Saturday, January 18, 2014

কামাখ্যায় ক্যারামতি

কামাখ্যায় ক্যারামতি
১৯৯৬ এ আমি যে কোম্পানি তে চাকরি করতাম, তার পোষাকী নাম অন্য হলেও হরিবাবু কা দুকান নামেই তা বেশি পরিচিত কলকাতার মাড়োয়াড়ী গুজরাটি ব্যবসায়ী মহলে। তা সে ওনাদের কি দোষ? হরি দার পুরো নাম বালাসুব্রামানিয়াম হরি, আমরা দাদাই বলতাম, উনি শিবপুরের ইলেক্ট্রিক্যাল, আমার দেখা সেরা মানুষদের মধ্যে একজন। কিন্তু তাঁর অন্তপ্রেনেউরিয়াল মাইন্ড নিয়ে কলকাতার ব্যবসায়ী মহল সেই সময়ে তেমন উদ্বেলিত ছিল না। কম্পিউটার মা বিজনেস ছে, অতএব দুকান তো ছে বটেই। তাই মাঝে মাঝেই ফোন আসতো ইয়ে হারিবাবুকা দুকান হ্যায় না?

সেই দোকানে আমি সিনিয়র প্রোগ্রামার হয়ে ঢুকেছিলাম, ক্রমে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট আর কন্সাল্টিং পদে উন্নতি হয়েছে। একবার গেটওয়ে নাইন্টি ফাইভ বলে একটা শো হল, ১৯৯৫ এ। সেখানে জন্যে অনেক খেটে একটা ব্রোশিওর তৈরি করা হল, তার সামনের পাতায় সুদীপ সেন এক খানা ফাটাফাটি বাস্কেটবল নেট করার ওয়াটারকালার ছবি এঁকে দিল, নিচে লেখা হল  স্ট্রেচ। দুর্ধর্ষ মেসেজ, দারুণ লেখা, কেউ পড়লেই ফটাফট আমাদের সফটওয়্যার কিনে ফেলার কথা। কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ছাপা হচ্ছিল, হরিদা বললেন কালো অপয়া রঙ, আমরা বরং ওটা ডার্ক ব্রাউনে ছাপাই, তাই হল, দেখলাম মন্দ লাগছে না। আমরা সবাই সেখানের স্টলে কম্পিউটার সাজিয়ে বসলাম, কিন্তু আমাদের অতি প্রিয় অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার সেখানে এক কপিও যে বিক্রি হল না, তার থেকে বড় দুঃখ, বেশ কয়েকজন এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন ও স্টেরচ কিত্নে কা হ্যায়? হরি দার তাতে বিকার নেই, জ্যোতিবাবু উদবোধন করতে এসেছিলেন, হরিদা তাতেই খুশি, ইউরিন্যালে আমার পাশে দাঁড়িয়ে চাপ ত্যাগ করতে করতে বললেন স্কিন টা দেখেছ? পিওর স্কচ ছাড়া ওটা হয়না!

তা এমন নির্বিকার মানুষের ও কয়েকটা দুর্বলতা ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক। হরি দার ফ্যামিলি কলকাতায় আছে ওনার বাবার সময় থেকেই, কিন্তু কিছু শুদ্ধ তামিল বিশেষত্ব বংশগত কারনেই বোধহয় ওনার মধ্যে রয়ে গেছে। উনি এইচ কে হেচ বলেন ইউরোপীয়দের মতো, বাংলায় বোতাম বলতে গিয়ে বোতুম বলেন, অন্য তামিলিয়দের মতোই ভীষণ ধর্মভীরু এবং তামিলনাড়ুর সাথে যুক্ত সবকিছুর ওপরেই অগাধ ভালবাসা। ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের হেডকোয়ার্টার চেন্নাই তে, অন্যান্য জায়গাতেও মুলতঃ তামিলরাই মুখ্য আধিকারিকের পদে আসীন, তাই এই ব্যাঙ্কের ওপরে হরিদার অগাধ আস্থা। সেই ব্যাঙ্কের একবার একটা কাজ এলো।

কাজটা সামান্য। ব্যাঙ্কে তখন কম্পিউটার ঢুকছে হুড়হুড়িয়ে, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কও সে দলে ভিড়েছে। গুয়াহাটিতে ওঁদের আঞ্চলিক শাখা, সেখানেও এইচ সি এল পারসোন্যাল কম্পিউটার বেচেছে। যে যাবে, তার কাজ হল রিজিওন্যাল ম্যানেজার ও অন্যান্য আধিকারিকদের একটা প্রেজেন্টেশান দেওয়া দৈনিক ব্যাঙ্কিং জীবনে মাইক্রোসফট অফিসের প্রয়োজনীয়তা এর ওপরে। একটু বাতেল্লা দিতে হবে, আর একটু অফিস আর এক্সেল শিখিয়ে দিতে হবে, এক দিনের মামলা।

তখন আমার বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক, কিন্তু ছুটির অভাবে হানিমুন টা করা হয়ে ওঠেনি। আমার বউ ও মোটামুটি মেনে নিয়েছে যে ওটা পরের জন্মে হলেও হতে পারে, এই জন্মে ওটার কোন চান্স নেই। কিন্তু হঠাৎই একটা সুযোগ পেলাম। হরিদা একদিন আমাকে ডেকে বলল বিজিৎ বোস, তুমি ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের কাজটা করে এসো। এ কাজ যে কোনো কচি ছেলেও করতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার ব্যাঙ্ক, তাই একটু সিনিয়ার লোক না পাঠালে কেমন দেখায় না? হরিদা আমার পদবী ধরে ডেকেছে মানে মুডও খুব ভালো। আমি দেখলাম, এই সুযোগ, বললাম যেতে পারি, কিন্তু তার আগে তিন দিন ছুটি দিতে হবে। অন্য কোনো সময়ে এক কথায় যেটা নাকচ হয়ে যায়, সেটাও এবারে পাস হয়ে গেলো, আমিও ঝপ করে তিন দিন বৌকে নিয়ে দীঘা ঘুরে চলে এলাম, সেই প্রথমবার হানিমুন না হলেও, স্যাকারিন মুন তো বলাই যায়। আর দীঘা থেকে ফিরেই আমি আবার স্যুটকেস গুছিয়ে ফেললাম। গুয়াহাটি।

বাড়ির ছেলে জীবনে প্রথম প্লেনে চাপবে। খবরের কাগজের ক্লাসিফায়েডে বিজ্ঞাপন ছাপানোর মতো ব্যাপার না হলেও বেশ বড়সড় ব্যাপার একটা। যদিও সকাল পৌনে দশটায় ফ্লাইট, বাবা আগের দিন হাফ কিলোমিটার দুরের এক আধচেনা ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ী গিয়ে তাকে দাওয়াত দিয়ে এলো, পাছে ট্যাক্সি পেতে অসুবিধে হয়। তিনি বললেন কুড়ি টাকা বেশি, আমরা তাতেই রাজী। বউ পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে কিছু ক্যালপল, ডিস্প্রিন, মেট্রোজীল আর দু পিস অ্যাভোমিন কিনে আনলো। বোন ঈর্ষাভরা চোখে তাকাতে লাগলো আর বলতে লাগলো অ্যাটলিস্ট কিছু একটা গিফট আনিস আমার জন্যে। মা বলল দেখিস বাবা, উল্টোপালটা কিছু খাস না যেন!

আটই আগস্ট, ছটার সময়েই ঘুম ভেঙ্গে গেছে, সাড়ে সাতটায় বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আমি প্লেনে চাপবো, কেউ সী অফ করবে না, তা কি করে হয়? তাই সঙ্গে বাবা, বৌ আর বোন। কুড়ি টাকা করে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকল বাকি সবাই, আমি খুব কায়দা করে আমার টিকিটটা  সি আই এস এফ কে দেখালাম, সে আড়চোখে দেখে বলল যাও যাও! কিন্তু ভেতরে ঢুকেই একটু কেলো হল, প্লেন নাকি কোথা থেকে আসবে, সে এসে পৌঁছয়নি, তাই ফ্লাইট ডিলেড। ভালই হল, বেশ অনেক্ষন সবাই এয়ারপোর্টে ঘুরে বেড়ালাম, এগারো টাকা করে সিঙ্গাড়া খেলাম, তারপর ডিসপ্লেতে আমার ফ্লাইটের পাশে চেক ইন দেখাতেই আমি সবাইকে টাটা করে ঢুকে পড়লাম সিকিয়োর্ড এরিয়া তে।

কাউন্টারে মাসিমা, তিনি বললেন সুটকেস বড়, তাই ক্যাবিন লাগেজে না নিয়ে ব্যাগেজে দেওয়া ভালো, নাহলে পরে আটকে দিতে পারে। পরে জেনেছি ওটা ডাহা মিছে কথা, কারন ওই একই স্যুটকেস আমি পরে অন্ততঃ একশো বার ক্যাবিন লাগেজে নিয়ে গেছি। কিন্তু সে তো তখন জানিনা, তাই আবার এক্সরে মেশিনের ওখান থেকে ঘুরে আসতে হল, ওরা একটা সাদা মোটা প্লাস্টিকের ফিতে লাগিয়ে সীল করে দিলো, হ্যান্ডেলে একটা ট্যাগ ঝুলিয়ে দিল, আমি সেটাতে তৎক্ষণাৎ নাম ঠিকানা লিখে ব্যাগেজে চালান করে দিলাম। আকাশী বোর্ডিং পাস পকেটে নিয়ে মাসীমা কে থ্যাঙ্ক ইয়ু জানিয়ে আমি আবার ঘুর ঘুর করতে লাগলাম একটু কফি খেলাম, একটা সিগারেট, তারপর বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা দেশ, একটা টাইমস জার্নাল আর বউকে কদিন ছেড়ে থাকার দুঃখ ভুলতে একটা ডেবোনেয়ার কিনে ফেললাম। একটু পরেই অ্যানাউন্স হল আই সি ২২৯, সিকিওরিটি চেক ইজ অন, প্লিস রিপোর্ট টু গেট নাম্বার ওয়ান আমি হন্ত দন্ত হয়ে সেদিকে ছুট দিলাম।

ওপাশে একজন জলপাই ড্রেস পরা বিহারী পুরুষ পর্দাওয়ালা খোপে ঢুকিয়ে যন্ত্রপাতি টিপেটুপে দেখে নিলেন, আর তার পরে এক মহিলা ব্যাগ চেক করতে গিয়ে ম্যাগাজিনের নামটা দেখে চট করে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন। পুরো ঢুকল না, আধখানা বেরিয়ে রইল। আমি নির্বিবাদে সেসব অত্যাচার সহ্য করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে একটা সোফায় বসবো বসবো করছি, এমন সময়ে একজন সাদা শার্ট নেভী ব্লু প্যাট পরা নিপাট বাঙালী ভদ্রলোক আমার পথ রোধ করে বললেন স্যার, প্লিজ চেক ইওর ব্যাগেজ - তাঁর ডান হাত টা একটা খোলা দরজার দিকে বাড়ানো। দরজা দিয়ে বেরোলাম, এটা একদম বাইরে, খোলা যায়গা। সেখানে অসংখ্য স্যুটকেস রাখা আছে, আরো কিছু রাখা হচ্ছে। একটু খুঁজতেই আমার স্যুটকেসটা পেয়ে গেলাম। ভালো করে দেখে নিলাম, ওটা আমারটাই কিনা হ্যাঁ, এই তো, আমার নাম টাও লেখা আছে ট্যাগে। হৃষ্ট চিত্তে ফেরত এলাম। ভদ্রলোক আবার জানতে চাইলেন আমি ব্যাগেজ আইডেন্টিফাই করেছি কিনা, আমি একটা স্মিত সবজান্তা হাসি দিয়ে বললাম ইয়েস প্লিস!

একটু পরে ফ্লাইট নাম্বারের পাশে বোর্ডিং লেখা পড়লো আর দুটো কমলা লাইট ঘুরতে লাগলো, আর ওমনি একটা হই হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। সবাই হুড়মুড় করে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঠেলাঠেলি হতে লাগলো, কেউ কারুর পা পাড়িয়ে দিল, বাচ্চারা ক্যাবলামির জন্য বকা খেলো, সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, পেছনের ভদ্রলোক টেরিয়ে টেরিয়ে আমার  ম্যাগাজিন গুলো দেখার চেষ্টা করছিলেন, ট্রেনের স্বভাব বোধহয়, আমি একটু গার্ড করে দাঁড়ালাম। বাস চলে এলো একটু পরে, পর পর দুটো, বাস ছাড়ার ঠিক আগে এক ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন তাঁর দিল্লী টিকিট আর এটা গুয়াহাটির ফ্লাইটে তুলবে, তাই হন্তদন্ত হয়ে নামতে গিয়ে বকা খেলেন অ্যাটেন্ড্যান্টের কাছে। শেষ অবধি দরজায় শেকল লাগিয়ে অ্যাটেন্ড্যান্ট বাসের গায়ে দুবার চাপড় মারলো ঠিক ফরটিওয়ান বির কন্ডাক্টারের মতো, আর ওমনি বাস ছেড়ে দিলো। 

প্লেনের সামনে বাস থেকে নেমে দেখি ওখানেও লাইন। মস্ত প্লেন, বোয়িং নয়, এয়ারবাস এ ৩০০। সিড়ির সামনে আরেকবার টিকিট আর বোর্ডিং পাস দেখা হল। তারপর উঠে সীট খুঁজে বসে পড়লাম। বড় প্লেন, তাই ২ বাই ৩ বাই ২ সিটিং, আজকের দিশি ফ্লাইটে খুব একটা দেখা যায়না।  জানালা পাইনি, কারন চাইতে ভুলে গেছলাম। পাশের ভদ্রলোক কে অনুরোধ করলাম, রাজী হলেন না। বাঙ্কের ওপর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে, আসলে ওটা অক্সিজেন। দেখলাম একটা করে লাইট আছে ওপরে, পাশে ছোট্ট ফ্যান একটা, আর ওপাশে একটা বোতাম, এয়ারহোস্টেসকে ডাকার। গরম লাগছিল একটু, ফ্যানটা বাড়িয়ে দিলাম পুরো। একজন এয়ার হোস্টেস এসে হাসি মুখ করে আমার কোল থেকে ব্যাগটা নিয়ে বাঙ্কে তুলে দিল, আমার দেখে মনে হল এটা ছোটমাসী বা দিদি হতে পারে, সো কল্ড মাসীমা নয় মোটেই, তাই রাগ করলাম না।

