Sunday, November 17, 2013

তাড়া নেই

তাড়া নেই
জায়গাটার নাম নোহারী, অর্থাৎ কিনা no hurry, কিন্তু সেই একদম ছোটবেলা থেকেই বাতাসে যেই পুজোর গন্ধ আসা শুরু, ওমনি যাওয়ার জন্য মনটা উচাটন হওয়া চালু হয়ে যেত, কত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারি। স্কুল এর বন্ধুদের হ্যাটা সে কি রে, পুরো পুজোটা গ্রামে কাটাবি? আমার একটুও মনে লাগতো না। নোহারী অজ গ্রাম। নোহারী যেতে গেলে ওই ভয়ঙ্কর স্টিম ইঞ্জিন ওয়ালা ট্রেনে চাপতে হয়। নোহারীতে নো কারেন্ট্‌। নোহারীতে অপু নেই, বনিও নেই, মাসিমনিও নেই। সবথেকে বড় কথা, নোহারীতেই আমার সেই ভয়ঙ্কর রাগী বড়জেঠুমনি থাকে। কিন্তু নোহারী ইজ নোহারী!
নোহারী মানেই লটবহর। তাতে ট্রাঙ্ক তো থাকবেই একটা, একটা বেডিং থাকবে, একটা ঝুড়িব্যাগ থাকবে, একটা বা দুটো পোঁটলা থাকবে, আর অতি অবশ্যই থাকবে একটা চামড়ার স্যুটকেস। এর মধ্যে ট্রাঙ্ক, বেডিং আর স্যুটকেস এ লেখা থাকতে হবে N. R. Bose, 18/14 Trunk Road, Durgapurআমার সবথেকে ইন্টারেস্টিং লাগতো বেডিং বাঁধার ব্যাপারটা। পঞ্চমীর রাত্রে বেশ একটা ৩ ফুট ডায়ামিটার এর রোল তৈরি হবে প্রথমে, তারপর আমি আর মা ওটা চাপতে থাকবো আর বাবা বেল্ট গুলো ধরে টানবে টারগেট ডায়ামিটার ১৭ ইঞ্চি, কিন্তু শেষ অবধি বাবা ২৩এই ছেড়ে দেবে। কিন্তু মা বলতো সব থেকে ফ্যাশনেবেল্‌ হল স্যুটকেস।
সেই স্যুটকেস এর ভেতরের দিকটা হাল্কা নীল, বাইরেরটা ডার্ক ট্যান্‌। মোটা সাদা সূতো দিয়ে ডেনিমের প্যান্ট এর মতন সেলাই। স্যুটকেস এর ঢাকনার ভেতরের দিকে অনেকটা ইজের এর পা সেলাই করে জুড়ে দিলে যেমন হয়, তেমন একটা পকেট, ইলাস্টিক দেওয়া, তাতে থাকবে মায়ের গয়না, বাবার ক্যাশ্‌। ঢাকনার দুদিকে দুটো স্প্রিং দেওয়া ক্লিপ, গর্ত বরাবর চেপে ধরলেই খঠাস করে আটকে যাবে, তারপর ১৫ মিনিট মতন চাবি ঘোরাতে থাকো, একসময়ে ঠিক লক্‌ হয়ে যাবে মাঝে মাঝে হয়েছে কিনা, সেটা বোঝার জন্য খুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যদি খুলে যায়, তার মানে লাগেনি, অতএব আবার চেষ্টা কর। এই স্যুটকেস এর ভারশান টু ও বেরিয়েছিল, যেটাতে ওই লক যদি খুলে যায়, তার ফল-ব্যাক প্ল্যান ইমপ্লিমেন্ট করা ছিল এক জোড়া বেল্ট থাকতো বাইরে থেকে ঢাকাটা আটকে থাকার জন্য। আমি অবশ্য তার অন্য ব্যাবহার ও দেখেছি যেমন ওভারলোড হলে ক্লিপ না লাগিয়ে শুধু বেল্ট লাগাও, কাপড় শুকনোর দড়ির অভাব হলে দুটোকে গিঁট দিয়ে টাঙ্গিয়ে দাও, কিম্বা নিদেনপক্ষে ওগুলকেই হ্যান্ডেল হিসেবে ব্যাবহার করো ইত্যাদি।
