Sunday, October 20, 2013

বোড়ে

বোড়ে

পুরন্দর খাঁর বংশধর হলে সাহস আর বুদ্ধি যে বেশী হবেই, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ কেবল বোকারাই করবে। সাহসের কথা বললেই শঙ্কর কাকুর ঘটনা মনে পড়ে রাতের বেলায় তিন চার রকম অস্ত্র নিয়ে ঘুমোতে যেত, বেড়ালের ভুত আক্রমন করলে যাতে কোনভাবেই পরাজয় স্বীকার না করতে হয়। আর বুদ্ধি? সে দূর ও নিকট, আমাদের বংশে দুইই আছে, চাঁদের শোভার মতো। তবে ভাবনা কিসের? ভাবনা যুদ্ধ লাগলে। কারন পুরন্দর খাঁর বংশে সেনাপতি অলমোস্ট সবাই, বোড়ের বড়ই অভাব এই বাড়িতে। তাই অর্ডার করার লোক অনেকই, মানার লোক খুঁজে বের করতে হয়। তবে সেনাপতির ও গ্রেড আছে, সেই হিসেবে বড়, মেজো, সেজো, , ফুল থেকে নিয়ে ছোট অবধি সবারই অলিখিত গ্রেডিং করা আছে। এই বিভিন্ন গ্রেডের সেনাপতি দের আমি কখনো বাইরে দেখিনি তা নয়, তবে সব্বাইকে এক জায়গায় দেখার সেরা জায়গা নোহারী।
সেনাপতিদের নিয়ে আলাদা করে লেখার অবকাশ তো রইলই। কিন্তু তার মাঝে রেয়ার কমোডিটি একজন বোড়ের কথা না লিখলে খুব অন্যায় হবে। সে আমাদের অসীম কাকু।
উপেন্দ্রনাথ এর চতুর্থ ভ্রাতা নোহারীর মায়া কাটিয়ে কলকাতায় গেলেন ডাক্তারি পড়তে। রূপবান পুরুষ তিনি, ডাক্তারি পড়া তো হলই, কিন্তু মদনদেবের ছোঁড়া তীরের খোঁচা তিনি অ্যাভয়েড করতে পারলেন না, ইচ্ছাও যে তেমন ছিল, তা নয়। অতএব বীর নৌসেনাপতি পুরন্দর খাঁর বংশধর অক্ষয়কুমার বসু যাবতীয় বীরত্ব জলাঞ্জ্বলি দিয়ে বিবাহবন্দি হলেন কলকাতার এক বনেদি বাড়ীর সুন্দরী বালিকার কাছে। সেটাও তেমন আহামরি কিছু ব্যাপার নয়, এমন হয়েই থাকে, কিন্তু সঙ্গে যেটা হল, সেটা হল শশ্রুপিতা নিজের আদরের মেয়েকে কিছুতেই চোখের বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলেন না, নোহারী হাজার হলেও গ্রাম, সেখানে ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার হাওয়া তেমন পৌঁছয়নি, তাতে সন্দেহ নেই, তাই সেখানের জমিদারের মাটির বাড়ীর থেকে মেয়েকে কলকাতার একতলা পাকা বাড়ীতেই থাকতে বলাটা শ্রেয়। অক্ষয়কুমার দ্বিতীয় বার বন্দি হলেন, এবারে গৃহ-জামাতা হয়ে।

এই পরিবার নিয়ে দু এক কথা না বললেই নয়। বেলেঘাটার আলোছায়া সিনেমা, যা এখন পাল্টে বিগ বাজার হয়েছে, তার ঠিক পেছনেই অক্ষয়কুমারের নতুন বাসস্থান হল। রাস্তার ওপরে সার দিয়ে চারখানি ঘর। ঘরগুলির একদম বাঁ দিক দিয়ে বাড়ীর এনট্রান্স। ভেতরে ঢুকেই ডানদিকে বারান্দা, সেখানে ওই চারটে ঘরের ঢোকার দরজা। বারান্দার সামনে উঠোন, তারপর একদিকে রান্নাঘর, অন্যপাশে বাথরুম ও পায়খানা। বারান্দায় সার দিয়ে ওপেন র‍্যাক, তাতে খবরের কাগজ, পুরনো খাতা ও বইয়ের ওপরে পুরু ধুলোর আস্তরন। বাথরুমে যে মাকড়সারা জাল বুনেছিল, তাদের কম সে কম ষোল হাজার জেনারেশন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ঝুল সেই তেমনি রয়ে গেছে। উঠোনের শ্যাওলায় রোলার স্কেট ছাড়াই রোলার স্কেটিং করা যায়। বাথরুমের বাল্বের ফিলামেন্টটা শুধু দেখা যায়, হয়ত এডিসন নিজেই তৈরি করেছিলেন সেই বাল্ব, তাই এখনো কাটেনি। বাথরুমের ভেতরে চৌবাচ্চা, তার  পাড়ে রাখা থাকে একখানি এলুমিনিয়ামের মগ। তার তলার দিকটা কোন এক সময়ে হয়তো ফ্ল্যাট ছিল, কিন্তু আছাড় খেয়ে খেয়ে ক্রমশঃ গোলাকৃতী ধারন করেছে। বাথরুমে ঢুকে যদি ওই মগ একবার টাচ করে ফেলা হয়, তাহলেই চিত্তির, কমসে কম পনেরো মিনিট লাগবে ওটাকে ব্যালেন্স করে বেরিয়ে আসতে।
এই বাড়িতেই বড় হচ্ছিল অক্ষয়কুমারের চার ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা সবাই ভীষণভাবে কল্কাত্তাইয়া ঢঙ্গে হালুম গেলুম করে, ছ কে চ বলাটাই তাদের স্টাইল, আর আজীবন কুপমন্ডুক থাকায় কলকাতার বাইরের কোন কিছু সম্বন্ধেই তেমন ধ্যান ধারনা নেই তাদের। এরা কোনদিন পরিক্ষায় ফেল করে না, তবে কেউ যদি জানতে চায় কেন এরা আগের ক্লাসেই গত তিন বছর আছে, তখন উত্তর আসে, এরা ক্লাসে পাকা হওয়ার জন্য রয়ে গেছে। নোহারী যে মঙ্গলগ্রহে, সে ব্যাপারে এরা সবাই নিশ্চিত।