দেখছি, লোকজন উঠছে, কেউ নিজেই সীট খুঁজে নিচ্ছে, কেউ বা আবার এয়ার হোস্টেস কে জিগ্যেস করছে। একজন মুসলিম ভদ্রলোক উঠলেন, দাড়ি আছে, মেহেন্দি দিয়ে রাঙ্গানো, গোঁফ নেই। মানুষের যদি দাড়ি ছাড়া গোঁফ থাকতে পারে, তাহলে উল্টোটা হলেও ক্ষতি কি, এমন ভাবাই যেতে পারে, কিন্তু কেন জানিনা ওটা দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় দ য়ে - দোয়াত আছে, কালি নাই, তাই খালিই চোখ চলে যায় ওদিকে। ভদ্রলোক বয়স্ক, মাথায় কুরুশের কাজ করা সাদা তাকিয়া টুপি, চোখে লালচে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে কলার দেওয়া কামিজ, ঘিয়ে রঙের, নিচে ঘিয়ে সালোয়ার। চোখের ছানি অপারেশন হয়ে গেছে, তাই খুব মোটা কাঁচ। একটু হাঁপাচ্ছেন দেখলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠেছেন বলেই বোধ হয়। আমার আগের রো তে বসলেন, মাঝের তিনটে সিটের একটাতে। এক ভদ্রমহিলা একখানা ধুতি বাঁধা পোঁটলা কোলে নিয়ে বসেছিলেন, এয়ারহোস্টেস ধমক দিয়ে সেটা কেড়ে নিয়ে বাঙ্কে রেখে দিল। একজন লম্বা ভদ্রলোক, বোধহয় বোডো, পাশ দিয়ে চলে গেলেন জিন্স আর বুক খোলা সাদা শার্ট পরে, ঘাম আর পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে, আড়চোখে দেখলাম ভদ্রলোকের মস্ত নখ দুই হাতেই। সাফারি স্যুট পরিহিত একজন মাড়োয়াড়ি ব্যাবসাদার সিটে বসেই এমন মন দিয়ে বিজনেস টাইমস পড়তে শুরু করলেন যে মনে হল উনি ওটা পড়তে পাবেন বলেই প্লেনের টিকিট কেটে গুয়াহাটি যাচ্ছেন। কয়েকজন সামনের পকেট থেকে বই তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরলো। একজন বমি করার ঠোঙ্গা টাও। লজেন্স এলো, খামচা খামচি শুরু হল।

এইসবই দেখছিলাম, এমন সময়ে এক সিনিয়র মাসিমা কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন আমার সিটের কাছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে ২৮ বি, হু ইস বিজিট বোস? বলে হুঙ্কার দিলেন। আমি সেই স্কুলের মতো হাত তুলে ফেললাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে এক ধমক হোয়াই হ্যাভেন্ট ইউ আইডেন্টিফায়েড ইউর ব্যাগেজ? আমি মিনমিন করে বললাম বাট আই ডিড্‌? কিন্তু সে তেমন ধোপে টিকলো না। কড়া ধমকে আমাকে চমকে চলে গেলেন তিনি, হাতে স্যুটকেসের ট্যাগ টা, অল্প ছিঁড়ে দিলেন কোনাটা। আচ্ছা বলুন তো, আইডেন্টিফাই মানে ট্যাগের কোনা ছেঁড়া, সেটা আমি কি করে জানবো?

প্লেন ট্যাক্সিইং করে রানওয়ের দিকে যাচ্ছে, এয়ারহোস্টেসরা হাত পা নেড়ে রোবটের মতো দেখাচ্ছেন বেল্ট কেমন করে পরতে হয়, আর প্লেনে আগুন লাগলে কোন দিক দিয়ে পালাতে হবে, একটা হই হট্টগোলে সেসব বন্ধ হয়ে গেলো। দেখলাম সেই বয়স্ক মুসলিম ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে গেছেন, চোখের পাতা উল্টে আছে, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। প্লেন দাঁড়িয়ে গেলো। একজন ডাক্তার ছিলেন যাত্রীদের মধ্যে, একজন গলা তুলে এনি ডক্টর হিয়ার? বলে চেঁচাতেই তিনি উঠে এলেন সিট ছেড়ে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাট্যাক! উনি একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে বললেন এক্ষুনি প্লেন থেকে নামালে সারভাইভ করতেও পারেন। এ টি সি তে খবর গেলো, একটু পরে সিঁড়িওয়ালা গাড়ী আর অ্যাম্বুল্যান্স চলে এলো, পেছনের দরজা খুলে নামানো হল ওনাকে, কিন্তু দরজা বন্ধ করে ফেরত আসার সময় দুজন এয়ারহোস্টেস বলাবলি করতে করতে গেলেন এক্সপায়ার্ড!

প্লেন আবার আসতে আসতে চলল রানওয়ের দিকে। মনটা এতো খারাপ হয়ে রইল, যে প্রথম ওড়ার উত্তেজনা টাই তখন মন্দাক্রান্ত। খানিক্ষন রানওয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পরে ঘোষণা হল অল হ্যান্ডস অন কন্ট্রোল, টাইম টু টেক অফ! আমার শরীরটা সীটের সঙ্গে সাঁটিয়ে দিয়ে প্লেন আটশো কিলোমিটার স্পিড তুলে কোন ফাঁকে আকাশে উঠে পড়লো, প্রথমে একদিকে হেলে একটুক্ষন উড়লো, তারপর সোজা উইন্ডো সিটের ভদ্রলোকের কানের পাশ দিয়ে দেখলাম, নিচের বাড়ী ঘর দোর সব পুতুলের মতো লাগছে, কিন্তু গাড়ী চলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, আর অনেক অনেক রুপোলি দাগ ওগুলো আসলে টিনের চাল। কলকাতা ছাড়িয়ে মেঘের ওপরে উঠে সীট বেল্ট বাঁধার সিগন্যাল যখন নিভিয়ে দেয়া হল, খেয়াল করলাম আমার মুখটা নিজের অজান্তেই কখন যেন হাসি হাসি হয়ে গেছলো, তখনো তাই হয়ে আছে।

এবারে মনে হল অনেকেই শুধু বাথরুমে যাওয়ার জন্যেই প্লেনে উঠেছেন পেছনের দুটো দরজার সামনে লাইন পড়ে গেলো, দু একজন ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে দরজাতে নক করেও ফেললেন। কারন টা বুঝলাম একটু পরে। খাবার এলো। লোকজন ওমনি লাফ দিয়ে পড়লো। সবাই সবকিছু খায়, এই প্রথম দেখলাম। আমিও নিলাম খাবার। খুব একটা সুস্বাদু তা নয়, কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেলের ছাপ মারা, তাই পেট ভরে খেয়ে ফেললাম, শেষে কফিটাও। জানালা দিয়ে একটা মস্ত নদী দেখা যাচ্ছিল, পদ্মা হবে বোধহয়, কিন্তু হাল্কা মেঘ আর কুয়াশা, তাই খুব পরিস্কার নয়। একটু পরেই প্লেন ল্যান্ড করলো।

গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট কলকাতার তুলনায় অনেক ছোট, করোগেটেড শীট দিয়ে বানানো একতলা বাড়ী একটা। এ সি নেই, বড় ফ্যান ঘুরছে শুধু। ব্যাগেজ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম, স্যুটকেসটা কনভেয়ারে চেপে চলে এলো একটু পরেই, আমি সেটা তুলে রওনা দিলাম বাইরে। খুব শান্ত নিশ্চুপ লাগছিল প্রথমে, তারপরে গাড়ির দরদাম করতে গিয়ে বুঝলাম কানে তালা লেগেছে। শীলপুখুরী যাব, অটোতেই যাওয়া যেত, আমি একটা মারুতি ভ্যান ভাড়া করলাম। এয়ারপোর্ট টা শহরের পশ্চিমে, বেশ খানিকটা দুরে। রাস্তা চকচকে, এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে একটা ঝিল পড়লো। বর্ষাকাল হলেও বেশ গুমোট - বোরিপাড়া, ইউনিভার্সিটি, জালুকবারি, রেলওয়ে স্টেশান, গুয়াহাটি ক্লাব, দীঘালি পুখুরি এসব পেরিয়ে শীলপুখুরি পৌঁছলাম।

রাস্তার ওপাশে একটা বেশ বড় গোলাকৃতি পুকুর, সেটাই শীল পুখুরি, আর এপারে একটা গলিতে একটা অফিস বাড়ির দোতালায় ব্যাঙ্কের অফিস। ঢুকে পরিচয় দেওয়া মাত্র একজন কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক এক গাল হেসে আমাকে আপ্যায়ন করলেন, জানালেন তাঁর নাম নাগাভুষনম। সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। দেখলাম সব্বাই ওনাকে নাগু বলে ডাকছে। ম্যানেজার মেঘালয়ের বাঙালী, নাম অমিত দেববর্মণ। কথা বার্তা হল খানিক, ওনার সাথেও। ফাইন্যালি, কম্পিউটার টা দেখতে গেলাম অফিসের মধ্যেই এক কোনায় একটা ছোট ক্যাবিন বানানো হয়েছে কাঁচের, তার ভেতরে এ সি লাগানো ভোল্টাসের, সেখানেই তিনি বিরাজ করছেন। এইচ সি এল এর Busy Bee। অন করে দেখা গেলো উইন্ডোস ইন্সটল্ড আছে, কিন্তু অফিস নেই। যেটা আছে, সেটা হল অসংখ্য গেমস। জানা গেলো, ওগুলো ওখানের সমস্ত কর্মচারী নিজেদের মতো নিয়ে এসেছেন। সময় খরচা না করে কম্পিউটার বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম, কারন পেছনে তখন চিড়িয়াখানার মতো ভিড় লেগে গেছে।

বাড়িতে খবর দেওয়ার জন্যে পাড়ার নার্সিং সেন্টারে ফোন করে বলে দিলাম। তখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে, অফিস টাইম পেরয়নি বটে, কিন্তু ক্লান্ত লাগছে খুব, নাগু কে বললাম হোটেলে ঢুকতে চাই এবারে, কাজকর্ম পরের দিন সকালে করবো, যেমন প্ল্যান ছিল। নাগু অতিশয় ভদ্রলোক, সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হোটেলের দিকে। একখানা অটো নিয়ে ওখান থেকে আবার পশ্চিমদিকে চললাম, যে রাস্তায় এসেছি, সেদিকেই। দীঘালি পুখুরি পেরনোর পরে একটা ট্যারচা মতো চৌমাথা, সেখান থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে একটু এগোতেই রাস্তাটা খুব ঘিঞ্জি হয়ে গেলো। থামলাম একটা গুরুদ্বারের সামনে। উলটো দিকের বাড়িটাই হোটেল, নাম হোটেল নোভা। খুব পুরনো হোটেল, কিন্তু চলনসই। ম্যানেজার ভদ্রলোক তেলেগু। তিন তলায় একটা ঘর পেলাম, সস্তায়, চলে যাবে, ঢুকে পড়লাম। সন্ধেয় রুটি তড়কা, তারপর ডেবোনেয়ার, তারপর? ঘুম।

পরের দিন সকাল সকাল অফিসে পৌঁছে কাজ শুরু। অফিস ইন্সটলেশন খুব একটা চাপের ব্যাপার কখনই নয়, তখনো ছিলোনা, আমি তাই তৎক্ষণাৎ তাতে লেগে পড়লাম। এর পরেই বিপত্তি! ৫ নম্বর ফ্লপি থেকে আর রিড করছে না! বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরে একবার হঠাৎ করে বলল উইন্ডোসের দু নম্বর ডিস্ক টা ঢোকাতে। ঢোকালাম। কিছুই হল না। মিনিট দশেক যাওয়ার পরে বিশ্বরূপ দর্শন বিজি বী বন্ধ হয়ে গেলেন। যতবার অন করি, উনি একটু চেষ্টা করেই ক্ষান্ত দেন, স্ক্রিনে লেখা নো মাস্টার বুট রেকর্ড। মনে পড়লো গেম গুলোর কথা ভাইরাস! সর্বনাশ! এবারে কি করি? নাগুকে খবর দিলাম। নাগু যেন একটু বেশীই ভেঙ্গে পড়লো। এইচ সি এল কে খবর দেওয়া হল। যিনি এলেন, তিনিও বাঙালী, নাম শৌভিক সাহা। তিনি বিধান দিলেন, ভাইরাসের দায়িত্ব ওঁদের নয়। তা তো বুঝলাম, এখন উইন্ডোজ আর অফিস পাই কোথায়? শৌভিক ভেবে নিয়ে বললেন, তিনসুকিয়াতে এক খানা কপি থাকতে পারে। আমি প্রচন্ড রেগে বললাম, আপনি আসুন এবারে। উনি বললেন, আপনি রেগে গেলে আমি কি করবো, এটা নর্থ ইস্ট, এখানে এক বাক্স এক্সট্রা ফ্লপি কিনতে গেলে কলকাতায় যেতে হয়, আপনি কিনা সফটওয়্যার চাইছেন। বরং গুলি বন্দুক বলুন, সেসব এখানে অনেক সহজে পাওয়া যায়।

অফিসে ফোন করলাম। উপায় নেই, কুরিয়ারই ভরসা। অফিস জানালো দিন দুয়েক লাগবে কপি পাঠাতে। হতাশ হয়ে বসে আছি, নাগু দেখলাম প্রায় কেঁদে ফেলেছেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার, আপনি এত ভেঙ্গে পড়লেন কেন? নাগু জানালেন, উনি দু বছর এখানে আছেন, বউ কথা বলে না, ছেলে চিনতে পারে না, সব্বাই মাছ খায়, শ্বশুরমশাই একবার এসেছিলেন, তিনি লাঞ্চ টাইমে অফিসে এসে ব্যাপার স্যাপার দেখে প্রচুর বাওয়াল দিয়েছেন। কম্পিউটার চলতে শুরু করলেই ওনার ট্রান্সফার টা হয়ে যাবে, উনি শুদ্ধ তামিল মানুষ, এই বিদেশে পাগল হয়ে যাচ্ছেন।  ভেবেছিলেন আজকে হয়ে যাবে, কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো মনে হয়। আমি প্রবোধ দিলাম দুটো দিন ওয়েট করুন, হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ সন্ধ্যে হয়ে গেছলো, হোটেলে ফিরবো, নাগু বললেন চলুন, আমি সঙ্গে যাচ্ছি, একা যাওয়া ঠিক নয়। কারন টা বুঝলাম রাস্তায় এসে।

