Sunday, June 15, 2014

আমার ঘর আমার বাড়ী

আমার ঘর আমার বাড়ী

১. আবার বদল

আমরা ট্রাঙ্ক রোডে থাকি। আঠারোর চোদ্দো। থাকি মানে আজ অবধি আছি, একটু পরেই চলে যাবো, অরবিন্দ অ্যাভিনিউ। আমি ঘরের ভেতরে ট্রাঙ্কের ওপরে বসে আছি। বারান্দার সামনে বাগানে ড্রেসিং টেবিলটা রাখা আছে, একটু পরেই ভ্যান রিক্সায় উঠে পড়বে, আমি এখানে বসেই পাশ দিয়ে শিউলি ফুলের গাছটা দেখতে পাচ্ছি, নিচের দিকটা, অনেক শুঁয়োপোকা আছে যেখানটায়, সেই যায়গাটা। কার্ত্তিকদাদা গণেশদাদাদের বাড়ী টাও আয়নায় দেখতে পাচ্ছি  জেবুলিরা ফোন করলে ওদের বাড়িতেই করে। মনটা খারাপ লাগছে, আবার ভালোও লাগছে  অপুদের কাছে চলে যাচ্ছি আবার। নতুন স্কুল্টাও বেশ কাছে হবে। কিন্তু বাড়ী কোথায়, সেটা বললে এটার কথা আর বলতে পারবো না? এই যে আমাদের বাইরের ঘর, ভেতরের ঘর, বারান্ডা  এইসব তো নতুন বাড়িতে নেই?

এখন আমি অনেক বড়, তাই মা যদিও কাঁদছে, আমি আর বাবা কাঁদছি না। অনেক আগে, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমরা আর দাদারা এক সঙ্গে একটা অন্য বাড়ীতে থাকতাম। সেটার নাম সি এন ফরটি ওয়ান, একতলা। ওই শহরটাও দুর্গাপুরেই, কিন্তু নাম অন্য  কোক ওভেন কলোনি। ওই বাড়ীটা কি ভালো ছিল। অনেকগুলো ঘর ছিল। দাদা ছিল, দিদি ছিল, লিন্টু মাসি ছিল, ডলি মাসি আসতো রানীগঞ্জ থেকে। ফুলদি, ছোড়দি আর ছোড়দা রাও কাছেই থাকতো, ওদের বাড়িটার নাম ডি এন সেভেন। ওরাও চলে আসতো প্রায় রোজই। আমি বেশ এর কোলে ওর কাঁধে চড়ে দিন কাবার করে দিতাম। মাঝে মাঝে ডি এন সেভেনেও চলে যেতাম সবাই।

জেবুলি যখন অফিস যেতো, সবাই বলতো ডিউটি, তখন গাড়ী আসতো, স্টেশন ওয়াগান, অ্যাকুয়ামেরীন রঙের। সেই গাড়ী চালাতো মোহিনী কাকু, মোহন কাকু কিম্বা ভবানী কাকু। আমার কাজ ছিল এক ফাঁকে এদের একজনের সঙ্গে ওই গাড়ীতে চেপে এক পাক ঘুরে নেওয়া। সন্ধ্যেবেলায় জেবুলী বাড়ী ফিরে যখন হাতা ওয়ালা গেঞ্জী আর মালকোঁচা মারা ধুতি পরে চেয়ারের ওপরে পা মুড়ে বসতো, আমি দেখেছি উনুনে বেগুন পোড়া দিলে একটু পরে ওটা ঠিক ওমনি করেই বসে। দু পায়ের মাঝখানের যায়গাটা বেশ হ্যামকের মতো, আমি চেয়ার বেয়ে উঠে বসে পড়তাম ওখানটায়, আর জেবুলী হাতের বইটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে একটা গল্প বলতো, জেবুলীর ছেলেবেলার, নোহারীর, কোনদিন বা মা দুর্গার গল্প - আমি হাঁ করে শুনতাম।

অফুরান শান্তি, অফুরান হট্টগোল, অফুরান আনন্দ। মা বকলে বাবা আটকায়, বাবা বকলে মেজোমা, মেজোমা বকলে জেবুলি। কেউ না আটকালে ঠাকুমা আছে। আদর করার জন্যে দাদা আছে। গাল টেপার জন্য দিদি আছে। হাঁটু ছড়ে গেলে মেন্টাল সাপোর্ট পাওয়ার জন্য ফুলদি আছে। খুনসুটি করার আর পিঠে শুড়শুড়ি খাওয়ার জন্যে ছোড়দি আছে। একটু আধটু বড় হওয়ার জন্য গাইড আছে  ছোড়দা। শোলের গল্পটা তো ওর কাছেই শুনলাম! সেজোমার ফাটাফাটি বাটি পোস্ত আছে, একটু চাইলেই চানাচুরের পুরো কৌটো ধরে দেওয়া আছে। বাবাকে চোখে হারাই, সামনে না থাকলে অনেকটা একরকম দেখতে সেজোজেঠুমনি আছে। মেজমার পালং শাকের ঘ্যাঁট টা তেমন ভালো না হলেও ফাস ক্লাস পাকা রুই মাছের ঝাল আছে। জেবুলির কোলে বসে গল্প শোনা আছে। আর, সবার ওপরে, ঠাকুমার কোল আছে।

এরকম একটা কোথাও থেকে গেলেই হতো সারা জীবন, কিন্তু কি যে হল সেটা বুঝলাম না, কিন্তু আমরা চলে এলাম ট্রাঙ্ক রোডের বাড়িতে। আজকে অবধি ছিলাম। বেশ ছিলাম। কিন্তু রাত্রে আর থাকবো না। কালকেও না। পরশু, তরশু, নরশু, ঘরশু  আর কোনোদিনও না। বাড়ী বদলাচ্ছি আমরা।


২. অন্য বাড়ীগুলো

সেই যে আমরা চলে এলাম ট্রাঙ্ক রোড, সে অনেক দিনের কথা। আমরা এলাম একা একা। সঙ্গে ঠাকুমা এলো অবশ্য, মাঝে মাঝে থাকবে। এখানে এসেছি আট বছর। এখনো আমরা অভ্যেস ছাড়িনি - কোনোরকমে সপ্তাহটা কাটিয়ে দিই, আর রোববার হলেই চলে যাই কোক ওভেনে, দুই বাড়িতে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যেয় আবার ফিরে আসি। এই বাড়ী পাহারা দেয় মোহন।

মেজোমারাও কিছুদিন পরে অন্য বাড়ীতে চলে গেলো তার নাম বি এন ফরটি থ্রি। এটা ডি এন সেভেনের কাছেই। মস্ত বাড়ী, দোতলা সামনে তেমনি বড় বাগান, সেখানে অনেক শাল গাছ। সামনে পোর্টিকো, তারপরে মস্ত বারান্দা, দু দিকে রেলিং দেওয়া। কলিং বেল আছে। ওখানের ঘর গুলোর নামও অন্যরকম। বাঁ দিকের ঘরটার নাম ড্রয়িং, যদিও ওখানে কেউ ছবি আঁকে না, সেখানে একটা কালো টেলিফোন, কটা সোফা। ওপাশেরটার নাম ডাইনিং, ওখানে একটা টেবিল টেনিস বোর্ড আছে কিন্তু তাতে সবুজ রেক্সিন পাতা, আর সবাই ওটার ওপরেই থালা রেখে খায়। মেজোমাদের বাড়ীতে ফ্রিজ আছে, কেল্ভিনেটার। তার পেছনে একটা মস্ত ঘর, তার নাম কিচেন। আমাদের রান্নাঘরে কলতলা, এখানে আছে সিঙ্ক। মস্ত সিমেন্ট বাঁধানো উনুন, তার দুটো চুল্লির মাঝে হট ক্যাবিনেট। মেজোমাদের গ্যাস ও আছে, ক্যাল গ্যাস। এক পাশে স্টোর রুম। এই গেলো এক তলা।

সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতে গেলে মাঝ সিঁড়িতে পড়বে ঠাকুর ঘর, তারপর ওপরে উঠলে তিনটে ঘর একটার নাম অমির ঘর, একটার নাম বাচ্চুর ঘর, আর একটার নাম বেডরুম। বাচ্চুর ঘরের সঙ্গে আবার মস্ত ঝুল বারান্দা। একটায় দাদা থাকে, অন্যটায় দিদি। কতগুলো বাথরুম সব মোজাইক করা, পায়খানা গুলো সব বাথরুমের ভেতরে। ঝকঝকে, নো আরশোলা। বাজে বলতে শুধু দুটোতে কমোড আছে, অত ওপরে উঠে বসতে অসুবিধে খুব, ব্যালেন্স রাখাও একটু মুস্কিল ট্যাঙ্ক থেকে একটা চেন ঝোলে, ওটা ধরেই ব্যালেন্স রাখতে হয়, কিন্তু একটু ব্যালেন্স এদিক ওদিক হলেই ঝপাস করে একটা চমকে দেওয়া আওয়াজ হবে, আর কোথা থেকে জল বেরিয়ে এসে নিচের দিকে শুড়শুড়ি দেবে। এটা নাকি বাড়ী নয়, এটার নাম নাকি বাংলো।