বড় ছেলে বলাই। তিনি নিজে ষাট পেরিয়েও সমবয়সি সুনীলের বয়স তার ছেলের সমান ভাবেন। উৎপল দত্ত যেভাবে ছবি তে অবাক হতেন, বলাই ও তেমনি খেজুর গুড় দেখলে অবাক হন, গঙ্গা ছাড়া নদী হয়না বলেই তাঁর ধারনা, জঙ্গল বলতে ভবানিপুর আর পাহাড় বলতে ধাপা, এই নিয়েই থাকেন। মেজ জন কালু, তিনি একটি বাংলা ছায়াছবির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সহকারি ছিলেন, তাই তাঁর চিন্তা ভাবনা অবশ্যই অন্য ধারার। ছোট জন অচিন্ত্য, ওরফে মাধু বা মাদু, তিনি সখের সাহিত্যিক, বই লেখার সময় তাঁর নাম হয়ে যায় অচিন্ত্যেশ বসু, একবার একটা হাভানা চুরুট উনি ছ দিন ধরে খেয়েছিলেন, এ আমাদের অনেকেরই নিজের চোখে দেখা। বোনদের আমি দেখিনি, তেমন বলতে পারবো না, তবে তাদের ছেলেদের দেখেছি, তাদের নিয়েও ডকুমেন্টারি বানাবার কথা ভেবেছিলাম এক সময়ে।
এরই মাঝে, সেজ জন, অসীম কাকু, কেমন যেন আলাদা। বাকিদের যখন নোহারীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ, অসীমকাকু নোহারী আর সেখানের দুর্গা পুজোকে একদম আঁকড়ে ধরেছিল যেন। বাকিরা যে নোহারী কখনো আসতেন না, তা নয়। কস্মিন কদাচিৎ মাতা ঠাকুরানির কৃপা হলে তাঁরা আসতেন দল বেঁধে, তবে সেই আসা কিছুটা দেখন্‌দারি আর কিছুটা সার্কাস দেখার মেন্টালিটি নিয়ে। মাদুকাকা কিছুটা বাইরে এর, আস্তে আস্তে নোহারীকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল তার, কিন্তু অসীমকাকু? সে অদ্ভুত ভাবে প্রহ্লাদ এর মতন নোহারী প্রেমিক, আর বাকি বংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা তার চোখে পড়ার মতো। ডেডিকেশন কি জিনিস, সেটা অসীমকাকুকে দিয়ে উদাহরন দেওয়া হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, অসীমকাকু সেনাপতি নয়, কিন্তু সবথেকে বেশী কাজের মানুষ এই অসীমকাকুই।
অসিমকাকু চাকরি করতো কাস্ট্‌মস এ। তার সুবাদে নানা ভাবেই কালো টাকা রোজগার এর উপায় ছিল তার। কিন্তু কোনদিন কারুর থেকে অসৎ উপায়ে এক পয়সাও নেয়নি সে। সিগারেট খেতে ভালোবাসতো খুব। বিদেশি সিগারেট পেলে নিয়ে আসতো ডক থেকে, নিজেও খেত, সমবয়সী দাদা ভাইদের খাওয়াতো, একটু বড় ভাইপো/ভাগ্নে দের, মানে আমার দাদাদেরও খাওয়াতো। বরাবরের সঙ্গী ছিল ষাটের দশকে কেনা একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ, সঙ্গে বাঁধা একটা জলের বোতল, আর তার সঙ্গে বাঁধা একটা হুইশেল। হুইশেলটা কেন থাকতো সেটা জানতে চাওয়ায় একবার বলেছিল ওটা নাকি সিকিওরিটি মেজার, কিন্তু কিসের সিকিওরিটি, সেটা কেউ জানতে পারেনি। অসীমকাকুকে রাগিয়ে দেওয়া যেত খুবই সহজে, আর বিয়ের কথা বললেই সে আলোচনা চলতেই থাকতো।
আমাদের পুজোর অনেক নতুন জিনিসই অসীমকাকুর অবদান। নোহারীতে প্রথম একসঙ্গে একশো আট প্রদীপ দিয়ে আরতি করার জন্য অসীমকাকু কলকাতার থেকে বানিয়ে আনলো একছড়ায় একশোআট প্রদীপের স্ট্যান্ড। ডাকের সাজ কি জিনিষ, তা নোহারীকে অসীমকাকুই দেখিয়েছে। ঠাকুরের নতুন চামর লাগবে? অসীমকাকুই ভরসা। নতুন ডে লাইট লাগবে? অসীমকে বল। ঠাকুরের জন্য কিং সাইজ হাতপাখা? সেও অসীমকাকু। এমনকি আমাদের পুজোতে কুমারী পুজোর চল ও অসীমকাকুই করেছে, বেলুড় মঠের ঢঙ্গে। কিন্তু এই সবই করেছে নিজে নিজেই কাউকে কোনদিন অর্ডার করতে দেখিনি অসীমকাকুকে।
প্রত্যেক পুজোয় আমাদের অ্যাট্র্যাকশান থাকতো অসীমকাকুর আনা বাজি। মস্ত হান্টার, রঙ বেরঙের হাউই, তুবড়ি, তারাবাতি, এমনি রঙমশাল কি না থাকতো তাতে। আমাদের লাইন করে দাঁড়িয়ে থলের থেকে বের করে দিতো বাজিগুলো, আমরা মহানন্দে পোড়াতাম। হান্টারগুলো কাজে লাগতো অন্ধকার রাস্তায় বিসর্জন দেওয়ার সময়, দিনের আলোর মতো আলো হতো তাতে। গাড়ীতে উঠে ঠাকুর ধরার কাজ দুলালদা, দাদা, ছোড়দা এরা করতো, কিন্তু ঠাকুর জলে নামানোর পরে সেই অসীমকাকু।
আমাদের বংশে অসীমকাকুর সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই বসু বাড়ির ইতিহাস সম্বন্ধে তার রিসার্চ সম্পূর্ণ নিজের টাকায় আর নিজের উদ্যমে সারা বাংলা ছুটে বেড়িয়ে সংগ্রহ করা সে ইতিহাস, নিজের টাকায় ছাপা সেই বংশলতিকা নিয়ে কেউ কেউ দশ টাকাও দিতে চাইতো না তার জন্যে। কিন্তু আজকে আমরা এত কথা যে জানি, তার একমাত্র কারন অসীমকাকু। 
অসীমকাকুর ডেডিকেশন এর আরেক নমুনা দিই আমার ঠাকুমা মারা গেছেন। শ্রাদ্ধ হবে নোহারীতে। আমি একদিন একটা গরুর গাড়ীতে চেপে এমনিই চলে গেছলাম বগড়ী রোড। দেখি ট্রেন থেকে নামলো অসীমকাকু। খালি পা, উস্কো খুস্কো না আচড়ানো চুল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কোমরে বেল্ট এর বদলে নারকোল দড়ি, কারন চামড়ার জিনিস অশৌচের সময় নাকি পরতে নেই। এই ছিল অসীমকাকু।