দুর্গাপুর থেকে নোহারী যাওয়া মানে অনেক হ্যাপা তখন। প্রথমে বাড়ির থেকে রিক্সা চেপে বেনাচিতি। সেখান থেকে তখন দু খানা বাস ছিল তখন ভবানী আর অন্নপূর্ণা তার যেটা পাওয়া যাবে, তাতে উঠে বসো। রিকশাওয়ালা মাল-পত্র তুলে তুলে ধরবে, আর যে লোকটা ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থেকে সেটা ছাদে তুলে নেবে, একটু পরে সেই লোকটাই ড্রাইভারকাকু। অন্নপূর্ণা হল ভবানীর তুলনায় নতুন বাস, তার হেডলাইট চৌকো ভবানীর গোল, আর ভবানীর হর্নটা সেই পিঁপ পিঁপ, কিন্তু অন্নপূর্ণারটা পিঁপ্পিরপুঁপ্যাঁ, ইলেক্ট্রিক হর্ন। তাই প্রেফারেব্‌লি অন্নপূর্ণা, আর না পেলে ভবানী চেপে অসংখ্য গর্তওয়ালা নাচন রোড্‌ দিয়ে ভিড়িঙ্গি হয়ে, গান্ধী মোড় হয়ে, ডি ভি সি মোড় হয়ে গ্যামন ব্রিজ পৌছতেই মনটা আনন্দে ভরপুর ঠিক একটা স্টপেজ পরেই দুর্গাপুর স্টেশন, ওখান থেকেই ধরতে হবে বাঁকুড়ার বাস, কিন্তু তার থেকেও আনন্দের ব্যাপার হল, ওখানে আমাদের জন্য ওয়েট করবে আমার দুই জেঠু, আর তাদের পুরো ফ্যামিলি। সঙ্গে অ্যাডেড আনন্দ হল ভানুকাকু, যে কিনা ঠিক নিজের কাকু নয়, কিন্তু বাবার ছোটবেলার বন্ধু, নোহারীরই লোক, তারও পুরো ফ্যামিলি। ভানুকাকুর কাছে ফ্যামিলির মাহাত্ত্ব্য নিশ্চয়ই অপরিসীম, শিব এর ফলোয়ার, কেননা অপুদা, মিঠুদির পরেও পিন্টুতেই শেষ নয়, ফোরথ্‌ এডিশন হিসেবে টিয়া ছিল। কখনো কখনো আবার সুনীলকাকুরা, অশোককাকুরাও একই বাসে উঠতো পুরো পরিবার নিয়ে এরা বাবার খুড়তুতো ভাই, কিন্তু খুব কাছের লোক সবাই আমার। আর এই গোটা পঞ্চাশেক লোক এর জন্য ভানুকাকু কন্ডাক্টরকে কত লিবি ঠিক করে বল বলে ডিস্কাউন্টেড রেট আদায় করে ফেলত ঠিক। তবে বাস এর থেকেও বেশি আনন্দ হয়েছে যেই যেই বছরে আমার জেবুলি, মানে আমার মেজজেঠু, অফিস থেকে বলে একটা ডজ ভ্যান এর বন্দোবস্ত করতো সেটাও আমাদের পৌঁছে দিত বাঁকুড়া। রাস্তায় পড়তো বাঁধকানা, বড়জোড়া, বেলেতোড়। বেলেতোড়, অর্থাৎ আমার ঠাকুমা প্রোমোদিনী বসুর বাপের বাড়ী, বাবাদের মামার বাড়ী। এমন আদর্শ মামার বাড়ী আমি দেখিনি আর, কিল চড় তো নেই, কিন্তু ভয়ঙ্কর আদর আছে, ভালবাসা আছে, আর আদর করে কিছু গালাগালি দেওয়ারও চল আছে। বাবার চার মামা, তার বড় দুজন ওখানেই থাকতেন, দুর্গাপ্রসাদ ও অপরাপ্রসাদ। দুর্গাদাদু এই সেদিন চলে গেলেন, ১০২ বছর বয়সে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ওই বেলেতোড় দিয়ে পেরলেই একবার দেখা হয়ে যেতই, আর বাসের ভেতর উঠে আসতো মিষ্টির প্যাকেট। কখনো সন্দেশ, কখনো বা সুগার কোটেড ক্যান্ডির মত ব্যাসনের ওপরে চিনির শক্ত কোটিং দেওয়া ম্যাচা সন্দেশ। ম্যাচা কে কেন সন্দেশ বলে, সেই ভাবতে ভাবতে জানলা দিয়ে দেখতাম রাস্তার পাশে লেখা আছে, সামনে ধবনী গ্রাম, গাড়ী আস্তে চালান, আর এই ভাবেই গন্ধেশ্বরী নদী পেরিয়ে ধুকে পড়তাম বাঁকুড়া শহরে।