ডি এন সেভেনে বাড়ীটা পুরোটাই দোতালায়। বি এন ফরটি থ্রি থেকে ছোট অনেক, কিন্তু উত্তেজনায় ঠাসা। নিচে থাকে সাহা কাকুরা, পাশে রনদের বাড়ী। রন আমার থেকে একটু ছোট, ও জেভিয়ার্সে পড়ে, আমি এ জি মিশন, এক ক্লাস ওপরে। বাড়ী ঢোকার দুটো দরজা একটা দিয়ে ঢুকলে যে ঘরটা, তার নাম বসার ঘর। ওখানে একটা সরু খাটে ছোড়দা শোয়, আর কটা বসার জায়গা আছে, কাঠের, মাঝখানগুলো সাদা প্লাস্টিকের বেত বোনা, তার ওপরে গদি। একটা শো কেস আছে, তাতে দারুন সুন্দর সব ঘর সাজানোর জিনিস, খেলনা, পুতুল, ডবল ডিম-পাড়া মুরগি এই সব। একটা হাফ দেওয়াল আলমারি, তাতে মনি মানিক্যে ঠাসা যত পুরোনো শুকতারা, আর ম্যান্ড্রেক-ফ্ল্যাশ গর্ডন-অরন্যদেবের বই, বাঁধানো। হ্যাঁ, আমি তখন বাংলা পড়তে পারি। আমি বাংলাটা নিজে নিজেই শিখেছি। প্রথম ছবি দেখতাম ছোটদের রামায়নে আর ছোটদের মহাভারতে। তারপর সুখলতা রাও এর নিজে পড়ো আর নিজে শেখো বলে দুটো বই দেখে দেখেই শিখে ফেলেছিলাম। তাই পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি জিমির সঙ্গে বাঘার মিল খুঁজতাম, নিজের ঘোড়া কেনার খুব শখ ছিল, আর বাজারে শোল মাছ দেখলেই ডলফিন মনে হতো। ডায়ানাকে ভালো লাগা, সে অনেক পরে।

বাড়িতে ঢোকার যে অন্য দরজা, তা দিয়ে ঢুকলে একদম সোজা খাবার জায়গা। ডান কোনায় বাথরুম, তার মধ্যেই পায়খানা, আর বাঁ কোনায় রান্নাঘর মাঝখানে ডাইনিং টেবিল। রান্নাঘরের বাঁ দিকে গলি, তাতে প্রথমে বসার ঘরে অন্য দিক দিয়ে ঢোকার একটা দরজা, তারপর মিডল রুম, তাতে ফুলদি আর ছোড়দি শোয়, আর শেষে থার্ড রুম, সেখানে জেঠুমনি আর সেজোমা। মিডল রুমের সঙ্গে একটা ব্যাল্কনি আছে, সেখানে লুকিয়ে চেয়ারে উঠলেই ডি এন মার্কেট দেখা যায়।

কিন্তু, রাতের বেলায় দেখছি দুই বাড়িতেই ভুতের উপদ্রব। নাহলে অমন বদ চিন্তা রোজ রাতে মাথায় আসবে কেন? ট্রাঙ্ক রোডের বাড়িতে আরশোলা থাকতে পারে, টিকটিকি থাকতে পারে, কিন্তু শালগাছ নেই, জঙ্গলও নেই, তাই ভুতও নেই। ভেবে দেখেছি, বাড়ীটা মন্দ না।


৩. ট্রাঙ্ক রোড, স্যুটকেস রোড

কোথায় থাকি জিজ্ঞেস করলেই বলে দিই ট্রাঙ্ক রোড, কিন্তু এই রাস্তার নাম কেন ট্রাঙ্ক রোড? ট্রাঙ্ক তো একরকমের বাক্স, আমাদের বাড়িতেও আছে দুটো, গায়ে বাবার নাম আর আমাদের ঠিকানা লেখা, লোহার তৈরি। লোহা না, স্টীল। লোহা নাকি তেমন শক্ত জিনিস নয়, তাই তার সঙ্গে আরো কি কি সব মিশিয়ে তৈরি হয় স্টীল। ইস্পাত। সেই ইস্পাত তৈরি হয় যে কারখানায়, সেখানে এখন আমার বাবা ডিউটিতে যায়, নীল রঙের বাসে চেপে, সেই কোন সকাল সাতটার সময়। রাখুদাও যায়, কিন্তু বাসে না, স্কুটারে চেপে। আগে মোটরসাইকেলে যেতো, বি এস এ,  তারপর একদিন ঘরে ওটা ঠেলে ঢোকাতে গিয়ে সোজা পপাত চ, তারপরই সেটা বদলে চলে এলো একটা ঝকঝকে ভেস্পা স্কুটার। রাখুদারা আমাদের আত্মীয়, রাখুদা অনেক বড়, বাবার থেকে একটু ছোট হবে, কিন্তু তাও রাখুদা বাবাকে মামা বলে। আমি রাখুদা কে শুধু দাদা বলি, আর মমতা বৌদিকে বৌদি। অপু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও বেনাচিতি জুনিয়রে পড়ে, আর পাকা বনিটা, আমার থেকে দু বছরের ছোট কিন্তু সর্বদা ওস্তাদি ও পড়ে মাউন্ট কারমেলে।

আমাদের বাড়ীর সামনে একটা বারান্দা আছে, তার বাঁ দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেই আমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে তোমরা। এটা বাইরের ঘর। এখানে একটা সোপাকাম্বেট আছে, তাতে আমি ঠাকুমা এলে সঙ্গে শুই, নাহলে ওপাশের ঘরে। তিনটে সোফাসেটি আছে, আর আছে একটা বেঁটে টেবিল, তার ওপরে একটা কাপড় দেওয়া থাকে, তার নাম টেবিলক্লত। এই ঘরটার নাম হল বাইরের ঘর। ঘরে তিনটে মস্ত তাক আছে, আমি একদিন দুপুরে উঠে দেখেছি, পা টা একটু গুটিয়ে নিলেই আমি ওখানে শুতে পারি। বাবাকে বলবো, আমাকে যেন ওরকম একটা ঘর বানিয়ে দেয়। তাকের পাশে দুটো জানলা আছে, রড দেওয়া, বাগান দেখা যায়, ওখানে আমি আর অপু ক্রিকেট খেলি, আর শীতকাল এলেই ওখানে কসমস, জারমিনিয়াম আর ফ্লক্স ফুল লাগানো হয়, তখন আমাদের সামনের মাঠে যেতে হয়। আমি ঐ রডে অনেক ওপরে উঠতে পারি, ওপরে উঠলে ফ্যানের হাওয়াটা অন্যরকম লাগে, কেমন সুন্দর সুঁই সুই করে আওয়াজ হয়। পাশের ঘরের নাম ভেতরের ঘর, ওখানে একটা খাট আছে, একটা আলনা, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা বেঞ্চ, দুটো ট্রাঙ্ক, আর কটা তাক। বেঞ্চের ওপরে আমাদের বিছানা থাকে, চাদর ঢাকা দেওয়া।

পেছন দিকে দুটো ঘর জুড়ে একটা বারান্দা, তার ডান কোনে প্রথমে রান্নাঘর, তারপর বাথরুম আর পায়খানা। বারান্দার ওপাশে উঠোন, পাঁচিল দেওয়া। ওখানে তিনটে মস্ত কাঁঠাল গাছ, দুটো আমগাছ, আর একটা পেয়ারা গাছ। এক কোনায় একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ, তার বাঁ দিকে লেবু গাছের ঝোড়, আর ডান দিকে লিচু গাছ, তাতে ফল হয়না। একটা পেঁপে গাছও আছে। একটা চৌবাচ্চা আছে, ডানদিক ঘেঁষে, তার পাশে কল, ওখানে আমি চান করি। উঠোনের এক কোনায় দুটো ইঁট, আমি স্কুল যাওয়ার আগে ওখানে বসি, খবরের কাগজ পেতে। আগে মা কিম্বা ঠাকুমা পাহারা দিতো, এখন দেয় না। পাশে একটা নর্দমা আছে, কাজ শেষে ওখানে ফেলে দিলেই নালি দিয়ে সবকিছু ম্যানহোলের দিকে চলে যায়, নো ট্রেস। তবুও মা বলবে আর কতদিন ধেড়ে ছেলে এইখানে করবি? আরে? পায়খানায় আরশোলা আছে না? যেতে বললেই যেতে হবে নাকি?


৪. উনুন

মা ওঠে অনেক ভোরে, উনুন জ্বালাতে হয় তো, তাই। উনুন গুলো সব বালতি থেকে তৈরী হয়। সেও স্টীল। যখন বালতির তলার ফুটোগুলো আর ঝাল দিয়ে কিম্বা রিপিট করেও ঠিক হয়না, তখন তার থেকে উনুন বানানো হয়। রিপিট করা মানে বার বার করা, আমার স্কুলের মিসেস ম্যাথুজ বলেছে। বার বার কি করলে বালতির ফুটো বন্ধ হয়, কে জানে? এই ঝালটাও অন্যরকম। মা বড়দের রান্নায় ঝাল দেয়, কিন্তু এই ঝাল টা তেমন নয়, লঙ্কা, গোলমরিচ, এমনকি ঐ আরশোলার মতো দেখতে গৌতমকাকুর গোলদারী দোকানের জিনিসটাও কোনো কাজে লাগে না। একটা সাইকেলের স্পোকের মতো কাঠি, চোখে গগলস পরে আগুন জ্বেলে তার সামনে ধরে থাকলেই দেওয়া হয়ে যায়, আমি শালবাগান রোডে দেখেছি। আমার মায়েরও গগলস আছে জয় বাংলা হয়েছিল বলে পরেছিল। আমি সেটা খুব খানিক লুকিয়ে পরেছিলাম, যাতে আমারো জয় বাংলা হয় আর আমারো একটা গগলস হয়, কিন্তু কিছুতেই হল না।