শেষ বয়সটা খুব কষ্টে কেটেছে অসীমকাকুর। সমস্ত টাকা পয়সা শুনেছি বেহাত হয়ে গেছলো। বছর কয়েক আগে আমার বাবা যখন খুব সিরিয়াস অবস্থায় অ্যাপোলো তে ভর্তি, এক অসীমকাকু ছুটে এসেছিল বাবাকে দেখতে, বেলেঘাটা থেকে পায়ে হেঁটে, কারন তার সব টাকা তখন ভাই, ভাইপো আর ভাগ্নেদের কাছে, তারা কেউ তাকে বাস ভাড়ার টাকাটাও দেয়নি, কিন্ত দেখা তাকে করতেই হবে, তাই হেঁটেই এসেছে, এমনি তার ভালোবাসা। শেষ দুবছর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছলো, অনেক সময়ে দেখে চিন্তেই পারতো না। অবশেষে ঘরের এক কোনায় ভাঙ্গা তক্তপোষে শুয়ে নিতান্ত অনাদরে মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল পুরন্দর খাঁর অন্যতম সেরা বংশধর। আমরা সেই চলে যাওয়ার কথাও জানতে পারলাম সে চলে যাওয়ার মাস তিনেক পরে।
এবারে পুজোতে বিসর্জনের সময় যখন রাস্তার কাদায় জেনারেটার বওয়া ট্র্যাক্টার আটকে গিয়ে আলো পৌঁছল না পুকুর অবধি, হঠাৎ মনে হল, অসীমকাকু থাকলে ঠিক এই সময়ে জ্বলে উঠতো একটা হান্টার, আলোয় আলোময় হয়ে উঠতো চারদিক, আর আমরা অসীমকাকুর ভাঙ্গা গলার সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠতাম বলো বলো দুর্গা মাই কি জয়! আসছে বছর, আবার হবে। অন্ধকার পুকুরের পাশে দাঁড়িয়েও গা টা একটুও ছমছম করলো না এটা ভাবতে গিয়ে, শুধু মনটা আমার কেমন যেন ভিজে ভিজে হয়ে রইল বেশ অনেক্ষন। সেটা মা চলে গেলেন বলে, নাকি অসীমকাকুর জন্য, তা ভেবে দেখিনি আর কিই বা হবে?

জাস্ট যাই

দক্ষিন রাঢ়ী বসু বংশের প্রতিষ্ঠাতা দশরথ বসুর সুখের সংসারের ঈশান কোনে সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে এলো যখন বিষম ঝগড়া লাগলো তাঁর দুই ছেলে কৃষ্ণ আর পরমের। কায়স্থরা শ্রেণী হিসেবে মুলত তথ্য রক্ষক ও তথাকথিত চিত্রগুপ্তের বংশধর হলেও মূল শেকড় সেই ক্ষত্রিয়, আর বসুদের গোত্রও সেই রাগি মুনি গৌতমের, তাই বীর রসের বাড়বাড়ন্ত, ঝগড়া বাড়তেই লাগলো, শেষে পরম রাগ করে চলে গেলেন পূর্ববঙ্গে, সেখানের জমিদারির ভাগ নিয়ে, সে জায়গার নাম ময়মনসিংহ, সেখানেই ঘর সংসার পেতে বসলেন। কৃষ্ণ রয়ে গেলেন নদিয়াতেই, খানাকুলের কাছে, সেখানেই তাঁর বংশবৃদ্ধি হতে লাগলো। প্রায় ছয় পুরুষ পরের কথা, ত্রয়োদশ শতাব্ধীর কোনো এক সময়ে, বংশের ছোট ছেলে মুক্তিনাথ বাড়ী ছেড়ে পাড়ি দিলেন ভাগ্যান্বেষণে, সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। মালঞ্চ গ্রামের কাছে পত্তন করলেন তাঁর বসত।
ভাগীরথী তখন বইতো অন্য পথে, সে পথের ধারে যেমন ভালো চাষবাস, তেমনি ভালো বাণিজ্য, তাই মুক্তির পরিবার খুব অল্প সময়েই বিত্ত্বশালী হয়ে উঠল। পৌত্র মহীপতি নাম কিনলেন তাঁর মেধা আর সুবুদ্ধির জন্যে, গৌড়ের সুলতান মহীপতির উপাধিকরন করলেন, নাম দিলেন সুবুদ্ধি খাঁ। মস্ত জাগীর দিলেন দানে, মহীপতির বসতের পাশেই, সেই জাগীরের নাম হল সুবুদ্ধিপুর। বংশ বৃদ্ধির ব্যাপারেও কারপন্য করেন নি মহীপতি, দশটি পুত্র ছিল তাঁর। এরই মধ্যে চতুর্থ পুত্র, যিনি উপাধি পেয়েছিলেন ঈশান খাঁ, হলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরি, তিনিও স্থান পেলেন সুলতানের দরবারে তাঁর মেধার জন্যে। তাঁর তিন পুত্র, তিনজনেই নিজগুণে যশস্বী, কিন্তু তার মাঝে মধ্যম জন, গোপীনাথ, সব্বাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। তাঁর প্রভূত মেধা ও ক্ষত্রিয় রক্ত একাকার হয়ে গেল, সুলতান হুসেন শাহ্‌র দরবারে তিনি নৌসেনাপতির পদে স্থলাভিষিক্ত হলেন, উপাধি পেলেন পুরন্দর খাঁ। গৌড় থেকে সুন্দরবন অবধি চলতে লাগলো তাঁর মান্দার বোট, বর্মি হানা বন্ধ হল সম্পূর্ণ ভাবে। পুরন্দর বীর তো ছিলেনই, সামাজিক সংস্কারের কাজেও মন দিলেন তিনি, বল্লালি প্রথা ভেঙ্গে কুলিন-মৌলিক বিবাহ চালু করলেন দেশজ ডারউইনের ধারায়, ঠগি আর বর্গি রোখার নানারকম বন্দোবস্ত করলেন, রাস্তা ঘাট তৈরিতে খরচা করলেন প্রভুত অর্থ, এক মাইল লম্বা দিঘি কাটালেন, নাম খানপুকুর।