আটটা বাজে খুব জোর, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বারোটা। রাস্তা পুরো শুনশান, যেন কারফিউ। অনেকক্ষণ পরে পরে একটা করে মিনি বাস ঝড়ের বেগে চলে যাচ্ছে, একদম খালি, কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না। এটা সেই সময়ের কথা, যখন বোডো আন্দোলন তুঙ্গে। প্রায়ই বোমা ফাটে এখানে ওখানে। মানুষ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে প্রতি পদে। দিনের বেলাটা তাও চালিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু সন্ধের পরে এখনো সন্ত্রাসই রাজা। অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি, নটা বেজে গেছে, ঝড় দিচ্ছে সামান্য, লোডশেডিং হয়ে গেলো। নাগুর মুখ শুকিয়ে এত্তটুকু হয়ে গেছে। আমিও বুঝতে পারছিনা কি করবো। এক খানা আলো দেখে হাত দেখালাম। এক খানা জিপসি এসে দাঁড়ালো সামনে। পুলিশ না, মিলিটারি। ক্যা কর রাহে আপ ইতনি রাত গ্যায়ে? বললাম, আমি কলকাতার ছেলে, এখানে এসেছি একদিন হল, আজকে অফিসে একটু দেরি হয়ে গেছে। বহত গলতি কিয়া আপনে! আইয়ে মেরে সাথ! ভাবলাম অ্যারেস্ট হচ্ছি, বোধহয়। যাকগে, দেখা যাবে খন।  জিপে উঠতেই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কোথায় উঠেছি। বললাম নোভা, ফ্যান্সি বাজার। সেই কালো অন্ধকার ভয়ের রাতে ভগবানের দুতের মতো মিলিটারির গাড়ী আমাকে আর নাগু কে পৌছে দিল আমাদের আস্তানায় নাগু আগে নামলেন, পরে আমি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে সেই মিলিটারি অফিসার বললেন, ইয়ে নোভা সে আছছে হ্যায় ডাইন্যাস্টি, আপক উস্মে রহনা চাহিয়ে থা! বলে হা হা করে হেসে উঠলেন। আমার মুখেও হাসি ফেরত এলো। ভদ্রলোক কে আমি অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম, তারপর ভিজতে ভিজতে ঢুকে গেলায় নোভার ভেতরে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে তখন।

পরের দিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই প্রেজেন্টেশান টা সেরে ফেলার বন্দোবস্ত করলাম। কম্পিউটার নেই, তাই বাগদেবীই ভরসা। দু ঘন্টা জাস্ট বকে গেলাম। কি কি বকেছি জানিনা, কিন্তু ম্যানহাট্টান প্রজেক্ট থেকে শুরু করে অ্যাডা লাভলেস কাউকে বাদ দিইনি। শেষে দেখলাম সবাই ইম্প্রেসড। একজন মহিলা, না সীমা বর্গহাঁই, নাগুকে চুপি চুপি কিছু একটা বললেন, দৃষ্টি আমার দিকেই। আমি হাসিমুখে এগিয়ে যেতে নাগু বললেন সীমা আজকে আমাকে অসমীয়া খাবার খাওয়াতে চান, রেস্তোঁরায়। আমি এক কথায় রাজি, আরো কয়েকজন চল্লেন সঙ্গে। ভালো খাবার বেশ, মাছ মাংস সব একটু অন্যরকমের, সেষে আবার ওদের ভাষায় আসার, দারুন লাগলো। প্রচুর প্রশ্নের জবাব দিতে হল, তাতে অবশ্য আমার তেমন খারাপ লাগেনি, আমি তো বকবক করতে ভালই বাসি। খাওয়ার শেষে সীমা বললেন অভার? হেপি? আমি দারুন খুশি, বললাম থ্যাঙ্ক য়ু, গ্রেট ফুড! ভেরি হ্যাপি! উনি বললেন ইউ হেপি, আই এম হেপি। ইউ আর গ্রেট ভাইয়া! এখনো ভাবলে অবাক লাগে, কি এমন ভাষণ দিয়েছিলাম সেদিন যে এক নিপাট ঘরোয়া ভদ্রমহিলা আমাকে অতখানি আপন করে ফেলেছিলেন। যে কদিন ছিলাম, ইংরেজি-হিন্দি তেমন জোরালো নয়, তাই কথা বলতেন না বিশেষ, কিন্তু রোজ দেখা হলেই মিষ্টি হাসতেন, আর একটা করে টফি দিতেন। সেদিন দুপুরে ডি টি ডি সি তে ফোন করলাম, জানা গেলো, প্যাকেট পৌঁছতে আরো দু দিন, কারন পরের দিন রোববার। নাগু বললেন, কামাক্ষ্যা যাবে?

যাব না মানে? এনি টাইম! পরের দিনের প্ল্যান হল, সেদিন নাগুর সঙ্গেই একটু ব্রহ্মপুত্রের ধারে চিড়িয়াখানা, হাইকোর্ট এসব দেখে এলাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, নাগুদা হাজির। স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম ওর সঙ্গে। কামাক্ষ্যা এয়ারপোর্টের দিকেই, অর্থাৎ শহরের পশ্চিমে, কিন্তু অত দুরে নয়, শহরের মধ্যেই নীলাচল পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত একান্ন সতী পীঠের এক পীঠ, কামাক্ষ্যা। দেবীর জঙ্ঘা পড়েছিল এখানে। দেবী চীররজঃস্বলা, তাই পীঠের ভেতরে কোনো এক চোরাপথে বয়ে চলে অখন্ড বারিধারা। সারা দেশ থেকে মানুষ আসেন এখানে তীর্থ করতে। দুর্গা আমার ইটারন্যাল ইন্টারেস্ট, আমার মনের ভীষণ কাছের দেবী, তাই আমি খুশি মনেই যাচ্ছিলাম বেশ। হাই কোর্টের সামনে থেকে এক খানা মিনি বাসে উঠে কামাক্ষ্যায় নেমেছি। প্রচুর মানুষ, মন্দিরে ঢোকার লাইন চলে এসেছে রাস্তার ওপরে। নাগু আমাকে চমকে দিলেন আবার দু খানা একশো পঁচিশ টাকার টিকিট কেটে আনলেন। ভালই হল, অনেক আগেই ঢুকে গেলাম মূল মন্দিরে। ভেতরে অন্ধকার, নিচে নামতে হয় খানিকটা, তাই মাঝে মাঝে সিঁড়ি। ওপরে টিউবলাইট কোথাও, কোথাও বা বাল্ব লাগানো। পাথরের দেওয়ালে নানা রকম মূর্তি, অপ্সরা অপ্সরীদের। সুযোগসন্ধানী মানুষজন সেরকমই কিছু মূর্তির গায়ে আর পায়ে সিঁদুর লাগিয়ে পাসে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্রাম্য কোনো মানুষ দেখলেই বলছেন প্রনাম করো, ইয়ে বিল্বনাথ জী হ্যায়।  বিশ রুপিয়া দো! ইসকো ভি পরনাম করো, ইয়ে নাগামাণী দেভী হ্যায় আর না দিলেই অত্যাচার। ভীষণ রাগ হচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। অবশেষে দর্শন হল, পবিত্র বারি স্পর্শ করে বেরিয়ে এলাম আমরা। নাগু একটা অটোর সঙ্গে কথা বলে নিয়ে গেলে দক্ষিনেশ্বরীর মন্দিরে, একই পাহাড়ে, আরেকটু ওপরে। দারুন ভিউ পয়েন্ট সেটা, পুরো গুয়াহাটি শহর একদিকে, অন্যদিকে দিগন্ত অবধি চলে গেছে ব্রম্ভপুত্র, ওপারে তার সবুজই সবুজ, সেদিকে কাজিরাঙ্গা। মন ভরাট করে হোটেলে ফিরে এলাম খানিক বাদে। 

পরের দিন সকালেই প্যাকেট গুলো চলে এলো। আমিও ফটাফট সব কিছু ইন্সটল করে ফেললাম, তারপর একটা সেশান নিয়ে নিলাম, হাল্কা ট্রেনিং যাকে বলে। বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ, পরের দিন দুপুরে বাড়ী ফিরবো। নাগু প্রস্তাব দিল, আজকে সে আমাকে ডিনার করাতে চায়। নাগু শুদ্ধ শাকাহারী, আমার মোটেও ইচ্ছে নেই, তারপরে শুনেছি নিজেই রান্না করে, কেমন হবে, কে জানে? অনুরোধের পর অনুরোধ আসতে লাগলো, ভেবে দেখলাম নাগুর মেসবাড়ী আমার হোটেল থেকে কাছেই, না বললে খুব বাজে দেখাচ্ছে, তাই শেষে রাজি হয়ে গেলাম। অফিস শেষ, সীমাদিদি আর অন্যান্যদের বিদায় জানিয়ে সন্ধেয় নাগুর সঙ্গে গেলাম তার মেসবাড়ীতে। সিমেন্টের মেঝে, কিন্তু ফুট তিনেক অবধি বাঁধানো। তার ওপর থেকে চাঁচের দেয়াল, ছাদে টালি। দুখানা ঘর, তাতে মোট চারজন থাকেন। খুব অবাক লাগলো দেখে - রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের একজন অফিসার এরকম বাড়িতেও থাকতে পারেন? একটু পরেই আরো কয়েজন তামিলভাষী চলে এলেন, এনারা সবাই নিমন্ত্রিত কেউ ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক, কেউ সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক, কেউ ক্যানারা। গল্প চালু হল, একটু পরেই গল্পের ব্যাপারটা তামিলে শিফট করে গেলো, তবে মাঝে মাঝে একজন বলে উঠতে লাগলেন ইংলিশ, ইংলিশ সেটা আমার কথা ভেবে। আমার যে খুব উৎসাহ নিয়ে শুনতে ইচ্ছে করছিল, তা না, কারন তখন আমার হোম সিকনেস চালু হয়ে গেছে। তার ওপরে রাতের মেনু খিঁচুড়ি, সাম্বার, পায়াসাম আমার ঘোর আপত্তি এসব খাবার খেতে। কিন্তু কি আর করা, ভালবাসার খাবার, সে খেতেই হবে, আই ইট ভেরি লেস বলে অল্প করে হলেও খেতেই হল সে খাবার। মনের দুঃখ মনেই রেখে বিস্বাদ নুন ছাড়া খিচুড়িকে বলতে হল গুড ফূড।  ১১ টায় হোটেলে ফেরত গেলাম, একটু শেষ আশা ছিল তড়কা রূটি দিয়ে শুদ্ধিকরন করার, কিন্তু সেখানেও খাবার নেই কিছু আর।

পরের দিন সকালে কয়েকটা জিনিস কিনলাম, দোকান পাট খোলেনি বেশী, তাই পেলাম না কিছুই তেমন। প্লেনে ওঠার সময়েও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি, শুধু এবারে আর বাস ছিল না, হেঁটেই উঠতে হল প্লেনে। প্লেনের দরজার কাছে আটকে দিয়ে একটা মেটাল ডিটেক্টার দাঁড় করিয়ে একবার চেকিং হল, কিন্তু সে জবরদস্ত কিছু না। জানালার টিকিট এবারে মনে করে চেয়ে নিয়েছিলাম, তাই জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে চলে এলাম কলকাতা।


রাতে শুয়ে আছি, মনে পড়লো, নাগুকেও আর ঐ খিচুড়ি খেতে হবে না বেশিদিন, চেন্নাইয়ের গরমে বসে সাম্বার দিয়ে কার্ড রাইস খাবে বউ এর হাতে। ডেবোনেয়ার টা হোটেলে ফেলে না এসে নাগুকেই দিয়ে এলে হতো, যে কটা দিন আছে...

Sunday, January 12, 2014

চেন্নাই ও আরেক বন্ধু

চেন্নাই ও আরেক বন্ধু

চেন্নাই থেকে ফিরেছি মাস দেড়েক হয়েছে, বস্‌ বলল আবার যেতে হবে। এবারের গন্তব্য কোয়েম্বাতুর। বৌ তখন ক্যারিইং, আর ওই সময়ে মেয়েদের অভিমান বেড়ে যায়, বেচারাকে একা ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছিল না।, কিন্তু চাকরি, না থাকলে খাবো কি, তাই যেতেই হবে। কোয়েম্বাতুর জায়গা মন্দ নয়। তামিলনাড়ুর এক কোনায়, কেরলের বেশ কাছাকাছি। উটির পাহাড়ের ঠিক নিচে, সুন্দর সবুজ শহর একটা। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন, প্ল্যান্‌ড। প্রচুর মুসলিম থাকেন, তাই উর্দু খুব চালু ভাষা ওখানে। আর তার মানে হিন্দিও মোটামুটি চলে। ভালই হল। মাঝে একটা রোববার পড়লে ঢুঁ মারা যাবে পাহাড়েও। অ্যারিস্টোক্র্যাট এর স্যুটকেসটা হাফ গোছানোই ছিল, কয়েকটা ফ্রেশ জামা কাপড় ঢুকলো শুধু।

ঘোষবাবু তখনো আছেন, তাই এবারেও ডাইরেক্ট ফ্লাইটের আশা করা বৃথা। আবার সেই সঞ্জীবদা এবারে টিকিট পাওয়া গেলো গুয়াহাটি-কলকাতা-ভুবনেশ্বর-চেন্নাই ফ্লাইটে। কিন্তু চেন্নাই থেকে কোয়েম্বাতুর কিভাবে যাবো, সেটা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিলো। ওভারনাইট ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেলো না, সব বুকড্‌। চেন্নাই থেকে তখন সবে কোয়েম্বাতুরের ফ্লাইট চালু হয়েছে, কিন্তু সে খবর আমাদের কাছে ছিল না।

ভাবছিলাম কি করা যায়, হঠাৎ মনে পড়লো রবিশঙ্করের কথা। রবিশঙ্কর ডিউ-পন্টের চেন্নাই শাখার আইটি হেড, জানুয়ারির শেষে কলকাতায় এসেছিল ট্রেনিং নিতে, তখন বেশ ভাব জমেছিল। কলকাতায় শ্বশুরবাড়ী। ফোন করলাম। রবিশঙ্কর উচ্ছ্বসিত এত তাড়াতাড়ি দেখা হবে সেটা ভাবেনি আগে বলল, কোনো চিন্তা কোরো না, সব দায়িত্ব আমার। দুর্দান্ত সব বাস আছে এখানে, তার একটায় আমি সামনের দিকের টিকিট কেটে রাখছি, তুমি শুধু চেন্নাইতে পৌঁছও, তাহলেই হবে।

পরের দিনই রবিশঙ্করের ইমেল চলে এলো, তাতে লেখা আছে কেপিএন ট্রাভেলস্‌ এর ৮:৩০ এর চেন্নাই-কোয়েম্বাতুর বাসে ৭ নম্বর সিটটা বিজিথ ভোস এর নামে, অর্থাৎ আমার। দক্ষিন ভারতীয়রা কোন একটা বিচিত্র কারনে আমার নামের বানান কখনই ঠিক লিখতে পারেনা, কখনো বিজিথ, কখনো বিজি, কখনো আবার বিজু, একবাত ডিজিট ও লিখেছিল। আর বোস টা প্রায়শঃই বস, ভোস বা বোশ হয়ে যায়। একটা কারন অবশ্যই ওদের বর্ণমালা যেখানে একশোর বেশী যুক্তাক্ষর, কিন্তু শুদ্ধ বর্ণে ক-খ-গ-ঘ এই চারটের জন্য একটাই অ্যালফাবেট, তেমনি চ, ট, ত, প সিরিজেও এক জিনিস। এর নানাবিধ অসুবিধের মধ্যে একটা প্রধান অসুবিধে হল, ওরা তাই সুরের রাজা হয়েও আন্তাক্সারিতে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যায়। তা না হোক, আমি যাচ্ছি কাজে, আর সময় পেলে, একটু ঘুরতেও, তাই গান নিয়ে আন করে লাভ নেই, বানান নিয়েও না।

ক্রেডিট কার্ডের ঝামেলা মিটেছে ততদিনে। কিন্তু এবারে আর কোনো রিস্ক নেওয়া নেই, বস্‌কে বললাম যথেষ্ট পরিমান ক্যাশ না দিলে আমি এবারে যাবোই না। বস বিশেষ বাক বিতন্ডা করলো না, অ্যাপ্রুভ্যাল হয়ে গেলো কয়েক মিনিটেই। দিন সাতেকের ট্যুর, ঘোষবাবুর ভাঙ্গা হৃদয় টুকরো টুকরো করে দিয়ে দু খানা একশো টাকার বান্ডিল পকেটে পুরে নিলাম। উনি যতবার বললেন গুনে নিয়েছেন তো? আমি ততবার আপনি গুনে দিয়েছেন তো? বলে একটা নারকীয় সুখ অনুভব করলাম শালা বুড়ো, আগের বার কিপ্টেমি না করলে মোটেই ওরকম দুর্দশা হতো না, এবারে দ্যাখ শালা কেমন লাগে!