তা সে যাই হোক, উনুনের কথা বলছিলাম। বালতি টা দোকানে নিয়ে গেলে প্রথমে খানিক দর দাম হয়, তারপর কাজ শুরু হয়। বালতির নিচের দিকের দেওয়ালে একটা জানালা কাটা হয়, সেই জানলাটা আমাদের নোহারীর বাড়ীতে যে কুলুঙ্গি আছে, তার মতো দেখতে। জানলাটার একটু ওপরে সার দিয়ে পাঁচ বা ছটা ফুটো করা হয়, দুপাশেই, সেখান দিয়ে এপার থেকে ওপারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কটা সরু রড। এগুলোর নাম শিক। এরপরে সমান গ্যাপে মাটি দিয়ে তিনটে পিরামিড বানাতে হয় বালতির কানা বরাবর। তারপর বেশ মোটকা করে মাটি দিয়ে দাও ভেতরের দিকে, উনুন তৈরি। সে মাটি আমার ঠাকুমাও দিতে পারে, বাবাও পারে, মাও পারে। উনুন জ্বালতে গেলে প্রথমে কাঠ দিতে হবে, একদম সব স্ট্যান্ডিং অবস্থায়, উনুনের ভেতরের দেওয়ালে, সার দিয়ে। তারপর কয়লা, আর গুল। বেশ টুপ্টুপে উপছে পড়ার মতো ভর্তি হলে একটু জুট কেরোসিনে ভিজিয়ে নিচের জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দাও, তারপর তাতে আগুন দিয়ে দাও। খানিক্ষন খুব কুয়াশা হবে, গরম কালেও, চোখ জ্বালা করবে, আর একটু পরেই উনুনে গনগনে আঁচ। একটা লম্বা এল এর মতো লোহার কাঠি আছে - ওটাও শিক - ওটা দিয়ে মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে খুঁচিয়ে দাও শিকের তলার দিকটা, একটু ছাই পড়বে, আর উনুন জ্বলতেই থাকবে। আঁচ কমে এলে আবার একটু কয়লা, একটু গুল আবার একটু কুয়াশা, তারপর পরের রান্না।

আমার ঠাকুমা গুল দেয়। কয়লার গুঁড়ো আর গোবর মিশিয়ে বেশ নারকোল নাড়ুর মতো বানিয়ে রোদে শুকোতে দাও, শুকিয়ে গেলেই গুল তৈরি। মা নিজেও মাঝে মাঝে দেয়, সেগুলো দেখতে বেশী সুন্দর। আমিও দু একবার ট্রাই করেছি, যদিও দিতে দিতে হাতটা প্যান্টে মুছেছিলাম বলে মা খুব বকেছিল। কিন্তু আমাদের বাড়ীর বড়দের গুল দেওয়া নিয়ে কেউ কিছু বলে না। বাবা দেয় না ঠিকই, কিন্তু আমি সিওর, দিলেও কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু চন্ডীদাদু যেদিনই আসবে, ফেরৎ যাওয়া মাত্র মা বাবাকে ফিস ফিস করে বলবে চন্ডীমামার গুল দেওয়ার অভ্যাসটা গেলো না। ফিস ফিস করে, কারন আমি জানি, চন্ডীদাদুরা অপুদেরও কেউ একটা হয়, তাই ওরা শুনে ফেললে খুব বাজে হবে ব্যাপারটা। আমি কিন্তু কোনোদিন চন্ডীদাদুকে গুল দিতে দেখিনি। আর দেবেই বা কিকরে? চন্ডীদাদু তো এলেই বাইরের ঘরে বসে, আর গুল দেওয়ার সরঞ্জাম তো আমাদের পেছনের উঠোনে। চন্ডীদাদু সেখানে কখনো যায়না।

চন্ডীদাদুরা টেগোর এভিনিউতে থাকে।


৫. আমাদের পাড়া

আমাদের স্ট্রীটটা আঠেরো নম্বর। একদম শুরুতে কালভার্ট, তার ওপরে আমি বসে থাকি বিকেলে, বাবা ফেরা অবধি। আগে এতোটা আসতে দিতো না, এখন দেয়। এই রাস্তা টা মোড়ামের, তাই লাল রঙের। রাস্তার প্রথম খানিকটায় কোনো বাড়ী নেই। তারপরে হঠাৎ করেই বাড়ী শুরু, একটা দিকেই, প্রথমটাই একদম ছয়। ওটা ডিপি-রোজিদের বাড়ী। ওরা আড়িয়া পাঞ্জাবী, তাই খুব ফরসা সবাই। ওরা কেউ বাংলা বলে না, কিন্তু আমার একটুও অসুবিধে হয় না। আমি খুব ভালো হিন্দি বলতে পারি। ইন্দার আমাকে হিন্দি শিখিয়েছে, স্কুলে। আর শিখিয়েছে মা, মাসিমনি আর মামা।

মোড়ের ওপর দিয়ে যে চওড়া রাস্তা টা চলে গেছে, ওটাই ট্রাঙ্ক রোড। ওটা ধরে একটু এগোলেই রাস্তাটা আপে উঠবে। বাঁ দিকে ত্যারছা করে যে গলিটা বেরিয়ে গেছে, ওটা শালবাগান রোড, ওটা দিয়েও বেনাচিতি যাওয়া যায়। এই রাস্তাটা বেশ মজার, একটাও শালগাছ নেই, কিন্তু নাম শালবাগান। এই রাস্তায় কয়েকটা ইগলুর মতো বাড়ী আছে, টিনের, হঠাৎ দেখলে মনে হবে মালগাড়ীতে তেল নিয়ে যায় যেগুলো, ওগুলো কেটে বানানো।  বাবা বলছিল ওগুলো নাকি পি ডাব্লিউ ডির কোয়ার্টার। কোয়ার্টার গুলো পেরোলেই রাস্তার দু ধারে দুটো আটাকল, একদম মুখোমুখি, তারপর রাস্তাটা একটু ডানদিকে বেঁকেছে সেখানে দু পাশে অনেক দোকান একটা আশিস ইলেক্ট্রিক্যালস, ওখান থেকে আমরা টিউব লাইটের দরদাম করেছি, সামনের মাসে কিনবো, বাবা বলেছে। কেরোসিনের দোকান টা ওখানেই, সাইকেল সারানোর দুটো দোকান আছে, তার পাশেই। একটা চা এর দোকান আছে, শ্যামল টী স্টোরস সামনে সার দিয়ে কোলে বিস্কুটের হাফ কৌটো, মেরুন রং করা, তার ওপরে সাদা দিয়ে লেখা আছে চা আর তার ঠিক মাঝখান দিয়ে লেখা একটা ইংরেজি “T” আমি যখন ওখান দিয়ে যাই, মনে মনে বলতে থাকি টিচা- টিচা- টিচা- টিচা আর একটু পরেই দেখি সেটা হয়ে গেছে চাটি-চাটি। আমি জানি, দস্যু রত্নাকরের এমন হয়েছিল, মরা থেকে রাম। 

যদি শালবাগান রোডে না ঢুকি, যদি সোজা চলে যাই, তাহলে প্রান্তিকা পৌঁছে যাব। সে মোড়ের আড়াআড়ি রাস্তাটার নাম নাচন রোড, বেনাচিতি বাজারের ওটাই শুরু, বাঁ দিয়ে এগোলেই শালবাগান রোড এসে মিশেছে। প্রান্তিকার মোড়ে ডান হাতে একটা কালীবাড়ি, কালীবাড়িটার ঠিক সামনে থেকে ছাড়ে অন্নপূর্ণা আর ভবানী দুটো মস্ত বাস। ভবানীটা পুরনো, কারন লাইটগুলো গোল, হর্নটাও বাজে। অন্নপূর্ণার লাইট গুলো রেক্ট্যাংগেল এর মতো, হর্ন টাও বেশ পিঁপ্পির-পুঁপ্পু। আর বাঁ দিকে একটু ফাঁকা জায়গা, ওখান থেকে এখন মিনিবাস ছাড়ে। এই মিনিবাস গুলো খুব মজার। বেঁটে, তাই ভেতরে দাঁড়ানো যায়না। কটা মোটে সিট, কিন্তু কয়েকজন বেশী লোক উঠলেই কন্ডাক্টার কাকু সিটের নিচ থেকে কটা মোড়া বের করে দেয়।

ট্রাঙ্ক রোডের ওই পার টা ডি এস পির জমি নয়। ওপাশে তাই প্রথমে একটু জলা জমি, তারপর বস্তি, আর সবার ওপারে বেনাচিতির বাড়ী ঘর দোর। ওখানেই ভৌমিক টেলার্স দের তিনতলা বাড়ী। আরে সেই ভৌমিক, যাদের থেকে অমানুষের মধু গুরু পাঞ্জাবী বানিয়েছিল। জয় বাবা তারকনাথ বলে একটা সিনেমা দেখেছি, তাতে সন্ধ্যা রায় শুধুই নাকের পাটা ফুলিয়ে কাঁদছিল আর উত্তর চাইছিল আর বিশ্বজিৎ সাপের কামড়ে মরে যাচ্ছিল সেটাতে অনেক গান ছিল। একটা ইপি রেকর্ড অনেকের বাড়িতে শুনেছি, কিন্তু ওই ভৌমিকরাই শুধু মাইক লাগিয়ে এলপি টা বাজিয়েছিল মনসা পুজোর সময়। আমাদের স্ট্রীটের ঠিক পরেই স্ট্রীটের সমান্তরাল একটা মেন রাস্তা, নাম লালা লাজপত রায় রোড, আর তাই, ওখানেই একটা গোলচক্কর। ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে প্রান্তিকা থেকে যদি আসি, বাঁয়ে পড়বে লালা লাজপত, আর ডাইনে গুরুদুয়ারা রোড, চলে গেছে সোজা বেনাচিতি অবধি। ওটাও প্রাইভেট জায়গা। ওখানে একটা মিষ্টির দোকান, একটা মাংসের দোকান আর দুটো কাঠের দোকান আছে, তার পেছনে মস্ত খাটাল। সেদিন মা চার কেজি কাঠ আনতে দিয়েছিল আমাকে আমি একবার শুধু কালভার্টের নামিয়েছিলাম, বাকি কোথাও একবার ও নামাইনি।