কালের খেয়ালে ভাগীরথী পরিবর্তন করলো পথ, কলকাতার আদি গঙ্গার একটুখানি রয়ে গেলো ক্ষীণকায়া হয়ে, যেটুকু টলি সাহেবের নালার সাথে জোড়া ছিল, মূল নদীস্রোত চলে গেলো অনেক পশ্চিমে। বদ্ধ জলে মহীনগরে দেখা দিল মহামারী, বসু পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হলেন, নতুন বসত তৈরি হল সাত কোদালিয়া তে। ততদিনে গোরারা বসত করেছে কলকাতায়, এক ভাই চলে এলেন উত্তর কলকাতায়, বাগবাজারের কাছে, একজন বসত করলেন ভবানীপুর গ্রামে, আরেক ভাই কলকাতাতে থাকলেও তাঁর মন বেরিয়ে পড়লো সুখের খোঁজে, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। এই ভাই, রামরাম বসু, বংশের প্রথা মেনে মুন্সীর কাজ নিলেন গোরাদের কাছে, ফারসী আর ইংরেজিটা শিখে নিয়েছিলেন, সেটা কাজে দিল। উইলিয়াম কেরির সান্নিধ্যে রমরমা বাড়ল তাঁর, জমিদারির পত্তন হল শীলাবতীর ধারে, আরাবাড়ির জঙ্গল কেটে, সে গ্রামের নাম নোহারি।
বুবাই হিষ্ট্রি একদমই ভালবাসে না। আমিও যে বাসি, তা মোটেই নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন মনে অনেক প্রশ্ন আসে অনেক কিছু নিয়ে, বিশেষ করে আমাদের পরিবারের কিছু লোকের কিছু অদ্ভুত এক্টিভিটি নিয়ে, ইতিহাসের কাছেই তার অনেকগুলোর উত্তর পেয়েছি আমি। তাই একটু একটু ইতিহাস ঘাঁটার শখ কখনো কখনো হয় বইকি। অবশ্যই অসীমকাকুর মতো নয়, যে কিনা ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে বিয়েই করল না, কিন্তু ওই অসীমকাকুর রিসার্চ থেকেই এর অনেক তথ্য পেয়েছি, সে কথা অস্বীকার করবো না।
নোহারীতে বসতবাড়ী তৈরি হল শীলাবতীর থেকে প্রায় এক যোজন দুরে, মুল নোহারী গ্রাম থেকে একটু পূর্বে, একটি ছোট্ট টিলার ওপরে। চাষের জমিতে জল আনার জন্য খোঁড়ানো হল মস্ত খাল, পূর্বপুরুষের নামে তার নাম রাখা হল পুরন্দর খাল। বাড়ির পাশেই তৈরি হল বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির ঘরানার আদলে শিব মন্দির ও সূর্য মন্দির। কৃষ্ণের দোল খেলার জন্য তৈরি হল দোল মন্দির, তাতে দোল খেলা হতো দোলপূর্ণিমার পরের পঞ্চমীতে। দামোদর এলেন ঘরে, তিনিই হয়ে গেলেন বসুদের কূলদেবতা, নতুন মন্দির তৈরি হল তাঁর জন্যে। অবশেষে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে, তৈরি হল আমাদের প্রথম দুর্গা মন্দির। তিন দরজা দেওয়া সে মন্দির চারচালা, ভেতরে মূর্তি থাকতো কিনা জানা যায়না, শুনেছি তখন পুজো হতো ঘটে। দামোদরের সন্ধ্যারতির মুড়ি বাতাসা, দুর্গাবাড়ীর ঢাক বাদ্যি, বাবুদের খাজাঞ্চী খানার হই হট্টগোল, সব মিলিয়ে এই জায়গাটাই হয়ে উঠলো একটা তিরিশ মাইল ব্যাসের বৃত্তের নার্ভ সেন্টার। নাম হয়ে গেলো বড় নোহারী, মূল নোহারী ততদিনে ছোট নোহারী বলেই সবাই ডাকছে।
প্রকৃতির নিয়মে ধীরে ধীরে শীলাবতী এগিয়ে এলো বসুবাড়ির দিকে, তাই সাঁওতাল পরগনার দলমাতে বৃষ্টি মানেও বসুবাড়ি থই থই, এমনই হতে লাগলো বার বার। উপায়ন্তর না দেখে বাড়ির কর্তারা ঠিক করলেন আবার বসত পাল্টাতে হবে। আরো কিলোমিটার খানেক ভেতরে আবার একটা উঁচু জায়গা দেখে তৈরি হল নতুন বসত। এও প্রায় দুশোকুড়ি বছর আগের কথা। দামোদর এর প্রতিপত্তি ততদিনে প্রতিষ্ঠিত, তাই তাঁর জন্যে তৈরি হল মস্ত মন্দির, এবারে আর চারচালা নয়, পঞ্চরত্ন, দক্ষিন মুখি, মূল কারুকাজ করা চুড়ার চার পাশে আরো চারটি ছোট চুড়া, তাতেও কারুকাজ কম নয়। দুই দিক খোলা সেই মন্দিরের, সামনের দিকে দুইখানা কারুকাজ করা পিলার, তার দুই পাশে ছোট আর্চ দেওয়া প্রবেশপথ, মাঝে মূল প্রবেশপথ, সেটাও আর্চ দেওয়া, কিন্তু অন্য দুটোর থেকে একটু উঁচু। একপর একফালি বারান্দা, ফুট দুয়েক চওড়া, তারপর মেন অ্যাট্রিয়াম, ওপরে আর্চড সিলিং, সেখানে কাঠের সিঙ্ঘাসনে আসীন দামোদর রূপী গনেশ। সেই অ্যাট্রিয়ামে ডান দিকের দরজা দিয়েও ঢোকা যায়। দামোদর মন্দিরের বাঁ দিকে তৈরি হল মস্ত দুর্গামন্দির, এক দেওয়াল তার দামোদর মন্দিরের লাগোয়া, কিন্তু দুর্গামন্দির ফুট পনেরো এগিয়ে। দুর্গামন্দিরের শুরু বরাবর উঁচু পাঁচিল দেওয়া হল দামোদর মন্দির কে ভেতরে রেখে, মাঝে দরজা ঘর, তার ছাদে নহবৎ বসার ব্যাবস্থা। দামোদর মন্দিরের পেছনে বসতবাড়ী। দুর্গামন্দির তৈরি হল তখনকার কলকাতার দালানবাড়ীর আদলে, আধা মুসলিম আধা ইউরোপীয় ঘরানায়, তার কথা আগেই বলেছি। সেখানেই মস্ত কাঠামো তৈরি করা হল শালকাঠের, তাতে মূর্তি গড়া হল লোক এনে, মূর্তি পুজোর সেই চল এখনো চলছে। আর বাড়ীর কাছে জলের জন্য নতুন খাল কাটানো হল, তার নাম নরু