বাঁকুড়ার কু বাদ দেওয়া যায় না কিনা, সেই নিয়ে ডিবেট চলতেই থাকবে আজন্মকাল কিন্তু বাঁকুড়া মানে একদম অন্যরকম শহর - শহর আর গ্রাম এখানে মিলেমিশে একাকার। বাস চলে, স্টিম ইঞ্জিন ওয়ালা ট্রেন চলে। রিকশা চলে, যার ক্রিং ক্রিং বেল নেই, হ্যান্ডেল এ দুটো ছোট রড এর মাথায় দুটো লোহার বাটি লাগানো, যেন স্ট্র্যাপলেস ব্রা, আরেকটা ছোট রড দিয়ে সেটা ঠুকে বাজাতে হবে। এখানে মোষের গাড়ী চলে, আমরা জানতাম ওগুলো কাঁড়ার গাড়ী। আরো একটা অদ্ভুত জিনিষ চলে, সেটা হল মেজো রেল। মিটার গেজ এর ট্রেন, এতো আস্তে চলে যে তার নাম বাঁকুড়া-দামোদর-রেলওয়ের বি ডি আর থেকে হয়ে গেছলো বড়-দুঃখের রেল। এখানের লালবাজারে একটাও পুলিশ নেই, এখানে গোবিন্দনগরে মেইন বাস স্ট্যান্ড হলেও সবাই মাচানতলা থেকেই বাস ধরে। এখানের স্টেশনের আলুর চপ দেখতে হল চমচমের মতন। এখানের স্টেশনে ট্রেন আসার আগে রেললাইন এর ঝুলিয়ে রাখা টুকরো ঘন্টা হিসেবে বাজানো হয়। আর এখানে পৌঁছেই বাবারা সবাই জমিদার হয়ে যায়। রিকশাওয়ালারা সব তুই হয়ে গেলো, কুলিও তাই, টি টি কে আপনির বদলে তুমি, এমনকি আমাদের গন্তব্য স্টেশন এ বেশিক্ষণ না দাঁড়ালে তুই বলতেও কসুর নেই। নিবি গুলো সব লিবি, “কোথায় গুলো কুথায়, এমনকি পেঁপে হয়ে গেলো পিফা। এই স্টেশনের সামনের রাস্তাতে এক জোড়া বাম্পার পেরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তো আমাদের দুর্গাপুর বাঁকুড়া রুটের এক্সপ্রেস বাস, আর আমরাও হই হই করে নেমে পড়তাম।
প্ল্যাটফর্মে আমাদের পৌঁছে দিয়ে বাবারা চলে যেত বাজারে, কারন হাতে অনেক সময়। বাজার থেকে আসতো বস্তা ভরা আলু, লাউ, কখনো দেরিতে পুজো হলে বাঁধাকপি বা ফুলকপি, আর একটু ভালো চাল। আমরা ইতিমধ্যেই গোটা চারেক চমচম মার্কা আলুর চপ উদরস্থ করেছি, স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে একবার দেখে এসেছি রিং এর মধ্যে বল লাগানো টোকেন, হাতল ঘুরিয়ে ফোন করাও, ছোড়দার হাত ধরে স্টেশন এর ওই মাথায় গিয়ে দেখে এসেছি কি করে জল ভরা হয় স্টিম ইঞ্জিনে, কয়লাই বা ভরা হয় কি করে।  মাঝে একটা দুটো ম্যানুয়াল ট্রলি বা কখনো ডিজেল ট্রলি দেখে উত্তেজিত হয়েছি। রেললাইনে লাইনম্যানের বেলচার শব্ধে চমকে উঠে ভেবেছি ট্রেন আসার ঘন্টা পড়লো বুঝি ওই। কালো রঙের ঝাল লজেন্স, একটা পাঁচ, দুটো দশ, তিনটে পঁচিশ, তাই খেতে খেতে হুইলারের স্টলে ইলাস্ট্রেটেড উইক্‌লি তে ওশোর আশ্রমের ছবি দেখে লজ্জা পেয়েছি, আর উঁকি মেরে দেখে নিয়েছি নিচের তাকে সাজিয়ে রাখা হিন্দি নভেল এক রাত কি সিলসিলার মলাটে চর্বিবহুল স্বল্পবাস নারীর হাসি। শেষে বাবাকে ধরে সেকেন্ড ঝালমুড়ির প্যাকেট টার সদব্যবহার করছি, এমন সময় সবাই হই হই করে উঠল, ট্রেন এবারে সত্যিই আসছে, কারন ওই যে, দুরে দেখা যাচ্ছে শরতের শাদা মেঘের প্রেক্ষাপটে আকাশ জোড়া কালো ধোঁয়া। বুক টা দুরু দুরু করে উঠতে লাগলো, কারন এক্ষুনি এসে পড়বে লৌহদানব, তাই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতাম কানে হাত দিয়ে, যতক্ষণ না সেই দানব হিঁসসস করে শান্ত হচ্ছে। তারপর একজন কাপ্লিং খুলে দিতো, দানব যেত জল খেতে আর কয়লা খেতে, আর সবার সঙ্গে উঠে পড়তাম ট্রেনে আমি।