আমাদের স্ট্রিটে মোট ছটা কোয়ার্টার, দুটো দুটো করে ছাদ জোড়া। একটার বারান্দা ডানদিকে, অন্যটার বাঁদিকে, তারপর পাশাপাশি চারটে ঘর, দুটো দুটো করে একটা কোয়ার্টারে। রাস্তার অন্য পাশটা মাঠ একটা, বিশাল বড়। তার একটু যায়গায় খেলি আমরা, অন্য দিকটা নিচু, ওদিকে শুয়োর চরে, গরু চরে। মাঠের ওপাশ দিয়ে খুব চওড়া একটা ড্রেন, তার ওপাশে একটা স্ট্রিট, ওটা চোদ্দো নম্বর। সেই রাস্তারও একদিকেই কোয়ার্টার শুধু, সেগুলো এক কামরার। ওখান থেকেই শুরু হয়েছে সুইপার বস্তি। মাঝের মাঠটা সেপারেটার, তাই অতো বড়, আর ষোলো নম্বর স্ট্রিটটাই হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ওদের শুয়োরগুলো কি ভাবে যেন নালাটা পেরিয়ে মাঠে চলে আসে, তাই মাঠের ওই দিকটায় যাওয়া বারন আমাদের।  বাড়ীর গেটে দাঁড়িলেই দেখা যাবে ট্যারছা মতো আরেকটা স্ট্রীটের পেছন দিক, ডানদিকে। ওটা টেগোর প্লেস। টেগর প্লেসের ভেতর দিয়ে একটু এগোও, ওখানেই ফাইনার্টস, ক্যারাম খেলা হয়, সিনেমা দেখায়, নাটক হয়, ফাংশান হয়। তার সামনে দিয়ে গেছে টেগোর এভিনিউ, যেখানে চন্ডীদাদুরা থাকে। ওই রাস্তা দিয়েও সোজা এলে সেই প্রান্তিকাতেই পৌঁছবে, কালীবাড়ীর পরের রাস্তাটায়, যেখানে ডি এস টি সির লাল বাস গুলো ছাড়ে। মাঝে ডানদিকে একটা গলিতে আমাদের হেলথ সেন্টার। ওখানে আমি টীকা নিয়েছি, স্মল পক্সের।


কি অন্যায় দেখো তোমরা, আমি এতো ভালো করে চিনি এই যায়গাটা, কিন্ত আমি আজকে রাত্রে থেকে এখানে নেই। কাল, পরশু, নরশু...


৬. এই বাড়ী

এই বাড়ীতে আসাটা যতটা বিচ্ছিরি হবে ভেবেছিলাম, তা হয়নি। কারন ঠাকুমা তো এলোই, কয়েকদিন পরে বড়দি এলো পি ইউ পড়বে বলে। ভিড়িঙ্গি স্কুলে, নাম টি এন স্কুল। মাসিমনিও চলে এলো কিছুদিন পরে। দুর্গাপুরেই পড়বে। কয়েকদিন পরে ছোড়দিও এলো, বড়দির পড়া শেষ হওয়া মাত্র। ছোড়দি মানে এ আমার আসল ছোড়দি নয়, আসলে নদি, বড় জেঠুমনির ছোট মেয়ে। কিন্তু ফুলদি যদি ওকে ছোড়দি বলে, আমিই বা বলবো না কেন? বরং বড় ছোড়দি বলতে পারি, ফারাক করার জন্য। কিছুদিন ঝড়ুদার কাছে টিউশানি পড়ে ছোড়দি ফেরৎ চলে গেছে আবার, নোহারী এখানে নাকি মন বসছে না।

মাসিমনি থেকে গেলো। মামা তখন কলেজে পড়ে, হাজারীবাগে, ছুটি ছাটায় চলে আসে। দাদুও আসে মাঝে মাঝে, রাধানগর থেকে। দাদু টাটানগরে চাকরি করতো, তাই মামাবাড়ীর দিকের সবাই, শুধু দিদু ছাড়া, হিন্দিতে চোস্ত। আরেকটা জিনিসেও সবাই খুব উৎসাহী সেটা হল গান। রোজ সন্ধ্যায় গান গাইতো মাসিমনি আর মা, মাঝে মাঝে মামা। মামা কম গাইতো, কারন মামা ভি আই পি, গানের কদর খুব বেশী। মায়ের গান গুলো একটু দুঃখ দুঃখ ভাবের হতো আরো আরো প্রভু আরো আরো, এমনি করে, এমনি করেই আমায় মারো আমি ভেবে নিতাম প্রভু মারছে আর ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে, আর মা গান গাইছে। ভালো না, মোটেই ভালো না। কিন্তু সুরটা বেশ। মাসিমনি গাইতো একটু কঠিন গান। আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। আমি মন দিয়ে শুনেছি কনিকা বন্ধোপাধ্যায় ঠিক যেরম করে গাইতেন, একদম তেমনি, কোনো ভুল নেই। মামা গাইতো মান্না দের গান। পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে এখানে তুমি আসবে, কতটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে? গানটা শেষ হওয়ার পরে কেউ কোনো কথা বলতো না।

মামা এখনো আসে, থাকে অনেকদিন। কলেজ ফুরিয়ে গেছে। মামা এখনো গান গায়। কিন্তু মামা চাকরি পাচ্ছে না। এতো ভালো হিন্দি বলে, কি দারুন স্কাল্পটিং করে থারমোকল দিয়ে, সিনারি সে বললেই এঁকে দেয়, এতো সুন্দর নকল করে সবাইকে, কি সুন্দর করে বলছিলো পুরুলিয়াঁ গেঁইছিলহম বাবু, হথায় ডিংলা বড় সস্থা! কিন্তু তাও, চাকরি টা পাচ্ছে না কিছুতেই। ডিপি-রোজিরাও চলে গেছে, বাড়ীটা এখন ফাঁকা।

৭. মানুষজন

ডিপি দের বাড়ির পরেরটা টুম্পাদের, তারপর নন্দীকাকু, অপুরা, আমরা, আর সবার শেষে রজনীরা। টুম্পাটা ছোট, কিন্তু খুব ভালো মেয়ে। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। ওর মা, ডালিয়া কাকিমা, সেও খুব ভালো। আমি তো মাছ খেতে ভালোবাসিনা, কিন্তু আমাকে একবার একটা মাছ খাইয়েছিল, পার্শে না কি না যেন, দারুন খেতে। ডালিয়া কাকিমা মাস্টার রেখে গান শিখতো। দারুন গলা, ঋতু গুহর মতো। কিন্তু ব্যানার্জি কাকুটা মহা বিচ্ছু। ওদের বাড়ীতে ঝামড়ি বলে একটা কুকুর ছিল, পাঁশুটে রঙের, লোমের গাছ একখানা। সারাদিন খালি কেঁউ কেঁউ করছে আর একে ওকে চেটে দিচ্ছে। আমার কুকুর খুব ভালো লাগে, লাগতেই হবে কারন কিট ওয়াকারেরও বাঘাকে ভালো লাগে, কিন্তু এতো লোম মোটেই পছন্দ হয় না। ব্যানার্জিকাকু আমাকে আদর করে কোলে নিয়ে তারপরেই ঝপাস করে হাত টা ধরে ঝামড়ির গায়ে লাগিয়ে দিত, আর আমি চীল চিৎকার করতাম। ওই ভয়েই ওদের বাড়ী যেতাম না। দোলের দিনে মেন রাস্তার সাইকেলওয়ালাদের ওপরে পিচকিরিটা শেষ করে বাড়ী আসছি রিফিল করার জন্য, তখন খপাস করে হাতটা ধরে মুখে বাঁদুরে রং লাগিয়ে দেওয়া, সেও ওই বিমান ব্যানার্জি কাকুরই কান্ড। অথচ দেখো, লোকটা নাকি স্পোর্টসম্যান। অলিম্পিক দেখতে যাবে, কোম্পানী টাকা দিচ্ছে। আবার লাল পার্টিও করে, সেদিন বাড়িতে পুলিশের জীপ এসেছিল, আমি দেখেছি। ঝামড়িটা বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে সপ্তাহ দুয়েক হল। বেশ হয়েছে। টুম্পা একটু কাঁদছিল, ওকে কুমিরডাঙ্গায় এক্সট্রা আবুলিস দেবো, ঠিক হয়ে যাবে।

নন্দীকাকুদের বাড়িতে অনেক লোক। কাকু আছে, কাকিমা আছে, ঠাকুরদা আছে, ঠাকুমা আছে, অনেক কটা কাকা আর পিসি আছে। মাঝে মাঝেই কাকা আর পিসি গুলো পাল্টে যায়। নতুন কাকা, নতুন সব পিসি আসে। কিন্তু এদের কারুর কথাই ঠিক বুঝি না। মা বলছিল চট্টগ্রামের লোকেরা নাকি এমন ভাবেই কথা বলে। কাকীমা মাঝে মাঝেই ইশে বলে, সেটা যে ইয়ের বদলে, সেটা বুঝি, কিন্তু অনেক কথাই বুঝি না। কাকীমা ভালো মানুষ, একবার না বুঝলে আবার একটু বাংলা বাংলা করে বাঙাল বলে, তখন বুঝতে পারি। একদিন দুপুরে আমাকে একটা পিসি যখন বলল বাবু, বাত আইতে ঝারগুই?, আমি হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। ছোটবনি বুঝিয়ে দিল বাবুদাদা, গোকুলপিসি তোমাকে ভাত খেতে যেতে বলছে। কি সব যাচ্ছেতাই! আমি তো ভাবছিলাম বাত, মানে কথা বেশী বললে যে হাই উঠবে, তাতে অসুবিধে কোথায়, এরকম কিছু জানতে চাইছে, কিন্তু ওই ঝারগুই না কি যেন, ওটা ঠিক অসুবিধে কিনা সেটাই বুঝছিলাম না। তা যাকগে, ছোটবনি থাকলে অবশ্য এসব চিন্তা নেই। অনুরাধা ভালো নাম, নন্দী কাকুর বড় মেয়ে। আমার যোগ্য হেড এসিস্ট্যান্ট। আমি ফেলুদা হলে এটাকেই তোপসে বানাবো দেখতেও ভালো। মাঝে মাঝে একটু বেশী রাগ করে, এই যা সে যাহোক, মানিয়ে নেওয়া যাবে। ওর ভাই, ডাম্পু টা লেজের মতো পেছন পেছন ঘোরে, ওটাকে একটু পিঠে কিম্বা মাথায় শুড়শুড়ির জন্য ইউস করবো। সেটিং হয়ে গেছে অবশ্য। যখন ঘুড়ি চেটাতে হয়, তখন ডাম্পুকে বললেই ওর ঠাকুমার ভোগের থালা থেকে ভাত এনে দেয়, নাহলে আঠা পাওয়া, সে এক ঝক্কি। ডাম্পু ভালো গান ও গায়, ফাংশান করলে ওকে দিয়ে কটা গানও গাওয়াবো। এর মধ্যেই দেখলাম, নন্দী কাকিমার পেটটা কয়েকদিন ঢাউস হয়ে ফুলে রইলো, আর ছোটবনি একদিন ফিক করে হেসে বলল আজ থেকে আমার ডুই টো ভাই, ডাম্পু আর ডাল্টন!