সকাল এগারোটায় ফ্লাইট, অফিস যাইনি আর সেদিন, বাড়ির থেকে সোজা এয়ারপোর্ট। চেক ইন করার সময় উইন্ডো সিট চাইলাম, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের মাসিমা দিতে পারলো না, বলল নেই নাকি। যাকগে, কি আর করা। প্লেনে উঠে দেখলাম অনেকে বসে আছেন আগের থেকেই, তখন মনে পড়লো প্লেন টা আসছে গুয়াহাটি থেকেই লোক নিয়ে, তাই জানালা খালি নেই। এইল সীটে বসে পড়লাম, আর অবাক করে দিয়ে ফ্লাইট একদম ঠিক সময়ে টেক অফ করলো।

প্লেন উড়ছে, লক্ষ্য করছিলাম, আগের বার যেমন স্যুট বুট পরা লোকই বেশী দেখেছিলাম, এবারে তেমন লোক খুব কম। নিতান্ত ছা পোষা লোকজনেই ভর্তি সব সিট। বছর দুয়েক আগে গুয়াহাটি গেছলাম, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের একটা কাজে, তখন নাগুর মুখে শুনেছিলাম দক্ষিনের ব্যাঙ্কগুলো প্রায় সমস্ত কর্মচারীকেই উত্তর পূর্ব ভারতে দু বছরের ম্যান্ডেটরি পোস্টিং দেয়। আন্দাজ করলাম, এনারা সেরকমই লোক জন। একটু কান পেতে আলোচনা গুলো শুনতেই বুঝলাম আমার গেস টাই ঠিক।

এনারা অনেকেই ফোর্থ ক্লাস স্টাফ, বেশিরভাগ উড়িষ্যার, কিছু অন্ধ্র আর তামিলনাডুর, বছর শেষের ছুটি কাটাতে ব্যাঙ্কের পয়সায় প্লেনে ফিরছেন। অনেকেরই সঙ্গে পরিবার। দুপুরে বাড়ী পৌঁছে যাতে আর খাবারের ঝামেলা না করতে হয়, সে ব্যাপারে সদাই তৎপর। কেউ দ্বি টা অন্ডা নিলেন, কেউ চারিটা। সমস্ত ম্যাগাজিন ব্যাগে ঢুকে গেলো। কেউ কেউ সিটের ওপরে পা তুলে দিচ্ছেন, কেউ বা বারো চোদ্দবার মাথার ওপরের এয়ার হোস্টেস কে ডাকার বোতাম টিপেই সময় কাটিয়ে দিলেন, কেউ চার প্যাকেট চিনি নিয়ে পকেটে ঢোকালেন। একজন ফ্যানটা ধরে কষে পাক দিতেই কড়াৎ করে শব্ধ করে তার বাইরের রিংটা তাঁর হাতে চলে এলো, তিনি এদিক ওদিক চেয়ে সেটা সামনের সিটের পেছনের জালির পকেটে গুঁজে দিলেন। একটা বাচ্ছা সিটের ওপরে দাঁড়িয়ে অক্সিজেন মাস্কের খোপ্টা টেনে ফাঁক করে বলছিল এ বাপু, এটঠি মধ্যিরে টিউবো অছি, এমন সময়ে একজন এয়ার হোস্টেস এসে কড়া ধমক দিতে সে ক্ষান্ত হলো। এয়ারবাস এ ৩২০ তখন জমজমাট, এমন সময়ে অ্যানাউন্সমেন্ট হল বেল্ট বেঁধে বসতে, কারন ভুবনেশ্বর চলে এসেছে, প্লেন নামবে এবারে।

যাঁরা ভুবনেশ্বর প্রায়ই যান, তাঁরা জানেন, শহরের একটু আগে পাহাড় আছে, সেখানে এয়ার পকেট হয় খুব, তাই রোলিং খুব বেশী। আমারো অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু এক মহিলার কাণ্ডে থতমতঃ খেয়ে ভুলে গেলাম। এটা বোধহয় ওনার প্রথমবার, প্লেন রোল করতেই চেঁচাতে শুরু করলেন মু মরি জিবো গো! মু আর করিবিনি গো! মু কে নামাই দিয় গো! কাঁই মুকে শাস্তি দিলু রে! এয়ারহোস্টেস সিট থেকে উঠে এসে দু এক কথা বলার চেষ্টা করলেন, তারপরে ক্ষান্ত দিয়ে আবার নিজের জায়গায় চলে গেলেন। মহিলা চালিয়ে গেলেন, থামলেন সেই প্লেন ল্যান্ড করার পরে। নিজের সিট ভিজে গেছে, সামনের ভদ্রলোকের কলারের পেছনে বমি, হাসি হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে গটগটিয়ে নামার সময় বীরাঙ্গনার ভঙ্গিতে বলে গেলেন সড়া, ম্যাড়া****, এ সবে মু কৌণ নাই, মু কে কিচ্চি করিতে পারিবিনি সড়া! ওই সিট টা বাকি রাস্তা যে খালিই যাবে, সে বলাই বাহুল্য। অন্য অনেকেই নেমে গেলেন, আমরা কিছু পরে আবার ওড়া শুরু করলাম।

ডিউ পন্টের তারামণি তে মস্ত অফিস আছে, গুম্নিপুডি তে কারখানা, কিন্তু রবিশঙ্কর বসে মাইলাপোরের অফিসে। এয়ারপোর্ট থেকে একটা প্রিপেড নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। রিসেপশনে খবর দিতেই রবি বেরিয়ে এলো, ওয়াও, বিজিথ বোসা বলে জড়িয়ে ধরল। লাঞ্চ করানোর জন্য চাপাচাপি করছিল, আমি বললাম দরকার নেই। একটু পরে ব্যাগ স্যুটকেস অফিসে রেখে বেরিয়ে পড়লাম, রবির স্কুটি তে।

রবির স্কুটির খবর আমেরিকা জানে না, জানা থাকলে নাসা নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতো। চেন্নাইতে হেলমেটের বালাই নেই তেমন। তবে লোকজন ধুলো নিয়ে খুব সচেতন, তাই মাথায় রুমাল বাঁধা থাকে। হেলমেটের সামনের কাঁচ যেরকম দেখতে হয়, সেরকমই কাঁচ ওখানে মোটা ইলাস্টিক ব্যান্ড সমেত কিনতে পাওয়া যায়, খুব সেল। সেই ফেস্‌মেট পরে রবি চলল চেন্নাইয়ের রাস্তায় তার রকেট নিয়ে। পেছনে বসে আমি, সিটের দুটো পাশ খামচে ধরে আছি, পা দুটো পেঁচিয়ে তুলে দিয়েছি পেছনের নাম্বার প্লেটের ওপরে।

সেন্ট্র্যাল লাইব্রেরী, ভেল্লুভ্‌র কোট্টায়াম, ফোর্ট, মন্দির এসব ঘুরে যখন টি নগরের জি এন চেট্টি রোডে পৌঁছেছি, দিন গড়িয়ে আসছে তখন। অফিস থেকে স্যুটকেস ব্যাগ গুলো তুলে নিলাম, কফি খেলাম একটু। ব্যবস্থা অন্যরকম চা আর কফি, দুয়েরই থকথকে সিরাপের মতো বানিয়ে রাখা আছে একটা করে পাত্রে, পটে গরম দুধ আর পাশে চিনি। দুধ ঢেলে নাও কাপে, এক চা চামচ চা বা কফির সিরাপ, তারপর তিতকুটে ভাব কাটানোর জন্যে প্রভূত পরিমানে চিনি ড্রিংক তৈরি। সাতটা নাগাদ ডিনার করতে গেলাম। রবি দেখলাম বিন্দাস মুরগি খাচ্ছে, শুধু আমাকে একবার সিরিয়াস মুখ করে বলল তোমার সঙ্গে আমার বউ এর কখনো দেখা হলে কিন্তু বোলো না যে আমি আমিষ খাই। আমার বয়েই গেছে! সেই সময়টা আমি মদ্যপানে বিরতি দিয়েছি নানা শারীরিক কারনে, রবি একাই হুইস্কি খেয়ে চোখ ঢুলু ঢুলু করে ফেলল। খাবারের শেষে জবরদস্তি বিল পেমেন্ট করে স্কুটিতে করে পৌঁছে দিল বাস স্টেশনে। আমি ওকে টা টা করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

চেন্নাইতে বাস স্ট্যান্ড বলে কম, স্টেশন বলে বেশি। সেখানে প্রত্যেক নামকরা ট্র্যাভেলসের একটা করে ঘর আছে, ওয়েটিং হল। কে পি এন এর ওয়েটিং হলে বসে আছি, মাইকে একজন তামিলে কিছু কথা বললেন, বাসের নাম্বারটা শুনে একবার গিয়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কনফার্ম করে নিলাম এটাই আমার বাস। সামনে এসে দাঁড়ালো এখানা সাদা রঙের উঁচু বাস, গায়ে কালো দিয়ে টাইমস নিউ রোমান ফন্টে লেখা কে পি এন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড, মস্ত লম্বা, বেশ উঁচু। ভেতরে টু বাই টু সিট, অড নাম্বার গুলো জানলা, ইভেন গুলো এইল। মস্ত সিট, বোতাম টিপে প্রায় শুইয়ে ফেলা যায়, মাথার কাছটা আবার বালিশের মতো উঁচু করা। বাসে উঠে বাঙ্কে সুটকেস রেখে বসে পড়লাম সাত নম্বর সিটে, ব্যাগ টা ছোট, তাই কোলে রাখলাম।

বিদঘুটে একটা তামিল ডিস্কো অ্যালবাম চালিয়ে বাস ছেড়ে দিলো। প্রচুর লোকজন, পুরুষরা সব্বাই ধুতি পরা মালকোঁচা মেরে, মহিলারা শাড়ি, কপালে বড় টিপ, মেটে সিঁদুরের, তার সঙ্গে চোখে পড়ার মতো বড় সাইজের সোনার নাকছাবি। সবারই চুল অল্পবিস্তর পেপার সল্ট, নারকেল তেল খাওয়ার ফল। যে যার মতো করে আনণে রেন্ডে মূণে ণালে করে সিট গুনে গুনে নিজের জায়গায় বসে পড়লেন। একজন মহিলা পতিরেণ্ডে পতিরেণ্ডে করে চেঁচাচ্ছিলেন, ভাবছিলাম বোধহয় স্বামীর চরিত্র নিয়ে গাল পাড়ছেন, তারপর দেখলাম তিনি আমার পেছনের রো তে বারো নম্বর সিটে বসলেন। আট নম্বর টা খালিই রইল, কেউ ওঠেনি। মাঝে একজন সাদা শার্ট প্যান্ট পরা আবলুশ ভদ্রলোক টিকিটা চেক পান্নি এলেন, তাঁকে টিকিট দেখাতেই না সুচক মাথা নেড়ে চলে গেলেন, অর্থাৎ ঠিক আছে।

চেন্নাই ছাড়িয়ে খানিক দূর যাওয়ার পরে, তখন ঘন্টা খানিক কেটেছে, বাস একবার দাঁড়ালো, সামনে লেখা মুরুগানস ডাবা হোটেল। সেখানে নেমে সিগারেট ফুঁকে নিলাম একটা, তারপর বাসে উঠে সিট টা লম্বা করে নিলাম। বাস ছাড়লো আবার, লাইট নিভিয়ে দেওয়া হল, গানের ভলিউম প্রথমে কমিয়ে দেওয়া হল, তারপর একদম বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙল পৌনে চারটে নাগাদ। বাস দাঁড়িয়ে আছে, জানালা দিয়ে দেখলাম সামনের সাদা স্কুল বাড়িটায় লেখা সেলম হাই স্কুল, সেইল, সেলম। অনেকটাই চলে এসেছি তাহলে! স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কারখানা আছে এখানে। বাবা সেইলেই চাকরি করতেন, তাঁর কাছে শুনেছি এটাই সেইলের একমাত্র প্ল্যান্ট যেখানে স্টেনলেস স্টিল তৈরি হয়। বাবার পঁচিশ বছর চাকরি হওয়ার পরে এক বাক্স বাসন দিয়েছিল গিফট হিসেবে, সেই বাক্সে লেখা ছিল সেলম স্টিল। দক্ষিন ভারত ভ্রমনে এসেও সেলমের ওপর দিয়ে গেছলাম, তার আগে ভাবতাম যায়গাটার নাম সালেম, সেবারের রাজু ড্রাইভার সে ভুল কাটিয়ে দিয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়লো, এখান থেকে কোয়েম্বাতুর ঘন্টা তিনেক হবে। এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি মারলাম চায়ের সন্ধানে, পেলাম না কিছু। কফি ছিল, কিন্তু অত বেশি মিষ্টি আমি খেতে পারি না, তাই ছেড়ে দিলাম। পাঁচ মিনিটেই বাস ছাড়লো আবার, লাইট ও নিভে গেলো।

পাঁচ মিনিটেই লাইট আবার জ্বলে উঠলো। সেই চেকার ভদ্রলোক এসে তামিলে কি সব যেন বললেন, কিছুই বুঝলাম না, শুধু কোয়েম্বাতুর শব্ধটা চেনা ঠেকলো, বলেই আবার চলে গেলেন ড্রাইভারের কাছে। বাসের সব্বাই হই হই করে উঠলো, পতিরেণ্ডে মুখ দিয়ে কুকুরকে ডাকার মতো চুকচুক করতে থাকলেন, তাঁর স্বামী পতিন্নূন্নূ নম্বর সিট থেকে ডজ করে বেরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন সামনের দিকে, আরো খবরের খোঁজে।