খাল। পুকুর কাটানো হল নতুন করে, প্রথমে গুহদের নামে, ক্রমে তার নাম গোপুকুর হয়ে গেলো, পাশেই কাটানো হল পুন্য পুকুর, আবার সবার পরে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে কাটানো হল নতুনপুকুর। ব্রাহ্মণরা তো ছিলেনই, গ্রামে এসে এবার বসত করলেন রায়রা, দত্তরাও এলেন বিয়ের সুবাদে, পুকুর কাটালেন দত্তপুকুর নামে, সে পুকুরে আজও গ্রামের সব দুর্গাঠাকুর বিসর্জন হয়, এলেন সেনরা। চামড়ার কাজ অনেক, এলো রুইদাসরা। আর কত লোক এসে বাস করা শুরু করলো এখানে, তার হিসেব রাখেনা কেউ, আর এত লোকের মাঝে এই দুর্গাপুজোই এলাকার মূল উৎসবকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো। জমিদারি একটাই, পুজো একটাই। তাই সবাই এখানেই জমায়েত হতে লাগলো পুজোর সময়।
তিন চার পুরুষ পরের কথা, বসুদের ক্ষত্রিয় রক্ত আবার গরম হল, এবারে ঝগড়া লাগলো ছোট আর বড় তরফে। ছোট তরফ আলাদা হয়ে গেলেন। দামোদর একই রইলেন, কিন্তু দুর্গা ভাগ হয়ে গেলেন, ছোট তরফ নতুন মন্দির তৈরি করলেন পাশেই। শাক্ত মতের পুজো তখন গৌরাঙ্গ মতে চলে গেছে, বলি টলি হয় না আর, মাংস খাওয়া বন্ধ পুজোর সময়, রায়দের মন উশখুশ করতে লাগলো। বড় তরফের পুজোকে লোকে ডাকতে লাগলো বড় বসু বাড়ীর পুজো, অন্যটি ছোট বসু বাড়ী। বড় তরফের শ্রীহরি বসুরা পাঁচ ভাই। তাঁর আমলেই বসু বাড়ির সঙ্গে বিয়ের সুবাদে জমি জিরেত অনেক পেলেন কন্যাপণ হিসেবে রায়দের একজন। সেই জমিতে নতুন বাড়ী বানালেন তাঁরা। শুরু করলেন নতুন করে শাক্ত মতে দুর্গাপুজো, আলাদা করে, তাতে ঘটা করে পুজোর তিন দিন ছাগবলি শুরু হল।
এইভাবেই, শুধু নোহারীতেই চালু হয়ে গেলো তিন তিনটে দুর্গাপুজো, যাদের একটার থেকে আরেকটার দুরত্ব ৩০ মিটারের বেশী নয়। সবারই মন্দিরের সামনে আটচালা, তাতে সারাবছর ধান ঝাড়ার কাজ হয়, আর পুজোর সময় লোকসমাগম, রাত্রে যাত্রাগান। জমজমাট হট্টগোল। আরো বেশী, কারন ধারে কাছে আর কোনো পুজো হয়না, সবচেয়ে কাছেরটা যেটা, সেটা হয় বিষ্ণুপুরের রাজাদের বাড়ীতে, তা এখান থেকে প্রায় বিশ ক্রোশ।
শ্রীহরির জ্যৈষ্ঠ পুত্র উপেন্দ্রনাথ, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র নীলরতন, তাঁর একমাত্র পুত্র বিজিৎ, আর বিজিৎ এর একমাত্র সন্তান ঋভু। উপেন্দ্রনাথও পাঁচ ভাই ছিলেন, আর তাঁর পরের জেনারেশন, অর্থাৎ আমাদের বাবাদের জেনারেশনে পুত্র সংখ্যা চল্লিশ এর ওপরে। এই চল্লিশ এর পরের জেনারেশন আমি। শ্রীহরির পাঁচ ভাইদের পরিবারের সকলেই এই পুজোর শরীক। তার থেকে বড় ব্যাপার হল, এঁরা প্রায় সব্বাই এই পুজোতে আসেন। তাই বুবাই এর জেনারেশনেই প্রায় ৩৫০ জন এই পুজোয় আসছে এখন। এছাড়া বন্ধু আছে, বৈবাহিক আত্মীয়রা আছেন, তাই পুজোতে বাড়ীর লোকই পাঁচশোর বেশি। 
ছোট তরফের মস্ত পাকা অট্টালিকা হয়েছে তাও প্রায় একশো বছর হতে চলল, দুর্গামন্দিরও পাকা হয়েছে অনেকদিন। বাবাদের ছোটবেলায় যেখানে ময়ুর এর খাঁচা থাকতো, সেটা ওপেন বারান্দা হয়ে গেছে অনেকদিন, কিন্তু তার রেলিং গুলো আছে এখনো কিছু কিছু, কাঠের, ভগ্নপ্রায়। মরাইটা হাওয়া হয়ে গেছে কোথায়, সেখানে এখন একটা বাথরুম। বাড়ীর পেছন দিকে যেখানে আমার ছোটবেলাতেও ২৫-৩০ টা গরু বাছুর মোষ থাকতো, সেখানে এখন আমরা গাড়ী রাখি। রায়দের আটচালার পরে প্রথমে বড়, পরে ছোটদের আটচালাতেও টিন লেগেছে। জেনারেটার এর পেছন পেছন আশির দশকে চলে এসেছে বিদ্যুতের লাইন। যে স্কুলবাড়ী আমার মেজ জেঠুরা নিজের হাতে মাটি বয়ে তৈরি করেছিলেন, আজ সেই স্কুল তিন তলা, পাকা। গ্রামে রানার নেই আর, পোস্টাপিসের পাশে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল। প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনার কল্যাণে এখন নোহারী অবধি পাকা রাস্তা। কিন্তু হয়ত বা জঙ্গল, দারিদ্র, ভালো রাস্তার অভাব এবং সবথেকে বেশী উদ্যোগের অভাব এই সব মিলিয়েই এই তিনটে পুজো ছাড়া নোহারীর আশেপাশে এখনো কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যে আর কোন দুর্গা পুজো হয়না এখনো।