অপু তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, শুধু স্কুলটাই যা আলাদা। আমরা একসঙ্গে চৌবাচ্চায় নামি, একসঙ্গে মাটির ভাঁড় নিয়ে ডিম পাড়া শিখেছি, কুমিরডাঙ্গা খেলার সময়ে শুধু যা একটু ঝগড়া হয়। ওদের বাড়ীতেও ফ্রিজ আছে, গ্যাস আছে। ওদের বাড়ীতে রবীন্দ্র রচনাবলী আছে, উপনিষদ আছে, ম্যাক্সিম গোর্কির অনেক বই আছে, লিও টলস্টয় এর বই আছে, এমনকি দস্তয়েভস্কির বই ও আছে। বনিকে একদিন বলেছিলাম তুই একটা দস্তয়েভস্কি এমন ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল, বোঝাতে হল যে ওটা মানে আসলে ভালো জিনিস। ওরা সোভিয়েত দেশ নেয়। দেশ ও নেয়। দাদা আর বৌদি পার্টি ও করে সুসি না কি যেন নাম। ওদের বাড়ির দেওয়ালে সাইকেল চিহ্নে ছাপ দিন বলে লেখা আছে। ওদের বাড়ীতে অনেকে আসে যারা সুসির লোক বাদশাকাকু, কোলে কাকু, ভাস্করকাকু। সুবাস কাকুও আসে, কিন্তু সুবাস কাকু সুসি নয়। সুসি নিয়ে দাদার সঙ্গে ঝগড়া করে, আমি শুনেছি। দাদা আসানসোল থেকে বাজি আনে কালীপুজোর সময়ে কি লম্বা লম্বা তারাবাতি, আর বড় মোমবাতি, ইলেকট্রিক তার, দোদোমা আর বাচ্চু বোম। দাদার একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা আছে, তাই দিয়ে দাদা ছবি তোলে আমাদের, বাবাদের সবার। আমি একটা ছবিতে দেখেছি, আমি ছোটবেলায় একদম টাকমুন্ডি ছিলাম, আর আমার ফেভারিট খেলনা ছিল একটা এরোপ্লেন। দাদা আগে রেলে ছিল, মাঝে মাঝে রেলের গল্প বলে। ওদের বাড়ীতেও দিনকয়েক হল একটা নতুন বাচ্চা এসেছে, এখন একটু একটু কোথাও বলে ওটার নাম রূপা। রুপার ঠোঁটের মাঝখানটা কাটা, তাই কথাগুলো খুব মিষ্টি শোনায়। মা কে দিদু বলতে পারে না, বলে ডিউ, আর আমাকে বলে ওয়াউ। এটা আমার সব কথা শোনে, তাই ঠিক করেছি এটাকে আমি আমার কাছেই রেখে দেবো।

রজনীরা রাজস্থানী। ওর দাদা সি আই এস এফের জীপ চালায়, উইলিস। জেবুলীর অফিসের স্টেশন ওয়াগান, সেও উইলিস, কিন্তু সেটা এর থেকে অনেক বড়। এটা ছোট্ট, কিন্তু স্মার্ট। জলপাই রঙের, পেছনে একদিকে লাল দিয়ে লেখা উইলিস, অন্য দিকে লেখা লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। আমাকে মাঝে মাঝে চড়ায়।  ওদের বাবা আগে কারখানায় ডাম্পার চালাতো, এক্সিডেন্টে আঙ্গুল খোয়ানোর পরে এখন আর চাকরি করে না। ওদের বাগানে একটা ট্র্যাক্টার আছে, সেটা চলে না, কিন্তু তাতে উঠে বসে আমরা মাঝে মাঝেই গিয়ার দিই। বনি আর রজনীর ওপরে ওঠার সাহস নেই, ওরা ন ঘরার কিতকিত খেলে পাশে ছক কেটে। কখনো কেমনো ছোটবনি এসে যোগদান করে। রজনীর মা এখানে থাকে না, রজনীর দিদি আর বোনের সঙ্গে রাজস্থানে থাকে। রজনী স্কুলে যায়না, ওর বিয়ে হয়ে যাবে কদিন পরেই, তাই। ও রান্না করে। ওরা ফেলুদার নাম শোনেনি, তোপসে কথাটা উচ্চারণই করতে পারে না ঠিক মতন। সোনার কেল্লা যে ওদের দেশেই, সে খবর ওর জানা নেই। ওদের সোনা রঙের বাজরার ক্ষেত আছে, ওরা তাই ট্র্যাক্টার কিনে রেখেছে। ওর বাবার এখনো কিছু টাকা পাওনা আছে, পেয়ে গেলেই দেশে চলে যাবে ওরা। দাদা থেকে যাবে, দাদার বিয়েটা ওর বিয়ের ঠিক পরেই।

৮. যুদ্ধ

মোটামুটি বন্ধু বান্ধব হয়েছে, বাড়ীটাও ভালো লাগতে শুরু করেছে, এমন সময়ে যুদ্ধ লেগে গেলো। একদম আসল যুদ্ধ। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। আমি শুনলাম আমরা বাংলাদেশের পক্ষে। যুগান্তরে নজরুলের ছবি ছাপা হল, সেদিন সন্ধ্যায় মাসিমনি গাইল নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল। আর আমি ভেবে ভেবে আকুল হলাম সত্যিই তো, দুটোর মধ্যে কোনটা নেওয়া যায়? একটু পরেই ঝপাস করে লাইট নিভে গেলো, অপু আর বনি চেঁচিয়ে উঠলো ব্ল্যাক আউট, ব্ল্যাক আউট! দেখলাম বড়রা সবাই বাইরে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। প্লেন দেখা যেতে পারে নাকি। অপুদের বাড়ীতে সুবেশ কাকু আর সঞ্জু এসেছিল, ওরাও বেরিয়ে এলো সবার সাথে। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম অনেক্ষন। মেঘ দেখলাম, তারা দেখলাম, উল্কা দেখলাম, কিন্তু প্লেন তো দেখলাম না কই।  সবাইকে হতাশ করে দিয়ে আলো জ্বলে উঠলো একটু পরেই।

দিন কয়েকের মধ্যেই কিন্তু ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠলো। বাবা কারখানা থেকে নিয়ে এলো গোছা গোছা কার্বন পেপার। ময়দা আর সবুজ রঙের একটা জিনিস, তুঁতে বলে ওটাকে, এই দুয়ে মিলিয়ে জল ঢেলে কলাই করা বাটিতে ফোটানো হল, তৈরী হল আঠা। কাগজ কেটে কেটে আমরা সবাই জানলার কাচে লাগিয়ে ফেললাম সেই আঠা দিয়ে। ডি এস পির নেভী ব্লু মারসিডিস বেঞ্জ বাস গুলো, ডি এস টি সির নীল রঙের লেল্যান্ড বাস তখন সবার হেডলাইটের অর্ধেক ঢেকে দেওয়া হল কালো পেন্ট দিয়ে। বাসের জানলার কাঁচগুলোতে চাপলো মোটা করে কালো পেন্ট। রাখু দাদার স্কুটারের আলোতেও একই ব্যাপার হল। রাস্তায় ল্যাম্প পোস্ট থেকে একটা আঁকশির মতো পাইপ ঝুলতো, তাতে ফ্লাইং সসারের মতো দেখতে শেডে একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলতো, সেগুলো আর জ্বলে না রাত্রে। কেমন একটা ভয় ভয় ব্যাপার যেন। একদিন সকালে শুনলাম, কালকে নাকি পানাগড় অবধি পৌঁছে গেছলো পাকিস্তানের প্লেন, তার একটাকে ওরা গুলি করে নামিয়েছে। সেদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, একটা প্লেনের অর্ধেক ভেঙ্গে গেছে, বাকি অর্ধেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে হেলমেট পরা পাইলট, আর একটা লোক জলপাই ড্রেস পরে মস্ত বন্দুক দিয়ে গুলি করে চলেছে, আর ওই পাইলটটা গুলি লাগলেই বলছে অ্যাঃ অ্যাঃ! তারপরে হঠাৎ করেই একটা গুলিতে লোকটা ভ্যানিস হয়ে গেলো। ভ্যানিস হওয়ার ঠিক আগে দেখলাম, লোকটার মুখটা লরেল হার্ডি সিনেমার হার্ডির মতো।

জেবুলীরা এসেছিল এক রোববার, সেদিন মাংস কিনতে গিয়ে বাবা খুব ঝগড়া করলো দোকানীর সঙ্গে। আট টাকা কিলো ছিল এক সপ্তাহ আগে, আর এখন বারো টাকা? দোকানী বলল বারো কি, কয়েদিনের মধ্যেই চোদ্দ হবে বাবু। বাবা বলল মাংস খাওয়া বন্ধ করে দেবো তাহলে। আমি বাড়ী ফেরার সময়ে বাবাকে একটা পরামর্শ দিলাম বাগানে মাঝে মাঝে যে ছাগল ঢুকে পড়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে,  ওগুলো ধরে রাখলেই তো আর দোকান থেকে মাংস কিনতে হয় না? বাড়ী ফিরে সবাই এটা নিয়েই এমন বিচ্ছিরি হাসলো, আমার খুব রাগ হয়ে গেলো। ঠিক আছে, আমি একদিন ধরে দেখিয়ে দেবো। সুযোগও এসে গেলো। একদিন সকালে বাবার ধুতিটা মালকোঁচা মেরে ট্রায়াল দিচ্ছি, জানলা দিয়ে দেখলাম বাগানে একটা ছাগল, মন দিয়ে কসমস গাছ চেবাচ্ছে। ছুটে চলে গেলাম, প্রায় বাগে এনে ফেলেছি, বেইমান ধুতিটা বাগড়া দিল। নেক্সট সিন আমি কাঁদছি, ঠাকুমা হাউ হাউ করছে  আর মা রিক্সা ডাকতে গেছে মোড়ে হেলথ সেন্টারে যেতে হবে যে। ওখান থেকে ফেরত এলাম যখন, ঠোঁটের ওপরে একটা মস্ত পুল্টিস আর সামনের একটা দাঁতের খানিকটা নেই।  সবাই বলল ওটা কোন ব্যাপার না, দুধের দাঁত তো, আবার উঠে যাবে। বাবা ডিউটি থেকে ফিরে কথা দিল, মাংস ওয়ালার সাথে আর কোনদিন দরদাম করবে না আর, যদিও আমি সেটা চাইনি। আমি তো শুধু একটু বুদ্ধি খাটিয়েছিলাম, কেউ কদরই করলো না।