আমি স্ট্রেইট হয়ে বসে আছি, পতিন্নুন্নু ফিরছেন, খপাস করে হাতটা চেপে ধরে বললাম হোয়াট?। উনি চোখ গোল গোল করে শুধু বললেন কোয়েম্বাতুর, বাম্ব, আল ব্যাড অর্থাৎ কোয়েম্বাতুরে বোমা ফেটেছে, খবর খুব খারাপ। হাত ছেড়ে দিলাম, উনি নিজের সিটে গিয়ে বসলেন। এর থেকে বেশি খবর এই বাসে আর পাওয়া যাবে না। সিধে হয়ে বসে আছি, বাকি সব্বাই ঘুমিয়ে পড়লো আবার, পতিরেণ্ডের ফুরফুর করে নাক ডাকছে।

এক ঘন্টায় একটা বড় বাস স্ট্যান্ডে বাসটা ঢুকল। উঠে গেলাম সামনে, ড্রাইভার বললেন ইরোড়। পো মা। সবাই নামবে, পেছনে লাইন পড়ে গেছে, আমাকেও নামতে হল। ইরোড়ের আকাশে রক্তিম আভা দেখা দিয়েছে তখন। পো, পো, পো বাসের ড্রাইভার সমানে বলে চলেছে। আরেকবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রাই করলাম, তাতে বুঝলাম এই বাস আর যাবে না, এখান থেকে আবার চেন্নাই ফিরে যাবে।

হতোদ্যম হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, দেখলাম আমার বাসের অনেকেই একটা অন্য আকাশী-সাদা স্টেট বাসে উঠছেন। আমিও পেছন পেছন উঠে পড়লাম। এই বাসেই প্রথম একজন প্যান্ট শার্ট পরা ভদ্রলোক দেখলাম। পরিস্কার ইংরেজি বলেন। ভরসা পেলাম একটু। ওনাকে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে। উনি বিস্তারিত বললেন, তার সারমর্ম এরকম আগের দিন আমি যখন রবির রকেটে চেপে চেন্নাই টহল দিচ্ছি, সেই সময়েই কোয়েম্বাতুরে বিজেপির একটা র‍্যালি ছিল, তাতে ভাষণ দেবার কথা ছিল লালকৃষ্ণ আডবানির। সেখানেই গোটা দুয়েক বোমা ফেটেছে গতকাল, তবে কেউ হতাহত হয়নি, গন্ডগোল ছিল বটে, তবে আজকে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। আমি জানতে চাইলাম উনিও কোয়েম্বাতুর যাচ্ছেন কিনা, তাতে বললেন না, উনি আগেই এক জায়গায় নেমে যাবেন। তা হোক, এবারে একটু শান্ত হল মনটা।

বাস চল্লো গড়গড়িয়ে, ঝকঝকে রাস্তা, মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছে, একজন দুজন উঠছে নামছে, পাশের ভদ্রলোক আমাকে অল দ্য বেস্ট জানিয়ে নেমে গেলেন এক যায়গায়। অ্যাড্রিন্যালিন ফ্লো কমে এসেছে, আবার ঘুম ঘুম পাচ্ছিল একটু। ভোর ছটা হবে, একটা পুলিশের জীপ ডিপারের সিগন্যাল দিয়ে আমাদের পাশ কাটালো, তারপর হাত দেখিয়ে বাসটাকে দাঁড়াতে বলল। দুজন নামলেন, ড্রাইভার মুখ বের করেছে, কথা বলছে সেই দুজনের সঙ্গে, আমিও জানালা দিয়ে মুন্ডু বের করে বোঝার চেষ্টা করছি কি হচ্ছে, কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেলাম। আমাদের বাসের কন্ডাক্টর। ভাঙ্গা উর্দুতে বললেন, উৎরো, আগে নেহি যায়েগী বস্‌। কেন? পুলিশ বলছে।

ব্যাগ পত্র নিয়ে নামলাম, পুলিশের জীপ এর মধ্যেই চলে গেছে, আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাস ফেরৎ চলে গেলো তার পিছু পিছু, দেখলাম বাসে বাকি যে ছয় সাত জন ছিল, তারা কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেলো। চওড়া রাস্তা, বেশ খানিকটা ছেড়ে দোকানপাট, সব বন্ধ। রাস্তার পাশে ক্যালানের মতো দাঁড়িয়ে একা বিজিথ ভোস, তামিল তেরিয়াদে, এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে সবুজ রঙের ক্লাব-লাগেজের ছোট ব্যাগ, একটা নেড়ি কুত্তাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও, রেপ উইদাউট কপিউলেশন এরেই কয় নিশ্চয়।

যায়গাটা কোথায়? দোকানে দেখছি লেখা আছে কোয়েম্বাতুর, কিন্তু সে তো ডিট্রিক্ট ও হয়? একটু পরে ঠাহর হল, অনেক দুরে একটা অটো দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় এক কিলোমিটার হবে, তাই আগে চোখে পড়েনি। কি আর করা, হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম বাহন চালক পুজো করছেন। বললাম, জায়েগা? উত্তর এলো, ইল্লা সার, ন। ইল্লে কে আমা করাতে গেলে কি করা দরকার, ভাবছি, আবার প্রশ্ন এলো কিদরকো জায়েগা? বললাম আর এস পুরম। শিউরে উঠে বল্ল আর কে পুরম নাহি জানা হোতা সার হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আবার প্রশ্ন ইউ গিব হ্নড্রেড ফিফটি? দেবো বাবা, উপায় কি? উঠে বসলাম, আর ঠিক দু মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আর এস পুরম, এতটাই কাছে, স্বচ্ছন্দে হেঁটে আসা যেতো।

কি আর করা, দেড়শো টাকা গচ্চা গেলো, অটো চলে গেলো আমাকে নামিয়ে দিয়ে, একটা টি এর মতো মোড়ে। সামনে, টি এর ডান বগলের নিচে একটা মস্ত কর্নার প্লটে হোটেল অন্নপূর্ণা, বিশাল বড়, কিন্তু বন্ধ, পুরো সামনের দিক টা রোলিং শাটার নামানো আছে। আসে পাশে অনেক দোকান, সব বন্ধ। ওদিকে একটা গ্রীন্ডলেস ব্যাঙ্কের হোর্ডিং দেখা যাচ্ছে, সেটাও বন্ধ মনে হল।

এখন আর ধৈর্য হারানর মানে হয় না, শুধু ঠিক সময়ের অপেক্ষা, কপাল আমার খুলবেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি, দেখলাম খাঁকি ড্রেস পরা একজন, বোধহয় দারোয়ান হবে, এসে একটা শাটারের তালা খুলল, একটু তুলে ভেতরে ঢুকে গেলো। শাটার টা নামাবে, আমি পেছন পেছন ঢুকে গেলাম। লোকটা হাঁ হাঁ করে উঠলো বন্ধ্‌ হ্যায়, বন্ধ্‌ হ্যায়! নিকুচি করেছে! বঙ্গমাতাকে স্মরণ করলাম একবার, তারপর পরিস্কার বাংলায় বললাম তাতে আমি কি করবো? আমি কি বন্ধ করেছি? আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, আমাকে থাকতে না দিলে পুলিশে কমপ্লেন করবো। ম্যানেজারের কাছে নিয়ে চল এক্ষুনি, নাহলে তোমার বাম্বু করে দেবো। বাম্বু, পুলিশ, কমপ্লেন  এগুলো ইচ্ছে করে ইংরেজি শব্ধই বললাম, ফর স্পেশাল এফেক্ট। বঙ্গমাতা কৃপা করলেন, দারোয়ান চুপ করে গেলো, আমি গট গট করে রিসেপশনে চলে গেলাম, পেছনে দারোয়ান, গুটি গুটি পায়ে ফলো করছে। সামনে সুন্দর মডার্ন কাউন্টার, তার পেছনে অসংখ্য চাবি ঝুলছে, কাউন্টারের ওপরে দেখা যাচ্ছে শুধুই দুখানা পা।

আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনে সেই পা নেমে গেলো, উঠে বসলেন আমারই বয়সি এক যুবক। সাদা শার্ট, সাদা ধুতি। এক মুখ দাড়ি, ঘুমোচ্ছিলেন, তাই চুল উস্কো খুস্কো। আমি বললাম হাই, আই আম ফ্রম ক্যালকাটা, আমার বুকিং আছে। উনি কিছু না দেখেই বললেন আই এয়াম সারি সার, প্লীস ফাইন্ড সাম আদার হোটেল। মশকরা হচ্ছে? এত ঝামেলা করে হোটেলে ঢুকেছি, হোয়াট ডু ইয়উ মীন বাই ফাইন্ড আদার? আই অ্যাম হিয়ার ফর ব্রুক বণ্ড, অ্যান্ড আই অ্যাম এন এস্টীমড গেস্ট অফ দেম। ইফ ইউ ডু নট অ্যালাউ মি, আই অ্যাম গোয়িং টু কমপ্লেন এগেনস্ট্‌ ইউ, ইন অ্যা ওয়ে, সো দ্যাট দে মুভ ওভার টু অ্যা ডিফারেন্ট হোটেল ফর অল দেয়ার গেস্টস! কাজ হয়েছে। ভদ্রলোক আমাকে ওান সেকেন্ড সার বলে কাকে একটা ফোন করলেন, ওনার বস হবে। অনেকবার সার ওয়ান্দে, ইদি ব্রুকবন্ড ইঙ্গে এই সব বললেন, তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ওকে সার, মায় বাস সেস্‌ য়ু ক্যান স্টে।

এরপরে আমি একটু হাল্কা হলাম। জানতে চাইলাম কি এত চাপের জিনিস হয়েছে যে হোটেলে গেস্ট রাখা যাবে না? ওনার নাম মাণি, বললেন আগের দিন কাছাকাছিই বোমা ফেটেছে, আবার যদি কিছু হয়, এই ভয়ে ওনারা গেস্ট রাখতে চাইছেন না। বাইরে কারফিউ, উনি নিজেও আটকে গেছেন, বাড়ী যেতে পারেন নি গতকাল থেকে। চাবি দিয়ে দিলেন রুমের, একখানা ছেলে, নাম আলম, আমার ব্যাগটা নিয়ে রুমে পৌছে দিল, সাত তলায় রুম, নাম্বার ছশোসাত।

রুমে ঢুকেই ক্লান্তি কেটে গেলো সামনের পুরো দেওয়ালটা কাঁচের, তার ওপারে দেখা যাচ্ছে উটির পাহাড়। কাঁচের ওপাশে ব্যাল্কনি, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। রোদের তেজ নেই তেমন, ফুর ফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, আলমকে জিজ্ঞেস করলাম কাঁহা হুয়া ইয়ে সব? আলম বাঁ দিকের ব্যাঙ্ক টার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ইধারকো সার! এতক্ষনে দেখলাম, গ্রীন্ডলেস ব্যাঙ্কের সামনেটা প্রায় পুরোটাই উড়ে গেছে, রাস্তার ওপরে একটা ছ ফিট ডায়ামিটারের গর্ত। বাপ রে! রুমে ঢুকে এলাম আবার।

সকালের কাজ সারার সাথেই ঝপ করে স্নানটাও সেরে নিলাম। তখনো বাড়ীতে ফোন ছিল না, বাড়ীর সামনের দোকানে ফোন করে জানালাম আমি পৌঁছে গেছি আমি দেখিনি বটে, কিন্তু বাড়ির সবাই টিভি দেখেছে, চিন্তাতেই ছিল নিশ্চয়ই। এখানের নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। একটু পরেই ফোন বাজলো, রামানাথন ফোন করেছেন, এখানের একাউন্টস ম্যানেজার, জানতেন আমি আসছি তাই হোটেলে ফোন করে খবর রাখছিলেন আমি কখন ঢুকছি। সাবধানে থাকতে বললেন, আর বললেন আজকে ফ্যাক্টরিতে এসো না, একে রবিবার, তায় কারফিউ, হেঁটে আসতে হবে। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, সেটা আর বললাম না। বাড়ির থেকে ফোন এলো, বললাম সব ঠিক আছে। বসের ফোন এলো তারপর, বলে দিল একটুও ঝুট ঝামেলা দেখলে যেন কেটে পড়ি। আর তারপরেই, ভীষণ খিদে পেল।

রুম সারভিস ডায়াল করলাম। ওয়ান চিকেন স্যান্ডউইচ, ওয়ান ডাবল এগ ফ্রাই, ওয়ান অরেঞ্জ জুস, চিল্ড। উত্তর এলো, চিকেন স্যনাডুইচ ইল্লে সার। ওকে, দেন এগ অর ভেজ স্যান্ডউইচ? আবার উত্তর, স্যান্ডউইচ ইল্লে সার। ভীষণ রেগে বললাম, দেন হোয়াট ডু ইয়ু হ্যাভ? নিরবিকার জবাব, ওয়ানলি ইডলি সার। মাণিকে ফোন করলাম। উনি জানালেন কারফিউ চলছে, হোটেলে কোন কিছু নেই আর, কুকও নেই, নিজেদের খাওয়ার জন্য ইডলি বানিয়েছে ওরা, খেলে খেতে পারি, না হলে হরি মটর। সারেন্ডার করতে হল। আলম এলো ইডলি নিয়ে। সিগারেট ফুরিয়ে গেছল, বললাম এনে দিবি? বলল, দিচ্ছি। এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিংসের দাম নিলো পঁয়তাল্লিশের বদলে একশো টাকা, উপায় নেই, দোকান বন্ধ সব। সারা দিন টিভি দেখে কাটলো। দুপুরে রাভা পোঙ্গাল - আমাদের সুজির হালুয়া, আর রাত্রে গিজড়ি, মানে খিঁচুড়ী।

সন্ধ্যে টা কাটিয়ে দিলাম ব্যাল্কনিতে বসে ওয়াকম্যানে গান সুনে আর পাহাড় দেখে। ভালো লাগলো দেখে, রাস্তা দিয়ে, যদিও প্রায় অন্ধকার, এক দুটো লোক মাঝে মাঝেই যাচ্ছে। স্বাভাবিক হচ্ছে কোয়েম্বাতুর।

সকালে বেরোলাম যখন, অন্নপূর্ণার রোলিং শাটার খুলেছে, যদিও ফ্যাসাডের দোকান গুলো বন্ধ। উল্টো ফুটে একটা পানের দোকান আর একটা জলখাবারের দোকান খুলেছে। একটু এগিয়ে একটা অটো পাওয়া গেলো, হুশ করে পৌঁছে গেলাম ফ্যাক্টরির গেটে। সবার সঙ্গে আলাপ হল। রামানাথন (এনারও নামের অন্য পার্ট টা রামাকৃষ্ণান) আলাপ করিয়ে দিলেন  বাকিদের সঙ্গে - রভিচন্দ্রন, গুরুমূর্তি আর জয়সুধা। রামানাথন ত্রিচির তামিল ব্রাহ্মণ, বাংলাও বলেন ভালই, অনেকদিন কলকাতায় পোস্টেড ছিলেন। রভিচন্দ্রন আর গুরুমূর্তি দুজনেই ইংরেজি বলেন স্পষ্ট, হিন্দিও বলেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা, দুজনেরই পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। গুরুমূর্তির মাতৃভাষা কান্নাডা, রভিচন্দ্রনের মালায়ালাম। জয়সুধা লোকাল মেয়ে। সব মিলিয়ে টোট্যাল ন্যাশানাল ইন্টিগ্রেশন একদম। এদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট ওই শ্যামলা রঙা জয়সুধা। মাত্র তেইশ বছর বয়স, আই টি অফিসার এখানের, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছে এখানে, মুখে সদাই হাসি, আমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সেই জিনিস রেডি।