আমার বড়জেঠুও জমিদারির খাজনা জমা করতে যেতেন অল্পবয়সে। এখন সে জমির খোঁজ কেউ রাখেনা আমাদের জেনারেশনে। কিন্তু পুজোটা আছে। ক্ষত্রিয় মেজাজটা এখনো মাঝে মাঝেই চাড়া দেয়, তখন ঠান্ডা করতে আমাদের বণিতারা প্রথমে মাতৃভাব ও পরে কাজ না হলে সামান্য উগ্রক্ষত্রিয় ভাব প্রকাশ করেন, আর ওমনি আমরা গলে জল হয়ে যাই। আগে দেখতাম বাড়িতে ঢুকতেই মস্ত বড় একটা কাঠের সিন্দুক। তার ওপরে উঠে মাঝের ছোট খোপটা খুলে দেখতাম ভেতরে তিন খানা মর্চে ধরা তরোয়াল, তাতে হাত দেওয়া বারন ছিল। সিন্দুকটা অনেকদিন হল উইয়ের পেটে, সেটার জায়গায় এখন দেওয়াল তুলে একখানা ঘর হয়েছে, তাতে ভঁদুজেঠু থাকে পুজোর সময়। সেই তরোয়াল গুলো কোথায় আছে, তার হিসেব রাখার মতন কার সময় আছে এখন? কিন্তু পুজোটা আছে, আর পুজোতে ঘট আনার পরে এখনো পুরন্দর খাঁ কে মনে পড়ে, যখন দেখি একখানা তরোয়াল আয়নার ওপরে ধরে ঘটের মা কে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই, এক গুরুর কথার মতো বলি, এখনো, পুজোর সময় এলেই, জাস্ট চলে যাই ওখানে।

Saturday, October 05, 2013

আমার গান শোনা

আমার গান শোনা
সেই কোন ছোট্টবেলায় শেখা প্রথম কবিতা হেবি সিড়ি ইয়েফ জী, এই চাই যে, কে এলেভেনো পি, সেটা বড়োদের কাছে বলে খুব বাহবা কুড়োতাম। কিন্তু গানের প্রতি আমার অমর প্রেম জন্ম নিয়েছিল তখন থেকেই, তাই এটাই সুর করে বলতে বলতে হয়ে গেলো আমার প্রথম গাওয়া গান।  সুরটা টুইঙ্কল টুইঙ্কল থেকে ঝাড়া হলেও সেই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ দিইনি বিশেষ। বড়জেঠুমনির ঝাড় খেয়ে অজ্ঞান হওয়ার পরেও গান শোনা বা গাওয়া নিয়ে কোন বাধাকে আমি বাধা বলেই গ্রাহ্য করিনি। এবং গান গাওয়ার বড় প্ল্যাটফর্ম নোহারী। শোনারও বটে। তবে আমাদের বাড়িতে গান শোনা মানে কাউকে গাইতে হবে সেটা, এটাই ছিল নর্ম, কারন মাইক ব্যাপারটার ব্যবহার রায়পাড়ার বাজে ছেলেরাই করে, এরকমই চিন্তাভাবনা ছিল আমাদের। তাই কোথাও কেউ সুযোগ পেলেই আসর বসে যেত, এবং মন জাগো মঙ্গললোকে থেকে হাম তুম হয়ে জন গন মন তে শেষ হতো।
আরও একটা কারনে লোকজনের গান গাওয়া বেড়ে যেত নোহারীতে, সেটা অতি অবশ্য ভাবেই ভুতের ভয়। নোহারীতে ভুতের শেষ নেই, তাই ভয় পাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী, আর ভুত যাক বা না যাক, ভয় তাড়াতে গানের কোন জবাব নেই। বাবাগো মাগো বলে চেঁচাতে হবে না, জাস্ট মনের সমস্ত জোর এক করে, গলার কাঁপুনি টা যতটা সম্ভব কন্ট্রোল করে, প্যান্ট শুকনো রাখার চেষ্টা করতে করতে গেয়ে যাও, সাহস ঠিক ফেরত আসবে। ন কারাত্মক শব্ধ অ্যাভয়েড করাটাই সমীচীন, কিন্তু সেটা তো অত সহজে করা যায়না, তাই সেটাকে নাক বাদ দিয়ে উচ্চারণ করার চেষ্টা করতে হবে, না হলে ভুতেরা সেটাকে শুনে আমাকে নিজেদের লোক ভাবতে পারে। আর অনেকটা একই কারনে রাম তেরি বংশী পুকারে আর হাম তো চলে পরদেশ একই রকম পপুলার, কারন দুটোতেই রাম নাম আছে। পরেরটা বেশি পপুলার, কারন শেষের দিকে একটা বেশ লম্বা টান আছে রামা হো রামা হো রামা হো বলে।
নোহারীতে ভুতের শেষ নেই।  বগড়ী রোডে নেমেছ কি ওমনি মস্ত আমলকী গাছ, তাতে ব্রহ্ম্যদত্যি। কিছুটা ধানজমি পেরিয়ে এগোলে একাড়ে গ্রাম, শুদ্ধ ভাষায় একচক্রনগর, সেখানে ভুত আছে কিনা জানা নেই, কিন্তু ডাকাত আছে। সেটা পেরলে খানিকটা গিয়ে ভুলা, সেখানের বাঁশঝাড়ে ভর্তি ভুত পিঁপড়ের চাকের মতো থিকথিক করছে। সেটা যদি পেরোলে, তো চলে এলো রয়দা, সেখানে আমাদের ফ্যামিলি পুকুর, তাতে মেছো ভুত রাতের বেলায় মাছ ধরে খায় বলে সবাই জানতাম, শুধু শংকর কাকু বলতো ওটা ঐ গ্রামের লোকদেরই কাজ। তারপর কিছুটা ধানি জমি, শেষে গিয়ে নরু খাল। জায়গাটার নাম বটতলা। ব্যাস, ওটাই আবার গ্রামের মেন শ্মশান, আর সমস্ত প্রার্থনাকে ব্যার্থ করে সব পুজোতেই সেখানে দেখা যেত পোড়া কাঠ আর ছাই, অর্থাৎ কিনা কিছুদিন আগেই কাউকে সেখানে দাহ করা হয়েছে, এবং ঐ পোড়া কাঠ হল আমার কাছে এখানে টাটকা ভুত পাওয়া যায় এর অফিশিয়াল নোটিস। এই জায়গা ভুলার থেকে অনেক বেশি ডেঞ্জারাস, যদিও হয়ত ভুত ডেন্সিটি পার স্কোয়ার ইঞ্চি ভুলার থেকে কম, তার কারন এখানে সমস্ত ভুতই পুরো বা আধচেনা লোকের ভুত তাই এই ভুতেদের খুবই অবশ্যম্ভাবী ভাবে আমাকে এঁই বাঁবুঁ, কোঁথায় চঁল্লি বলে ডাকার চান্স আছে। এছাড়া বাড়ির লোকাল ভুত কালীপিসি, ভুলিপিসি ইত্যাদিরা তো আছেনই, যদিও তাঁরা মানুষ হিসেবে খারাপ ছিলেন না, কিন্তু ভুত হিসেবে কেমন সেটা আনপ্রেডিক্টেবেল।  ভুতেদের চটাতে আমি চাইনি কখনই, কিন্তু ভয় কে তো তাড়াতে হবে, আর তার জন্য আমার একমাত্র হাতিয়ার ছিল গান।