আমার একটা নেশা ছিল, বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়া। এখনো যাই। তখন তো আমাদের ফ্রিজ ছিলো না, তাই প্রায় প্রতিদিনই বাজারে যাওয়া হতো। প্রথমে একটা অ্যাটলাস সাইকেল ছিল, তার সামনের রডটায় আমার জন্য একটা ছোট্ট সিট। আমি ওটাতে বসেই যেতাম, মাঝে মাঝে বেলটাও বাজিয়ে দিতাম। কিছুদিন পরে বাবার শরীর খারাপ হল, সাইকেলটা নিয়ে চলে গেলো মোহনের চাচা, যে আমাদের দুধ দেয়। আমি কিন্তু তারপরেও হেঁটে হেঁটেই যেতাম, বাবার সঙ্গে। আমার আরো একটা নেশা ছিল, রবারের বল কেনা। এমন নয় যে আমার একসঙ্গে অনেক গুলো বল থাকতো। কখনো নীল, কখনো হাল্কা সবুজ, কখনো ম্যাজেন্টা একটা করেই কিনে দিত আমায়। কিন্তু ওই যে উঠোনের নালি টা, ওটা সব কটা খেয়ে ফেলতো এক দুদিনের মধ্যেই। বলগুলো বেজায় বেয়াদপ, একবার মিস করলেই ঠিক সেই ড্রপ খেতে খেতে নালিতেই ঢুকে যাবে। একবার সুইপার এসে ম্যানহোল খুলে তেরোটা বল বের করে দিয়েছিল, কিন্তু মা ওগুলো ছুঁতেই দিল না, সব দূর দূর করে ফেলে দিল।

একদিন সন্ধ্যায় বাজারে গেছি, শালবাগান রোডের কেরোসিনের দোকানে বাবা কেরোসিন কিনছে। পাশের দোকানে নেটের ভেতর বল ঝুলছে, আমি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, বাবা বলল নিবি? আজকেই দুপুরে নালিটা একটা বল খেয়ে নিয়েছে, আমি বলটা নিলাম, কুড়ি পয়সা। এটার রবারটাও বেশ ভালো, খুব ড্রপ খাচ্ছে। একটু পরে, বাবা আমের দোকানে আম কিনছিল, আমি পাশে দাঁড়িয়ে বলটা ড্রপ দিচ্ছিলাম, পাশে তাকিয়ে হঠাৎ দেখলাম বাবা নেই। বুকটা একবার ছ্যাঁৎ করে উঠলো। হারিয়ে গেলাম নাকি? এদিক ওদিক তাকালাম, তারপরে বাজারের ভেতরে গুড়কাকুর দোকানে গেলাম, ওখানেও নেই। পুরোনো গুড়কাকুর ওখানেও নেই। ফলওয়ালার উল্টোদিকে একটা মিষ্টির দোকান আছে, দেওয়ালে একটা খালিগায়ের লোকের ছবি, আগে ভাবতাম মালিকের বাবা, তারপরে জেনেছি ওটা ওদের গুরুদেব, নাম অনুকুলচন্দ্র, সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই দোকানে ছানার টোস মিষ্টি পাওয়া যায়, আমি খুব ভালবাসি, ভাবলাম বাবা এখানে একবার নিশ্চয়ই আসবে। এলো না। একটু দেখবো কি এদিক ওদিক? আস্তে আস্তে মেন রোডে এসে মদন স্টোরসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি, এমন সময় ব্ল্যাক আউট হয়ে গেলো। আর ওমনি, বাজারের হাজার হাজার লোক সবাই একসঙ্গে যাঃ বলে উঠলো, তাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হল। আমার গা টা এবারে শিরশির করছে। এখানে দাঁড়ানো ঠিক না। পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম। কাপুর মার্কেট পেরোলাম, রুমা সুইটসে মোমবাতি জ্বলছে, পেরিয়ে গেলাম। বাঁ হাতে সেলুনটা চিনতে পারলাম, যেখানে চুল কাটার পরে বাবাকে খুব মারে মাথায়, ঘাড়ে, কিন্তু বাবা রাগ করে না, আরামে চোখ বন্ধ করে রাখে। ওটা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার এখন। তারপরের দোকানটা গাঠিয়ার, ওদের উনুন এখনো জ্বলছে।  প্রান্তিকার কালিবাড়ীতে হ্যারিকেন জ্বলছে, একটা বাস এলো, অন্নপূর্ণাই হবে। আমি ট্রাঙ্ক রোড ধরে এগোচ্ছি। পায়ে হাওয়াই চটি, খুলে হাতে নিয়ে নিলাম, পায়ের শব্দে যদি ছেলেধরারা বুঝে যায় আমি যাচ্ছি? শালবাগানের ইগ্লু গুলো দেখা যাচ্ছে ডানদিকে লম্ফ জ্বলছে বোধহয়। ওই তো, আমাদের কালভার্ট দেখা যাচ্ছে। টুম্পাদের বাড়ীটা পেরোচ্ছি, কারেন্ট চলে এলো।

মা আমাকে দেখে অবাক। তোর বাবা কই? আমি একগাল হেসে বললাম হারিয়ে গেছে। সে কি রে? তুই বাড়ী এলি কি করে? আমি বললাম কেন? হেঁটে? মা বলল, তোর ভয় লাগেনি? আরে, অন্ধকার তো, আমাকে ছেলেধরারা দেখতে পেলে তবে না ধরবে? মা দেখলাম বার বার বলছে আচ্ছা ছেলে যাহোক। একবার বাইরে গেলো, অপুরা নেই, তালা বন্ধ, আমি দেখেছি। গেটের আওয়াজ পেলাম। তরুন মামা, বি জোনে থাকে, জয়দেবে। বেনাচিতি এসেছিল, ফেরার সময় দেখা করতে এসেছে। মা যেন নতুন করে সাহস পেল। সব কান্ড বলল তরুন মামাকে। মামা চলে গেলো সাইকেল নিয়ে বাজারে। একটু পরে বাবা ফেরত এলো। এসেই আমাকে দেখতে পেয়ে হাতটা ফুলিয়ে নিয়ে আমার পাছায় এক চড়। বাবা ওমনি করেই মারে, যাতে ব্যাথা না লাগে। আমি তখনো হাসছি, মার খেয়েও, মার খেয়ে আমার কাঁদার নিয়ম, কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে না যে। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল, মুখে হাসি, শুনলাম মা কে বলছে শুনছো, তোমার ছেলে বড় হয়ে গেছে, আর আমার কোন চিন্তা নেই

৯. কমপ্ল্যান বয়

বড় হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই, এটা যে বড়রা কেন বোঝেনা, কে জানে? তুমি না চাইলেও তুমি বড় হবে, তাই বড় হয়ে যাওয়াতে আনন্দের কিছুই নেই। বরং দুঃখ আছে, অনেক কটা। সবসময়ে প্যান্ট পরতে হয়, নাহলে নাকি অ্যাল। কোলে ওঠা যায়না, তাই সব যায়গায় নিজে নিজেই হেঁটে যেতে হয়। পড়ে গিয়ে ব্যাথা লাগলেও কাঁদা বারন, অন্ততঃ চোখে জল এলেই মুছে ফেলতে হবে, আর খুব লাগলেও বলতে হবে লাগেনি একটুও। এতোদিন প্রথমে মায়ের পায়ের ওপরে, তারপরে ইঁটের ওপরে বসে খবরের কাগজে নিত্য কর্ম সারতে, এখন তোমাকে ওই আরশোলার ডেনে ঢুকতে হবে। সবথেকে বড় দুঃখ, স্কুলে যেতে হবে।

বাবা একদিন গুরুদুয়ারা রোড দিয়ে একটা স্কুলে নিয়ে গেলো। বাইরে লেখা আছে অ্যাগ মিশন। জোরে জোরে পড়ছিলাম, বাবা ঠিক করে দিয়ে বলল ওটা এ জি মিশন স্কুল। মস্ত গেট, পেরিয়ে ঢুকতেই সামনে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা, দু পাশে ফুলের গাছ আর লন, বাঁ দিকে লনের পাশে একটা দুটো ক্লাসরুম, সেখানে টিচাররা পড়াচ্ছে। এগুলো পেরোলেই অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে দুটো দোলনা আর দুটো সিলিপ, কিন্তু কেউ খেলছে না। আমি দোলনার দিকে এগোচ্ছিলাম, বাবা হাতটা টেনে আটকে দিল। সামনে টানা অনেকগুলো ঘর, দোতলা একদিক আর একতলা আরেকদিক। তিনটে সিঁড়ি লাফ দিয়ে উঠে বারান্দার মতো জায়গাটায় উঠে পড়লাম। একদম ডানদিকের ঘরটায় লেখা আছে অফিস। দু নম্বর ঘর টা, তার বাইরে লেখা আছে প্রিন্সিপাল, সেটার দরজার সামনে গিয়ে বাবা বলল মে আই কামিন?