কাজ এগোতে লাগলো ভালোই। দুপুরে ওদের ক্যান্টিনে ভালোই খেলাম, দক্ষিনি খাবার, কিন্তু চেন্নাই-পন্ডিচেরীর সেই উগ্র গন্ধটা নেই। এক বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গেও আলাপ হল, সুবীরবাবু, ছাব্বিশ বছর আগে বনগাঁ থেকে এসে এখানেই সংসার পেতেছেন, মাটির সঙ্গে যোগাযোগ নেই তেমন, তাঁর কাছে বাংলাদেশ এখনো প্রমোদ দাশগুপ্তর সময়েই আছে। সন্ধেয় যখন ফিরলাম, তখন অনেক দোকান খুলে গেছে হোটেলের আসেপাশে।

কোয়েম্বাতুর শহরটা খুবই প্ল্যান্‌ড, যেন ক্লাস ওয়ানের অঙ্ক খাতা। দুই রো করে বাড়ী, তারপরেই একটা রাস্তা, চওড়া। আমার হোটেলের ব্যাল্কনিটা রাস্তার পেছনের দিকে, সেদিকে আরেকটা রাস্তা। পরের দিনটা কেটে গেলো নির্ঝঞ্ঝাটে। পেছনের রাস্তাটায় একটা আকাশী ফিয়েট পার্ক করা ছিল, তাতে নাকি বোমা থাকতে পারে, সেই নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলছে। সকাল সন্ধ্যেয় দেখতাম নীল জংলা ড্রেস পরা বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা অনেক কিছু করছে ওখানে। পরের দিন ট্রাক ভর্তি মাটি, স্টোণ চিপ্স, পিচের গাড়ী, রোড রোলার চলে এলো, ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তা রিপেয়ার হবে। সামনের দোকান গুলো এক এক করে সব খুলে গেলো, যদিও ভীড় নেই এখনো। সাইকেল, অটো চলা শুরু হল, শুধু পেছনের রাস্তাটা নো এন্ট্রি হয়ে রইলো।

আমি রোজ ফ্যাক্টরি যাচ্ছি, লাগছেও ভালো। ব্রিটিশদের তৈরি ফ্যাক্টরিটা চা-কফির, কফিই প্রধান, একদিকে ওয়্যারহাউস, সেখানে একটা শেডে ডাঁই করে রাখা কফি বিন্সের বস্তা, অন্যটায় কালচে খয়েরি রঙের চিকোরির পাহাড়। চিকোরি একটা গাছের শেকড়। কফিতে চিকোরিই প্রধান উপকরন, ফিল্টার কফিতে চিকোরি থাকে সত্তর শতাংশ, ইন্সট্যান্ট কফিতেও নাহোক ষাট শতাংশ তো বটেই। কফি বিন্‌সে মূলতঃ গন্ধ আর হাল্কা রঙ হয়, তিতকুটে স্বাদ, তাতে ভলিউম আসে চিকোরি দিয়ে। দুটোকেই রোস্ট করা হয়, তার মিঠে কড়া গন্ধ ভেসে থাকে বাতাসে, তারপর গুঁড়ো করে প্যাকেট করা হয় ফিল্টার কফি। ইন্সট্যান্ট কফির অন্য প্ল্যান্ট লাগে, সে প্ল্যান্ট এখানে নেই। অনেকটা যায়গা জুড়ে কারখানা, ভেতরে সবুজ লন, ইঁট বাঁধানো রাস্তা, মাঝে মাঝে কৃষ্ণচুড়ার গাছ, লাল ফুল হয়ে আছে, কিছু হলুদ আর সাদা শিরীষ, পাউডার পাফ, হলদে রাধাচুড়া, বেগ্‌নে ফুলের জাকারান্ডা। ইঁটের বর্ডার দেওয়া নুড়ি পাথর ফেলা রাস্তার দুপাশে কেয়ারি করে সিজন ফ্লাওয়ার লাগানো, মাঝে কিছু পাতাবাহার কারখানা নয়, মনে হয় যেন কোনো বাগানে এসেছি।  

বুধবার সকাল এগারোটা হবে, জমিয়ে কাজ চলছে, হঠাৎ দুম করে একটা শব্ধ পেলাম। পাত্তা দিইনি তখন, কিন্তু তার একটু পরেই একটা হই হট্টগোল শুরু হল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম লোকজন পাঁচিলের পাশে একটা যায়গায় ভীড় করেছে। পায়ে পায়ে আমিও গেলাম, রভিচন্দ্রনের দেখা পাওয়া গেলো। জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? রভিচন্দ্রন বলতে লাগলো আঙুল দেখিয়ে। কারখানার সামনে একটা চওড়া রাস্তা, তার ওপাশে খানিকটা ফাঁকা জমি, শ পাঁচেক মিটার হবে। তারপর আরেকটা বাউন্ডারি ওয়াল, তিন ফুটের, তার ওপাশে লক্ষ্য করলাম সেই নীল জামা পরা বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা। একজন এসে খবর দিল ওটা একটা স্কুলের মাঠ, স্কুল ছুটি, তাই কয়েকটা বস্তির বাচ্চা ওখানে ডাস্টবিন ঘাঁটছিলো। ওখানেই বোমাটা ফেটেছে, একটা বাচ্চা মারা গেছে, অন্য একজনের অবস্থাও ভালো না। এর বেশি কিছু জানা গেলো না, একটু পরে আবার ফিরে এসে কাজে বসলাম, কিন্তু মনটা ভালো থাকল না আর।

কিছু পরে পিয়া ফোন করলেন। জানতে চাইলাম, কবে আসছেন, কারন ওনারও আসার কথা। বললেন সেই নিয়েই ফোন করেছেন, অফিস থেকে আসতে বারন করছে, আমাকেও বললেন বেরিয়ে পড়তে, কারন ব্যাপারটা খুব একটা ভালো ঠেকছে না। আমারও ভালো লাগছিল না। আসার দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাবো কি করে? বাস তো বন্ধ, ট্রেন এও ওঠা যাবে কিনা জানিনা। তখনই জানলাম, কোয়েম্বাতুর থেকে চেন্নাই ফ্লাইট চালু হয়েছে সবে, ব্যাঙ্গালোর-কোয়েম্বাতুর-চেন্নাই। তার টিকিট পাবো কোথায়? পিয়া বললেন, চিন্তা করবেন না, সে দায়িত্ব জয়সুধার।

জয়সুধা কোনো একটা ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করলো। তারা একজন কে পাঠিয়ে দিল একটু পরেই। তিনি আমার টিকিট নিয়ে এসেছেন, পরের দিন বারোটায় ফ্লাইট। ব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপের মেশিন বের করলেন, পেমেন্ট হয়ে গেলো। আমি এই ফাঁকে রভিচন্দ্রনকে ধরে একটা দোকান থেকে দুই পেটি ব্যানানা চিপ্স কিনে আনলাম, কলকাতায় খুব চাহিদা তার, তখন পাওয়াও যেত না তেমন। বেরিয়ে পড়লাম ৫টা নাগাদ, হোটেলের দিকে। দেখলাম হোটেলের আসেপাশের দোকানপাট আবার বন্ধ হয়ে গেছে, আমি রুমে ঢুকে পড়লাম।

খানিক্ষন টিভি দেখলাম। আজকের বোমা ফাটার খবর আছে, তাছাড়া নতুন আর কোন খবর নেই। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। জুতোটা আগেই খুলেছি, জামা টা গোঁজা ছিল এতক্ষন, এবারে বের করলাম। লাইট চলে গেলো হঠাৎ। চপ্পলটা পায়ে গলিয়েছি, ফোন টা বাজলো। মাণি।

বিজিথ, ইউ আর স্টিল দেয়ার? হ্যাঁ রে বাবা, তা তো আছিই। কালকে বেরোবো। মাণি এরপর যা বলল, সেটা আচমকা, আতঙ্কের এবং আশঙ্কার। পেছনের রাস্তাটায় যে ফিয়াট টা ছিল, যার দরজা খোলা যাচ্ছিল না পাছে বোমা ফেটে যায়, পুলিশকর্তারা ঠিক করেছেন, সেটা আজকেই খোলা হবে। বোমা ফাটতেই পারে, তাই সাবধানতা রাখতে সমস্ত বাড়ী খালি করে দেওয়া হচ্ছে। লাইটও পুলিশের আদেশেই নেভানো হয়েছে, যদিও বোমার সাথে আলোর কি সম্পর্ক, সেটা বোঝা গেলো না, হয়তো দিওয়ালীর রাতের মতো ব্যাপার, আলো জ্বললে দেখা যাবে না ভালো, তাই। মাণি বলল, ইউ নীড টু রান বিজিথ, ইউ আর দ্য লাস্ট পার্সন ইন্সাইড দ্য হোটেল আদার দ্যান মি।

মাথা কাজ করছে না ঠিকমতো, কি কি করা উচিৎ? লাফ দিয়ে পড়ে ফোল্ডারটা নিলাম হাতে, ওতে ফেরার টিকিট। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে নিলাম, আর নিলাম ক্যামেরা টা। ঘরের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে ছুটে বেরোলাম বাইরে, পায়ে চপ্পল। প্যাসেজটা অন্ধকার। লিফট চলছে না, সেটা বলতে হয় না। সিঁড়ির কাছে গেলাম। স্কাইলাইট দিয়ে হাল্কা আলো আসছে আকাশের। হাতড়ে হাতড়ে সাতটা ফ্লোর নামা, সেটা যে কত কঠিন, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছি, প্রতিটা স্টেপে। প্রানের ভয়, তাই বোধহয় দশ মিনিটেই নেমে এসেছিলাম। নিচে একখানা মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাণি, আমাকে দেখে একটু হাসি ফুটলো, কিন্তু চোখে ভয়, বলল গুড গড, ইউ আর হিয়ার ইন টাইম। মোমবাতি নিভিয়ে দুজনে বাইরে এলাম, দারোয়ান শাটার নামিয়ে দিল।

রাস্তায় কে যেন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে, এতো অন্ধকার। অনেকেই আছে রাস্তায়, কিন্তু আলো নেই কোনো। মাঝে মাঝে বিড়ি সিগারেটের আগুন জোনাকির মতো, কেউ কেউ টর্চ জ্বালছেন কখনো কেমনো। মাণি একটু পরে কোথায় চলে গেলো, অন্ধকারে ঠিক ঠাহর পেলাম না। উল্টোদিকের একটা দোকানের সিঁড়িতে বসলাম। মশা কামড়াচ্ছে, পোকা উড়ছে। মাঝে মাঝে একজন মুখে টর্চ মারছে, আমি কলকাতায় হলে বাপান্ত করে দিতাম, বিদেশ বিভুঁই বলে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকছি। লোকজন তামিলে কি যেন বলছে, জানতে চাইছে, আমি কিছুই বুঝছি না। কেউ একজন বোধয় প্রশ্ন করে উত্তর পেল না বলে গালাগালি দিল আমাকে। হাতটা মুঠো করে রাখলাম, সহ্য করতেই হবে। কিছু বললাম না, মুখে হাসিটা আটকেই রেখেছি। সময়ও দেখতে পাচ্ছি না, টর্চ টা নিয়ে নামিনি। এক একটা মুহূর্ত যেন একটা করে ঘন্টা, সময় কাটছে না কিছুতেই।

অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে এসেছে, একটা আউটলাইন দেখে মনে হল যেন মাণি। ডাকলাম, সাড়াও পেলাম, মাণিই বটে। কটা বাজলো? মাণি বলল সাড়ে আটটা। আর কতক্ষন? নো আইডিয়া। এমন সময় রাস্তায় একজোড়া আলো দেখা গেলো। জীপের আলো। কাছে আসতে বুঝলাম, পুলিশ। কয়েকজন নেমে কিছু একটা বললেন, আর মানি আমার পিঠ চাপড়ে বলল ইট ইস নাট গোয়িং টু হ্যাপেন টুডে, সো উই আর সেফ নাউ! বিস্তারিত শুনে বুঝলাম, গাড়িটার দরজা কিছুতেই খোলা যায়নি, রাতের অন্ধকারে জোর করে খুলতে গিয়ে ওটা ফাটানো ঠিক হবে না বলে মনে হয়েছে, তাই আপাততঃ বন্ধ ব্যাপারটা। কালকে সকাল আটটায় আবার শুরু হবে কেত্তন। কয়েক মিনিটেই আলো চলে এলো, রুমে ফেরত গেলাম।

যে আমি গত সাত বছরে সূর্যদয় দেখিনি, সেই আমি সকাল পাঁচটায় উঠেছি পরের দিন। সাড়ে পাঁচটায় চেক আউট, মাণিকে ঘুম থেকে টেনে তুলে। হোটেলের সামনে অটো পাইনি, হেঁটেই চলে গেলাম ফ্যাক্টরিতে, হাতে স্যুটকেস কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। গেটে তালা ঝুলছে, ক্লান্ত আমি ঘেমে নেয়ে ফুটপাথেই স্যুটকেস রেখে বসে পড়েছি, এমন সময়ে একজন দারোয়ান দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এলো কেয়া হুয়া সাব? আপ আভি? য়াঁহা? হাসলাম শুধু। আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো সে, ফ্যানের হাওয়ায় বসলাম। জয়সুধা এলো সবার আগে, কার্ড পাঞ্চ করতে এসে আমাকে দেখে মুখে চমকানো হাসি। ইউ? বললাম কালকের বৃত্তান্ত্ব। এর পর একে একে সবাই এলো, গল্প করতে করতে কখন যেন সাড়ে দশটা বেজে গেছে, গাড়ী চলে এলো। ছোট্ট এয়ারপোর্ট, লাউঞ্জে বসে মা দুর্গাকে ডাকছি, ফ্লাইট যেন ক্যান্সেল না হয়।

ঠিক সময়েই প্লেন উড়লো। চেন্নাই পৌঁছে এবারে জি এন চেট্টি রোডের হোটেল ডি সি ম্যানর, রবিশঙ্কর রেকমেন্ডেড। তেরোশো টাকা, ইয়েসি। ফেরার টিকিট টা ওপেন ছিল, হোটেলের রুম থেকে এয়ারলাইন্সে ফোন করে পরের দিনের জন্যে কনফার্ম করলাম, সিট ছিল, হয়ে গেলো। রবিশঙ্করকে ফোন করলাম, জানালাম সব গল্প। বলল আসছে একটু পরেই। চা এসেছে, এক চুমুক দিয়ে উঠে জানলার পর্দাটা সরালাম।