দুর্গাদালানের সামনে যেমন আটচালা, বাঁ দিকে বেল গাছ, তলাটা বাঁধানো, ওখানেই দুর্গা ষষ্ঠির দিন হয় বেল্লিবরন। সেই উইয়ে খাওয়া বেলগাছেও নাকি এক ব্রহ্মদত্যি থাকেন, তবে উনি খুব একটা রেগুলার নন, আর বিশেষ করে পুজোর সময় উনি ওখানে থাকতেন না, বাইরে কোথাও একটা যেতেন, বুদ্ধমাস্টার এর মতো, এমনই শুনেছিলাম, তাই অনাকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয়নি কখনো। আটচালার বাঁ দিকে ছোট্ট দোলমন্দির, আটচালা চুড়ো তার, ফুট দুয়েক উঁচু প্ল্যাটফর্ম তার, মন্দির ইঁটের ওপরে পোড়ামাটির মোটিফ, তার ওপরে চিটেগুড়, চুন আর সুরকির প্রলেপ দিয়ে তৈরি, সেখানে পুজো হয় কেবল পঞ্চম দোল এর সময়, তা ছাড়া ফাঁকা, কোন বিগ্রহও নেই, জুতো খুলে উঠে পড়ো, তারপর কর্নার কর্নার খেলো বুবুদা আছে, মুনা দি আছে, তনুদি তেমন খেলে না, বাবুন রিঙ্কু আছে, গৌতম আছে, কালু আছে, চেঁড়ু আছে, এমনকি বদ্যিনাথদার ছেলে খোকা, আর মেয়ে, আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ড, বুবিও আছে। হাঁদুল ইমেজ ঠিক রাখার জন্য এই চেঁচামেচির খেলা অ্যাভয়েড করতো, কিন্তু তাতে খুব একটা মাইন্ড করিনি সেই সময়, তার কারন ওকে বাদ দিলেও অনেক লোক। তার পেছন দিকে ভানুকাকা টু দের বাড়ী, সেখানে আটচালাও আছে, দুর্গামন্দির আছে, মস্ত পাকা দোতলা বাড়ী আছে।
অনেক ছোটবেলা থেকেই জানতাম যে ওরা আমাদের দশ পুরষ আগেকার আত্মীয়, প্লাস ভানুকাকা টু, যার আসল নাম অলোক বসু, হল আমার বাবার ছোটোমাসির ছেলে, তাই ঐ বাড়ীটা, অর্থাৎ কিনা ছোটোবোস দের বাড়ীটা, হল ফ্রেন্ডলি ফ্রন্টিয়ার। ওরা আমাদের যাত্রা দেখবে আমাদের মন্দিরের দড়ি দিয়ে ঘেরা জায়গায় বসে, আর যদি কোনদিন ওদের আটচালাতে যাত্রা হয়, আমরাও দেখবো ওদের বৈঠকখানার সামনে বসে। কিন্তু ওদের বাড়ী ছাড়িয়ে আরেকটু গেলেই এনিমি প্রপার্টি রায়পাড়া।
রায়পাড়া মানে আমাদের কাছে পাকিস্তান। কেন পাকিস্তান, সেটা কেউ জানায় নি কোনদিন। কিন্তু ওদের কিছুই যে ভালো নয়, এমন একটা চিন্তাধারা মনের মধ্যে ঢুকে গেছল, তার প্রধান কারন বেশ কয়েকবার ওদের সঙ্গে বাবা-দাদাদের মারামারি দেখেছি। ওরা দোদোমা ফাটায়, চকলেট আর বাচ্চু বোমা ফাটায়, মদ টদও নাকি খায়, ওদের গায়ের জোর বেশি। আমাদের দুর্গাঠাকুর বেশ মা মা দেখতে, আর ওদের দুর্গা? ইশশ্‌, ডেঞ্জারাস একদম। ওরা বিসর্জন দেওয়ার সময় মশাল জ্বালায়, বোমা ফাটায়, ব্যাম্পারটি নিয়ে আসে, আমরা শুধুই ঢাকি। তাই ওরা খারাপ। অথচ, ঐ রায়পাড়ারই সুবল কাকু, যে কিনা ওদের যাত্রার হিরো, সে যখন দুর্গাপুরে আমার মেজজেঠুর বা সেজোজেঠুর বাড়িতে আসতো, তখন কত গল্প, কত হাসি, নোহারীর ভালো কি করে করা যায়, সেই নিয়ে কত আলোচনা। ঐ রায়পাড়ারই কিরীটী রায় আমাদের কাতুজেঠুর কত বন্ধু। বাবা কাকাদের কোন কচি ব্যাথার থেকেই এই বিবাদ কিনা তা জানি না, কিন্তু ওদের সঙ্গে আমাদের পুজোর কম্প্যারিশন, এবং মারামারি, হতেই থাকতো।
চুপি চুপি বলে রাখি, ওরা কিন্তু অনেক ব্যাপারেই আমাদের থেকে এগিয়ে থাকতো। যেমন আমাদের বাড়ীশুদ্ধ লোক, মিলনদা বাদে, মোহনবাগান এর সাপোর্টার, তাই আমাকেও ফুটবল একটুও না বোঝা সত্ত্বেও মোহনবাগানের সাপোর্টার হতে হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই মনে হতো ইষ্টবেঙ্গল একটু যেন এগিয়ে থাকে ওভার অল, মনে হতো ওদের রক্তের জোর যেন বেশি। রায়পাড়াও আমাদের কাছে ইষ্টবেঙ্গলের মতোই। আর ওরাও যেন নিয়তির অমোঘ নিয়মে একটু হলেও আমাদের থেকে অ্যাডভান্সড। আমাদের তখনো খড়ের আটচালা, ওদের আটচালার চাল টিনের হয়ে গেলো। কাতুজেঠু বলল টিনের চালার গরম কত জানিস? আমাদের খড়ের চালা রাখা কেবল ঠান্ডা রাখার জন্যেই, নাহলে এটার হ্যাপা কম নাকি? আর খরচাও অনেক। আমাদের মন্দিরে, যাত্রার আসরে হ্যাজাক আর ডে লাইট জ্বলে, ওরা নিয়ে এলো জেনারেটার।  ওদের মন্দির রাস্তার পাশে, তাই গেট বানানো শুরু হল, আমরাও কিছুদিন পরে সম্পূর্ণ ফাঁকা একটা জায়গায় একটা গেট বসিয়ে দিলাম। তাতে আবার টুনি বাল্ব, চেঞ্জার দেওয়া, যায় লোকাল নাম জ্বলা নিবা। আমাদের গান শোনা মানে কেউ গাইছে, আর ওদের চলে এলো মাইক। অবশেষে, অনেক আলাপ আলোচনার পরে এক বছর ঠিক হল, আমাদেরও মাইক আসবে।