মস্ত ঘর, ওদিকে একটা কালো মতো লোক বসে আছে মোটকা সোটকা, মাথায় একটু টাক তরুন মামার মতো, স্টেনলেস স্টিলের চশমা পরা, সে বলল কামিন। আমদের হাত দিয়ে দেখালো, উল্টোদিকের চেয়ারে বসলাম। তারপরে বাবার সঙ্গে কি সব ইংরেজি তে কথা হল, আমি সেসব শুনিনি, লোকটাকে ভাল লাগছিল না, তাই। বরং দেওয়ালে একটা ছবি ঝোলানো, সেটাই দেখছিলাম। বি ফর ব্যাট হয়, এরা কিছুই জানে না, বি এর পাশে একটা বলের ছবি দিয়ে রেখেছে। লাল রঙের, ফেটে গেছলো বোধহয়, তাই মাঝখানে সেলাই করা। চশমা পরা লোকটা বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে এবারে আমাকে ডাকল হোয়াট ইস ইওর নেম বয়? আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, মাই নেম ইজ বিজিৎকুমার বাসু, নিকনেম ইজ বাবু, মাসিমনি কলস মি বাপ্পা। লোকটার চোখ কপালে উঠে গেছে, বাবাকে জিজ্ঞ্যেস করলো হাউ ডাজ হি স্পিক ইন ইংলিশ? আরে বাবা, এসব তালিম আমার নেওয়া হয়ে গেছে অনেকদিন। আমি খবরের কাগজ ও পড়তে পারি আজকের অমৃতবাজারের হেডলাইন আছে ইন্ডিয়া ইস উইথ দ্য পিপল অফ ইষ্ট পাকিস্তানঃ ইন্দিরা। লোকটা একটা কাগজ আর পেন দিয়ে আমার নাম লিখতে বলল। আমি কাগজটা বাগে পাচ্ছিলাম না ঠিকঠাক, তাই নির্দ্বিধায় পাশের চেয়ারটা বেয়ে উঠে টেবিলের কাছে পৌঁছে গেলাম বাবা রিয়্যাক্ট করার আগেই, তারপর স্যাট করে পেন টা বাঁ হাতে নিয়ে লিখলাম বিজিৎ কুমার বাসু।  লোকটা বাবাকে জিজ্ঞ্যেস করলো ইস হি লেফটি? বাবা বলল ইয়েস। লোকটা মুখে বলল ভেরি গুড, আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল বাবার হাতে। বাইরে বেরিয়ে বাবা বলল আমাকে নিয়ে নিয়েছে ওরা, নার্সারিতে। সোমবার থেকে স্কুলে আসতে হবে, রোজ। হঠাৎ একটা ঘন্টা বাজলো কোথায়, আর বৃষ্টি হলে আমাদের বাড়ীর সামনের ড্রেনটা দিয়ে যেমন জল যায়, ঠিক তেমনি ভাবে অনেকগুলো আমার মতোই, কিম্বা একটু বড় হবে কয়েকজন, ছেলে আর মেয়ে, ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর গুলো থেকে। শুনলাম, ওগুলো ক্লাসরুম বলে।

স্কুল চালু হয়ে গেলো, নীল সাদা কুচি কুচি চেক এর জামা, তার পকেটের ওপরে এম্ব্রডায়রি করে লেখা এজি, নেভী ব্লু প্যান্ট, পায়ে বাটার জুতো এই সব চলে এলো, পরে টরে আমি স্কুল গেলাম। পিঠে নতুন ব্যাগ, খাঁকি রঙের।

অ্যাসেম্বলি হল বলে একটা বড় ঘর আছে, সেখানে সব্বাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করালো প্রথমে। সেই কালো লোকটা, যে কিনা প্রিন্সিপাল, কি কি সব বলল, শেষে বলল গড ইস গুড, আমেন। এ কথা আবার লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কেন শুনতে হবে, কে জানে এ তো ঠাকুমা, মা, দিদু, দাদু সবাই বলে। তারপর একটা ইংরেজি গান গাইলো একজন মিস, তার সঙ্গে গলা মেলালো বাকি কয়েকজন মিস। শেষে একটা কথা সব্বাইকে বলতে বলল মিসেস মার্গারেট, আমিও না বুঝেই বললাম, কিন্ত কি ভাষা বুঝলাম না। তারপর লাইন দিয়ে একটা ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিল।

ক্লাসগুলো বেশ বড় বড়, ঘরে চারটে ফ্যান, তার মধ্যে দুটো ঘুরছে। সামনে দেওয়ালে লাগানো একটা কালো রেক্ট্যাঙ্গেল ওটা ব্ল্যাকবোর্ড। ডানদিকে ঢোকার দরজা, আর বাঁ দিকে মস্ত বড় একটা ইংরেজি এ এর মতো স্ট্যান্ড, পেছনে আরো একটা পা, যাতে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই এ টার মাঝের কাটা টা যেখানে থাকে, সেখানে দুটো এল এর মতো হুক বেরিয়ে আছে। আমি বসেছি একটা বেঞ্চে, সেটা সামনের টেবিলের সঙ্গে দুটো সাইডে দুটো কাঠ দিয়ে জোড়া। টেবিলটা বাড়ির টেবিলের মতো সমতল না, প্রথমে একটু সমতল, তারপরের আমার দিকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে, শেষের দিকে একটা খাঁজের মতো, সেখানে পেন্সিল রাখতে হয়। এর নিচে আবার একটা তাকের মতো যায়গা আছে, সেখানে স্যুটকেস রাখতে হয়। এটাকে বলে ডেস্ক।

একটা বেঞ্চে দুজন বসা যায়। আমার পাশে বসেছে একটা ছেলে। মাথার দুদিকে বিনুনী করে কেমন ভাবে যেন মাথার ওপর দিয়েই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। আমাকে দেখে হাসল, আমিও হাসলাম। ও মা, তারপরেই বলে মেরা নাম ইন্দার হ্যায়, তেরা কেয়া নাম হ্যায় বে? আমি জানি বে খারাপ কথা, বলতে নেই, তাও কি আর করবো, নতুন যায়গা, সবার সঙ্গেই একটু ভালো সম্পর্ক রাখাটা জরুরী, একটু গম্ভীর হয়ে বললাম বিজিৎকুমার। ইন্দার আবার হেসে বলল তু কিশোরকুমার কা ভাই হ্যায় কেয়া? আমিতকুমার? আমি উত্তর দিলাম না। অমিতকুমার কিশোরকুমারের ছেলে, সেটাও জানে না।

প্রথম একটা পিরিয়ড ভালই ছিল, কিন্তু তার পর থেকেই মনটা কেমন কান্না কান্না হতে থাকল। বার বার নয়ন ভরা জল গানটা গাইতে ইচ্ছে হতে লাগলো। একটু পরে মন খারাপ করে বেঞ্চে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। একটু পরেই ঠেলে ঠুলে তুলে দিল বিজিৎ, হোয়াই আর ইউ স্লিপিং? আর ইউ আনওয়েল? আমি কিছুই বললাম না, শুধু চোখের পিচুটি টা মুছে নিলাম। সেদিন মা নিতে এসেছিল মিস আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওর কি শরীর খারাপ? নাহলে ক্লাসে ঘুমোয় কেন? যাহ্‌ তেরি মন খারাপ হয়েছে, তাই ঘুমিয়েছি, তাতেও অসুবিধে?

সেই থেকে রোজ সকাল ছটার সময় উঠে পড়তে হল। তারপর ব্রাশ করে, হাগু করে, ড্রেস পরে, চুল আঁচড়ে সোফাসেটিতে বসে পড়ো। মা কিম্বা মাসিমনি জুতো পরিয়ে দেবে, ফিতে বেঁধে দেবে, তারপর একটা চ্যাপ্টা গোল বাক্স থেকে কালি বের করে লাগিয়ে দেবে। বাবা ডিউটি বেরিয়ে যাবে এর মধ্যেই, টাটা করে তুমিও বেরিয়ে পড়ো স্কুলের দিকে। অপু আর বনি, দুটোই আগে চলে গেছে, ওরা বাসে চেপে স্কুলে যায়, বেনাচিটি জুনিয়ার স্কুল। আমি যাই হেঁটে হেঁটে, পাথরের সঙ্গে ফুটবল খেলতে খেলতে। স্কুল যাওয়ার পথে সবথেকে ইন্টারেস্টিং জিনিস হচ্ছে হাগু দেখা। আমি জানি মেয়েরা এটা নিয়ে নাক সিঁটকোবে, ছেলেরাও সামনে যা তা বলে তারপরে লুকিয়ে এটা পড়বে, কিন্তু কি করবো, ওটা এতো ইন্টারেস্টিং, যে না বলে পারছি না। গুরুদুয়ারা রোড ডি এস পি টাউনশিপের বাইরের জায়গা, তাই ব্যবসাদারের বড় বাড়ীও যেমন আছে, তেমন বস্তি আর খাটালও আছে। আর ওই বস্তির কারুরই বাড়ীতে ওই উঁচু মতো ঘরটা নেই, বা থাকলেও ব্যবহার নেই তেমন। সবাই খুব ভোরে উঠে রাস্তার ধারেই কাজ সেরে যায়। রাস্তার ধারেই নালি। যারা একটু লজ্জা শরম করে তারা নালিতে, আর যারা নালি দেখে ভয় পায় কিম্বা লজ্জা নেই তেমন, তারা নালির থেকে অনেক বেশী পছন্দ করে রাস্তার ধারটা। রাস্তা থেকে রাস্তার মাটি বেশ ইঞ্চি ছয়েক নিচে, তাই অবস্ট্রাকশনের অসুবিধেটাও নেই। অনেক রকম শেপ আর কোয়ান্টিটি দেখেছি, কিন্তু তার থেকেও ইন্টারেস্টিং হল রং সোনালি হলুদ, কালচে হলুদ তো কমন, কিন্তু লালচে, বটল গ্রীন, সাদাটে, এমন কি ফিকে সবুজও দেখেছি। সঙ্গে মা, মাসিমনি কিম্বা ছোড়দি যেতো, যাতে সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারি। আমি সারা রাস্তা মন দিয়ে দেখতে দেখতে যেতাম, আর নতুন রং পেলেই খুব উৎসাহ নিয়ে ডেকে ডেকে দেখানোর চেষ্টা করতাম কেন কে তাতে অত বকতো, এখনো বুঝিনা। পড়ে থাকলে দোষ নেই, আর দেখালেই দোষ?