রাস্তায় অফিস ফেরতা লোকজনের ঢল নেমেছে। বাস যাচ্ছে, অটো, বাইক, মোপেড। ফিল করলাম, এমন ভালো শহর সারা দক্ষিন ভারতে আর নেই। মানুষ তো কোয়েম্বাতুরেও ছিল, এখানে রবিশঙ্করও আছে।

Saturday, January 11, 2014

চেন্নাই ও এক বন্ধু

চেন্নাই ও এক বন্ধু

মায়ান সভ্যতার ২০১২র গল্পটা তখনো লাইম্ লাইটে আসেনি, বিংশ শতাব্ধীর শেষ দিকে পৃথিবী তখন কম্পমান অন্য ভয়ে তার নাম ওয়াইটুকে মিস্‌। অতিহিসেবি মার্কিনরা ডেট ফিল্ডের দু খানা বাইট বাঁচাতে গিয়ে সারা দুনিয়াকে প্রায় শেষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, নাকি নতুন ব্যাবসার দিগন্ত খুলে দেবে বলেই এমন করেছিল, তাই নিয়ে পৃথিবী তোলপাড়। এমন একটা সময়ে, ১৯৯৮ এর ১৯ জানুয়ারি, আমি চল্লাম চেন্নাই। মাদ্রাজ এর আগেও গেছি, একবার নয়, দুবার। ১৯৯০ তে আমাদের ফুল ফ্যামিলি আর মেজোজেঠুর ফুল ফ্যামিলি দক্ষিন ভারত ভ্রমণে গেছলাম, সেবার এক রাত্রি ছিলাম, কিছুই দেখিনি প্রায়, শুধু দুটো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলাম। তার একটা হল মিলিটারি হোটেল খুঁজে বের করেছিলাম যেখানে পরোটা আর মাংস আমাদের এখানের মতোই খেতে, আর অন্যটা হলো, রাত্রে বেলায় আমি আর বাবা একটা রুমে ছিলাম, সেই রাত্রেই বাবাকে জানিয়ে ছিলাম যে আমি একজনকে নিয়ে সংসার করার প্ল্যান করছি ফিউচারে, মা কে যেন ম্যানেজ করে নেয়। এর পরে সেবছরই আরেকবার গেছলাম মার্চে, শঙ্কর নেত্রালয়ে, একদিন থেকে ডাক্তার দেখিয়ে পরের দিনই ফেরার ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। কিন্তু চেন্নাই, অর্থাৎ নাম বদলের পরে, সে এই প্রথমবার, তাও আবার একা।

অফিসের পেটি ক্যাশ যিনি দেখতেন, ঘোষবাবু, উনিও মার্কিনীদের মতোই হিসেবি মানুষ, ফান্ড নিয়ে সদাই চিন্তিত, এমনকি একবার কেউ ওনার পুরো নাম জিগ্যেস করাতে আনমনে বলেছিলেন এখন তো ফান্ড নেই ভাই, না এলে কিচ্ছু বলা যাবে না। অতএব পাছে ফান্ড আগে বেরিয়ে যায়, সেই ভয়ে টিকিটটা মোটেই সময়ে কাটা হয়নি। তখন কলকাতা-মাদ্রাজ ডাইরেক্ট ফ্লাইট একখানাই, আর তাতে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ঘেমো মাসীমারা গোমড়া মুখে দয়া করে কিছু আধবাসি খাবার দাবার দিয়ে থাকেন বটে, কিন্তু ও ছাড়া উপায় নেই বলে সে ফ্লাইট সবসময়েই ওভার বুকড্‌। শেষ মুহূর্তে সঞ্জীবদা অনেক চেষ্টা চরিত্র করে জেট এয়ারলাইন্সে একখানা টিকিট যোগাড় করে দিলো, কলকাতা-হায়দ্রাবাদ-চেন্নাই, হায়দ্রাবাদে প্রায় পৌনে দু ঘন্টার ব্রেক। যাকগে, এক ট্রিপে দু খানা প্লেনে চাপা হবে, এ আর মন্দ কি, এই ভেবে বেরিয়ে পড়লাম, পকেটে হাজার পাঁচেক টাকা, ঘোষবাবু অনেক কষ্ট করে দিয়েছেন। অসুবিধে নেই, ক্রেডিট কার্ডও আছে, উনিশ হাজার টাকা ক্রেডিট লিমিট, তাতে সপ্তাহ দুয়েক আগে তন্দুর হাটে শ চারেক টাকার খেয়েছিলাম, বাকিটা পুরোটাই আছে, তাই নিজের মাপকাঠিতে বড়লোক আমি।

অফিস থেকে যখন বেরিয়েছি, তখনো কন্ট্যাক্ট ডিটেলস আসেনি, তাই হায়দ্রাবাদ পৌঁছে এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করলাম একটা, ক্লায়েন্ট অফিসের ঠিকানা ফোন সবই পাওয়া গেলো। থাকার ব্যাপারটা ওরাই জানিয়ে দেবে, তাই নিশ্চিন্ত। হায়দ্রাবাদ থেকে প্লেন যখন উড়লো, সূর্য তখন দিগন্তের খুব কাছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই আকাশ, নিচে মেঘ, পাঁশুটে রঙের, তাতে হাল্কা কমলা রঙ ধরেছে দিগন্তের ধারে, তারপরে আসতে আসতে সিঁদুরে লালের দিকে চলে গেছে। আমার পায়ের কাছের মেঘ গুলো কিন্তু সাদা। মাথার ওপরে আকাশটা পুরো কালো। সূর্যটা খুব ছোট, মনে হয় যেন অনেক দুরে, কিন্তু তার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না, এত উজ্জ্বল। পুরো জিনিসটায় কোথাও শুরু নেই, শেষও নেই। মঙ্গলগ্রহের কাল্পনিক ছবির সাথে কোথাও অমিল নেই। হাত নিস পিস করছে ক্যামেরাটা আনিনি বলে। গাড় নীল পোষাক পরা দারুণ সুন্দরী এক সেবিকা শরবৎ দিয়ে গেলো স্মিত হেসে, গায়ের রংটা নির্ঘাত ফোটোশপে বানানো, ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম এক মিনিটে, নাহলে অভিমান করতে পারে, আদর করে দিয়েছে না? ঘন্টা খানিকের মধ্যেই প্লেন ল্যান্ড করলো, ঘোষনা হল কামারাজ এয়ারপোর্ট, চেন্নাইমে আপকা স্বাগত হো। হমে আশা হ্যায় কি আপকা ইয়াত্রা সুখদ রহি। বাহার কা তাপমান ত্যাঁয়ত্রিস ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্যায়।

ত্যাঁয়ত্রিস? পাঁয়তাড়া হচ্ছে? জানুয়ারির উনিশ তারিখে ত্যাঁয়ত্রিস? গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর একটা লিমিট আছে তো, নাকি? ফারেনহাইট বলতে গিয়ে সেলসিয়াস বলল? প্লেন থেকে নেমেই সব আশঙ্কা সত্যি হল প্যাচপ্যাচে গরম, ফুর ফুর করে ভারি ভারি একটা হাওয়া দিচ্ছে, লাউঞ্জে এসি নেই, বড় সাইজের দু ব্লেডের ফ্যান ঘুরছে ভোঁ ভোঁ করে, আর সব জায়গাই লেখা আন্নাদুরাই এয়ারপোর্ট, কামারাজ লেখা খুব কম যায়গায়। সামনে প্রি পেড ট্যাক্সি বুথের ডানপাশে একখানা এসটিডি বুথ, তাতে এক নিকষ কালো স্বাস্থ্যবতি ভদ্রমহিলা কুকুর বাঁধার চেনের মতো মোটা একটা হলদেটে সোনার হার পরে মাথায় মাফলার বেঁধে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। বছর দশেক আগে শেষ যেবার চেন্নাই এসেছিলাম, সেই ট্রিপের লার্নিং হল, এখানে আমার চেনা কোন ভাষাতেই পুরো সেন্টেন্স বলতে যাওয়া বৃথা, জাস্ট দরকারি শব্ধগুলো বলো, আর বাকিটা সাইন ল্যাংগুয়েজ। ফোন? বলে ভুরু কোঁচকাতেই ভদ্রমহিলা না সুচক মাথা নাড়লেন, অর্থাৎ হ্যাঁ।

ঘড়িতে বাজে ৬টা, বুথে ঢুকে পড়ে ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন লাগালাম। ওপাশে ফোনটা ধরতেই জিভটা একটু দাঁত দিয়ে কুরে নিয়ে খুব স্টাইলিশ ভাবে বললাম মে আই স্পিক টু মিস্টার এস রামাকৃষ্ণান? তখনো জানতাম না, মাদ্রাজের যেকোনো বড় অফিসে অন্ততঃ সাতষট্টি জন রামাকৃষ্ণান থাকেন, তাদের মধ্যে অন্তত বাইশ জনের প্রথম নাম এস। উত্তর এলো রামাকৃষ্ণান ওয়ানদে? সিকিওরিটি ফোন ধরেছে, অফিসে ওরাই ফোন ধরে ওখানে, তাদের বললাম অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার রামাকৃষ্ণান। না। তিনি নেই। অন্য কোন রামাকৃষ্ণান? না, তাঁরাও কেউ নেই। এল্লা রামাকৃষ্ণান ইল্লে সার। অফিসে কেউ নেই। কারুর নাম্বার দাও? মুড়িয়াদে সার। মরিয়া হয়ে সিকিওরিটিদের হেডকেই ধমকাতে লাগলাম মোবাইল নাম্বার? আদার নাম্বার? নো নাম্বার? কন্ট্যাক্ট হাউ? হু স্পিক্স? পুলিশ? ফাইন? পেনাল্টি? পানিশমেন্ট? এসব বলে। পানিশমেন্ট শুনে ভদ্রলোকের কি হল জানিনা, একটা ল্যান্ডলাইন নাম্বার দিয়ে দিলেন। সতেরো টাকা সত্তর পয়সা বিল হয়ে গেছে ততক্ষনে, এবার অন্য নাম্বারটায় ফোন করলাম। কপাল ভালো, ধরলেন এক মহিলা যিনি ইংরেজি বলেন ভালই, তিনি রামাকৃষ্ণানের স্ত্রী, কারন নাম্বারটা রামাকৃষ্ণানের বাড়ীর, তবে ওনার নাম শ্রীবিদ্যা, সারদামনি নয়। তিনি জানালেন রামাকৃষ্ণান অফিসের একটা পার্টীতে গেছেন, রাত এগারোটার আগে ফিরবেন না। তাহলে আমি কি করবো? উনি সাজেশন দিলেন, আজকের রাতটা কোনো হোটেল এ ঢুকে পড়ে ওনাকে সেখানের নাম্বারটা জানিয়ে দিতে, যাতে রামা বাবু ফিরে ফোন করতে পারেন আমাকে। ভালো কথা, কিন্তু থাকবো কোথায়? সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে গ্রেট হোটেল আছে শ খানেক টাকায়, কিন্তু সেখানে থাকা কি এই অধুনা একজিকিউটিভের শোভা পায়? বলতে হয়নি সেকথা, শ্রীবিদ্যা নিজেই জানালেন ক্লায়েন্ট অফিসের পাশেই এক খানা ভালো হোটেল আছে, নাম হোটেল রঞ্জিৎ, সেখানেই থাকতে, কারন তাতে আমার যাতায়াতের সুবিধে হবে। অতীব সুপরামর্শ, অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন টা রাখলাম, তারপর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম প্রি-পেড ট্যাক্সির লাইনে।

রঞ্জিতের ভাড়া দাঁড়ালো একশো সত্তর, স্লিপে গাড়ীর নম্বর দেখে খুঁজে নিয়ে সটান উঠে পড়লাম ব্যাগ সুটকেস নিয়ে। ড্রাইভার নেই, হয়তো হিসু করতে গেছে। বসে আছি, আর মনে মনে গাল পাড়ছি দুনিয়ার সবাইকে, বাঁ দিকের জানলা দিয়ে সাদা জামা খয়েরী প্যান্ট পরা একটা লোক এসে বলল সোলুঙ্গে সার। আমি কিচ্ছু কিনবো না, আমার গাড়িও বুক করা, আমি বুক চিতিয়ে বললাম থ্যাঙ্ক ইউ, নট নীডেড। লোকটা আবার হেসে আরো একটু নরম সুরে বলল ইন্না স্যার, সোলুঙ্গে? আমি এবারে বিরক্ত। শালা, আচ্ছা জ্বালা তো? নেব না বলছি, তাও খোঁচাচ্ছে? খেঁকিয়ে উঠলাম আই টোল্ড ইউ আই ডোন্ড নীড এনিথিং, ডিড্‌ন্ট আই? লোকটি হাতের ঝাড়নটা লম্বা ভাঁজ করে কলারের ওপরে চাপালো, তারপর ড্রাইভারের দরজা খুলে, গাড়ীর চাবি পকেট থেকে বের করে চাবির খোপে লাগিয়ে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বলল সোলুঙ্গে সার?। আমি মিনিট খানেক নিলাম ব্যাপারটা বুঝতে, তারপর একবার মুচকি হেসেই আবার গম্ভির হয়ে গিয়ে বললাম হোটেল রাঞ্জিৎ