ট্রেনে উঠে, আবার ঝালমুড়ি খেয়ে, বাঙ্ক এ উঠে আর নেমে, জানলা দিয়ে মুখ বের করে চোখে কয়লার গুঁড়ো আর মাথায় বাবার চাঁটি খেয়ে, একটাই গাছ চলন্ত ট্রেন এর জানলা দিয়ে টানা ৬ মিনি ৪৭ সেকেন্ড দেখা যায় এমন স্পীড এ চলতে চলতে সেই আদ্রা-পুরী প্যাসেঞ্জার ভেদুয়াসোল, ওন্দা, রামসাগর, বিষ্ণুপুর আর পিয়ারডোবা পেরিয়ে অবশেষে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছত বগড়ী রোড্‌। ওটার সঙ্গে ছাগলের কোন লিঙ্ক আছে নিশ্চয়ই, কারন বকরী মানে যে ছাগল, সেটা জানতাম। স্টেশন আছে, কিন্তু প্লাটফর্ম নেই, টিকিট ঘর নেই, টিকিট কালেক্টার নেই, স্টেশনমাস্টার নেই। ট্রেন থেকে নামা আর পেয়ারা গাছ থেকে নামার একিরকম থ্রিল, একটু সময় সাপেক্ষও বটে। তাই ভানুকাকু আডভান্স থ্রেট দিয়ে রাখতো টি টি কে। আর যদি তারপরেও যদি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তুই তাকারি করে গালিগালাজ।
যাই হোক, ট্রেন থেকে নামাটাই যে অনেকের কাছে একটা মিনি আডভেঞ্চার, তা শুধু নয়, তারপর, স্টেশন থেকে রাস্তা অবধি পৌঁছতে হলে একটা মিনি মাউন্টেনিয়ারিং এর কোর্স করা থাকতে হবে, এতটাই নিচে রেললাইন থেকে রাস্তা। সেখানে পার্ক করা থাকতো বড়জেঠুমনির দু-দু খানা হাম্বাস্যাডার। তাতে মাথার উপরে চাঁচ, ইংরেজি ইউ উল্টে লাগানো আছে যেন, তার উপরে পরিপাটি করে চট লাগানো, নিচে বসার জায়গায় মোটা করে খড় দিয়ে তার উপরে তালাই পাতা। আর ড্রাইভার আমার জীবনের প্রথম হিরো রতনদা, বাবারা যাকে ডাকতো রত্না বলে, আর আমার স্কুল এর ঈন্দার সিং কিছুতেই মানতে চাইতো না যে রত্না একজন ছেলের নাম। হুড়হুড়িয়ে সেই গাড়ি চালিয়ে একাড়ে গ্রাম, ভুলা আর রয়দা পেরিয়ে রতনদা গরুর গাড়ি নামিয়ে দিত নরু খালে। ওপারে উঠলেই নোহারী। বাড়ির দুর্গাদালানে পৌঁছে দেখতাম মা এসে গ্যাছেন তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে, আর কি করে যেন অন্যবারের মতন এবারেও বুবুদা আমার আগেই পৌঁছে গ্যাছে ওখানে।

1 comment:

Priyankar said...

Bijit da,
Besh bhalo lagchhe aapnar lekha porte. Eke probashe elei bangla-r proti taan ta uthle othe, taay aapni majhe majhe chhotobela-r smriti tao firiye dichchen. anek dhanyobad.
Ekta nehat e chhotto byapar ... oi jhal lozenge er daam er jayga ta ... ekta panch hole tinte pochis to hobar noy, mone hoy ekta 10, duto 20 aar tinte 25 chhilo.
Jaak ge, tate beshi kichhu aase jaay na ... maane, thik seirokom jhal lozenge je aar pawa jaay na, ei dukkho ta kichhu kome na. tobu, oi porte giye ektu hochot kheye gelam.
Jai hok, bhalo thakben, aaro likhben, aamader o 'anondiben'. -Priyankar.