এই তুমুল উৎসাহ কিন্ত আইসক্রিম ফ্যাক্টরিটা পেরোলেই কমে গিয়ে কেমন যেন পেট টা ব্যাথা ব্যাথা করে করে। স্কুলটা ভালো, কিন্তু ভালো না। ওখানে অপু নেই, বনি নেই, মিসেস মার্গারেট, যে কিনা ঐ কালো ফিলিপ বলে লোকটার বউ আর তাকে সবাই বলে হেড মিস্ট্রেস, সে ফর্সা হলেও হাসিখুশী মোটেই নয়। ও মর‍্যাল সায়েন্স পড়ায়, তার মানে যীশু আর তার মায়ের গল্প। আমার মায়ের নাম তো বানী, সবাই বলে বানী কাকীমা। তাহলে মেরীকে কেন মেরী কাকিমা বলে না? একদিন মিসেস মার্গারেট ক্লাসে যীশুকে নিয়ে কি একটা বোঝাচ্ছিল, তখন সামনে একটা কাপড়ের ওপরে আঁকা সুন্দর সিনারি ঝুলিয়ে রেখেছিল আমি ওটা দেখেই উদবুদ্ধ হয়ে গুন গুন করে হের গগন ভরি জাগে সুন্দর টা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম, ওমনি আমাকে স্ট্যান্ড আপ অন দ্য বেঞ্চ করে দিল, আর সুতপা মন্ডল, যে কিনা রোজ নাক খুঁটে খায়, সেও পাশে বসে খুক খুক করে হাসতে থাকলো।

পরের দিনও খুব কান্না পেলো, কেঁদেই ফেললাম। মিস প্রথমে খানিক সান্তনা দিল, তারপর নিজের টিফিন বক্স থেকে একটা কেঁচোর মতো জিনিস দিল আমাকে সেটা বেশ ঝাল ঝাল, খেয়ে মনটা আর তেমন খারাপ রইল না।  তারপরের দিন যখন কাঁদলাম, সেদিন অন্য মিস, পাত্তাই দিল না।

এই স্কুলে এই ক্লাসে আমি নতুন হলেও বাকি সবাই কিন্তু পুরনো। আমি জুন মাসে ভর্তি হয়েছি, আর এরা সবাই জানুয়ারীতে। তাই এরা কেউ কান্নাকাটি করে না, এদের মন খারাপ হয়না তেমন। আমিও আসতে আসতে দেখলাম কেঁদে তেমন কিছু হচ্ছে না, উল্টে কেমন যেন লজ্জা লাগছে। তাই কাঁদাটা বন্ধ করে দিলাম। বন্ধু বানানো শুরু হল।

উনুনের যেমন শিক আছে, তেমনি আমার ক্লোস ফ্রেন্ডও একটা আছে স্কুলে, ইন্দার - ওরা শিখ। ইন্দারজীৎ পাটকা বাঁধে না, তাই ওকে বাঁধাকপি বলা যায় না, ওদের বাড়ী গুরুদুয়ারা রোডে, আইসক্রিম কারখানার পাশেই। মাথার দুপাশে বিনুনি করে তারপরে সেটা কেমন করে যেন মাথার ওপর দিয়ে ক্রিস ক্রস করে ক্লিপ দিয়ে বেঁধে রাখে।  ইন্দারজিৎ আইসক্রিম খায়, কিন্তু আমি খাইনা। আমাকে মা দেখিয়েছে, কারখানার পাশেই বিরাট ড্রেন। ওরা ওই ড্রেনের জল দিয়েই আইসক্রিম বানায়। তাই আমি আইসক্রিম খাইনা। আমি পাঞ্জাবে বেড়াতে গেলে ওদের বাড়ীতে থাকতে দেবে বলেছে।

ভারতী সাহার বাবা ডাক্তার, সবসময়ে সাদা প্যান্ট আর শার্ট পরে, তাই দেমাক খুব। মেয়ের দেমাক আরো বেশী। হবেও না কেন, মান্থলি টেস্টে ফার্স্ট হয় তো। ওর মুখটাও একটু বেঁকা, আর আমি সেদিন যখন স্ট্যান্ড আপ অন দ্য বেঞ্চ হয়েছিলাম, তখন মুখটা একটু বেশী বেঁকাচ্ছিল, সেটা ইচ্ছে করে। আকবর ভাবছিলাম অ্যাসেম্বলিতে দেবো পেছনে এক লাথি, কিন্তু ওর বাবা যদি লম্বা সূঁচ দিয়ে আমাকে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দেয়, তাহলে খুব বাজে হবে, তাই করিনি, ক্ষমা করে দিলাম। অ্যানুয়্যালির রেসাল্ট বেরোক, তখন দেখব মুখটা আজীবন ওরকম বেঁকে যায় কিনা। বরং নীলম পান্ডে অনেক ভালো। ফর্সা, কটা চোখ, মেমসাহেবদের মতো, চূলগুলোও সোনালী। বাংলা বলতে পারে না তেমন, আর গায়ে একটু আচার আচার গন্ধ সবসময়ে, কিন্তু আমি তো আর ওর গায়ে পড়তে যাচ্ছি না, আর ওই রুটি আর আচারের টিফিনও খেতে যাচ্ছি না, তাই ওকে ভালো বন্ধু বলতে আমার অসুবিধে নেই। সুতপা মন্ডল আমার থেকেও একটু লম্বা। ও নাক খুঁটে খায় ঠিকই, কিন্তু মাঝে মাঝেই পেন্সিল হাফ হয়ে গেলেই আমাকে দিয়ে দেয়, আর তার থেকেও ভালো, একটুও ইংরেজি বলে না। ও রাবারকে রবাট বলে। সেদিন সুজির হালুয়া অফার করেছিল, আমি একটু নিয়েছি, চামচ দিয়ে।  সবথেকে বোকা বোকা হল যে মেয়েটা, তার নাম এ নান্দিনি। ভালো করে ইংরেজি বলতে পারে না, আবার হিন্দি আর বাংলা বলার শখ। সঙ্গে আরেকটা নেকি আছে, তার নাম সুভাষিণী। সেদিন ইন্দার বলেছে হাম তো গোলচক্কর মে চক্কর কাট রাহা থা, ফির সব কুছ ঘুমনে লাগা আর সুভাষিণী অবাক মুখে জানতে চাইছে চক্কর ওয়ানদে? আমরা সবাই মজা নিচ্ছিলাম, পাকা নান্দিনি মাথার ওপরে হাত ঘুরিয়ে বলল চক্কর ওয়ানদে ঘুররররর। ধ্যুত, পুরো মজাটাই মাটি।

অম্বরীশটা এমনিতে ভালোই, কিন্তু দোলনায় ওঠার সময়ে ঠিক আমাকে ঠেলে আগে গিয়ে উঠে পড়বে। একদিন ল্য্যং মেরেছিলাম বলে ওর দাদাটা ক্লাস টু থেকে এসে আমার কান মুলে দিল টিফিন টাইমে। খুব বেইজ্জতি হল সেদিন। অবশ্য এখন ক্ষমা করে দিয়েছি, কারন পরের দিন স্কুলে ঢুকেই অম্বরীশ বলল সরি, তারপরে একটা এক্লেয়ারস দিল। রিকোয়েস্ট করলো, তাই মার্গারেট মিসকে বলিনি। পরমজীৎ টাও মন্দ নয়, তবে লাস্ট ইয়ার থেকে এই ক্লাসেই আছে বলে মিস রা ওকে একটু হ্যাটা করে। সেদিন ম্যাথিউ মিস বলল নার্সারিতে কাউকে ফেল করতে এই প্রথম কাউকে দেখছে। ও ব্যাটা তখনো হাসছে, আমার একটু মন খারাপ হয়ে গেলো আহা, সবার তো আরে বুদ্ধি সমান হয়না? করুক না ফেল, কিন্তু ও কেমন টেবিল বাজাতে পারে, আর কেউ পারবে? টি মুরলিটাও ভালো, কিন্তু মুশকিল হল, কিরকম করে একটা ইংরেজি বলে যেন, কথা বললেই মনে হয় কেউ ওভাল্টিনের কৌটোর ভেতরে নুড়ি পাথর ভোরে নাড়াচ্ছে, ওর সঙ্গে বেশী বন্ধুত্ব করা মানে খুব পরিশ্রম। মানিশ আছে, ভালো ছেলে, শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট, তাই ওর সঙ্গে আমার বেশ ভাব। আরেকটা একটা ছেলে আছে, লিয়াকৎ, সে বেটা কারুর সঙ্গে কথা বলে না, মিস কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলে না। মাথামোটা বোধহয়। খালিই মার খায় আর বকা খায়। আবার বকলে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর স্কেল দিয়ে মারলে মুখ দিয়ে শুধু ইশ ইশ করে শব্ধ করে, কিন্তু একটুও কাঁদে না। মাঝে কদিন আসেনি, তারপর যখন এলো, মিস কি একটা জিজ্ঞেস করলো খুব নরম গলায়, আর ও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো, দু চোখে জল। এই প্রথম দেখলাম মিস একটুও বকছে না, শুধু বলছে সিট ডাউন বেটা, এভরিথিং উইল বি ফাইন। পাশের ডেস্ক থেকে সুতপা ফিস ফিস করে বলল কেন কাঁদছে জানিস? ও মা মরে গেছে, তাই

সেদিন বাড়ী ফিরে রাত্রে যখন শুয়েছি আর লাইট নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে, মা কে জড়িয়ে ধরে চুপি চুপি একটু কেঁদে নিলাম। মা বুঝতে পারেনি।

(চলবে)