সোলুঙ্গে সার এর বয়স বছর পঁয়ত্রিশ, নাম যথারীতি রাজু আমি এর আগে দুবার, আর পরে অসংখ্য বার দক্ষিন ভারতে গেছি, অন্ততঃ দুশো বার গাড়ী নিয়েছি, এর মধ্যে বেশ পাঁচ ছয় বার ছিল রহিম, একবার আলতাফ, বার দুয়েক রঘু, একবার মুরুগান আর একবার মীনাসুড্ডি, কিন্তু বাকি সব বার আমার বাহন চালকের নাম রাজুই হতো। এই রাজুদের গেঞ্জি-জাঙ্গিয়াই আমাদের এখানে পরা হয় কিনা তা বলতে পারবো না, কারন এরা গেঞ্জি পরেনা, সবাই নেটের ছকোনা ফুটো ওয়ালা হাত কাটা অন্তর্বাস পরে, ওপরে ইনভ্যারিয়েব্‌লি সাদা জামা, সামনে পকেট। নিম্নাঙ্গে কেউ ফুল প্যান্ট, কেউ বা মালকোঁচা মারা লুঙ্গির মতো করে পরা সাদা ধুতি। রাজু সারা রাস্তা গল্প করলো, আমিও করলাম, যদিও একে অপরের কথা বোঝার ঝামেলা দুজনেই করিনি। বরং রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম মন দিয়ে। চওড়া রাস্তা, কোথাও ভাঙ্গা নেই, কুচকুচে কালো পিচ, ধুলো নেই, মাঝে সাদা লাইন দেওয়া, সবাই নিয়ম করে লাইনের এপার দিয়ে যাচ্ছে। ত্যাঁয়ত্রিস ডিগ্রীতেও স্কুটারের পিলিয়ন রাইডারের মাথায় উলের স্কার্ফ, ট্রামের মতো দু খোপ ওয়ালা বাস, এমনি বাস ও আছে, সবুজ রঙের, তাতে জানলায় কাঁচের বদলে তাঁবুর কাপড়ের খড়খড়ি লাগানো। আর আছে অসংখ্য অটো, মিটার দেওয়া। বেশ কিছু লম্বা আর উঁচু বাস গেলো, তার চারিদিকে লাইট দেওয়া, লং রুটের হবে, ঝকঝকে। গোটা কয়েক ট্রাক পেরিয়ে গেলো, মস্ত লম্বা, অশোক লেল্যান্ডের, তাদের একটার সামনে ইংরেজিতে লেখা ইয়েস উই ইয়েম ট্রান্সপোর্ট (Yes Wee Yem) – বুঝলাম মালিকের বা তার ছেলে-মেয়ের, অথবা শ্বশুরের, শর্ট নাম SVM,  তার নামেই নাম। অনেক দোকান দুপাশে, কোনো দোকানেই ঠিকানা, যায়গার নাম, কিছুই দেওয়া নেই। একটা সিগারেট বের করেছি, ধরাতে যাবো, রাজু বলল সার, রাঞ্জিথা হোটেলা ইঙ্গে সার

রাজুকে টা টা করে রাঞ্জিথাতে ঢুকলাম। ভালো হোটেল, ঝকঝকে চকচকে। ডবল বেড সিঙ্গল অকুপ্যান্সি, ইয়েসি বারশো, নন ইয়েসি আটশো। ইয়েসিই নিলাম, যা পচা গরম! কার্ড অর ক্যাশ? কার্ড। কার্ড টা চাইলো একবার, কি সব দেখে কাকে একটা ফোন করে কি সব বলল, তারপর ফেরত দিয়ে দিলো। রুম এ ঢুকলাম বেশ ভালো রুম এমাথা থেকে ওমাথা কার্পেট, সুন্দর সাদা চাদর, বালিস, বাথরুমে বাথটাব, ঘরে সোফা, টি টেবিল। চা চলে এলো একটু পরেই, খেতে খেতে প্রথমে বাড়িতে খবর দিলাম, তারপর শ্রীবিদ্যাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমি রঞ্জিৎ-এই উঠেছি, রুম নাম্বার দুশো বারো। রাতের খাবার আনিয়ে নিলাম, ফ্রায়েড রাইস, ব্ল্যাক ডাল, চিকেন চেট্টিনাড, স্যালাড। রাত সাড়ে এগারটায় রামাকৃষ্ণান ফোন করলেন। উনি কালকে থাকছেন না, কিন্তু অফিসে জি নাগারাজু থাকবেন, তিনিই সমস্ত বন্দোবস্ত করবেন। সে নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে হল না তখন, কালকেই দেখা যাবে, কারন স্টার মুভিসে একটা অদ্ভুত ভালো ছবি প্রথমবার দেখছিলাম তখন, কিয়ানু রীভসের নাম আ ওয়াক ইন দ্যা ক্লাউডস। ছবি শেষ হল, মনটা উদাস হয়ে গেলো, বউকে ফোন করতে ইচ্ছে হল কিন্তু এতো রাতে সামনের দোকান ডেকে দেবে না বলে ক্ষান্ত দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিত্যকাজ সেরে আ ওয়াক ইন ইন দ্যা ক্রাউডস শুরু হল। এক হাতে একটা ফাইল, অন্য হাতে একটা চিরকুট, তাতে লেখা এপেক্স প্লাজা, নুঙ্গাম্বক্কম। যাকেই দেখিয়ে জানতে চাই এটা কোথায়, সবাই এমন করে পালায় যেন ভিক্ষা চাইছি। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেলো তো? একটা দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলাম। দোকানদার তিনবারে উইলসা?, প্যাকেটা?, ঊর প্যাকেটা? জিগ্যেস করে তবে সিগারেট দিল, কিন্তু চিরকুটটা দেখাতেই এক গাল হেসে বলল ইংলিস তেরিয়াদে সার। শালা, ইংলিশ, সেটা বোঝে, কিন্তু জানে না? ন্যাকামি যত্তো! ভাবছি হোটেলে ফিরে গিয়ে অফিসে ফোন করবো, সামনে ল্যান্ডমার্ক বলে একটা দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম। বেশ বড় দোকান, একদিকে তার মিউজিক স্টোর, অন্য দিয়ে খেলনা, বই ইত্যাদি। সেখানে একটি মেয়েকে জিজ্ঞ্যেস করলাম এপেক্স প্লাজা চেনো? মেয়েটি বলল হোয়াই নট? দিস ইস এপেক্স প্লাজা ওয়ানলি সার! বোঝো ব্যাপার!

ওই বিল্ডিং এর দোতলায় অফিস আমার ক্লায়েন্টের। সিঁড়ি দিয়েই উঠলাম। সেখানে আবার তামিলভাষী সিকিওরিটিদের টপকে একজন বছর চল্লিশের কড়া ধাতের রিসেপ্সনিস্ট মহিলার কাছে গিয়ে খোঁজ করলাম মিস্টার জি নাগারাজু? ঊনি ইন্টারকমে ডেকে দিলেন, মিনিট খানিকের মধ্যে হাজির হলেন গাজুলা নাগারাজু, আই টি অফিসার। আমার সাথে করমর্দন করে নিয়ে গেলেন নিজের ডেস্কে। মাঝে একটা দরজা ছিল, সেখানে উনি পার্সটা পকেট থেকে বের করে তুলে ধরতেই দরজার লক্‌ খুলে গেলো, আমরা ঢুকে যেতেই ফের বন্ধ। কাজ শুরু হল। মাঝে আমি একটা সিগারেট খেতে গেছলাম, ফেরার সময়ে দরজায় এদিক ওদিক চেয়ে লুকিয়ে আমার পার্স দেখালাম, কাজ হল না, তাই বাধ্য হয়ে আবার রাজু কে ইন্টারকমে ডাকলাম। রাজু দরজা খুলে দিয়ে এবারে আমাকে একটা কার্ড দিলেন আমার নিজের ব্যবহারের জন্য, তখন বুঝলাম এ দরজা মানিব্যাগে খোলে না, ব্যাগে কার্ড থাকলে তবেই খোলে। সেই প্রথম প্রক্সিমিটি কার্ড কাকে বলে দেখলাম।

কাজ শুরু করেছিলাম, কিন্তু খানিক্ষন পরে বোঝা গেলো, আমি যে কাজের জন্যে ওখানে গেছি, ওনারা তার জন্য এখনও তৈরি নন। তিন চার দিন সময় লাগবে। রাজু সাজেস্ট করলেন, আমি বরং এই ফাঁকে পন্ডিচেরির কাজটা সেরে আসতে পারি। আমি ভাবলাম, সেই ভালো। একটু পরে ফাইল পত্র গুছিয়ে ওকে, সি ইয়ু নেক্সট মান্ডে বলে বেরিয়ে এলাম, কালকের গণেশ ট্রাভেলসএর গাড়ীর বন্দোবস্ত করে দিয়েছে এরাই, যদিও পয়সা আমাকেই দিতে হবে। অফিসে ফোন করেছিলাম, খরচাপাতি কিভাবে করবো সেটা জানতে। বস বলল পন্ডিচেরিতে ক্লায়েন্টের তরফের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আসবেন। উনি ব্যাঙ্গালোরের বাঙালী, নাম পিয়া রায়। ওখানের খরচা উনিই দেবেন, সো নো চিন্তা। মহানন্দে একটা পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরা কিনলাম পাশের দোকান থেকে, রোল ভরে নিলাম ক্রেডিট কার্ডে। পরের দিন ভোরে পন্ডিচেরি। হোটেলে পেমেন্ট করার সময়ে ক্যাশেই করে দিলাম, অল্প টাকার মামলা!

পন্ডিচেরির দিন কটা ঘটনাবহুল নয়। পিয়া এলেন, আদতে কলকাতার মেয়ে, বালিগঞ্জের, চাকরিসুত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন, বাবা মা কলকাতাতেই। এখনো বিয়ে করেন নি। আমারই বয়সী, ইন ফ্যাক্ট একটু ছোটও হয়তো, বেশ বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেলো। ওখানে থেকে চেন্নাই এলাম একসাথেই। ফেরার পথে মহাবলিপুরম, ওদের ভাষায় মামাল্লাপুরম, সেটাও দেখে নিলাম চট করে। দিন তিনেকে চেন্নাইয়ের কাজ গুছিয়ে আমার কলকাতায় ফেরার দিন চলে এলো। অফিস থেকে হোটেলে ফেরত এলাম, চেক আউট করতে হবে এবারে। পিয়াও ফেরত গেলেন গেস্ট হাউসে, ওনার ফ্লাইট পরের দিন ভোরে, তাই সন্ধ্যেয় একটু কেনা কাটা করবেন বললেন। সন্ধ্যের মুখে গাড়ী এসে রিপোর্ট করলো, ব্যাগপত্র নিয়ে নিচে নামলাম, ফাইন্যাল পেমেন্ট করে বেরিয়ে পড়বো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। হাজার ছয়েক বিল হয়েছে তিন দিনে, পামেন্ট করবো ক্রেডিট কার্ডে। রিসেপশনের ভদ্রলোক বার কয়েক চেষ্টা করলেন কার্ড টা নিয়ে, তারপর বললেন সার্ভিস ডিনায়েড সার! বলে কি রে? টাকা পাবো কোথায়? খুব জোর হাজার টাকা ক্যাশ আছে পকেটে। আগের বার থাকার সময়েও তো ক্যাশ দিয়েছি, পন্ডিচেরি যাওয়ার গাড়ী ভাড়াও দিয়েছে, পাঁচ হাজার টাকাই তো, কতদিন আর যাবে? একবার ভাবছি ঘোষ বাবুর মতো বলবো নাকি - ভাইটি, ফান্ড নেই, আর ফান্ড না এলে কিচ্ছু করা যাবে না - কিন্তু সে কথা এরা শুনবে কেন?

অনেকদিন পরে জেনেছিলাম, হোটেলে যতবার আমার কার্ড দেখতে চেয়েছে, ততবারই পাঁচ হাজার টাকা করে ব্লক করে রেখেছিল, তাই ব্যালেন্স ছিল না আর তখন তো আর এখনকার মতো অনলাইন ডেবিটের সুবিধে ছিল না। যাই হোক, সে তো পরে। তখন তো নাজেহাল অবস্তা। কি করি? ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন করলাম, নাগারাজু ধরলেন না। রামাকৃষ্ণান তখনো ট্যুরে। পিয়া বেরিয়ে গেছেন অফিস থেকে। কি করবো? ঘামছি আর ভাবছি। কলকাতায় আমার অফিসে ফোন করলাম। সবাই বেরিয়ে গেছে। আবার ক্লায়েন্ট অফিসে ফোন করলাম, শেষ চেষ্টা। আপনাদের গেস্ট হাউসের নাম্বার আছে? মহিলা বললেন চেন্নাইতে ওনাদের তিন খানা গেস্ট হাউস, কোনটা চাই। তিনটেরই নাম্বার নিলাম। সৌভাগ্য আমার, প্রথমটাতেই যিনি ধরলেন, তিনি হিন্দি বোঝেন। তিনি কনফার্মও করলেন পিয়া রায় ওখানেই উঠেছেন, এবং এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন, পায়ে হেঁটে। সর্বনাশ! ভাইয়া, থোড়া বুলা দো ঝটাপট্‌, হিঁয়া আগ লাগ গেয়া! উনি ফোন নামিয়ে রেখে ছুটলেন, পিয়াকে ধরে আনলেন ফোনের কাছে। বললাম সব বৃত্তান্ত, পিয়াকে। উনি বললেন টাকা নিয়ে চাপ নেই, কিন্তু গাড়ী নেই, আসবেন কি করে? আমি হোটেলের লোকদের সবিনয় অনুরোধ করলাম, সুটকেসটা বন্ধক রেখে আমাকে কি একটু ছাড়া যায়? ওনারা কিন্তু কিন্তু করছিলেন, কিন্তু তারপর কি ভেবে যেন ছেড়ে দিলেন যাহোক। আমি গাড়ী নিয়ে রাস্তা চিনে গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম, পিয়া অপেক্ষা করছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন। হোটেলে পৌঁছে নিজের ক্রেডিট কার্ড দিলেন, পেমেন্ট হল, আমি ওই গাড়ী নিয়েই বেরিয়ে গেলাম, পিয়াকে নিজের দায়িত্ত্বে রেখে। যোগাযোগ নেই আজকাল আর, কিন্তু সত্যি বন্ধু বললে লিস্টে একদম ওপরের দিকে পিয়ার নাম থাকবে, সেটা হলফ করে বলতে পারি।

চেক ইন কাউন্টারে যখন পৌঁছেছি, তখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেন ছাড়তে আর মাত্র দশ মিনিট দেরি। আমাকে পাত্তা দেওয়ার কথা না, কিন্তু অল্প ডিলেড ছিল বলে এক ভদ্রলোক টিকিট টা হাতে নিয়ে খুব ধমকা ধমকি করতে লাগলেন। আমি দেখলাম উপায় নেই, কাঁদো মুখ করে পরিস্কার বাংলায় বলতে লাগলাম কাকু, খুব ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না, বিশ্বাস করো! ভদ্রলোক একটু থমকে গিয়ে বললেন নো ইংলিসা? আমি আবার বাংলায় ফুল ফেসিয়াল এক্সপ্রেশান দিয়ে বললাম জানলে কি আর এই অবস্থা হয়? তুমিই বল? ভদ্রলকের কিছু বুঝলেন কিনা জানিনা, কিন্তু বাংলা শুনে রাগ কমে গেলো ঝপ করে, বললেন ঊও কে, ওয়ানলি লাস্ট টাইম, আদার টাইম বোরডিং মুড়িয়াদে! তারপর বোর্ডিং কার্ড প্রিন্ট করে ধপাস করে একটা স্ট্যাম্প মেরে বললেন রান, দাউরো! আমি দাউরাতে দাউরাতে বাসে উঠলাম, বাস ছেড়ে দিল। প্লেনে উঠে যখন বসলাম সিটে, তখনো ঘামছি। কলকাতায় ল্যান্ড করার পরে মনে হল যেন তিন দিন বাথরুম চাপা ছিল, এই রিলিজ হল।

তখন কে জানতো যে তার এক মাস পরেই আবার সেই চেন্নাই যেতে হবে? আর সেই চেন্নাই ভালোও লাগবে? সে গল্প এর পর।