সেই মাইক এসে পৌঁছল সপ্তমীর দিন সকালে, ছাদ হীন কাঁড়ার গাড়ির উপরে চেপে। একটা রেকর্ড প্লেয়ার, একটা এমপ্লিফায়ার, আর গোটা পাঁচেক স্পিকার, যাকে চলতি ভাষায় বলা হয় ম্যাগনেট, সঙ্গে তিনটে নরম্যাল চোঙ্গা, আর দুটো লম্বা চোঙ্গা। লম্বা চোঙ্গা দুটো আনার প্রধান কারন অবশই যাতে রায়পাড়ার প্রতিটি ঘরে আমাদের গান পৌঁছোয়, এবং রায়পাড়া পেরিয়ে যাতে ইস্কুলডাঙ্গাতেও একটু হলেও শোনা যায় সেই গান। সঙ্গে একটা মাইক্রোফোন, সেটা ভঁদুজেঠুর অর্ডারে আনানো। পাশে একটা স্টিলের কালো রঙের সামান্য মরচে ধরা ট্রাঙ্ক, তাতে ভরা আছে গুচ্ছ এল পি আর ই পি ভিনাইল রেকর্ড। সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট যেটা, সেটা হল এই মাইকের জীবনসুধা, একটা মস্ত বড় চব্বিশ ভোল্টের ব্যাটারী। প্রতিদিন ধাধ্‌কা থেকে চলে আসবে একটা ফ্রেস ফুললি চার্জড রিপ্লেস্মেন্ট, আর ঐ কাঁড়ার গাড়ীতেই চলে যাবে চার্জ ফুরোনো ব্যাটারি টা। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ভিড় জমে গেলো আর জেঠুরা, বিশেষ করে নয়নজেঠু আর ভঁদুজেঠু, লেগে পড়লো ভিড়ের লোকজনকে একটু ডিসিপ্লিন্ড করতে। 
দোল মন্দিরের পাশেই ছিল একটা বহু পুরনো কুসুম গাছ, একজন, খূব সম্ভবত ক্যাবলাই হবে, উঠে গেলো সেই কুসুম গাছের উপরে কোমরে একটা নারকোল দড়ি বেঁধে, তারপর সেই দড়ির অন্য মাথায় বেঁধে দেওয়া হল একটা লম্বা চোঙ্গা, দড়ি ধরে ওপরে তুলে কষে বেঁধে দিল রায়পাড়ার দিকে মুখ করে।  আরেকটা বদ্যিনাথদা দের বাড়িতে বাঁধার প্ল্যান হচ্ছিল, কিন্তু বিশুদার প্রবল প্রতিবাদে সেটার স্থান পরিবর্তন হয়ে চলে গেলো অশ্বত্থ গাছের ওপরে। বাকি তিনটে বাঁধা হল তিনটা লম্বা বাঁশের মাথায়। আর দোল মন্দিরের সামনের যায়গাটা হল কন্ট্রোল রুম। সেই কন্ট্রোল রুমের কম্যান্ডার হল দাদা। মেন শাগরেদ মঙ্গলদা আর চন্দনদা। দাদারা যখন খালে যায়, মানে বড় কাজ আর স্নান করতে, তখন ইন চার্জ হয়ে যায় ছোড়দা, সঙ্গে ভোম্বলদা, ভ্রমরদা ইত্যাদি। এরই মাঝে, কখনো কখনো ভঁদুজেঠু ওপরে উঠে মাইক্রোফোন লাগিয়ে পড়তে শুরু করে শ্রী শ্রী চণ্ডী। সব মিলিয়ে একটা এত গমগমে ব্যাপার, কি বলব। মাঝে একবার হোমের সময় ছোড়দা হমে তুমসে পেয়ার কিতনা লাগিয়েছিল, আমার ছোটঠাকুমা, অর্থাৎ বাবার ছোটকাকিমা, শ্রীমতী রাধারানি বসু আলতো করে বললে মুখপোড়া, তাতে ভঁদুজেঠু দোল্ মন্দিরে উঠে  ভ্রমরদাকে তুমুল বকা দিল, গান বন্ধ।  
ঐ সেবারেই, একবার দাদার বোধহয় আমার মুখ দেখে করুণা হয়েছিল, আমাকে দোল মন্দিরে উঠিয়ে রেকর্ড চালানোর সুযোগ দিল। আমার একটুও অসুবিধে হয়নি, কারন অপুদের বাড়িতে একদম একরকম রেকর্ড প্লেয়ার চালানো আমি দেখেছি, ফিলিপ্সের। তিন রকমের স্পিড একদম পুরনো গুলো সব ৭৮ স্পিডে চালাতে হয়, আরেকটা ছোট রেকর্ড আছে, যেটার নাম ই পি, সেগুলো ৪৫ এ চালাতে হয়, আর এল পি, অর্থাৎ কিনা লং প্লেয়িং রেকর্ড চালাতে হয় ৩৩ অথবা ৩৩ ১/৩ আর পি এম এ। এটা ছিল অষ্টমীর সকাল। সেই পুজোতে আমার ক্যাপ বন্দুক শিকেয় রইল, কোন কিছুতেই মন ছিল না আর, এমনকি ফ্যালা তামলীর দোকানেও যাইনি আর, শুধুই গান বাজিয়েছি।

অনেকদিন পরে, আস্তে আস্তে এসে গেলো বদল হওয়ার দিন। একটা অত্যাশ্চর্য জিনিস একবার দিদির প্রাক্তন বর, সেই যাকে আমি মশারীর স্ট্যান্ড দিয়ে চেপে দিয়েছিলাম, তার কাছে দেখেছিলাম। তাতে গান তো বাজেই, কিন্তু রেকর্ডিং ও করা যায়। ভেতরে রেকর্ডের বদলে লাগাতে হয় ক্যাসেট। তার নাম টেপ রেকর্ডার। তো বাবা একবার কিনে ফেললো একটা টেপ রেকর্ডার, কারখানার এক সর্দারজির কাছ থেকে। সেবারেই পুজোতে গিয়ে দেখি টেপ এর ছড়াছড়ি। কেউ ঢাকির বাজনা রেকর্ড করছে, কেউ, কাঠি নাচের গান, কেউ বা আবার মন্ত্র পড়া রেকর্ড করে সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে প্লে ব্যাক শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। পুজোর সঙ্গীতায়োজনেও বদল এল, মাইক এর বদলে চলে এলো বক্স, তার গায়ে লেখা মিদ্যা ক্যাবিনেট। রেকর্ড প্লেয়ার এর বদলে টেপ ডেক। তাও চলেছে অনেকদিন। তারপর সি ডি চলে এলো, আর এখন তো দেখি পেন ড্রাইভ থেকেই গান চলে। ইওকো-ও কোম্পানির সেই টেপ রেকর্ডার দেহ রেখেছেন অনেকদিন। পেন্সিল গুলোও হারিয়ে গেছে কথায় যেন। মৃত কবির কবিতার মতো, ক্যাসেটগুলো রয়ে গেছে শুধু।