল এ যাওয়ার বয়স হল যখন, একদিন ইঁটগুলোও হাওয়া হয়ে গেল, আর আমার দুর্দিন শুরু হল। মস্তবড় প্যান ওয়ালা একটা টয়লেট ছিল, যেটাকে এখন বলে পটি, আর আগে বলতো পায়খানা, সেখানের আরশোলাদের চেঁচিয়ে তাড়াতে হবে, কিন্তু শুধুই ভাগ, হ্যাট্‌ - এসব বলে চেঁচালে সবাই ভাববে ভিতু, তাই গান গাওয়াটাই শ্রেয়, এই ভেবেই গান গাইতে শুরু করলাম।
কি গান গাওয়া যেতে পারে সেই নিয়ে কন্সালটেশন এর উপায় নেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড্‌ অপু গান এর ব্যাপার এ মোটেই উৎসাহী নয়, কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না। প্লাস্‌ অপু শুঁয়োপোকা কে ভয় পায়, আরশোলা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তখন সবে জন গন মন টা শিখেছি, কিন্তু সেটা দাঁড়িয়ে গাইতে হয়, আর ইন্ডিয়ান টয়লেট এ দাঁড়িয়ে গান গাওয়া যেতে পারে, আরশোলা দের থেকে একটু দুরত্বও বাড়ানো যেত, কিন্তু তাহলে সঙ্গের আসল কাজটা করতে গিয়ে খুব বাজে ল্যাপ্টালেপ্টি ব্যাপার হবে, মা কেলিয়ে বৃন্দাবন দেখাবে, তাই সেটা বাদ দিয়ে দিলাম।
একদিন আন অন্ধ লোকে, মঙ্গল আ লোকে গেয়ে দেখলাম কাজ হচ্ছে, কিন্তু মঙ্গলদা কে অন্ধ বলাটা ঠিক নয়, সেটা বাথরুম এ হলেও নয় হাজার হলেও সে আমার জেঠতুতো দাদা, মাথায় একটু চুল কম, কিন্তু আমাকে খুব ভাল বাসে। গামছা রা ওই রাঙা মাটির ঠিক স্যুট করল না, যদিও সেটাতে একটা সামঞ্জস্য ছিল, গামছা পরে অনেকেই বড় বাড়ি যায়, আমিও যেতাম, রাঙা মাটি দিয়েও হাত মাটি করা যায় - সাবান না থাকলে গ্রামে মাটি ব্যাবহার করে, সেটা আমার গ্রাম এর বাড়িতে পুজোর সময় গিয়ে দেখেছি, সেটাকেই বলে হাতমাটি কিন্তু মনে হল না আরশোলারা এই গানটাতে খুব একটা বিব্রত হচ্ছে।
অনেক ভেবে দেখলাম ভয় যদি দেখাতেই হয়, সাহস যদি আনতেই হয়, যুদ্ধের গান গাইলে একটা দ্রুত লয় থাকবে, দম থাকবে বেশ ভালো হবে সেটা। শঙ্খ ছেড়ো বিউগল তায় নিজেরে অপমান - এটা যুদ্ধের গান বলেই জানতাম, মানে যুদ্ধের আগে শঙ্খ ছেড়ে বিউগল বাজাচ্ছে সেনাপতি, নিজের দেশের অপমান এর বদলা নেবে। সঙ্গের "আহ, হা আ আ আ আ আ" টা গাইতে সবথেকে ভালো লাগত, কারন ওটাতে কোনো বাংলা শব্দ মনে রাখতে হত না। ওটাকেই পটি করার সিগনেচার টিউন বানিয়ে ফেললাম।
কিছুদিন পরে একটু মোনোটনি চলে এলো, গান পাল্টাবার সময় এলো। একটা কাউন্টিং এর গান ছিল, অঙ্ক তে ভয় বলে সেই গানটাকে বেশ সমীহ করতাম – “তুমি কেমওওন করে গাআন কর হে, গুনিবেশ একটা যে যত গান গাইবে, তার তত নাম, এমন একটা ব্যাপার। সেটা কিছুদিন গাইলাম। তারপরে আবার পাল্টাবার সময় এলো ঠিক করলাম কিছুদিন ছাড়াছাড়াই পাল্টাতে হবে। ওখানের মগ এর সাথে জগ মিলিয়ে কখনো গাইলাম জগ হতে আনন্দ, জগ এ আমার নিমন্ত্রন, কোনদিন বা ঝরিয়ার কয়লা মাফিয়ার গান আয়তো বে সাহচরি, হাতিয়াতে ধরাধরি, আবার কোনদিন বা নেপালি গান এই মোমজো ছোনায় অঙ্গভি দিয়ে, এ সোনা গল্পকো কারি
এইভাবেই গান গাইতে গাইতে একদিন দেখলাম শুধু ওই ছোট্ট ঘরটাতেই না, বাইরেও গান গাইছি, আর একটু একটু বুঝতেও পারছি। তারপর থেকে অনেক যায়গাতেই গেয়েছি, অনেক সময়েও, কিন্তু কালি খাওয়ার ব্যাপারটা জমেনি বলে এবার কালী তোমায় খাবো বিশেষ গাইনা। এছাড়াও আরো কিছু গান আমি এখনো গাই না, তবে সেগুলোর কথা আরেকদিন।